“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১৯.
রসগোল্লার মতো চোখ করে শহরকে দেখতে লাগলো রোদসী,কী বলবে বুঝতে পারছেনা ৷ শহর আরেকটু কাছে এসে যেতেই রোদসী চিৎকার দিয়ে বলল,
‘সরি সরি সরি। আ.আর করবো না কখনো এমন৷ এবারের মতো মাফ করে দেন৷ ‘
শহর গাল বাঁকা করে হাসছে ৷ রোদসী চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। শ্বাসও আঁটকে রেখেছে বোধ হয়। শহর ইচ্ছে করে আরেকটু ভয় দেখিয়ে রোদসীর গালে হাত স্লাইড করে বলল,
‘আমার তো মনে হয় না, তুমি আর করবেনা। এখন ছাড়া পেতে বলছো। পরে আবার পল্টি মারবে। ‘
‘না না, সত্যি বলছি। ‘
‘সত্যি তো? ‘
‘এ..একদম সত্যি। এবার ছাড়ুন আমাকে। ‘
শহর ছেড়ে দিতেই রোদসী একপ্রকার পালিয়ে চলে গেলো। শহর হো হো করে হাসলো। আজকে অনেক দিন পর মেয়েটাকে জব্দ করতে পারলো। আনন্দ নিয়ে সিটি বাজাতে বাজাতে রেডি হয়ে নিলো। তারপর শহর বাহির হতেই রোদসী ভয়ে ভয়ে ঘরে আসলো। মনে মনে ইচ্ছে মতো গালমন্দ করলো, কী হতচ্ছাড়ারে বাবা! কোন কুক্ষণে এর সাথে লাগতে গিয়েছিলাম আল্লাহ জানে। বিরবির করতে করতে নিজেও তৈরি হলো। কষ্ট লাগছে, এখনই এই ঘরটা ছেড়ে আবারও চলে যেতে হবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে দরজা আঁটকে চলে গেলো। কিংবা জীবনের অন্ধকার একটা প্রহরকে তালাবদ্ধ করে দিলো। কিন্তু সবকিছু কী আর মুছে যায়?
_
নিজের বাসা থেকে আসার পর মনটা ভার ভার হয়ে আছে রোদসীর। গুমোট একটা ভাব জেঁকে বসেছে। শহর বাহিরে আছে। রোদসী একবার বারান্দায় গিয়ে বসলো। এই বারান্দাটা যদিও একই সমান৷ তবুও রোদসীর বারান্দার মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। কোনো টবও নেই ফুলফলের। শুধু তিতুসের খাঁচাটা আছে। এখানে আসার সময় নিয়ে এসেছে সে। রোদসী ওটার সঙ্গেই বসে বসে কথা বলতে লাগলো। মন লাগছে না। তাই উঠে রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো।
ঘন্টা খানেক বাদে শহর বাহির থেকে ফিরতেই দিলারা এসে বলল,
‘শোন, ওর মনটা বোধ হয় ভালো নেইরে। কোথাও থেকে একটু ঘুরিয়ে আন যা। ‘
‘কার মন ভালো নেই? ‘
‘আরে রোদসীর! ‘
শহর ভ্রু কুচকে বলল,
‘ওমা! ওর আবার কী হবে? ‘
‘আমি জানি না। আসার আগেই থেকে চুপচাপ অনেক। আমার সাথে কিছুক্ষণ এটা ওটা বলে ঘরে চলে গেছে। ওকে নিয়ে কোথাও যা। ‘
‘আচ্ছা দেখছি দাঁড়াও। ‘
শহর চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকলো। রোদসীকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বিছানার কাছে এসে বলল,
‘কী হয়েছে তোমার ? ‘
রোদসী জেগে ছিলো। বিরস মুখে ফিরে তাকালো। শহর ভাবগতি বুঝতে পারলো না। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার। একবার মন চাইলো মেয়েটার হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু আরেক মন বলল,যদি বিরক্ত হয়? বাড়িয়ে দেয়া হাতটা গুটিয়ে নিলো সে। রোদসীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘রেডি হয়ে নাও ৷ ‘
রোদসী শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ দুটো ছোট ছোট করে কৌতুহল নিয়ে বলল,
‘কেনো? ‘
শহর উঠে যেতে যেতে বলল,
‘বাহিরে যাবে তোমাকে নিয়ে। ‘
‘কোথায়? ‘
‘বাজারের হাঁটে। তোমাকে নিয়ে বেঁচে দিয়ে আসবো। ‘
হেঁসে চলে গেলো শহর। মন খারাপের মাঝে মনে হলো এক বিন্দু ভালোলাগা ছুঁয়ে দিয়ে গেলো রোদসীকে। মনে মনে হেঁসে ফেললো রোদসীও। ছেলেটা যত যাই হোক, মন ভালো করতে জানে ভীষণ!
_
হালকা সেজেগুজে বের হলো রোদসী। শহর বাহিরে বসে ফোন টিপছিলো। রোদসীকে বের হতে দেখে বাহিরের দিকে যেতে লাগলো। কিছুটা আশাহত হলো রোদসী। রাগ হলো খুব ৷ এটা কেমন ছেলে? এতো সুন্দর করে সেজেগুজে বের হলো একটা মেয়ে আর তাও নিজের বউ। ভালো করে তাকালে এমন কী হয়ে যেতো! চোখ দুটো কী নষ্ট হয়ে যাবে! নিজের ভাবনায় যদিও কিছুটা অবাক সে। তবে, রাগের সামনে অবাক ভাবটা অতোটা পাত্তা পেলোনা। শহরের পিছু পিছু বাহিরে আসলো। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে রোদসীকে বসতে বললেই রোদসী ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘গাড়ি কার? আপনার সাইকেল কোথায়?’
শহর হেঁসে ফেললো। গাড়ি থেকে মাথা বের করে বলল,
‘সাইকেল তো আমি শখের বশে চালাই। আমার রোজগারের টাকা দিয়ে কেনা তাই। কিন্তু আমি এতোটাও অধম না, যে আমার নতুন বউকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে কিপ্টুস উপাধি লাভ করবো। এখন তোমার শ্বশুরের টাকায় কেনা গাড়িতে ওঠো। কোনো একদিন নিজের স্বামীর টাকার গাড়িতে বসো। এটা আমাদের পারিবারিক গাড়ি। আমি না লাগলেও মা আর চাচীর লাগে। ‘
রোদসী আনমনে হেঁসে উঠলো। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে বিরবির করে বলল,আপনি তো এমনিতেই কিপ্টুস। যদিও কথাটা কানে এলো শহরের। তবে সে রাগলো না। হাসি ফুটিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। রোদসীর মন ভালো হয়ে গেছে এটাই বড় কথা। অনেকটা পথ গাড়ি চলার পর যখন থামলো। তখন রোদসী চমকে উঠলো। কারণ এটা চিড়িয়াখানা। এর আগে দুই বার ঘুরতে এসেছিলো। শহর নিজে বের হয়ে রোদসীর সাইডের দরজাটা খুলে দিলো। রোদসী বের হয়ে আসলো। শহর টিকিট কিনে এনে রোদসীকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এখন পরিবেশটা হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা। তাই কোনো গরমের ছাপ নেই। এসময়টা ঘুরাঘুরির জন্য পারফেক্ট। শহর যেতে যেতে হঠাৎ দুষ্টুমি করে বলল,
‘আমার হাত ধরে নাও রোদচশমা। ভীড় আছে, হারিয়ে যেতে পারো। ‘
রোদসী জানে শহর কথাটা নিতান্তই দুষ্টুমি করে বলেছে। কিন্তু ওর নিজের কী হলো কে জানে! নিজ থেকেই ডান হাতটা দিয়ে শহরের বাম হাতটা আঁকড়ে ধরলো। শহর অনেকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। তবে, রোদসী অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো তেমন কিছুই হয়নি। শহর নিজের হাতে থাকা হাতটা আরেকটু জোরালো ভাবে আঁকড়ে নিলো মৃদু হেঁসে। রোদসীও কী ভেবে একটু হাসলো। থাকুক না কিছু কথা অন্তরালে লুকিয়ে! যত্ন গুলো তো মন্দ লাগেনা। মানুষটা হোক পাগলাটে, কিছুটা অগোছালো। নিজেরই তো। সবশেষে তো বিশুদ্ধতায় পরিপূর্ণ। মনের গহীনে একটুখানি জায়গা দেয়া যায় তাঁকে? রোদসী অন্য রকম দৃষ্টিতে অপলক তাকায় শহরের দিকে। শহর চঞ্চলতা নিয়ে হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘এই রোদচশমা, এতো কী দেখো? ‘
রোদসী দৃষ্টি সরায় না। বরং ফিসফিস করে বলে,
‘আপনাকে। ‘
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।