মেঘভেলায় প্রেমচিঠি” পর্ব ২৫

0
477

”মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

২৫.

হাত দু’টোর দিকে একবার দুর্বল চোখে তাকিয়ে দেখলো রোদসী। সূর্যের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই এক অদ্ভুত রকম শক্তি অনুভব করলো রোদসী। সূর্য তাকে খাটে এনে বসিয়ে দিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিতেই রোদসী ঢকঢক করে তৃষ্ণার্থ পাখির ন্যায় তা পান করে নিলো। সূর্য গ্লাসটা রেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলো। রোদসীর নিস্তেজ হাতটা টেনে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসলো ওর। মুখ ফিরিয়ে নিলো। সূর্য হাসতে হাসতে বলল,

‘ওও মাই গড! এখনো দেখছি নাকের ডগায় রাগ নিয়ে চলো। তোমার এই স্বভাবই আমাকে টানে তোমার দিকে! ‘

রোদসীর দিকে নোংরা দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয় কথাটা বলেই। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে এগিয়ে যেতেই ক্রিং ক্রিং শব্দে মোবাইলটা বেজে ওঠে। বেজায় বিরক্ত হয় সূর্য। পকেট থেকে মোবাইল বের করে জানালার পাশে চলে যায়। নদী কল করেছে। ধ্যাৎ! এই মেয়েটা সবচেয়ে বিরক্তির কারণ। সব কাজে বাঁধা দেয়। কল রিসিভ করে দুই চারটে ঝাড়ি মেরে কল রাখে। নদী এটা ওটা জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয়না।
সূর্য মোবাইলটা রেখে খাটের কাছে আসতেই চমকে উঠলো। বিছানা খালি পড়ে আছে। সূর্য মাথায় হাত দিয়ে চেপে ধরে। মেয়েটা পালিয়ে গিয়ে যদি সবাইকে সব বলে দেয়! তাহলে তো সর্বনাশ! দ্রুত পদে বের হয়ে অন্য লোকদের খবর দেয়।

খুরিয়ে খুরিয়ে পা টেনে দৌড়াচ্ছে রোদসী। চারদিকে গভীর অন্ধকার। রাত দুইটা কিংবা তিনটা বাজে। সূর্য হয়তো এই নির্জন সময়টাকেই বেছে এসেছিলো। না খাওয়ার ফলে গায়ে শক্তি পাচ্ছেনা বেশি। তবুও দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করবে নিজের সম্মানটা বাঁচানোর। জুতাবিহীন পায়ে দুই তিনটা কাটাও লেগেছে ইতিমধ্যে। রোদসীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পেলো কয়েক জন মানুষ ওর পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। তখন সতর্ক হয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেলো। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রেখেছে যেনো কেউ ওর অস্তিত্ব না বোঝে। অল্প খানিকটা মাথা ফিরিয়ে দেখলো সূর্য সহ ওর পাঁচজন সঙ্গী এদিকে ওদিকে খোজাখুজি করছে। আত্মা ছিঁড়ে বের হওয়ার উপক্রম। এবার যদি ওকে খুঁজে পায়, তাহলে সূর্য ওকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দিবেনা। হতে পারে, দলবল নিয়ে ওর ওপর হামলে পড়তেও পারে। মুখ চেপে কাঁদতে থাকলো নিঃশব্দে। সূর্যের তীক্ষ্ম দৃষ্টি হঠাৎ সেই গাছটায় গিয়ে পড়লো৷ চিৎকার করে সেদিকে যেতেই রোদসী দৌড়াতে শুরু করলো। সবাই ওর পিছনে ধেয়ে আসছে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে ওরা। রোদসী হঠাৎ উষ্ঠা খেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়তেই রুহ কেঁপে উঠলো। মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। সূর্য সহ বাকীরা দৌড়ে এসে ওকে দেখতেই আঁতকে উঠলো। সূর্য শ্বাসের বেগ দেখে বুঝলো বেঁচে আছে এখনো। কিন্তু চারদিকে এখন আলো ফুটতে শুরু করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে বেশি কিছু করতে পারবেনা। তাই, হঠাৎই মাথায় এক বুদ্ধির আবির্ভাব হলো। রোদসীর জামার বেশির ভাগ অংশই ছিড়েখুঁড়ে দিলো। গলা, হাত, পায়ে গাঢ় আঁচড় কেটে দিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো। এবার স্বস্তি।
যে কারো দেখলেই মনে হবে, রোদসী এখন ধর্ষিতা। মাথায় এক ঢিলে দুই পাখি মারার চিন্তা ভাবনা করেই হেঁসে রোদসীর পায়ে জোড়ে লাথি মেরে প্রস্থান করতে করতে বলল,

‘এবার আমিও দেখি, তুুমি আমার কী করে না হও! ‘

সকালের দিকে জাহিদ ময়লা পরিষ্কার করার জন্য এই রাস্তাটায় মোড় এসে পড়ে রোজ। ছোটবেলা থেকেই এসব কাজ করে বড় হয়েছে। হাতে ঝাড়ু নিয়ে পরিষ্কার করা শুরু করে। গাছের আশেপাশের শুকনো পাতাগুলো সরাতেই গোলাপি রঙের একটা কাপড় বেরিয়ে আসে। ভ্রু কুচকে সেটা টান দিতেই একটা সাদা ঠান্ডা হাত বেরিয়ে আসে। চিৎকার করে দূরে সরে যায় জাহিদ। সবগুলো পাতা সরিয়ে একটা মেয়েরূপী শরীর দেখে ভেবেই নেয়, হয়তো ধর্ষণের পর হত্যা করে এখানে ফেলে রেখে গেছে। দ্রুত মানুষজনকে ডেকে আনে। লোকেরা পুলিশকে খবর দিতেই পুলিশ ফোর্স সেখানে হাজির হয়। রোদসীর জীর্ণ শীর্ণ ছিড়েখুঁড়ে দেয়া শরীর লাশের মতো করেই ওঠানো হয়। কাছাকাছি একটা হাসপাতালে পাঠানো হলো। সঙ্গে রোদসীর পরিবারকেও খবর দেয়া হয়। তিন দিন যাবৎ নিখোঁজ হওয়ার জন্য কেয়া আর মনিরুল দুজনেই পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলো। কেয়া হোসেন প্রায় কাঁদতে কাঁদতে পাড়া প্রতিবেশী জড়ো করে ফেলেছেন। একটা লাশ পাওয়া গেছে এই খবর পেতেই তিনি গগনবিহারী চিৎকার করে ওঠেন। কেয়ার বাবার বাড়ির সকলেই সেখানে উপস্থিত। সবাই মিলে হাসপাতালে গেলেন। পুলিশদের কাছে যেতেই তারা বিস্তারিত জানালেন। আশরাফ আর মাহিন দুই ভাই প্রচুর বিচলিত হয়ে খবরাখবর নিলো। জানতে পারলো, আইসিউতে শিফট করা হয়েছে রোদসীকে।
প্রথমে শ্বাসের গতি খুব কম হওয়ার কারণে সবাই ওকে মৃত ভেবেছিলো। কিন্তু অভিজ্ঞ ডাক্তার এসে বললো, অনেক সময় ধরে না খেয়ে থাকা এবং সারা রাত ঠান্ডায় থাকার কারণেই দূর্বল হয়েছে। কেয়া হোসেন হা হুতাশ করে কাঁদছিলেন। দীর্ঘ তিনদিন কেটে যাওয়ার পর জ্ঞান ফেরে রোদসীর। নিজেকে সাফেদ বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আন্দাজ করতে পারে সে কোথায়। সবাই কেবিনে আসতেই রোদসী মায়ের বুকে ঝাপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কিন্তু অবাক হয় মা তাঁকে ছুঁয়েও দেখছে না। এমনকি কারো কারো দৃষ্টিতে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য। বিস্মিত হলেও রোদসী কান্নার মাঝে মা’কে কিছু বলার আগেই তিনি গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে রোদসীকে পরপর দুটি চড় বসিয়ে দেন। হতভম্ব হয় রোদসী। কেয়া রেগে বলেন,

‘তোকে পড়ালেখা শিখিয়েছিলাম কী এইজন্য! যাতে
শিক্ষকের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে ধর্ষণ হতে পারিস! ‘

রোদসী বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখের অশ্রু শুকিয়ে গেলো প্রায়। সে অবাক হয়ে বলল,

‘এসব তুমি কী বলছো মা! ‘

‘একদম চুপ কর তুই! আমাকে মা বলবি না। ‘

‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তোমরা এসব কী বলছো! ‘

কেয়া যা বললেন তাতে রোদসীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পেছন থেকে কেয়া রোদসীর দুই বান্ধবীকে ডাক দিলো। কেয়া বললেন,

‘রিম্মি, সোহা বলেছে তুই নাকি কোচিং এর স্যারের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গেছিলি! ‘

রোদসী অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো দু’জনের দিকে। দুজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মূলত, দুজন ভেবেই নিয়েছে যে এখন যদি আসল সত্যি সবাই জেনে যায়,যে সূর্যকে ওরা হেল্প করেছিলো রোদসীকে পাঠিয়ে তাহলে হাজতে যেতে হবে। ওরা দুজন জানতো না যে সূর্য এমন কিছু করবে। সূর্য আশ্বাস দিয়ে অনেক অনুরোধ করেছিলো, যে রোদসীকে মনের কথা জানানোর জন্যই কোচিং এ পাঠাতে। প্রথমে ওরা রাজি না হলেও সূর্যের প্ররোচনায় পড়ে গেলো। এখন দুজনেই ভাবলো, রোদসীর নামে এই কথাটা বললে ওরা বেঁচে যাবে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিলো। রিম্মি আর সোহার মা ওদেরকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘ছি ছি , এমন একটা মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করতি! চল, আর কখনো এই মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করবিনা। কী নির্লজ্জ মেয়ে! স্যারের সাথে প্রেম করে পালিয়ে যায়! ‘

রিম্মি আর সোহা চুপচাপ চলে যায়। রোদসী সেদিন ওদের পথের দিকে তাকিয়ে এক বিশাল বড় উপলব্ধি করে। কিছু মানুষ আমাদের জীবনে সুখের সময়ে কোকিল পাখি হয়ে আসে। আর দুঃখের সময় গা ঝেড়ে পালায়। রোদসী তাকিয়ে দেখে , দরজা দিয়ে দুটো প্রাণের বান্ধবী নয় বরংচ ভালো মানুষীর মুখোশ পরিহিতা দুটো কালসাপ হেঁটে যাচ্ছে। যারা ওর জীবনটাকে আরও এক ধাপ নারকীয় করে দেয়। এর পর কেয়া আর মনিরুল হোসেন যে সিদ্ধান্ত নেন তা শুনে রোদসীর ইচ্ছে করে বিষ খেয়ে প্রাণের আহুতি দিতে!

চলবে-

(গত পর্বে অনেকেই বললেন, এতো ছোট পর্ব না দিয়ে একদিন পরপর বড় পর্ব দিতে। আমার আইডিয়াটা মন্দ লাগেনি। তাই এই নিয়মেই দেবো।)

গল্প সম্পর্কে নিজের মতামত জানাতে পারেন আমার গ্রুপে- রোদসীর পাঠকমহল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here