#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১১
নিস্তব্ধ সন্ধ্যার মুহূর্তটা ভয়াবহ রুপ নিলো। ফায়ার প্লেসের জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ডে কাঠ পোড়ার কর্কশ আওয়াজ আসছে। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে। আর জুনায়েদ রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ভীষণ শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো
–ম্যামকে একা বাইরে যেতে দিয়েছ কেন?
এমন শীতল কণ্ঠ শুনে ভয়টা আরও বেড়ে গেলো সবার। এলেক্স আর ম্যালিনা নিচের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। রোজ নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে ভীষণ ভীত কণ্ঠে দক্ষ ইংরেজদের মতো বলল
–ম্যামকে আটকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম আমরা। কিন্তু উনি কারো কথা শুনেন নি। উল্টা আরও ধমক দিয়ে চলে গেছেন।
–আমাকে কেন জানানো হয়নি তখন?
আবারো শীতল কণ্ঠে রোজ কেঁপে উঠলো। এবার আর তার মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছে না। এভাবে চুপ করে থাকলে জুনায়েদ আরও রেগে যাবে বুঝেই জন মুখ খুলল। ভীত কণ্ঠে বলল
–আসলে স্যার…।
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই গালে শক্ত হাতের থাপ্পড় পড়লো। বেশ জোরেই আঘাত লাগলো তার। এক হাত গালে রেখে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পড়লো। জুনায়েদ চেচিয়ে উঠে বলল
–খেয়াল রাখতে পারবে না সেটা আমাকে আগে বললে না কেন? তোমাকে বলেছিলাম ওকে কখনো একা ছাড়বে না। ওর সমস্ত আপডেট আমাকে দেবে সময় মতো। কিন্তু তুমি পুরোটা সময় আমাকে কিছুই জানাওনি। যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখন জানিয়েছ। তোমার ধারনা আছে ওর কি কি ক্ষতি হতে পারতো? আজ যদি অবনীর কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি তোমাদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখতাম না। মনে রেখো।
থেমে আঙ্গুল তুলে প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে শীতল কণ্ঠে বলল
–অবনীর যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে কেউ বাঁচবে না। এটাই শেষবার। আমি দ্বিতীয়বার এই কথা বলবো না।
বলেই দ্রুত পায়ে চলে গেলো উপরে। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিজ নিজ কাজে চলে গেলো তারা।
————
কলোরাডোতে আজ ঝকঝকে আকাশ। পাহাড়ের উপরে পড়েছে মিষ্টি রোদ্দুর। এলোমেলো হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। অবনী আজ সকাল বেলাতেই রান্না ঘরে এসেছে। নিজের মতো রান্না করছে। বাড়িতে কে আছে কে নেই সেসব নিয়ে কোন খেয়াল করেনি। দুপুরের রান্না শেষ করে এলেক্সকে বলল
–তুমি টেবিলে খাবার সাজাও। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।
বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো। যাওয়ার আগে একবার জুনায়েদের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। কিন্তু এই সময় তো জুনায়েদের অফিসে থাকার কথা। তাহলে ঘরে কে? বিষয়টা মাথায় ঢুকলেও খুব একটা গুরুত্ব দিলো না অবনী। নিজের ঘরে চলে গেলো। কিছুটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো সে। ভেজা চূলগুলো ভালো করে মুছে নিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই চোখ আটকে গেলো। জুনায়েদ চেয়ারে বসে আছে। জায়েদ রহমান তার সামনের চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছেন। আর বাবা ছেলে মিলে কি যেন গল্প করছে। অবনী কিছুটা অবাক হল। জুনায়েদ অফিসে যায়নি কেন? সে তো অকারনে অফিস মিস করেনা? আর আজ তো ছুটির দিনও না তাহলে কেন বাসায়? ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। জুনায়েদ এখনো খাবার শুরু করেনি। কিন্তু জায়েদ রহমান ব্যস্ত ভঙ্গীতে খাবার খাচ্ছেন। মনে হচ্ছে খুব তাড়া আছে। অবনী এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল
–এভাবে তাড়াহুড়ো করে খাবার খাচ্ছেন কেন বাবা? ধিরে ধিরে খান।
বাবা ছেলে দুজনই ঘুরে তাকাল। জায়েদ রহমান মুখে খাবার রেখেই অস্পষ্টভাবে বলল
–একটু তাড়া আছে মামনি। একটা কাজে যাবো। তাই তোমাকে রেখেই খেতে বসেছি।
অবনী মুচকি হাসল। বলল
–ঠিক আছে বাবা। আপনি খেয়ে নিন। আমি এখন বসছি।
বলেই চেয়ার টেনে বসে পড়লো। প্লেটে খাবার তুলতে গিয়েই খেয়াল করলো জুনায়েদ অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবনী এক পলক তাকাতেই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। জুনায়েদের দৃষ্টি কেমন নেশাল। এভাবে তাকে কখনো দেখেছে কিনা অবনীর ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু আজ এমন কি হল? অবনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কিন্তু নিজের স্বভাব বশত কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে মৃদু স্বরে বলল
–এভাবে দেখবেন না জুনায়েদ সাহেব। দৃষ্টির সাথে মনের বড় সংযোগ আছে। কখন পরিবর্তন হয়ে যায় কে জানে।
জায়েদ রহমান কথাটা শুনতে না পেলেও জুনায়েদ ঠিকই শুনতে পেলো। অবনী ভেবেছিলো জুনায়েদকে জ্বালানোর জন্য এমন কথা যথেষ্ট হবে। এখনই রেগে যাবে সে। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে সেসব কিছুই হল না। জুনায়েদ আলতো করে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল
–বাবা তুমি কখন আসবে?
জায়েদ রহমান খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়েই বলল
–লেট হবে। কেন? কিছু বলবে?
–তুমি বলছিলে সানফ্রানসিসকো যেতে। আমি অফিসে কথা বলে ছুটি নিয়েছি। ১০ দিনের। ভেবেছি এই কয়দিনে সানফ্রানসিসকো ঘুরেই আসি।
জায়েদ রহমান অদ্ভুত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে প্রশস্ত হেসে বললেন
–যদি তোমাদের কোন প্রবলেম না থাকে তাহলে আজ বিকেলেই রওনা হয়ে যেতে পারো। আমি এখনই কথা বলে নিচ্ছি।
জুনায়েদ একবারেই সম্মতি দিয়ে দিলো। অবনীকে কিছুই বলার সুযোগ দিলো না। অবনী শুধু হা করে বাবা ছেলের কথা শুনেই যাচ্ছিল। জায়েদ রহমান খাবার শেষ করে উঠে পড়লেন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। অবনী এতক্ষন চুপ করে ছিল। জায়েদ রহমান চলে যেতেই জুনায়েদের দিকে ফিরে ঝাঁঝালো গলায় বলল
–সবকিছু ঠিক করে ফেললেন অথচ আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না? আমাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার মতামত নেয়ার প্রয়োজন নেই নাকি? অদ্ভুত মানুষ তো আপনি।
জুনায়েদ খাবার খেতে খেতে সেদিকে তাকিয়েই বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল
–মতামত নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি কারণ বাবা যেদিন এই কথাটা প্রথম বলেছিল সেদিন হানিমুনে যাওয়ার সখটা তোমারই বেশী ছিল।
বলেই থামল। অবনীর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চমৎকার হেসে বলল
–ভুলে গেছো? কি বলেছিলে মনে করিয়ে দেবো? এখন এভাবে কেন বলছ? যাবে না নাকি হানিমুনে?
অবনী কিছুটা ভড়কালো। মনে পড়ে গেলো সেই রাতের কথা। থেমে থেমে বলল
–তবুও আমার অনুমতি নেয়া উচিৎ ছিল।
জুনায়েদ গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। মাথাটা ঝুঁকে অবনীর কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বলল
–বিয়ে করার সময় তো আমার অনুমতি নাওনি। তখন তো নিজের ভালবাসা প্রকাশ করতে ব্যস্ত ছিলে। কি থেকে কি হয়ে গেলো যে আমাকে আমার অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করে ফেললে। জিজ্ঞেস করা তো দুরের কথা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি। কবুল বলার আগ মুহূর্তেই জানতে পারি আমার বিয়ে। সেই বিয়ে করা বরের সাথে এখন হানিমুনে যেতে এতো নাটক কেন সুইটহার্ট!
জুনায়েদের এমন সম্বোধনে অবনী এলোমেলো হয়ে পড়লো। অনুভূতিগুলো কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো আচমকাই। নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লাগলো। এর মাঝেই জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালো। ফোনের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার জন্য পা বাড়াতেই অবনী মৃদু স্বরে বলল
–খাবারটা শেষ করেলেন না যে? কোথায় যাচ্ছেন?
জুনায়েদ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই উত্তর দিলো।
–ক্ষুধা নেই। খাবার শেষ করে কফি নিয়ে আসো আমার ঘরে।
অবনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। জুনায়েদ নিজের ঘরে চলে গেলো। খোলা ছাদের ছাউনির নিচে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো অবনীর। বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর দরজায় নক করতেই মুচকি হেসে বলল
–কাম ইন!
জুনায়েদ সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠের আওয়াজ আসলো।
–স্যার কফি।
তৎক্ষণাৎ ঘাড় ফিরিয়ে এলেক্সকে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। ভেতরের নরম অনুভূতিটা গুড়িয়ে শক্ত হয়ে উঠলো। হুঙ্কার ছেড়ে বলল
–তুমি কেন এসেছ? ম্যাম কই?
এলেক্স কিছুটা ভয় পেলো। নত দৃষ্টিতে বলল
–ম্যাম পাঠিয়ে দিলো স্যার।
জুনায়েদ সামনে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রাগে তার সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটার কাজ কর্মে সে ভীষণ অতিস্ট। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে এমন উদ্ভট কাজের জন্য শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে না। মেয়েটার কষ্ট হয়তো সে সহ্য করতে পারবে না। তাই সুপ্ত রাগটা প্রকাশ হওয়ার আগেই ঝিমিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে কঠিন গলায় বলল
–চলে যাও।
এলেক্স দ্বিতীয় কোন বাক্য উচ্চারন না করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জুনায়েদ শীতল কণ্ঠে বলল
–দাঁড়াও।
এলেক্স থেমে গেলো। জুনায়েদ উঠে এসে কফির কাপটা ওর হাত থেকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে নিচে ফেলে দিলো। কাপটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে কফিটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। জুনায়েদ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–এটা দ্রুত পরিস্কার করবে। আর ম্যামকে বল যে স্যার রাগ করে কাপ ভেঙ্গে ফেলেছে। এবার কফিটা আপনাকেই নিয়ে যেতে হবে।
এলেক্স এমন অদ্ভুত আচরনের কারণ বুঝতে পারলো না। অদ্ভুত ভাবে তাকাল। কিছু না বুঝেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। জুনায়েদ আবারো নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। এলেক্স পুরো ঘর পরিস্কার করে নিতেই অবনী কফির কাপ হাতে ঘরে ঢুকল। জুনায়েদের দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–আপনার কফি।
জুনায়েদ ঘুরে তাকাল। মুচকি হেসে কাপটা হাতে নিয়ে বলল
–থ্যাঙ্কস!
অবনী কিছুটা অপমানের স্বরে বলল
–আমার হাতের বানানো কফি তো জঘন্য হয় জুনায়েদ সাহেব। তাহলে আজ হঠাৎ কি মনে হল যে আমাকেই কফিটা বানাতে বললেন।
জুনায়েদ কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েই থেমে গেলো। মেয়েটার এমন গা জ্বালানো কথা তার অসহ্য। সে কি বোঝেনা? দীর্ঘশ্বাস টা গোপনে লুকিয়ে বলল
–আমার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশী। যেমন তুমি।
বলেই অবনীর দিকে তাকাল। ভীষণ অদ্ভুত ভাবে হাসল। অবনী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–আমার কাজ আছে। আমি আসছি।
জুনায়েদ থামিয়ে দিলো। বলল
–গুছিয়ে নাও সবকিছু। আমরা একটু পরেই রওনা দেবো।
অবনী কথার বিপরীতে কিছুই বলতে পারলো না। নীরবে নিজের ঘরে চলে এলো। তার কাছে আর কোন উপায় নেই। জুনায়েদ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই ডক্টর শাহের এর নাম্বারে ডায়াল করলো। তিনি ফোনটা ধরেই বলল
–কি খবর জুনায়েদ? সব ঠিক আছে তো?
জুনায়েদ আশস্তের সুরে বলল
–সব ঠিক আছে আঙ্কেল। আমি আসলে একটা কথা জানাতে ফোন করেছিলাম। অবনী কে নিয়ে সানফ্রানসিসকো বেড়াতে যাচ্ছি। আমার মনে হয় একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলেও ওর মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন হবে।
ডক্টর শাহের কিছুটা সময় নিয়ে বললেন
–প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার এর পেশেন্টরা আসলে কিভাবে ভালো থাকতে পারবে সেটা তাদের পরিবেশের উপরে ডিপেন্ড করে। ঘুরতে যাও। সিদ্ধান্তটা ভালো। কিন্তু একটা বিষয় তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে। তোমার ওর প্রতি দুর্বলতা খুব বেশী প্রকাশ করে ফেল না। এই ধরনের পেশেন্টরা কাছের মানুষকেই বেশী সন্দেহ করে। তাদের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা করে। তাই তোমাকে আমি এতদিন অবনীর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। যদি কোনভাবে তোমাকে ওর শত্রু ভাবতে শুরু করে তাহলে কিন্তু বিপদ হয়ে যাবে জুনায়েদ। ইউ হ্যাভ টু বি ভেরি কেয়ারফুল।
- চলবে……