“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
২৮.
কলিং বেলের তীর্যক আওয়াজ পেতেই সকলের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবার প্রথমে রোদসীর চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। এলোমেলো বেশেই দৌড়ে গেলো যতদ্রুত সম্ভব। টেবিলের সঙ্গে পা লেগে আঘাত পেয়ে রক্তও বের হলো। ব্যাথাটুকু অনুভব হলেও সেটাকে পাত্তা দিলো না রোদসী। উদ্বিগ্নতার সঙ্গে ছুটে গেলো। দরজা খুলে দিতেই এক প্রশান্তির বাতাস তাঁকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুয়ে দিলো। কারণ, সামনেই যে শহর দাঁড়িয়ে। রোদসীর আঁটকে থাকা শ্বাসটুকু অবশেষে রেহাই পেলো। চারপাশের সবকিছুকে তোয়াক্কা না করে রোদসী শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ফুপিয়ে উঠলো।
শহর তাল মিলাতে না পেরে দরজার চৌকাঠ ধরে নিলো। অবাক হয়ে গেলো একেবারে। রোদসীর কান্নারত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।
হুঁশ ফিরতেই এক হাত রাখলো রোদসীর মাথায়। আরেক হাতে আলতো করে জড়িয়ে নিলো। ভীষণ আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
‘কী হয়েছে রোদচশমা? কাঁদছো কেনো? ‘
রোদসী আহ্লাদী হয়ে শহরের বুকে নাক ঘষলো। প্রতিউত্তর করলো না। শহর বলল,
‘ইশশ,আমার শার্টে নাকের পানি চোখের পানি এক করে দিচ্ছো! ‘
রোদসী বুক থেকে মাথা তুললো। ফোলা ফোলা চোখে একবার অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ মুছে চলে গেলো ভেতরে। শহর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভেতরে আসলো। হঠাৎ করেই সন্ধ্যায় আজকে অফিসে থাকাকালীন একটা কল এলো। সেটার পরের ঘটনায় বেশ চিন্তিত শহর। তবে এতোটা লেট হবে জানতো না।
দিলারা এসে প্রচুর বকাবকি করলেন। শহর এটা ওটা বুঝ দিয়ে দিলো। কিন্তু আসল কথাটা বলল না। সবার অগোচরে হাফ ছাড়লো। রুমে ঢুকে দেখলো কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে রোদসী। নিজেরও খারাপ লাগলো শহরের। এতোটা দেরি হবে বুঝতে পারেনি৷ আর মোবাইলটাও চার্জ শেষ হয়ে অফ হয়ে গেছিলো। প্রেশারে অন্য কিছুর খেয়াল হয়নি। হাত মুখ ধুয়ে এসে মোবাইলটা চার্জে দিলো শহর৷ রোদসীর পাশে শুয়ে রইলো। কোনো কথাই বলল না। কপালের উপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে রাখলো। অথচ রোদসী আশা করেছিলো শহর তাঁকে ডাকবে। কিছু একটা হলেও বলবে। রোদসী রেগে ফুপিয়ে উঠলো। বালিশে মুখ গুঁজে ফুপাতে থাকলো। শহরের কানে সেই শব্দ আসতেই সজাগ হলো সে। উঠে আধশোয়া হলো। পাশ থেকে রোদসীর হাত টান দিলো কয়েক বার। রোদসী জেদ করে শুয়ে রইলো। শহর বুঝতে পেরে হালকা হেঁসে রোদসীকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরলো। কানের পিঠে ফু দিতেই গা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো রোদসী। তবে, শহর ছাড়লো না। আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে নিলো। রোদসী হাল ছেড়ে দিতেই শহর বলল,
‘শক্তি শেষ? ‘
রোদসী ফোসফোস করে তাকালো। শহর সশব্দে হাসলো। উঠে বসে রোদসীকে এক টানে কোলে তুলে নিলো। রোদসী হকচকিয়ে বলল,
‘একি! কোলে তুললেন কেনো? ‘
শহর মিষ্টি করে হাসলো। উঠে দাড়িয়ে রোদসীকে কোলে নিয়েই পা দিয়ে দরজা ঠেলে বাহির হলো। রোদসী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো। রোদসীকে আগলে ধরে ছাদে বিছানো পাটিতে শুয়ে পড়লো। রোদসী লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। শহর ওকে বুকের উপর নিয়েই শুয়ে আছে।
রোদসী একবার হাত দিয়ে উঠার চেষ্টা করলেও শহর ছাড়লো না। শহর নিঃশব্দে হেঁসে রোদসীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আকাশে আজ লাল চাঁদ, দেখো। ‘
রোদসী থমকে গেলো আকাশের দিকে চেয়ে। সত্যিই বিরাট একটা লাল রঙের চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রোদসী শহরকে বলল,
‘আপনি জানেন আকাশে লাল চাঁদ ওঠে কেনো? ‘
‘হুম,চাঁদ সূর্যের আলোয় আলকিত হয়। পূর্ণিমার সময় সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে যাবার সময় শুধু লাল বর্ণালীর আলো চাঁদের গায়ে পড়ে, তাই তখন চাঁদ লালচে লাগে। তুমি কী ভেবেছিলে আমি পারবো না? ‘
‘হ্যা,সেটাই কীভাবে পারলেন? ‘
‘বোকা মেয়ে,আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট। ‘
‘ওহ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। ‘
রোদসী শহরের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি কোথায় ছিলেন আজকে? ‘
‘আমার আরেকটা বউয়ের কাছে? ‘
‘মজা বন্ধ করুন। ‘
‘তোমার কেনো মনে হচ্ছে আমি মজা করছি? সত্যিও তো হতে পারে। ‘
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। ‘
শহর আরও কিছু বলতে নিয়ে থমকে গেলো। রোদসীর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
‘এতোটা বিশ্বাস করো? ‘
রোদসী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। লজ্জায় মাথা তুলতে পারলো না। শহর উঠে বসে ছিলো। এবার রোদসীর দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
‘ভালোবাসো? ‘
রোদসী আমতা আমতা করে উঠতেই শহর চলে যেতে নিলো। রোদসী তাঁর হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
‘ভালোবাসি। ‘
শহর বিস্মিত হয়ে তাকালো। বিশ্বাস করতে পারলো না। আনন্দে চোখে জলের কণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। রোদসীকে এক টানে বুকে এনে নিলো। চোখ বন্ধ করে বলল,
মিষ্টি রাতও থমকে গেছে,
তোমার অপেক্ষায়।
আলোক শিখায় আধার ছেয়ে,
তোমার প্রতীক্ষায়।
রাতের বাতি জ্বলছে না আজ,
তুমি আসবে বলে তাই।
আমার দিবস গেছে রঙিন হয়ে,
তোমার প্রেমের ছোঁয়ায়।
(রোদি)
চলবে-