“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি”
৮.
ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ফুচকা মুখে পুরছে শহর। পাশে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে রোদসী। এতো ফুচকা মানুষ কীভাবে খেতে পারে, ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছে না। মেয়ে হলেও মানা যেতো। ফুচকা পাগল, তাও আবার কিনা কোনো ছেলে! ভাবা যায়! নাহ, মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রোদসী ট্রিট দিতে এনেছে শহরকে। যদিও প্রতি মাসে মনিরুল হোসেন কিছু হাত খরচের টাকা দেন। সেগুলো সাধারণত জমিয়েই রাখে সে। টিউশনি করে যা পায়, তা-ই খরচ করে। প্রথমে ভেবেছিলো শহর ছেলে মানুষ, ফুচকা আর কতটুকুই বা খেতে পারবে! যাক ভালোই হয়েছে রেস্তোরাঁয় গেলে বেশি টাকা লাগতো। সঞ্চয়ী মনোভাব থেকে একটু খুশিই হয়েছিলো। কিন্তু এখন দেখছে, লাভ তো দূর। দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছে। পাঁচ প্লেট ফুচকা শেষ করে ছয় নম্বর প্লটটা হাতে তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলো। আর ফুচকাওয়ালাকে এক প্লেট বাসার জন্য প্যাক করে দিতে বলতেও ভুললো না। রোদসীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শহর ফিক করে হেঁসে বলল,
‘খাচ্ছো না কেনো? ‘
রোদসী থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নিজের ফুচকায় টক ঢেলে বলল,
‘কই, খাচ্ছি তো। ‘
শহর আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘নাকি, আমাকে খাদক বলছো মনে মনে! ‘
রোদসী তোতলানো গলায় বলল,
‘না না, তা কেনো হবে! আপনি খান, আরও খেলে বলুন। ‘
‘থাক,তা তুমি বললেও খাবো,না বললেও খাবো। ফুচকা আমার খুব প্রিয়। সব খাবার ত্যাগ করলেও এটা পারবো না। ‘
‘এতো পছন্দ আপনার! ছেলেরা তো ফুচকার বদনাম করে। ‘
‘মনে রাখবে, যার যেমন টেস্ট। সে সেটাকে সাপোর্ট করে। ‘
রোদসী চুপ করে নিজেরটা খেতে থাকলো। ওর অবশ্য ভালো লাগলেও, বিশেষ কিছু মনে হয় না। মেয়ে বলেই যে ফুচকা, চটপটি অতিরিক্ত পছন্দ হবে আর ছেলে বলেই যে তীব্র অপছন্দ হবে এটা অযৌক্তিক। খাবারের স্বাদ যার যেমনটা ভালো লাগে,তাঁর ঠিক তেমন জিনিসেই আগ্রহ। দুজনের বিলটা মিটাতে গেল রোদসী। ফুচকাওয়ালাকে টাকা দিতে নিলেই তিনি বললেন,
‘বিল তো দেয়া হইছে। ‘
রোদসী অবাক হয়ে বলল,
‘মানে! কে দিলো? ‘
‘ঐ যে শহর বাবা। ‘
রোদসী বুঝতে পারছে না, শহর কখন বিল দিলো। আর শহর তো অযথা নিজের পকেট থেকে দশটা টাকাও বের করে না। সে মিতব্যয়ী জীবনযাপন করে। শহর ঝাল মেটাতে ঠান্ডা পানি খাচ্ছিলো আর সামনে অগ্রসর হয়েছিলো। রোদসী হাতের টাকাটা ব্যাগে ভরে তৎপর হয়ে ছুটে এলো। শহর স্মিত হাসলো ওকে দেখে। রোদসী অবাকতার স্বরে বলল,
‘আপনি কেনো বিল দিলেন? আর কখন? ‘
‘যখন তুমি ঝালে হিসহিসিয়ে জুস খাচ্ছিলে তখন। ‘
‘কিন্তু কেনো?বিল তো আমার দেয়ার কথা! আপনি নাকি পাঁচশ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এতো বিল তো হয়নি। ‘
শহর ফুটপাতের ওপরে একটু ঝেড়ে বসলো। রোদসীকেও বসতে বললে, সেও বসে পড়লো৷ শহর অদূরে কোথাও একটা দেখতে দেখতে বলল,
‘জানো রোদি, আমরা মানুষরা বড় অদ্ভুত। এই দেখো, আমরা যখন কোনো রেস্তোরাঁয় যাই। তখন পাঁচশ বিল হলে আর একশো টাকা বাড়িয়ে দিয়ে নবাবের মতো ওয়েটারকে বলি ‘এটা আপনার ট্রিট ‘। আর কোনো গরীব লোক যখন প্রচুর পরিশ্রম করে সবজি, ফলমূল বিক্রি করে অথবা বুড়ো হয়েও ছেলের অবহেলায় রিকশা চালাতে রাস্তায় নামে। তখন আমরা কয়েকটা টাকার জন্য কথা কাটাকাটি করি, এমনকি আমি এটাও দেখেছি যে বুড়ো লোকটাকে মেরে আধমরা বানিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছে। তাঁর অপরাধ, সে তাঁর প্রাপ্য টাকাটার জন্য আওয়াজ তুলেছিলো। ওই দামী দামী রেস্তোরাঁয় গিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে খরচ না করে এই গরীব মানুষ গুলোর কাছ থেকে জিনিস কিনে কিছু টাকা বেশি দিতে পারি৷ অনেক সময় আক্ষেপ করে বলি, ‘আমার যদি অনেক টাকা থাকতো, আমি গরীব মানুষ গুলোকে সাহায্য করতাম। তাঁকে একবেলা খাওয়াতাম ৷ ‘ কিন্তু আমাদের উচিত তাদের একবেলা না খাইয়ে, প্রতি বেলা যেনো আহার করতে পারে সে ব্যবস্থা করে দেয়া। তা না পারলে, এই যে টুকটাক করে দেয়া। যেমন, কামাল চাচুকে দেখো। তাঁর বয়সটা কিন্তু এই ভরদুপুরে রাস্তায় কড়া রোদে ফুচকা বিক্রির নয়। সারাজীবন যাদের জন্য পরিশ্রম করেছে, তাদের কী উচিত ছিলো না, এই বাবাটাকে একটু স্বস্তি দেয়া! অথচ, তাঁর ছেলেদুটো দুজনেই ব্যবসা করে। তবুও বাবাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আমি এই চাচার কাছেই ফুচকা খাই। ইচ্ছে করেই একটু বেশি করে খাই। যাতে বেশি টাকা দিলে তাঁর এটা না মনে হয়, আমি বেশি করুণা করেছি। সারাজীবন আত্মসম্মান বজায় রাখা মানুষ গুলো করুণা দয়া সহ্য করতে পারে না।
এরপর খেলে কিন্তু তোমাকে দিয়েই বিল দেয়াবো, হুম। ‘
শেষের কথাটা শহর বলল কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে। রোদসী ভাবতেই পারেনি,এমন বোকাসোকা ভাব করা সরল ছেলেটা এতো গভীর ভাবে। কই, অনেক বড়লোককেই তো দেখেছে ৷ টাকা নানাবিধ জায়গায় খরচ করেছে কিন্তু গরীব মানুষকে নিয়ে কোনো কিছু ভাবেনি। রোদসীকে এক ধ্যানে নিবিষ্ট হতে দেখে শহর হাসি দিয়ে বলল,
‘কী হলো, রোদচশমা? ‘
রোদসী চকিতে উঠে গেলো। চোর ধরা পড়ার মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘কিছুনা কিছুনা!’
চলবে-
লেখিকা -নাঈমা হোসেন রোদসী।