“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১৮.
পরদিন ঘুম ভেঙে রোদসী দেখলো, একা বিছানায় শুয়ে আছে। এপাশ ওপাশ ফিরে শহরকে না দেখতে পেয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। সর্বনাশ! দশটা বারো বাজে। দ্রুত গায়ের কাঁথা ফেলে বিছানা থেকে নামলো। ভাগ্যিশ, এটা নিজের মায়ের বাসা। নাহলে, শ্বশুর বাড়িতে সবাই কী মনে করতো! নিজেকে আর নিজের কুম্ভকর্ণ ঘুমকে বকতে বকতে হাত মুখ ধুয়ে আসলো। বিছানা গুছিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিয়ে বের হলো। কেয়া বোধ হয় ওর আসার অপেক্ষাই করছিলেন। শহর পাশে সোফায় বসে আরুর সঙ্গে ভিডিও গেম খেলছিলো। রোদসী বের হওয়া মাত্রই কেয়া বললেন,
‘রাজকন্যার ঘুম ভেঙেছে, এই কে কোথায় আছো! ঢাক ঢোল বাজিয়ে স্বাগতম জানাও। ‘
রোদসী খিটমিট করে উঠলো। শহর আর আর্শ ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। শহর তো পারছেনা লুটোপুটি খেয়ে হাসতে। রোদসী ফস করে বলল,
‘কী আর এমন ঘুমিয়েছি, যে তুমি এমন বললে মা! ‘
কেয়া শহরের জন্য ফল কাটছিলেন৷ রোদসীর দিকে তাকিয়ে নাস্তার প্লেটটা এগিয়ে দিলেন। বিরবির করতে করতে রান্না ঘরে গেলেন। রোদসী হনহন পায়ে এসে দাঁড়ালো শহরের সামনে, হাতে থেকে খপ করে গেমের রিমোটটা টেনে নিলো। শহর হা করে তাকিয়ে আছে। রিমোটের দিকে একপলক দেখে বলল,
‘কী হলো! রিমোটটা দাও। ‘
রোদসী কোমরে হাত রেখে বলল,
‘আমাকে ডাকেননি কেনো আপনি?’
শহর মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘যাহ বাবা! রাত করে ঘুমিয়েছো, ভাবলাম থাক আরেকটু ঘুমাও। যার জন্য চুরি করি, সেই বলে চোর। ভালাই কা তো জামানা হি নেহি রাহা! ‘
‘চুপ করুন, ইচ্ছে করে বকা খাওয়ানোর জন্য এমন করলেন আপনি। ‘
শহর মুখ ভেঙচিয়ে দিলো। মেয়েদের সঙ্গে কথায় পারা যায় না। একবার ভাবলো, বাহিরে গিয়ে ঘুরে আসবে। কিন্তু, শ্বশুর বাড়িতে থেকে এমন আচরণ করা ঠিক হবেনা। মোবাইল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ খবর নিলো। রোদসী শহরের হাত টেনে চিপায় বসিয়ে হাত পা মেলে বসলো। শহর একবার চোখ মুখ কুঁচকে উঠে রুমে চলে গেলো। ঘন্টা খানেক বাদে দুপুরের খাবার সময় হলো। শহর ডাইনিং টেবিলে বসলো৷ রোদসী পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য স্বেচ্ছায় নয়। কেয়া চোখ গরম করে ইশারা দেয়ায়। এ-ও বলেছে, স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে যেনো খাবার বেড়ে দেয়। রোদসী চুপটি করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শহর পৈশাচিক হাসি দিয়ে তাকালো। গা পিত্তি শুদ্ধ জ্বলে উঠলো রোদসীর। শহরের মুখভঙ্গি দেখেই বুঝেছে,
শহর ওকে তাচ্ছিল্য করে বলেছে,
‘এতো ঠ্যাট দেখিয়ে লাভ কী! পতিসেবাই তো করতে হলো! ‘
রোদসী মনে মনে কিছু একটা ভেবে হাসলো। তারপর পাশের ঝাল ঝাল মাংসের ঝোল নিয়ে শহরের প্লেটে দিলো। যেহেতু শহর ঝাল তেমন একটা খায় না। তাই স্বাভাবিকভাবেই ডিমের কোর্মা আর রোস্ট দিয়ে খাচ্ছিলো। রোদসী এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে বলল,
‘ঝাল কম হয়েছে না? ‘
শহর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। রোদসীর কাজের অর্থ বুঝতে পারলো না। শহর বলল,
‘না, ঠিক আছে।
কিন্তু ওকে আরও চমকে দিয়ে রোদসী মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মা, ইনি অনেক লাজুক তাই বলতে পারছে না। ঝাল কম হওয়াতে সে মাংস ছুঁয়েই দেখছেনা। ‘
কেয়া বেশ দুঃখী চেহারায় তাকালেন। তিনি সব খাবারেই বেশি ঝাল দেননি। ভেবেছিলেন শহর ঝাল অতোটা খায় না। কিন্তু এখন উল্টো হওয়ায় তার খারাপ লাগলো। ছেলেটাকে তৃপ্তি করে খাওয়াতে পারলেন না তিনি, আহারে! আহারে!
তিনি দুশ্চিন্তা নিয়ে বললেন,
‘রোদিরে! আমি তো খুব বেশি ঝাল দিয়ে কিছুই রান্না করিনি। শুধু গরুর মাংসেই মোটামুটি ঝাল। এখন যে ছেলেটাকে পেট ভরিয়ে খাওয়াতে পারলাম না। আগে কেনো বললি না তুই? ‘
রোদসী একটু ভাবুক গলায় বলল,
‘ওহহ মা,এতো চিন্তা করছো কেনো! আমি আছি না!
আমি যে তোমাকে মরিচ ভর্তা বানাতে বলেছিলাম, বানিয়েছো? ‘
‘হ্যা, কালকে রাতে হুট করে বললি বউয়া ভাতের সঙ্গে ভর্তা দিয়ে খাবি নাকি। তাই সকালে করেছি তোর জন্য। কিন্তু এখন জিজ্ঞেস করছিস কেনো? ‘
‘ব্যাস হয়ে গেলো। তুমি মরিচ ভর্তাটা আনো। ‘
‘মানে? ‘
‘আরে, উনি মরিচ ভর্তা অনেক পছন্দ করেন৷ খেতে সুবিধা হবে। ‘
‘কিন্তু, পোলাও দিয়ে.. ‘
‘আহা! এতো কথা না বলে আনো তো। ‘
কেয়া হন্তদন্ত হয়ে ভর্তা নিয়ে আসলেন। রোদসী ভীষণ সুন্দর করে হাসলো। বিজয়ীর হাসি। শহর হাবার মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে। আজ তাঁর সঙ্গে কী হতে চলেছে, তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তাঁকে। হাত দিয়ে মানা করার আগেই রোদসী এক খাবলা মরিচ ভর্তা প্লেটে দিয়ে চমৎকার ভাবে বলল,
‘নিন, খেয়ে দেখুন। এবারও না খেতে পারলে বুঝবো, আমার মায়ের হাতের রান্না একটুও ভালো না। ‘
শহর একবার প্লেটের দিকে তাকালো তো আরেক বার রোদসী আর ওর মায়ের দিকে। কেয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেনো, শহর যদি এখন তার রান্নাকে ভালো বলে তাহলে উনি বিশ্বসেরা রাধুনি বলে পরিচিত হবেন। আর খারাপ বললে জঘন্য রান্না করেন বলে জানবেন । শহরের ইচ্ছে করলো কেঁদে চিৎকার করে বলতে, ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। ‘
কিন্তু পরিবর্তে কেউ এলো না তাঁকে বাঁচাতে। নিষ্ঠুর এই চক্রান্তে বাধ্য হয়ে মরিচ দিয়ে পোলাও মেখেই লোকমা মুখে দিলো। জিহবায় তখনও অতোটা স্বাদ লাগেনি বিধায় অনায়াসেই হেঁসে বলল,
‘বাহ! আন্টির হাতের রান্না দেখছি ঝাক্কাস! ‘
কেয়া খুশিতে গদগদ হয়ে তাকালেন। আরেকটু ভর্তা দিলেন। রাগে দুঃখে শহরের চোখ লাল হয়ে গেলো।
বেচারা না পারলো উঠতে আর না পারলো মানা করতে। অতএব, মুখে হাসি ঝুলিয়ে মেখে খেয়ে নিলো। যেনো অমৃত খাচ্ছে। রোদসী প্রথমে একটু অবাক হলেও বুঝতে পারলো শহরের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কেয়া মনের সুখে অন্য কথা বলেছিলেন।
রোদসী বুঝলো, কাজটা একটু বেশি হয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো শহর হয়তো সহ্য করতে না পেরে উঠে যাবে। রোদসী প্রস্তুত ছিলো, শহর তাঁর কাছে অনুনয় করে বলবে, প্লিজ আমি আর খাবো না সরি। কিন্তু নাহ! এমন কিছুই হলো না। রোদসী ভয় পেয়ে গেলো। এখন যদি শহর কিছু না বলে তাহলে এর ভয়ঙ্কর পরিণাম তাঁকেই ভোগ করতে হবে। শহরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মুখ খিঁচে আছে। ঠোঁট লাল হয়ে তিরতির করে কাঁপছে। ঝালে চোখ থেকে পানি পরতে শুরু হয়েছে। রোদসী শেষমেষ তাড়াতাড়ি বলল,
‘আর খেতে হবে না থাক, আপনি উঠুন৷ ‘
শহর ওকে আঁটকে বলল,
‘না ঠিক আছে, আমি খাচ্ছি। ‘
রোদসী শুকনো ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। শহর খাওয়া শেষ হলে উঠে হাত ধুয়ে রুমে চলে গেলো। রোদসী মনে মনে সাহস জুগিয়ে হাতে দুটো মিষ্টি নিয়ে বাটিতে করে ঘরে আসলো। শহরকে দেখলো মাথায় হাত চেপে নিচু করে বসে আছে। রোদসী ঘরের দরজা লাগিয়ে ভয়ে ভয়ে সামনে এসে বলল,
‘নিন, মিষ্টি খেলে ঝাল কমবে। ‘
শহর কিছু বললো না। রোদসী কাঁধে হাত রাখতেই শহর ছিটকে দাঁড়িয়ে গেলো। চিৎকার করে বলল,
‘ঝাল, ঝাল, ঝাল। ‘
রোদসী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। শহরের মুখে টুপ করে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলো। শহর একাই পরের মিষ্টিটা মুখে নিলো। বেচারা, হাঁপাচ্ছে ঝালে। একটু ঝাল কমতেই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রোদসীর হাত দুটো চেপে ধরলো। পিছাতে পিছাতে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। শহর গমগমে মুখে বলল,
‘আমাকে এভাবে ভোগানোর ফল বুঝবে এবার রোদচশমা। ‘
চলবে –