–আপনি যতবার আমাকে এই ঘর থেকে বের করে দেবেন আমি ঠিক ততবার এই ঘরে আসবো। দেখি কতবার বের করে দিতে পারেন। নিজের দেশ, পরিচয়, অস্তিত্ব সবকিছু ছেড়ে এসেছি নতুন অস্তিত্ব তৈরি করার উদ্দেশ্যে। কতদিন আপনি আমাকে গ্রহন না করে থাকতে পারেন এখন সেটাই দেখার পালা। আমিও অবনী হাওলাদার। এতো সহজে নিজের অধিকার ছেড়ে দেবো না।
কথাটা কানে আসতেই জুনায়েদের চাপা রাগটা চেড়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–তোমার এসব নাটক বন্ধ করো। এ জীবনে কোনদিনে তুমি নিজের অধিকার পাবে না। নিজের দেশ, পরচিয় ছেড়ে চলে এসে ভুল করেছো। এই ভুলের মাশুল সারাজীবন দিতে না চাইলে এখনই দেশে ফিরে যাও। সময় শেষ হয়ে যায়নি।
অবনী শব্দ করে হাসল। হাসি থামিয়ে বেশ শান্ত কণ্ঠে বলল
–এমন যেন নাহয় জুনায়েদ সাহেব আমাকে মাশুল দিতে বলে পরে নিজেই আফসোস করবেন। আর আমি সময়ের তোয়াক্কা করিনা। সবকিছু পেছনে ফেলে চলে এসেছি। এখন শুধু সামনে এগোনোর পালা। পিছে দেখার সুযোগ নেই জুনায়েদ সাহেব।
অবনীর হাসির শব্দে জুনায়েদের শরীর জ্বলে উঠলো। রাগটা আরও তীব্র আকার ধারন করতেই সে দরজাটা দুম করে বন্ধ করে দিলো। চেয়ারটাতে জোরে লাথি মেরে বিছানায় গিয়ে বসল। দুই হাতে মাথার দুই পাশে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রাগটা দমন করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন পরেই অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে। সেই মিটিং এটেন্ড করতে হবে। এই রাগ নিয়ে সে কোনভাবেই মিটিং এটেন্ড করতে চায়না। তাই নিজেকে শান্ত করতেই হবে। পাশেই সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে জ্বালাল। ধোঁয়া উড়ছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। সেটার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। নিকোটিনের ধোঁয়া পুরো ঘরে গ্রাস করে নিলো। তবুও রাগটা কমাতে পারলো না জুনায়েদ। এই মেয়েটা এখন এই বাড়িতেই থাকবে। ২৪ ঘণ্টা তার সামনে থাকবে সেটা ভেবেই ক্ষণে ক্ষণে রাগটা চাড়া দিয়ে উঠছে। এই বাড়িতে আর কিছুক্ষন থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। খুব দ্রুত অফিসের জন্য রেডি হল। এখনো অনেক সময় বাকি তারপরেও সে এখনই বের হয়ে যাবে। এখানে আর থাকা সম্ভব না। কোনভাবেই না। জুনায়েদ নিজের ঘর থেকে বের হয়ে অফিসে যাওয়ার আগে প্রতিদিন বাবার সাথে দেখা করে তারপর যায়। আজ রাগের মাথায় সেই কথা ভুলেই বসলো। শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে সে। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই চোখে পড়লো অবনী টেবিলে খাবার রেডি করছে। জুনায়েদ বেশ বিরক্ত হল। আজ আর বাসায় নাস্তা খাওয়া হল না তার। এই মেয়ের হাতে সে কোনভাবেই নাস্তা খাবে না। চোখমুখ খিঁচে দ্রুত পায়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অবনী ডাকল।
–জুনায়েদ সাহেব নাস্তা করবেন না? নাকি এখন আর বাঙালি খাবার ভালো লাগছে না?
জুনায়েদ থেমে গেলো। পেছন ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললো অবনীর উপরে। ভীষণ রাগী কণ্ঠে বলল
–আমি আমার কাজের জন্য কাউকে কৈফিয়ত দেই না। এই বাড়িতে আমাকে কেউ প্রশ্ন করেনা। এই দুঃসাহস করবে না। খারাপ হবে কিন্তু। আর আমাকে এসব বিরক্তিকর নাম ধরে ডাকবে না।
কথা শেষে অবনী মাথা নাড়াল। যেন সে সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনল আর অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। তারপর প্রশস্ত হেসে বলল
–তাহলে কি বলে ডাকব সেটা আপনিই বলে দেন। কারন আমার আপনার যেটা সম্পর্ক সে হিসেবে তো আমি আপনাকে আদর করে অনেক কিছুই ডাকতে পারি। কিন্তু আপনি সেটা মেনে নেবেন তো?
জুনায়েদ রক্তিম চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে পা দিয়ে মেঝেতে আঘাত করলো বেশ জোরে। সামান্য ব্যাথাও হয়তো পেলো। কিন্তু এই মুহূর্তে রাগটাই বেশী প্রাধান্য পাচ্ছে তার। তাই ঘুরে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে মেইন গেটের সামনে দাড়িয়ে হর্ন দিতে লাগলো দরজা খোলার জন্য। সেই হর্ন শুনে অবনী নিজের কাজ ফেলে আচলে হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলো এক দৌড়ে পেছনের দরজা দিয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে। দারোয়ান গেট খুলে দিলো। গাড়ি ঘুরিয়ে নিতেই লুকিং গ্লাসে চোখ পড়লো জুনায়েদের। অবনী ঠিক পেছনেই দাড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি। এক হাত উঠিয়ে নাড়ছে বেশ অদ্ভুত ভঙ্গীতে। জুনায়েদ সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ভাবল। এই মুহূর্তে তাকে একদম বাঙালী পরিবারের আদর্শ বউয়ের থেকে কম কিছুই মনে হচ্ছে না। স্বামীরা কাজের জন্য বের হলে বাঙালী পরিবারের বউরা যেমন পেছন থেকে হাত নাড়ে ঠিক তেমনই লাগছে তাকে। মুহূর্তেই আবার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। এই মেয়ে নিশ্চয় বাংলা সিনেমা, নাটক এসব দেখতেই অভ্যস্ত। তাই তো এমন নিখুত ড্রামা শুরু করেছে। এসব করে তার মন কিছুতেই গলাতে পারবে না। প্রচণ্ড রাগ আর তিক্ত অনুভূতি নিয়ে স্থানটা ত্যাগ করলো সে। গাড়ীটা দৃষ্টি পেরিয়ে অদৃশ্য হতেই অবনী নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হেসে বাড়ির ভেতরে আবার চলে গেলো। টেবিলে খাবার গুছিয়ে জায়েদ রহমানকে ডাকতে গেলো। ঘরে ঢুকেই প্রথম যেটাতে চোখ পড়লো সেটা হল সাবিনা ইয়াসমিনের একটা ছবি। যেটা বেড সাইডে খুব যত্ন করে রাখা আছে। সাবিনা ইয়াসমিন বরাবর অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা। তবে ছবিটাতে কেমন অদ্ভুত মায়া আছে। সাদা কালো ছবিটা দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। সেটা হাতে তুলে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে অবনী।
–ওটা বিয়ের আগের ছবি। এই ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এক দেখায়।
কথা শেষ করেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন জায়েদ রহমান। তার কথার শুরুতে অবনী কিছুটা চমকালেও পেছন ফিরে চেহারা দেখেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। ছবিটার উপরে যত্ন করে হাত বুলিয়ে বলল
–ভীষণ সুন্দর ছিলেন উনি। মায়াপরির মতো চেহারা। সাদা কালো ছবিতেও কি অদ্ভুত ভাবে ফুটে উঠেছে সৌন্দর্য। রুপ যেন জ্বলজ্বল করছে।
জায়েদ রহমান আরেকবার হাসলেন। অবনীর কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাত থেকে ছবিটা নিয়ে বললেন
–সেই সময়ের সেরা সুন্দরীদের মধ্যে একজন ছিল। শুভাকাঙ্খির অভাব ছিলনা। কিন্তু এর মাঝে আমি নিজের জায়গা করে নিয়েছি।
এবার অবনী হাসল। বেশ জোরেই হেসে উঠে বলল
–প্রস্তাবে সাড়া দিতে কতদিন সময় নিয়েছিল?
জায়েদ রহমান ছবিটা আগের জায়গায় রেখে বললেন
–সুন্দরী তো! বেশ নখরা ছিল। মাস তিনেক পিছে ঘুরিয়েছে। খুব কঠিন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করত। কিন্তু আমিও তো বুঝতাম ঐ কাঠিন্যের আড়ালে একটা সাবলীল মন আছে। তার নিজের কিছু স্বপ্ন আছে। সেসবকেই ক্যাপচার করার চেষ্টা করেছিলাম। আর পেরেও গিয়েছিলাম।
অবনী হেসে ফেললো আবারো। হাসি থামিয়ে বলল
–কয় বছর প্রেম করেছিলেন?
–দুই বছর। তারপর বাবা জানতে পারেন। সাবিনার বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। তিনি সম্মান রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বন্ধুর কাছে ছেলের জন্য মেয়ে চেয়ে বসলেন। সাবিনার বাবা সময় নিয়েছিলেন। আমি তো ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। যদি তিনি না বলেন তখন কি হবে। পালিয়ে যেতে হবে। পালিয়ে কোথায় যাবো সেটাও মনে মনে ঠিক করে ফেললাম।
বলেই উচ্চ শব্দে হাসলেন তিনি। অবনীও হাসল তার কথা শুনে। তিনি আবারো ফিরে গেলেন অতীতে। বেশ সাবলীল ভাবে নিজের প্রেম কাহিনি ব্যক্ত করতে লাগলেন। বললেন
–কিন্তু এমন কিছুই করতে হল না। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাবিনার বাবা হ্যা বলে দিলেন। তারপর বিয়ে করে একবারেই ঘরে নিয়ে এলাম।
আবারো উচ্চ হাসিতে মেতে উঠলো দুজন। হাসি থামিয়ে অবনী বলল
–এবার নাস্তা খাবেন বাবা। চলুন আমার সাথে।
জায়েদ রহমান উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–হ্যা চলো।
ঘর থেকে একসঙ্গে দুজন বেরতে বেরতে জায়েদ সাহেব বললেন
–জুনায়েদ কোথায়?
–অফিসে চলে গেছে।
অবনির হতাশ কণ্ঠ শুনেই তার দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালেন। বললেন
–এতো তাড়াতাড়ি? কিন্তু এখনো তো অফিসের সময় হয়নি।
অবনী স্বাভাবিকভাবে তাকাল। ফিচেল কণ্ঠে বলল
–আমি এসেছি তো তাই তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে। এখন থেকে রোজ এই সময় যাবে। আবার মাঝে মাঝে রাতে নাও আসতে পারে।
বলেই হাসতে লাগলো সে। জায়েদ সাহেব পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন। এই মুহূর্তে মেয়েটাকে তার অদ্ভুত লাগছে। এতো সহজ ভাবে বিষয়টা বর্ণনা করলো যেন এটা কোন ব্যাপার না। এরকমটাই হওয়া স্বাভাবিক। অন্যকিছু হলে ঘোর অনর্থক হয়ে যেতো। জায়েদ সাহেবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবনী একটু কাছাকাছি এলো। ফিসফিসানির ভঙ্গীতে বলল
–মায়ের ছেলে তো। একটু ঘোরাবেই। এতো ভাববেন না। একবার যখন এসে পড়েছি তখন আমাকে আর ফেরাতে পারবে না।
বলেই হেসে ফেললো আবার। প্রাণবন্ত মেয়েটিকে দেখে জায়েদ রহমানের মনে কিঞ্চিৎ অপরাধবধের উদয় হল। তার সিদ্ধান্ত মেয়েটির জন্য অন্যায় হয়ে গেলো নাতো? মেয়েটিকে তিনি এক অনিশ্চিত সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিলেন না তো? তার ছেলে কি আদৌ মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবে?
————
ডুপ্লেক্স বাড়িটার ছাদের সাথে লাগোয়া ঘরটার সামনের দরজাটা খুলতেই এক ফালি পাহাড়ি মেঘ এসে ছুঁয়ে দিলো চোখে মুখে। সাথে ভেসে এলো দূর পাহাড়ের শীতল হাওয়া। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এক হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগটা চেপে ধরে আরেক হাতে গায়ে জড়ানো চাদরটা বেশ শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে নিয়েই সামনে পা বাড়াল অবনী। ছাদের অর্ধেকটাতে ছাউনি। আর বাকি অর্ধেকটা খোলা। ছাউনির নিচে একটা ছোট টেবিল আর দুটো চেয়ার। অবসরে নিশ্চয় জুনায়েদ এখানে বসেই সময় কাটায়। টেবিলের একপাশে একটা অ্যাশ ট্রে আর তার ঠিক কাছাকাছি দামি লাইটার। সেটাই হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো অবনী। বুঝে গেলো জুনায়েদের নিকোটিনের নেশা আছে। এখান থেকে দূর পাহাড়গুলো আবছা দেখা যায়। ঠাণ্ডা হাওয়াটার জোর বাড়তেই অবনী ছাউনির নিচে এসে বসল। কফির মগটা দুইহাতে চেপে ধরে একটা চুমুক দিয়ে তাকাল আশেপাশে। সামনে ঘাসগুলো সবুজ গালিচার মতো দেখতে লাগছে। অপরুপ দৃশ্যটা মুহূর্তেই মন কেড়ে নিলো তার। ভীষণ ভাললাগা ছেয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষন সেখানে বসে থাকলো। কফিটা শেষ হতেই ক্লান্তি জড়িয়ে ধরল তাকে। এবার বিশ্রাম নেয়ার পালা। ভীষণ ক্লান্ত সে। কাল রাতেই নিজের দেশ ছেড়ে এসেছে কলোরাডোতে। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসার একমাত্র কারন নিজের অধিকার আদায় করা। নতুন অস্তিত্তের সন্ধানে অচিন পথে পাড়ি দেয়ার মতো দুঃসাহস তো করেই ফেললো। কিন্তু সত্যিই সে কি পারবে? এই প্রথম নিজের দেশ পরিবার সবাইকে ছেড়ে সুদুর বিদেশের কোন এক জায়গায় বসে আছে সে। বিষয়টা ভাবতেই তার মন তীব্র বিষাদে ঢেকে গেলো। কিন্তু সেই মন খারাপকে প্রাধান্য দিলো না। নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখতে হবে। এই মুহূর্তে যেকোন দুর্বলতা তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার উদ্দেশ্য যে ভিন্ন কিছু। যে করেই হোক জুনায়েদের মনে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করতেই হবে। আজ থেকে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে নতুন যাত্রা তার। আর যেভাবেই হোক এই যাত্রায় অবনী নিজেকে সফল প্রমান করবেই।
চলবে…
#মেঘপিয়নের_ডাকে
সূচনা পর্ব
(গল্পটা মূলত কলোরাডোর পটভূমিতে উপস্থাপন করা হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের কিছু অংশ থাকবে। কিন্তু বেশিটাই দেশের বাইরের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা হবে। তাই সেগুলোকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে মেলাবেন না দয়া করে। প্রথম পর্ব পড়েই সবটা বুঝতে পারবেন না। হয়তো মনে হবে খুব কমন প্লট। তাই সবার কাছে অনুরধ থাকবে ধৈর্য নিয়ে পড়তে। অবশ্যই ভালো কিছু পাবেন। এই পোস্টটাতে দয়া করে গঠন মূলক মন্তব্য করার চেষ্টা করবেন। পেজের অবস্থা খুব খারাপ। আপনাদের সাহায্য কামনা করছি। আর এই গল্পটা শুধু পেজেই পাবেন।)