“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১৪.
শহরের নির্লিপ্ততা ভীষণ ভাবে অবাক করে তুললো রোদসীকে। সাধারণ দিনের তুলনায় সিমসাম গোছানো পরিপাটি করা। অন্য দিনের তুলনায় মুখটা ভদ্রতায় ঘেরা। দৃষ্টি আগাগোড়া নির্মল শান্ত। রোদসীর পাশেই গা লাগিয়ে বসে আছেন দিলারা। কিন্তু মোটেও মুখ মন্দ করে যাচাই বাছাই করছেন না। হাসিমুখে কথা বলছেন। সহজ সরল মানুষ কিনা ওইরকমই।
রোদসী প্রথম দফায় ঝটকা খেয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। হতভম্বতা কাটিয়ে রাগী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে যেতে নিলেই কেয়া চোখ গরম করে তাকালেন। ওই দৃষ্টির ভাষা বুঝলো রোদসী, ‘চুপ করে বসে থাকে, নাহলে তোর খবর আছে।’ বাধ্য হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় অবশিষ্ট রইলো না।
শহরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বারংবার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু শহর ভুলে তাকাচ্ছে না। যেনো রোদসীকে একবার দৃষ্টিতে আবদ্ধ করাও মহাপাপ বলে আখ্যায়িত হবে।
রোদসী বুঝতে পারলো না, শহর কীভাবে রাজি হলো বিয়ের প্রায় নিয়ে বাসায় আসতে। এতোটুকু অন্তত রোদসী জানে, দিলারার কথাতেই হয়তো শহর বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। কিন্তু যে কিনা রোদসীকে কথায় কথায় কটাখ্য করে সে মানুষ কী করে এতোটা ভদ্রলোকের ব্যবহার করতে পারে! এহেন চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে রোদসীর। এ-ও ভাবছিলো রোদসী, যে তাঁর মা কী করে শহরের সঙ্গে বিয়ে দিতে হ্যা বললো। যেখানে মায়ের মুখে ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছে, ছেলের যদি উপার্জনের কোনো চেষ্টা না থাকে তবে তেমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। মোট কথা কর্মঠ হতে হবে। তবে দিলারা যখন বললেন, শহর পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংএর কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। কিন্তু বিস্মিত হলো, এই ভেবে যে শহর কোন সময় কাজ করে! কারণ দুটো মাসে আজ অব্দি শহরকে ভবঘুরে উড়ে বেড়ানো ছাড়া কিছু করতে দেখেনি। হয় তাঁকে চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখেছে আর দ্বিতীয়ত মাঠেঘাটে কড়া রোদে ক্রিকেট খেলতেই চোখে পড়েছে। সে যাকগে, রোদসীর ওসবে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মোটকথা সে ভাবতে চায়না। এখন তাঁর মাথায় চলছে,কীভাবে ওই বাঁদর ছেলেটা হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। আর ইচ্ছেমতো টাইট দিতে পারবে। সুযোগও হলো। দিলারা বললেন, দু’জনকে একান্তে কথা বলে নিতে।
রোদসী শহরকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলো মায়ের বলায়। নিজের ঘরে ঢুকেই রোদসী ক্ষিপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করলো। শহর তেমন একটা গুরুত্ব দিলোনা৷ সে চুপচাপ কাউচে বসে পা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। রোদসী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি সিরিয়াস? ‘
শহর চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
‘কোন বিষয়ে? ‘
‘বুঝতে পারছেন না? বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার মানে কী? ‘
‘বিয়ের প্রস্তাব কেনো আনে মানুষ? ‘
‘বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আপনার সঙ্গে কী কখনো আমার এমন কথা হয়েছে, যেখানে আমি ইঙ্গিত দিয়েছি আপনাকে পছন্দ করি? এক্ষুনি না বলবেন সবাইকে। ‘
‘এহ! তুমি এমন একটা ভাব নিচ্ছো। যেনো তোমাকে বিয়ে করতে মরেই যাচ্ছি আমি। নেহাৎ মায়ের দিব্বি খেয়ে বাধ্য হলাম। ‘
‘দেখুন, রাগ উঠাবেন না আমার। চুপচাপ আন্টিকে বলবেন, আপনি রাজি না। ‘
‘কেনো কেনো? আমি কেনো ফাঁসবো মায়ের কাছে বলে! তোমার এতো সমস্যা হলে তুমি আন্টিকে বলো।’
রোদসী চেচিয়ে বলল,
‘বিয়ে কী শুধু আমার একার? ‘
‘না, আমারও। কিন্তু আমি মায়ের সামনে না বলতে পারবো না। আমার মায়ের কসম খেয়েছি আমি। ‘
রোদসী নিরাশ হয়ে সোফায় মাথা চেপে বসে পড়লো।
নরম হয়ে বলল,
‘আপনি না খুব ভালো! প্লিজ,আমার দ্বারা বিয়ে সম্ভব না। বোঝার চেষ্টা করুন। মা অসুস্থ না হলে আমি জোর গলায় না করে দিতাম। ‘
শহর ভ্রু কুচকে বলল,
‘বাহ! বারো মাস আমি বেয়াড়া ছেলে, বাদর, অসভ্য। আর এখন ভালো হয়ে গেলাম?’
‘হ্যা, হয়ে গেলেন। প্লিজ! ‘
‘আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা? নাকি তুমি সারাজীবনই কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছো? ‘
‘সেটা আপনার জানতে হবেনা। ‘
‘তাহলে আমারও কোনো ঠ্যাকা পড়েনি। নিজের খেয়ে অন্যের জন্য কাজ করবো। তোমার ঝামেলা তুমি বোঝো। আমি গেলাম। মায়ের মুখের উপর কথা বলিনা আমি, জানোই তো আমি খুব ভালো ছেলে। ‘
শেষের কথাটা বলে ঠিক আগের মতো গা জ্বালিয়ে দেয়ার মতো দাঁত কেলিয়ে হেঁসে ঘর থেকে চলে গেলো। শুধু যাওয়া সময় হাত নাড়িয়ে বলল,
‘টাটা, ডিয়ার হবু বউ। তেজপাতা জীবনে আগমনের প্রস্তুতি নাও। ‘
ফুঁসতে ফুঁসতে সোফার কুশনটা ছুড়ে দিলো রোদসী। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটা শহরের গায়ে লাগলো না। রোদসী ঠিক ঠিক বুঝেছে, শহর আগে বিয়েতে অমত রাখলেও এখন রাজি হয়ে যাবে। কারণ রোদসীকে পার্মানেন্ট জ্বালানোর সার্টিফিকেটটা হাতছাড়া করতে চাইবে না কোনোমতেই। রোদসী বিরবির করে বলল,
‘আপনি মায়ের কত বাধ্য ছেলে, তা ভালোই জানা আছে আমার। যতসব আমাকে জ্বালানোর ধান্দা। কয়েক দিন আগে ইগনোর করার জন্য প্রতিশোধ নিতে চাইছেন তো! আমিও দেখে নিবো আপনাকে। আপনার লাইফটা ত্যানাত্যানা না করেছি, আমার নামও রোদসী না! ‘
সময়টা যেনো দৌড়ে পালাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ের ডেট ফিক্স হয়ে গেলো। রোদসী বাবা মায়ের কাছে হাজারও তালবাহানা দিয়েও পাড় পেলো না। অতঃপর বুঝে গেলো, বিয়েটা কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব না। তখন রাগে খিটমিট করতে করতে সম্মতি দিয়ে গেলো। তারমধ্যে শহরের রোজকার কল তাঁকে আরও অতিষ্ট করে তুললো।
না না, সে মোটেও আট দশটা ছেলের মতো হবু বউয়ের সঙ্গে রোম্যান্টিক কথাবার্তা বলেনা। বরং রোদসীকে এটা ওটা বলে পৈঁচাশিক আনন্দ নেয়। যেমন, রোদসী যখন ভোরের দিকে শান্তি মতো একটু ঘুমায় সেই শান্তি হারাম করতেই শহর কল দিয়ে বকবক করে। যেহেতু রোদসী কম কথা বলে এবং বাঁচাল মানুষ পছন্দ করে না। তাই অতিরিক্ত কথাই বিষের মতো ঠেকে রোদসীর কাছে। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচালেই শহর কেয়ার কাছে বিচার দেয়ার হুমকি দেয়। অতএব এই অত্যাচারে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই রোদসীর। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আগামী কাল বিয়ে। দুই পক্ষের পরিবারের মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত। রোদসী মলিন মুখ করে শুয়ে আছে। রাত বাজে এগারোটা।
ঘুম আসছেনা। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো শহরের কল। মুখ ভেঙচিয়ে রিসিভ করে কানে দিলো। রোদসীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একাই নিজের মতো কথা বলতে থাকলো। রোদসী ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে চোখ বুজে নিলো। অর্ধঘুম অর্ধজাগ্রত অবস্থায় আছে। শহরের সব কথা বুঝতে না পারলেও একটা কথা শুনে ঘুমের মধ্যেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। শহর তখনও ডেকে ডেকে বলছে,
‘এই শুনছো, বিয়ের পর কিন্তু আমার মোজা জোড়া ধোঁয়ার দায়িত্ব তোমার। এই শুনছো? ‘
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(বিয়েতে আমন্ত্রণ রইলো সবাইকে। উপহার নিয়ে না আসলে ঢুকতে দিবো না।)