#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১২
সানফ্রানসিসকো মেঘের শহর। উঁচু উঁচু দালানের মাথায় মোটা মোটা বরফের আস্তরণ। গাছ পালা সবকিছু বরফে ঢেকে আছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু শুভ্র তুষার। আকাশ থেকে অনবরত নিজের খেয়াল খুশিমতো পড়ছে। অবনী বারান্দায় দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরে। অন্ধকারের মাঝেও রাস্তার আলোয় শুভ্রতা বেশ নজর কাড়ছে। কিছুক্ষন আগেই তারা দুজনে এসে পৌঁছেছে সানফ্রানসিসকো। পুরো রাস্তায় অবনী জুনায়েদের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনি। জুনায়েদের আচরন তার কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। কথা বার্তা কেমন অদ্ভুত। ইচ্ছা করে এমন করছে নাকি অন্যকোন কারণ আছে তার। অবনী ঠিক বুঝতে পারছেনা। জুনায়েদের কথা শুনে কখনো সে বিরক্ত হচ্ছে। কখনো আবার লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। আবার কখনো অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে। মানুষটাকে বেশ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।
–এটা খেয়ে নাও।
কাচের গ্লাসে হলদেটে কোন তরল। একদম নিচে পড়ে আছে। অবনী ভ্রু কুচকে স্বভাব বশত নাকটা এগিয়ে দিলো। উটকো গন্ধ নাকে লাগতেই গা গুলিয়ে এলো তার। দুই আঙ্গুলে নাক চেপে ধরে মুখ বেকিয়ে বলল
–এসব কি? কি বিশ্রি গন্ধ।
জুনায়েদ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–গন্ধটা একটু বিদঘুটে কিন্তু ততটাও না। এই যে কাঁপছ ঠাণ্ডায়। এটা খেলে ঠাণ্ডাটা কম লাগবে।
অবনী নাক ছেড়ে দিলো। স্বাভাবিক হয়ে বলল
–আমি ঠাণ্ডায় মরে গেলেও এটা খাবো না। একদম বাজে।
জুনায়েদ ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলে রেখে দিলো। নিজের টাতে এক চুমুক দিয়ে বলল
–এজ ইউর উইশ।
বলেই ভেতরে সোফায় বসে পড়লো। সামনের দেয়ালে টাঙ্গানো বড় স্ক্রিনটা অন করতেই উচ্চ শব্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো ইংরেজি একটা ছবি। অবনী বারান্দাতেই দাড়িয়ে থাকলো। জুনায়েদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আবারো বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। জুনায়েদ ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–ভেতরে এসো।
অবনী ভীষণ আব্দারের সুরে বলল
-একটু থাকি না?
–নাহ!
জুনায়েদের কাঠ কাঠ জবাবে সে মুখ ভার করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। জুনায়েদ সামনে তাকিয়েই কঠিন স্বরে বলল
–ক্লোজ দা ডোর।
অবনী দরজাটা শব্দ করেই বন্ধ করে সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অনেক রাত হয়েছে। আজ রাতটা তারা রেস্ট নিয়ে কাল থেকে ঘুরতে বেরোবে। অবনী একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো। জুনায়েদ ভলিউমটা কমিয়ে দিয়ে অবনীর দিকে ফিরে তাকাল। ভীষণ অসহায় দৃষ্টি। মস্তিস্কে নানা রকম চিন্তা ভর করলো। এভাবে সে অবনীর কাছে কোনদিন যেতে পারবে না। কি করলে অবনীর মনে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারবে। যার উপরে অবনী নিজের থেকেও বেশী বিশ্বাস করবে। মূলত তাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসার কারণ এটাই। বাইরে জুনায়েদকে ছাড়া অবনী আর কাউকে চেনে না। তাই প্রতিটা ক্ষেত্রে তার উপরেই ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। মোটামুটি বাধ্য হয়েই তার উপরে ভরসা করতে হবে তাকে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাবে জুনায়েদ। অবনীর সম্পূর্ণ বিশ্বাসটা সে অর্জন করে ফেলবে।
————
তৈয়বা নাজনিন অনবরত ঘামছে। আচলে নিজের মুখ আর গলা মুছে নিয়েই সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল
–বিশ্বাস করো। আমি এসবের কিছুই জানিনা। জুনায়েদ কেন এমন করলো আমি সেটাও জানিনা। আমি জানলে এমনটা কিছুতেই হতে দিতাম না।
আশরাফ উদ্দিন টেবিলে জোরে শব্দ করলো হাত দিয়ে। এতে তিনি খানিকটা ব্যাথা পেলেন। কিন্তু তার রাগটা এখন এতই বেশী যে পারলে তৈয়বাকে খুন করে বসেন। নিজের রাগটা সামলে নিয়ে বললেন
–বিশ্বাস করলাম তোমার কথা। কিন্তু কোনভাবে যদি আমি জানতে পারি এর সাথে তোমার কোন যোগসূত্র আছে। তাহলে তোমাকে মেরে ফেলবো মনে রেখো।
তৈয়বা কেঁপে উঠলো। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। আশরাফ উদ্দিন চলে গেলেন। কিন্তু তৈয়বার ভয়টা কিছুতেই কমলো না। ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ১১ টা মানে এখনো জুনায়েদ ঘুমিয়ে পড়েনি। তাকে ফোন দেয়া যেতে পারে। সাত পাচ না ভেবে ফোন লাগাল। কয়েকবার রিং হতেই জুনায়েদ ধরে ফেললো। তার গম্ভীর আওয়াজের বিপরীতে তৈয়বা ভীত কণ্ঠে বলল
–জুনায়েদ আমাকে বাঁচাও।
এমন কথা শুনে জুনায়েদ কয়েক মুহূর্ত ভাবল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–আপনাকে বাঁচাব মানে? কি হয়েছে?
তৈয়বা শুকনো ঢোক গিলে বললেন
–আশরাফকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য র্যাবের অফিসে ডেকেছে। সে জেনে গেছে তুমি সব করেছো। আমাকে সন্দেহ করছে। বলেছে কোনভাবে এর সাথে আমার যোগসূত্র পেলে মেরে ফেলবে।
জুনায়েদ ভীষণ সস্তির কণ্ঠে বলল
–এতো ভাববেন না আনটি। আমি আছি তো। কথা দিয়েছি আপনার কোন ক্ষতি হতে দেবো না। আপনি আমার উপরে ভরসা রাখুন। আর হ্যা আঙ্কেল কে জানানোর ব্যবস্থা আমিই করে দিয়েছি। উনি তেমন কিছুই করতে পারবেন না।
তৈয়বা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। বললেন
–অবনী কেমন আছে?
জুনায়েদ অবনীর পাশেই শুয়ে ছিল। তাকে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে। সে এখন কোনভাবেই জেগে যাবে না। তাই তার পাশে কথা বলতেও কোন সমস্যা নেই। মাথায় হাত দিয়ে আদরের ভঙ্গীতে বলল
–ভালো আছে।
–ওর ট্রিটমেন্ট কেমন চলছে? সবকিছু ঠিক আছে তো?
জুনায়েদ অবনীর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–ঠিক আছে।
তৈয়বা আকুলতা নিয়ে বলল
–একটু কথা বলা যাবে? যদি তুমি অনুমতি দাও।
জুনায়েদ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–এখন ঘুমাচ্ছে। কাল আমি সময় করে অবশ্যই কথা বলার ব্যাবস্থা করে দেবো। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন। অবনী যেন কিছুই না জানতে পারে। এতে ওর ক্ষতি হবে।
তৈয়বা কেদে ফেললো। মুখে আচল চেপে আটকানোর চেষ্টা করলো। বলল
–আমি ওকে আমার সন্তানের মতো মানুষ করেছি। ওর ক্ষতি চাওয়ার সাহস আমার নেই। বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। আমি ওকে আমার নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসি।
জুনায়েদ মৃদু হেসে বলল
–আমি জানি। আপনি ভাববেন না। আমি ওর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবো।
তৈয়বা সস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিলো। ভেতরটা তার চৌচির হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র বোন মারা যাওয়ার পর তার বোনের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নেন। সংসারে আসে সৎ মা। সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচাতেই নিঃসন্তান তৈয়বা বোনের মেয়েকে নিয়ে আসেন সংসার পূর্ণ করতে। তার স্বামী আশরাফও তাকে নিজের মেয়ের মতোই মেনে নেয়। ভরন পোষণে কোন ত্রুটি করেনি। কিন্তু অবনী যতো বড় হতে থাকে তৈয়বা ওর আচরনে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। বিষয়টা ধিরে ধিরে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে অবনী আশরাফের সাথে কথা বললে তিনি বলেন বিষয়টা দেখবেন। কিন্তু অবনীর আচরনের কোন পরিবর্তন হয়না। তাই কারো সাথে কথা না বলে নিজের ডাক্তারি পেশার বদৌলতে নিজেই মেয়ের পরীক্ষা করান। জানতে পারেন ওর ব্লাডে মারাত্মক শক্তিশালী ড্রাগ পাওয়া যায়। কিন্তু এই ড্রাগ শরীরে কিভাবে যায় সেটাই তার মাথায় ঢুকল না। তিনি দেরি না করে বিষয়টা তৎক্ষণাৎ জানান আশরাফকে। কিন্তু তারপরেই ঘটে যায় আসল ঘটনা। আশরাফের সমস্ত মুখোশের উন্মোচন ঘটে। আশরাফ একজন ড্রাগ ডিলার। শহরের নামিদামি একজন ব্যবসায়ি তিনি। কিন্তু তার এই ব্যবসার মূল বিষয় অবৈধ ভাবে ড্রাগ বাংলাদেশে আনা। উচ্চ পদস্থ লোকজনের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় বিষয়টা আরও সহজ হয়ে যায়। আর সে প্রতিদিন কোন না কোনভাবে অবনীর খাবারের সাথে ড্রাগ মিশিয়ে দিত। তার কারণ অবনীর নানা তার মায়ের সম্পত্তির সব অংশ তার নামে লিখে দেয়। আর অবনীকে পাগল বানিয়ে সেটা আত্মসাৎ করার প্ল্যান করেন আশরাফ। পুরো ঘটনা জানার পরে তৈয়বা বিশ্বাস করতে পারেনি। এতদিন ধরে যে মানুষটার সাথে সংসার করে এসেছে সে যে এমন হবে সেটা ধারনাতেও ছিল না। তারপর শুরু হয় অবনীকে বাচানর যুদ্ধ। দ্রুত ঐ বাড়ি থেকে তাকে বের করার চেষ্টা করে তৈয়বা। অবনীকে তার নানার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আশরাফ বারবার তাকে ফিরিয়ে আনে। অবনীও আশরাফকে নিজের বাবার থেকেও বেশী ভালবাসে আর বিশ্বাস করে। আশরাফের ভয়ে তৈয়বা এসব কিছুই কাউকে বলতে পারেনি। কিন্তু অবনীকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঠিক সেই সময় জায়েদ রহমান বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। আর এক পর্যায়ে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে তৈয়বার শরণাপন্ন হন। ট্রিটমেন্টের বদৌলতে তৈয়বার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় জায়েদ সাহেবের। বাবাকে দেখতেই দেশে আসে জুনায়েদ। তখনই পরিচয় হয় অবনীর সাথে। জুনায়েদের তাকে খুব ভালো লেগে যায়। জায়েদ রহমান বিষয়টা নিয়ে তৈয়বার সাথে আলোচনা করেন। তৈয়বা মনে মনে ভীষণ খুশী হয়। বিয়ে করে হলেও অবনীকে ঐ বাড়ি থেকে সরানো যাবে। কিন্তু এই কথা আশরাফ জানার পর কোনভাবেই রাজি হয় না। এমন কি অবনিকে সে বিয়ে না দেয়ার কথা জানিয়ে দেন। তাদের রাজি না হওয়ায় জুনায়েদ ভীষণ কষ্ট পায়। সে অবনীকে খুব ভালবেসে ফেলে। তাই তৈয়বার কাছে নিজে গিয়ে কথা বলে। জুনায়েদের কাছে প্রথমে কিছু না বললেও তৈয়বা তার কথায় বুঝে যায় জুনায়েদ অবনীকে কতোটা ভালয়াসে। আর সে যে তাকে ভালো রাখবে সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই বাধ্য হয়ে জুনায়েদকে সবটা খুলে বলে। জুনায়েদ সব শুনে তার বাবার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। অতঃপর জায়েদ রহমান তার নিজের বুদ্ধি প্রয়গ করেই এমন কিছু করে যাতে অবনী নিজেই বিয়ে করতে রাজি হয়। পুরোটা তার প্ল্যান অনুযায়ী হয়। আর এতে আশরাফ সাহেব জুনায়েদ আর তার বাবার উপরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। প্রতিশধ নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। এই লোকটা ভীষণ ভয়ংকর। যে কোন বিপদ ঘটাতে পারে। তৈয়বা নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো। ভয়ে ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। না জানি তার মেয়েটার কপালে শেষ পর্যন্ত কি আছে?
চলবে…
(রিচেক করা হয়নি। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)|