মেঘফুল পর্ব-৯

0
3662

#মেঘফুল_৯
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
____________________________________

মেঘালয় এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,” সমস্যা কি তোমার? এই সকাল বেলা কানের কাছে এসে এত কান্নাকাটি কিসের?”

জান্নাত কান্নাভেজা চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,” অনেক সুখ দিয়েছেন তো। তাই অতি সুখে কান্না করছি!”

একে তো মেঘালয়ের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে জান্নাত। দ্বিতীয় তো বাঁকা কথা বলা। তাই দেখে মেঘালয় রাগে কটমট করে বললো,” চুপ! সমস্যা কি বলবে না আবার আমার কাছে এসে ন্যাকা কান্না করো। এক লাথি দিয়ে রুমের বাইরে ফেলে আসবো। অসভ্য!”

জান্নাতও রাগান্বিত হয়ে বললো,” ফেলে দিন না। আপনারা পশুর থেকে কম কিসে? মানুষকে মানুষ মনে করেন না। যা ইচ্ছা তাই করেন!”

মেঘালয়ের মেজাজ বিগড়ে গেলো। ও বিছানা থেকে উঠে ক্ষিপ্ত বাঘের ন্যায় জান্নাতের গালে সজোড়ে একটা চড় মারলো। বিছানায় চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”মুখে মুখে তর্ক করা আমি একদমই পছন্দ করি না।বেশি আদর দিয়ে ফেলেছি তাই বোধহয় লাই পেয়েছো?”

” ছাড়ুন আমাকে…বলার মধ্যেই তার ওষ্ঠদ্বয় চেপে দন্ত দিয়ে ঠোঁট কেটে দিলো মেঘালয়। জান্নাত অসহ্য যন্ত্রনায় কেঁদে ফেললো। চোখ দিয়ে অজস্র জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। মেঘালয়কে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় সে চেষ্টা ব্যার্থ করে দিলো। তার চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করিয়ে বললো,” আর কখনো আমার কথার উপর কথা বললে,আমার সাথে তর্ক করলে, মেরে একদম ভর্তা বানিয়ে দিবো!” বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো।

জান্নাত কি করবে? কি বলবে? কান্নাকাটি ছাড়া তার কিছু করার নাই। সে সর্বশক্তি দিয়ে তার ললাটে আঘাত করে বললো,” কেমন কপাল নিয়ে আসলাম আমি? একটু সুখের আশা করতে না করতেই, তার বদলে আমার উপর ঝড় বয়ে গেলো। ওরা কি আধো মানুষ নাকি পশু!”
কাঁপা কাঁপা হাতে ঠোঁট থেকে রক্ত মুছে চোখের সামনে আনতেই সে মাথা ঘুরিয়ে ফ্লোরে ধপাস করে পরে গেলো।
মেঘালয় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জান্নাতকে অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার কাছে এসে কয়েকটা ডাক দিলো। কিন্তু জান্নাতের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সেন্টার টেবিলে রাখা বোতলটা আনলো। বোতলের মুখা খুলে তার মুখে পানির ঝাঁপটা দিলো। একবারে জান্নাতের জ্ঞান ফিরলো না। দ্বিতীয়বার পানির ঝাঁপটা দিতেই তার জ্ঞান ফিরলো। মেঘালয়কে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ঠোঁট ভেঙে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললো। পাছে মেঘালয় তার প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হবে। কিন্তু তার বদলে মেঘালয় গম্ভীর হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। দরজার কাছে গিয়ে কি মনে করে থেমে গেলো। পিছন ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বললো,” সরি!” বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে চলে গেলো।

তার সরি বলা শুনে,রাগে জান্নাতের শরীর জ্বলে উঠলো। ইচ্ছা করছে সে নিজেই নিজের মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে। দেয়ালে কপাল ফাটাতে। পরক্ষণেই মনে পরলো কিছু কথা। যা মনে পরতেই সে নীরব হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিলো। সে একটা বইয়ে পড়েছিলো,” নিজের শরীরে আঘাত করা,দুঃখ-কষ্ট পেলে নিজের বুকে-মুখে আঘাত করা,এটা সম্পূর্ণ হারাম। অন্যকে আঘাত করার ব্যাপারেও একই কথা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বলেন,” হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু।[১]

সে মেঘালয় আর তার মায়ের আচরণে অনেক কষ্ট পেলো। উপরোক্ত কথাগুলো মনে করে তাদের ক্ষমা করে দিলো। তাদের জন্য এবং নিজের জন্য হেদায়েতের দোয়া করলো। কান্না করায় তার চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। সে বেসিংয়ে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো।

ইদানীং মেঘালয়কে খুব ব্যাস্ত দেখা যায়। লুকিয়ে লুকিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে। জান্নাতের চোখে পরতেই তার মনে কৌতূহল জাগলো। সেই কৌতূহল একদিন উদঘাটন হলো। মেঘালয় ফোন রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। তার ফোনে প্রভা চৌধুরী নামক একটা আইডি থেকে অসংখ্য এসএমএস আসছে। ফোন লক থাকায় জান্নাত এসএমএস গুলো দেখতে পেলো না। তবে মেঘালয় বেরিয়ে যাওয়ার পর জান্নাত মেঘালয়ের ডায়েরিটা খুঁজতে লাগলো। অবশেষে ডায়েরিটা খুঁজে পেলো। সে তড়িঘড়ি করে ডায়েরি খুলে দেখলো,মেঘালয় নতুন একটা পাতায় প্রভার ফেসবুক আইডির নাম ও নাম্বার লিখে রেখেছে। জান্নাত তার ফোনে প্রভার নাম্বার সেইভ করে রাখলো। ফেইসবুকে সে একটা আইডি খুললো। সময় পেলে সে একদিন প্রভার সাথে কথা বলবে।

যত দিন যাচ্ছে জান্নাতের প্রতি মেঘালয় আর তার পরিবারের অত্যাচার বেড়েই চলেছে। মেঘালয় নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য জান্নাতকে ইচ্ছেমতো ব্যাবহার করে। কখনো ভালো আচরণ করে,আবার কখনো খারাপ আচরণ করে। তবে খারাপ আচরণের মাত্রাটাই বেশি। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় জান্নাতকে সে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়। এ কয়দিনে জান্নাতের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। শরীরে যেন রোগা ভাব চলে এসেছে। সে মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছে। তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারউপর মেঘালয় তাকে অবহেলাও করছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে একটা নর্দমার কীট! মেঘালয়ের স্ত্রী নয়,যেন রক্ষিতা!

সে ঠিক করলো তার বাবার বাড়িতে যাবে। তার আগে তার মনে হলো তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর সাথে একবার যোগাযোগ করা দরকার। তার বান্ধবীর নাম স্নেহা। সে ঢাকায় থাকে। জান্নাত তাকে কল দিলে ওপাশে_

” আসসালামু আলাইকুম জান্নাত?”

” ওয়া আলাইকুমুসসালাম। হু,কেমন আছিস? ”

” আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোর খবর কি?”

” আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি অনেক টানাপোড়নের মধ্যে আছি রে। মনে হচ্ছে আমি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছি। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ছি আমি!”

স্নেহা বান্ধবীর এমন কথা শুনে সে প্রচন্ড মর্মাহত হলো। সে জিজ্ঞেস করলো,” আল্লাহর উপর ভরসা কর। মূল কারণটা কি জানতে পারি?”

” আমার হবিকে নিয়ে। সে আমাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে কষ্ট দেয়। আমাকে অবহেলা করে। লুকিয়ে লুকিয়ে তার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে পরকীয়া করে!”
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো।

স্নেহা অবাক কন্ঠে বললো,” কীহ! তোর হবির আগে স্ত্রী ছিলো?”

” হ্যাঁ। আমি বিয়ের দিন রাতে এটা জানতে পারি।”

” আল্লাহ! এখন কি করবি বল?”

” আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারছি না। আমাকে একটা পরামর্শ দে প্লিজ!”

” শোন,তুই বেবি নেওয়ার চেষ্টা কর। আর ধৈর্য ধর একটু। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”

” সে না চাইলে আমি কি করে পারবো! ধৈর্য ধরেছি বলেই তো আমি এ পর্যন্ত টিকে আছি। না হলে সেই কবেই তাকে ছেড়ে দিতাম। এত কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না।”

” তাহলে তাকে ছেড়ে দে?”

” অসম্ভব! সে খারাপ হলেও আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে ছেড়ে যাওয়ার কল্পনাও আমার মাথায় আসে না। আর ত্বলাক দিলে,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে, আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। আমি শুধু একটু শান্তি চাই। ”

” বাহ! তাহলে আপাতত তোদের বাড়ি গিয়ে কয়দিন থাক। ”

” আমিও সেটাই ভাবছি। আচ্ছা এখন রাখছি পরে কথা বলবো।”

” আচ্ছা। আসসালামু আলাইকুম।”

” ওয়া আলাইকুমুসসালাম, ফি-আমানিল্লাহ।”

জান্নাত কল কেটে দিলো। শশব্যস্ত হয়ে উঠলো ঘরের কাজ করার জন্য। মেয়েরা স্বামীর ভালোবাসার কাঙাল। তাদের একটু কেয়ার,ভালোবাসা দিলেই তারা খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। জান্নাত বুঝতে পারে না তার স্বামী কেমন? তার মধ্যে কি বিধাতা একটুও ভালোবাসা নামক মান যন্ত্রণাটি দেন নাই? মনে হয় বিধাতা দেন নি। কিন্তু মেঘালয় সেটা কুড়িয়ে নিয়েছে। তার সমস্ত ভালোবাসা প্রভার জন্য। জান্নাতের জন্য একটুও না। জান্নাত তার সব অভিমান হৃদয়ের গহিন বনে লুকিয়ে,জমিয়ে রাখলো। একদিন সে মেঘালয়কে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিবে,অবহেলা জিনিসটা কতখানি যন্ত্রণার!

আজ বিকেলে জান্নাতের ফোনে একটা কল এলো। কথা বলার পর জান্নাতের মনটা খচখচ করে উঠলো। সে এরকম দুঃসংবাদ দ্বিতীয়বার শুনতে চায় না। আষাঢ়ে বৃষ্টির ন্যায় সে কাঁদলো। কান্নারা তার মনে বিরহের ঢেউ তুললো। এত কষ্ট কেন তার অনুভূত হচ্ছে?

রেফারেন্সঃ-
[১] সূরা নিসা,আয়াত:২৯

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here