#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১০
বাংলাদেশ সময় রাত ১২ টা। তৈয়বা নাজনিন নিজের সব কাজ শেষ করে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভ্যাপসা গরমে চারিদিকে অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু ওনার ঘরের আবহাওয়া বেশ শীতল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটা শনশন শব্দে ঘরের তাপমাত্রা পরিবর্তনে ব্যস্ত। ঘুমানোর আগে প্রতিদিনের অভ্যেস বশত এক গ্লাস গরম দুধ হাতে নিয়ে বসেছেন। রকিং চেয়ারটা ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে দুলছে। তৈয়বা নাজনিন একটা বই হাতে নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন অন্যমনস্ক হয়ে। সেটা শেষ করেই বিছানায় যাবেন। মরিয়ম খুব যত্নে বিছানা গুছিয়ে রেডি করছে। টেবিলে রাখা ফোনটায় কম্পনের আওয়াজ হতেই তিনি চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে দিয়ে সেদিকে তাকালেন। অপরিচিত একটা নাম্বার তাও আবার বাইরের দেশের। কপালে চিন্তার দীর্ঘ রেখা দেখা দিলো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তিনি ফোনটা ধরলেন। গম্ভীর গলায় বললেন
–হ্যালো।
ওপাশ থেকে ভীষণ গাম্ভীর্য পূর্ণ পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো।
–মিসেস তৈয়বা নাজনিন বলছিলেন?
গলাটা চেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনভাবেই পরিচিতি পেলো না। তাই বেশ কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–জি বলছিলাম। কিন্তু আপনি কে?
–আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।
ভীষণ পরিচিতের মতো কথাটা বলেই লোকটা থামল। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো মৃদু হাসির শব্দ। তৈয়বা একটু হকচকালেন। এই মাঝ রাতে তার সাথে কে মজা করতে পারে সেটাই ভাবছেন। ভেবেও যখন কোন কুল কিনারা পেলেন না তখন বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন
–আপনি যেই হন না কেন? এই মাঝ রাতে এসব মজা আমার একদম ভালো লাগছে না। আমি রাখছি।
–আরে রাখবেন না। পরিচয়টাই তো পেলেন না। তাতেই রেখে দিচ্ছেন? আর এই মাঝ রাতে কেন আপনার সাথে মজা করবো বলেন? আপনার সাথে কি আমার মজার সম্পর্ক?
কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠের জবাবে তৈয়বা কিছুটা নরম হলেন। পূর্বের চেয়ে কিছুটা নরম কণ্ঠে বললেন
–এখনো তো জানতেই পারলাম না আপনি কে? আগে পরিচয়টা দিন। তারপর নাহয় সম্পর্কটা ঠিক করবো।
ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটা শব্দ করেই হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বলল
–আমি যে বাংলাদেশ থেকে ফোন করছি না সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
তৈয়বা মৃদু হেসে বললেন
–সে তো নাম্বার দেখেই বুঝেছি। এখন পুরো পরিচয়টা দিলেই বাকিটা বুঝে যাবো।
ওপাশের ব্যক্তিটা আবারো হেসে উঠলো। বলল
–আমি সুদূর কলোরাডো থেকে ফোন করেছি। আর আমার নাম…।
বলেই থেমে গেলো। তৈয়বার মস্তিস্ক সজাগ হয়ে উঠলো। কলোরাডো নামটা শুনেই কয়েক মুহূর্ত ভাবতে বাধ্য হল। ভীষণ চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–কে?
–জুনায়েদ। জুনায়েদ ইশতিয়াক। পরিচয়টা কি যথেষ্ট নাকি আরও কিছু জানার আছে আপনার?
নামটা শুনেই থমকে গেলেন তৈয়বা। সমস্ত কথা গলার মাঝে দলা পাকিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতো শীতল পরিবেশেও তিনি ঘেমে যাচ্ছেন। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেলেন। চোখ পড়লো মরিয়মের দিকে। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে কঠিন গলায় মরিয়মকে বাইরে যেতে বললেন। মরিয়ম চলে যেতেই তিনি চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছেড়ে ফোনটা আবার কানে লাগিয়ে বললেন
–তুমি কেন ফোন করেছো? কি চাও?
জুনায়েদ হেসে উঠলো। ভীষণ সহজ ভাবে বলল
–আপনার অপকর্ম নিশ্চয় নতুন ভাবে আপনার কাছে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। নিজে কি করেছেন সেসব তো নিশ্চয় মনেই আছে। আর এতো বছরের ডক্টরের ক্যারিয়ারে নিশ্চয় আপনি দাগ লাগাতে চাইবেন না। কারণ আপনি তো দেশের একজন সনামধন্য ডক্টর। আপনার লাইসেন্সটা নিশ্চয়…।
জুনায়েদ কে মাঝ পথেই থামিয়ে দিলেন তিনি। ফাঁকা ঢোক গিলে তৃষ্ণার্ত গলাটা ভেজাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ হল না। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন
–তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ফোন করেছিলে?
জুনায়েদ বাকা হেসে বলল
–এই তো। একদম পারফেক্ট! আপনি খুব বুদ্ধিমতি। এখন আমার একটা কাজ আপনাকে করতে হবে যে?
–কি কাজ বলে ফেলো। আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত।
তৈয়বা সময় না নিয়েই বলে ফেললেন কথাটা। ঘর জুড়ে শুরু হল নিস্তব্ধতা। শিতাতপ নিয়ন্ত্রনের যন্ত্রটার ক্ষীণ শব্দটাও যেন মাথায় ধরছে। শীতল পরিবেশটাও বিষাক্ত গরমে ছেয়ে যাচ্ছে ধিরে ধিরে।
————–
পাহাড়ের মাথায় বিশাল সূর্যটা জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ডের ন্যায় একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। রাস্তায় এখন গাড়ি ঘোড়া কিছুটা বেশী। আজ ড্রাইভার না আসায় জুনায়েদ নিজেই ড্রাইভিং করছে। সমস্ত নিয়ম মেনেই সে ড্রাইভিং করে। এই ব্যাপারে সে খুব সচেতন। সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়িতে বসেই কলোরাডোর প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। ভীষণ ক্লান্ত ভঙ্গীতে সিটে মাথাটা এলিয়ে দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। জুনায়েদ কানে লাগানো ব্লু টুথ টা চেপে ভারী গম্ভীর আওয়াজে বলল
–হ্যালো।
ওপাশ থেকে বেশ ভীত আওয়াজ কানে আসলো। কাঁপা কাঁপা গলায় একজন যুবক বলল
–স্যার ম্যাম একা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। আর বাড়ির পাশের মার্কেটে এসে অসুস্থ হয়ে গেছেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।
জুনায়েদের বুক কেঁপে উঠলো। ভেতরটা কেমন অস্থির হয় উঠলো মুহূর্তেই। ভীষণ এলোমেলো অবস্থায় অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলো
–এখন কোথায় আছে?
–ম্যাম শপিং মলেই আছে। আমিও ওনার সাথেই আছি।
জুনায়েদ ঢোক গিলে নিজের অস্থিরতা প্রকাশ না করেই বলল
–বাসায় নিয়ে যাও। আমি আসছি।
বলেই দ্রুত ফোন কেটে দিলো। নিজেকে ভীষণ বিদ্ধস্ত মনে হচ্ছে। এলোমেলো লাগছে। টাই টা ঢিলে করে দিল। অস্থিরতায় ঘেমে যাচ্ছে পুরো। মুখ মুছে নিলো হাত দিয়ে। ফোন থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে নাম্বার বের করে ডায়াল করলো। ওপাশে কয়েকবার রিং হয়ে ফোন ধরতেই জুনায়েদ অস্থির কণ্ঠে বলল
–আঙ্কেল অবনী…। অবনী…।
কথা শেষ করতে পারলো না। অস্থির ভাবে নিশ্বাস নিতে লাগলো। ডক্টর শাহের অবস্থা বুঝেই নরম কণ্ঠে বলল
–কাম ডাউন জুনায়েদ। অবনীর কি হয়েছে? আমাকে বল।
জুনায়েদ অস্থির শ্বাস ছেড়ে বলল
–অবনী জ্ঞান হারিয়েছে। আপনাকে বাসায় যেতে হবে।
ডক্টর শাহের কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন
–ঠিক আছে আমি আসছি। টেনশন করো না।
জুনায়েদ স্থির হতে পারলো না। টেনশন তার মাথা থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না। অবনীর যদি কোন সিরিয়াস কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজেকে মাফ করতে পারবে না। চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলো। এলোমেলো ভাবে গাড়ি চালিয়ে কোনরকমে বাড়ি পৌঁছল। গাড়ীটা ব্যাক ইয়ার্ডে রেখেই নেমে গেলো। অস্থিরভাবে বাড়িতে ঢুকে পড়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। অবনীর ঘরের দরজা খোলা। সেখানে দাড়িয়েই কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। অচেতন দেহটা বিছানায় পড়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে। ডক্টর শাহের এসেছেন। তিনি খুব সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। পাশেই দাড়িয়ে আছে জন। জুনায়েদ জনের দিকে একবার তাকাল। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। এই মুহূর্তে তার সাথে কথা বলার সময় নেই তাই বিষয়টা স্কিপ করে এগিয়ে গেলো। অচেতন অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে আঙ্কেল? সব ঠিক আছে তো?
ডক্টর শাহের জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে আশস্ত করে বললেন
–একদম ঠিক আছে। সেরকম কিছু না। ঘুম হয়তো ঠিক মতো হচ্ছে না তাই একটু দুর্বলতা কাজ করছে। দুর্বলতার জন্যই জ্ঞান হারিয়েছে।
জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ডক্টর শাহের বলল
–আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি।
জুনায়েদ একবার অবনীর দিকে তাকিয়ে বের হয়ে এলো। দুজনে একদম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সোফায় বসে ডক্টর শাহের বললেন
–অবনীকে গত ৬ বছর ধরে রেগুলার ড্রাগ দেয়া হতো সেটা তুমি জানো।
জুনায়েদ হতাশ শ্বাস ছাড়ল। অসহায়ের মতো বলল
–জি। জানি।
ডক্টর শাহের জুনায়েদের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি নিচে স্থির। তিনি আবারো বললেন
–ওকে আমি যে মেডিসিন দিয়েছি ওগুলো রেগুলার নিচ্ছে তো?
জুনায়েদ মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো যে নিচ্ছে। তিনি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন
–ওর ঘুমটা কমপ্লিট হচ্ছে না। আর তাছাড়াও কোন একটা মানসিক টেনশন ওর মাঝে কাজ করছে। যার ফলে আমি কিছুটা ক্ষতির আশংকা করছি।
জুনায়েদ বড় বড় চোখে তাকাল। বলল
–মানে কি আঙ্কেল?
–আমি ওর রিপোর্ট সব দেখেছি। ওর শারীরিক কোন প্রবলেম নেই। ওকে বিভিন্ন প্রবলেম এর কথা বলে অনেক ধরনের মেডিসিন দেয়া হতো। আবার ওর খাবারে ড্রাগস মিশিয়ে দেয়া হতো। এতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। ওর মস্তিস্কে এসবের অনেক প্রভাব পড়েছে। এখন ওকে যে ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে সেগুলো চালিয়ে আমি দেখতে চাই ঠিক কতোটা ডেভলোপ করছে। তারপর ধিরে ধিরে আমি মেডিসিন কমিয়ে দেবো।
জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে বলল
–আমার মনে হয় ওর স্লিপিং পিলস গুলো খুব বেশী পাওয়ার ফুল। ওর নাকি রাতে ভালো ঘুম হলেও দিনের বেলা ঘুম পায়। এরকমটাই বলছিল। এতে যদি কোন ক্ষতি হয়? তাই বলছিলাম ডোজ টা একটু কমিয়ে দিলে হয়না?
ডক্টর শাহের তাকালেন। বললেন
–আমি যা ঔষধ দিয়েছি সেসবে ওর কোন ক্ষতি হবে না। আর স্লিপিং পিলের পাওয়ার কমানো এখন সম্ভব নয়। ওর শরীর মেডিসিনের সাথে একটু স্বাভাবিক রেসপন্স করলেই আমি ডোজ কমিয়ে দেবো। আপাতত কিছুই করা সম্ভব নয়। আর ও নিজে থেকে যতই বলুক ভালো ঘুম হচ্ছে। ওর ভালো ঘুম হচ্ছে না। কোন কিছু নিয়ে একটু টেনশন করছে। সেটা কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই টেনশনের কারণ বের করে সেটাকে নির্মূল করতে হবে জুনায়েদ। আমি সব কিছু ভেবেই ওর ট্রিটমেন্ট করছি। ভরসা রাখো।
জুনায়েদ হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি কিভাবে সেটা জানতে পারি আঙ্কেল। আপনি তো জানেন আমি ওর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলতে পারিনা। এই অবস্থায় কিভাবে ওর টেনশনের কারণ জেনে সেটা নির্মূল করবো।
ডক্টর শাহের বেশ চিন্তিত ভঙ্গীতে বললেন
–আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার এমন অস্বাভাবিক ব্যাবহারটাই অবনীর মানসিক অবসাদের কারণ। এখন বাকি সবকিছুর থেকে অবনীর ভালো থাকাটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই তুমি বাকি সবকিছুকে গুরুত্ব না দিয়ে অবনীকে গুরুত্ব দাও। একটু কৌশলে ওকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করো। আসলে আমিই তোমাকে বলেছিলাম যে ওর মানসিক অবস্থাটা পুরোপুরি না বুঝে ওর কাছে নিজের অনুভূতি জাহির করতে যেও না। এতে হিতের বিপরীত হতে পারে। তোমার উপরে ভরসা করার বদলে শত্রু ভেবে বসতে পারে। কিন্তু এখন দেখছি তোমার আচরণ ওর জন্য বিপদ হয়ে উঠছে। এবার কিন্তু তোমাকে সময় বেশী দিতে হবে জুনায়েদ। এমন ভাবে ওর খেয়াল রাখতে হবে যেন ও তোমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। ওর জীবনে তুমিই একমাত্র ভরসার ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারো।
চলবে……
(গল্প কিছুটা থ্রিলার ধাঁচের। তাই প্রয়োজনে সিনেমাটিক প্লট থাকতে পারে। ধিরে ধিরে রহস্যের খোলাসা হবে। একটু ধৈর্য নিয়ে পাঠক মহলকে পড়ার অনুরধ রইল।)