#মেঘফুল_১১
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
__________________________________
জান্নাত মেঘালয়কে না জানিয়েই তার বাপের বাড়িতে চলে এসেছে।সে জানে মেঘালয় তাকে নিয়ে আসবে না। তারউপর যা অত্যাচার করেছে সেটা আবার নাই বা বলি! আসার আগে সেন্টার টেবিলের উপর একটা চিরকুট রেখে এসেছে। মেঘালয়ের ঘুম ভাঙলো সাতটার দিকে। জান্নাতকে রুমে দেখতে পেলো না। তার চোখ আঁটকে গেলো সেন্টার টেবিলে রাখা চিরকুটের উপর। সে হন্তদন্ত হয়ে চিরকুটের ভাঁজ খুলে দেখলো তাতে লেখা আছে,_
জানি আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না। আমার মা ভীষণ অসুস্থ। শান্তি পাচ্ছিলাম না। আপনি তো আমাকে বুঝলেন না। তাই না জানিয়ে একাই বেড়িয়ে পড়লাম। জানিনা কবে ফিরবো। আমাকে ক্ষমা করবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।
ইতি
এক অভাগা নারী
জান্নাত
মেঘালয় চিরকুট পড়ে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ডাস্টবিনে ফেলে বললো,” যাক ভালো হয়েছে। আপদ বিদায় হলো!”
—
শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জান্নাত যখন ঘরে এসে ঢুকলো,বেলা তখন সকাল আটটা বাজে। এ সময় জান্নাতকে দেখে নীলু বিস্মিত হয়ে বললো,” আপা তুমি…!”
জান্নাত কান্না আটঁকিয়ে বললো,” হ্যাঁ আমি এসেছি মাকে দেখার জন্য।” বলতে বলতে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রাবেয়া বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। জান্নাত বিছানায় বসে মায়ের হাত মুঠোয় নিয়ে কেঁপে উঠলো। কুন্ঠিত হয়ে বললো,” একি শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! মা তোমার কি হয়েছে? দেখো তোমার মেয়ে এসেছে। কথা বলো মা…!”
রাবেয়া মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে পিটপিট করে চোখ খুললেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। থেমে থেমে বললেন,” কেমন আছিস মা? জামাই বাবাজি আসেন নি?”
” ভালো আছি মা। ওর কাজ আছে তাই আসতে পারেনি।”
মাকে মিথ্যে কথাটা বলায় তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। তবুও বললো। পাছে মা শুনলে কষ্ট পাবেন বলে।
রাবেয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,” মনে হচ্ছে খুব শীগ্রই মরে যাবো আমি। তোকে এত রোগা লাগছে কেন? মুখ এত মলিন কেন! আমাকে মিথ্যে কথা বললি?”
জান্নাতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। এটাই মা। কেউ না বুঝলেও মা ঠিকই এক লহমায় তাকে বোঝে ফেললেন। আবারও সে কুন্ঠিত হয়ে মায়ের মুখে হাত রেখে বললো,” অমন কথা বলো না মা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মিথ্যে কথা বলার জন্য আমি দুঃখীত। এ সময়ে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
“আমি সবই বুঝিরে মা। আর কাউকে নিয়ে আমার এতটা চিন্তা হয় না তোকে নিয়ে যতটা চিন্তা হয়। সবর কর মা।” বলতে বলতে রাবেয়ার দাঁতের মাড়ি দিয়ে র ক্ত বের হয়ে মুখ দিয়ে গড়িয়ে পরলো। নাক দিয়েও কয়েক ফোঁটা র ক্ত গড়িয়ে পরলো। র ক্ত দেখে জান্নাতের মাথা ভনভন করে উঠলো। সে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। ভেতরটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। চিৎকার করে দীলুকে ডাক দিলো। দীলু রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে অবাক হয়ে বললো,” আপা! তুমি কখন এলে? আর চিৎকার করছো কেন? কি হয়েছে?”
জান্নাত কেঁদে বললো,” দেখ মায়ের নাক-মুখ দিয়ে র ক্ত বের হচ্ছে। ডাক্তার দেখাসনি? বাবা কোথায়?”
দীলুও র ক্ত দেখে ভয় পেলো। একটা গামছা দিয়ে র ক্ত মুছে দিতে দিতে বললো,” কাল তো ডাক্তার দেখিয়ে আনলাম। ঔষধ দিলো এক সপ্তাহের। আর বাবা বাইরে কোথাও গেছেন হয়তো।”
রাবেয়া মেয়েদের শান্ত করার জন্য বললেন,” আহা! তোরা এত উদ্বিগ্ন হচ্ছিস কেন? আমি তো ঔষধ খাচ্ছিই। এটা কোনো সমস্যা না। সেড়ে যাবে।”
” কিন্তু মা…জান্নাতকে থামিয়ে রাবেয়া বললেন,” আর কোনো কিন্তু না। যা গিয়ে বোরখা খুলে ফ্রেশ হয়ে আয়।”
—
জান্নাত পুকুরে গেলো হাতমুখ ধুয়ার জন্য। তারপর ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসলো। মেঘালয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। তার মনে হচ্ছে হয়তো প্রভার সাথে সে যোগাযোগ করেছে। প্রভাও হয়তো তাকে মেনে নিয়েছে তাই মেঘালয় তাকে এত অবহেলা করে, কষ্ট দেয়। সে মনে মনে বললো,” নাহ! আজ আমি প্রভার সাথে কথা বলবো। যাক ভালো হয়েছে আসার সময় মেয়েটার নাম্বার নিয়ে এসেছিলাম।”
সকাল গড়িয়ে বিকেলে জান্নাত প্রভার ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। প্রভা সাথে সাথে এক্সপেক্ট করে নিলে জান্নাতের মনে হালকা খুশির ঢেউ বয়ে গেলো। সে সালাম দিয়ে টেক্সট পাঠালো,
” কেমন আছেন আপু?”
” ওয়া আলাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কে?”
“আপু আপনি আমাকে চিনবেন না। তবে পরিচয় দিলে হয়তো চিনবেন। আপনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। আপনি কি এখন ফ্রী?”
” জানি না আপনি কে? তবে আমি এখন ফ্রী আছি। কি বলতে চান বলুন।”
জান্নাত একটু দম নিয়ে টেক্সট লিখলো,
“আপু দয়া করে আমার স্বামীর পিছু ছেড়ে দিন?”
প্রভা কপট রাগ নিয়ে টেক্সট লিখলো,
” কি আবোলতাবোল বকছেন? কে আপনার স্বামী?”
“মেঘালয়! তিনি আমার স্বামী। আপনাকে সে নাকি ভালোবাসে। তাই আমাকে অবহেলা করে, কষ্ট দেয়। আমি আর নিতে পারছি না আপু।”
” ও আচ্ছা। আপনি মেঘালয়ের বউ! ঘরে বউ রেখে আবার আমাকে বিরক্ত করে। তাও মুখ ফুটে বললো না যে,সে বিয়ে করেছে। বলি আপনি থাকতে আপনার স্বামী কেন পরকিয়া করে? আপনি তাকে সামলাতে পারেন না? আর আমাকে বলছেন আমি আপনার স্বামীর পিছু ছেড়ে দিবো! কি ভেবেছেন আমাকে? আমি কেন তার পিছু নিতে যাবো? আজ কতটা দিন ধরে সে আমাকে বিরক্ত করে! জানো? আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছি পরের বার আমাকে বিরক্ত করলে তার নামে মামলা করবো।”
” না আপু এমনটা করবেন না প্লিজ। আপনি তাকে বুঝিয়ে বলুন।”
” সে বুঝার লোক নয়। আচ্ছা তোমার শ্বশুর কেমন আছে?”
জান্নাত ভাবলো এত কিছু থাকতে শ্বশুরের কথা কেন বললো?
” জ্বী ভালো আছেন আপু। আপনি কেন মেঘালয়কে ডিভোর্স দিলেন?”
” এই প্রশ্নটা আমাকে করবে না। আমি শুনে খুশি হলাম যে,আপনার শ্বশুর ভালো। দোয়া করি সুখে থাকুন। আমার মতো যেন আপনার জীবন নষ্ট না হয়। আর হ্যাঁ আমার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। আপনার স্বামী নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। তার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই।”
বলে ব্লক করে দিলো জান্নাতকে।
জান্নাত বিব্রত হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
—
রাবেয়ার অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাথায় সবসময় প্রচন্ড ব্যাথা থাকে। শরীরেও অসহ্য যন্ত্রণা। তার সাথে নাক মুখ দিয়ে র ক্ত পড়া তো আছেই। এই অবস্থা দেখে জান্নাত সহ্য করতে পারলো না। বাবার সাথে কথা বলে এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। র ক্ত পরীক্ষার কথা বললেন। র ক্ত পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, রাবেয়ার ডেঙ্গু হয়েছে। এ কথা শুনে জান্নাতের মন খারাপ হয়ে গেলো। ডাক্তার কিছু ঔষধ পত্র লিখে দিলেন। আর বললে, রাবেয়া যেন বেশি বেশি বিশ্রাম নেন। এবং তরল খাবার বেশি করে খান। ডাক্তারের কথামতো সবকিছু চলছিলো। এর মধ্যে একদিন জান্নাতের বাবা বললেন,” জান্নাত আর কতদিন থাকবি? তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যদি রাগ করে!”
” ওসব নিয়ে চিন্তা করো না বাবা। আমি আর যাবো না।”
” সেকি! যাবি না মানে?”
” চিন্তা করো না। আমি এখান থেকে চলে যাবো তবুও আর ঐ বাড়িতে উঠবো না।”
” কি আবোলতাবোল বকছিস! আমার মানসম্মান কি নষ্ট করে দিবি?”
” তোমার মেয়ের সুখের চাইতে মান সম্মানটাই কি তোমার কাছে অনেক বড় বাবা?”
জমির মিয়া কিছু না বলে গম্ভীর হয়ে চলে গেলেন।
জান্নাত এক শুকনো নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো,” আজ এতটা দিন ধরে বাপের বাড়িতে এসেছি। কই একবারও তো তারা আমার খোঁজ করেনি!” পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,…….
চলবে……