“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি”
৯.
ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে একটা ক্রিম বিস্কুট ভিজিয়ে আয়েশ করে ছাদে বসে খাচ্ছে শহর। মাথার উপরে মস্ত বড় আকাশে রোদ মেঘের লুকোচুরি। এই কড়া রোদে বসে নির্লিপ্ত হয়ে চুমুক দিচ্ছে কাপে। ছাদে কাপড় মেলতে এসে থমকে দাঁড়ালো রোদসী। মাত্রই গোসল করে এসেছে। শুক্রবারের দিন। ছেলেদের অফিস ঘাট বন্ধ। ভার্সিটিও নেই বলে রোদসী বাসায়।
নাহলে, এমন সময় প্রতিদিন সাজ্জাদ স্যারের দেয়া কাজের ঘানি টানতে টানতে মাথার ঘিলু সিদ্ধ হতে থাকে। শহর বোধ হয় মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসেছে। তাঁর পড়নে শুভ্র পাঞ্জাবি। মাথার টুপিটা পাশেই রাখা। তবে, এই সময় কেন ঘরে দুপুরের খাবার না খেয়ে গরমে ঘেমে-নেয়ে বসে তারউপর উত্তপ্ত চা খাচ্ছে! রোদসী মনে মনে ভাবলো, ছেলেটা কী পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি! হাতের ভেজা কাপড়গুলো দড়িতে মেলে শহরের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মাথা খারাপ নাকি আপনার? এই গরমে চা খাচ্ছেন কেনো? ‘
শহর বুঝি তাঁর উপস্থিতি আগেই টের পেয়েছিলো। তাই কোনোরকম চমকানো ছাড়াই চটপট বলল,
‘গরমে চা খাওয়া নিষিদ্ধ নাকি? ‘
‘তা বলিনি। কিন্তু এতো গরমে কষ্ট হচ্ছে না? ‘
‘হুম, যে গরম পড়েছে! তবুও নামাজ পড়ে এসে চা না খেলে ভালো লাগে না। তারপর ভাবলাম, চা খেতে খেতে আমার কবুতর গুলোকে খাবার দিয়ে দেই। ‘
রোদসী পাশে তাকিয়ে দেখলো, বড় করে খাঁচা বানানো হয়েছে। আগে তেমন করে খেয়াল করেনি খাঁচাটা। বুঝতে পারলো, এগুলো শহরের কবুতর। সে খানিকটা বিস্মিত মুখে বলল,
‘এতগুলো কবুতর আপনার! ‘
শহর হাসলো। হাতের আধখাওয়া চায়ের কাপটা রেখে
উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘হ্যা, আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন থেকে কবুতর পালি। সেসময় কম ছিলো। আস্তে আস্তে বেড়েছে। দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। ‘
রোদসী কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলো দেখার আশায়। শহর দুই হাতে তালি বাজিয়ে শিস বাজাতেই আকাশে উড়তে থাকা সাদা কালো মিশেলে একটা কবুতর এসে শহরের কাঁধে বসে পড়লো। রোদসী হা করে তাকিয়ে বলল,
‘এটা কী হলো! ‘
শহর ঝলমলে হেঁসে কাঁধের কবুতরটা হাতে নিয়ে ওটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘এটা আমার সবচেয়ে পুরনো কবুতর, সিটি। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলাম। চার বছর আগে কোথা থেকে উড়ে এসেছিলো শীতকালে ৷ অসুস্থ ছিলো ও। টানা এক সপ্তাহ যত্ন করতে হয়েছে। তারপর
সুস্থ হলে, ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও যায়নি। আমার পোষ মেনেছে। ‘
রোদসী তাকিয়ে আনমনে বলল,
‘তিতুসও আমার খুব প্রিয়। আমার মন খারাপের সাথী। ‘
শহর একটু টিটকারি হেঁসে বলল,
‘তোমার আবার মন খারাপও হয় নাকি? ‘
‘কেনো? হবে না কেনো? ‘
‘আরে, সারাদিন ঐ এক টেবিলেই তো মুখ গুঁজে বসে থাকো। গম্ভীর একটা মুখ করে ঘুরে বেড়াও। পরিবার আছে, মা বাবা ভাই। মন খারাপ আবার হবে কখন?
আচ্ছা তোমার ইচ্ছে করে না, এই একটা ঘর বা জায়গা ছেড়ে উন্মুক্ত আকাশের মেঘভেলা দেখতে! পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে! ‘
রোদসীর কেনো যেনো হঠাৎ করেই খুব কান্না পেয়ে গেলো। অন্য পাশে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল নাক টুকটুকে লাল হয়ে গেলো। শহর ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। রোদসীর আচমকা নাক টানায় ভড়কে গেলো।
কিছু বলবে তাঁর আগেই রোদসী কঠোরতা বজায় রেখে চুপচাপ পা বাড়িয়ে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো। শহর কিছু বলতে নিয়েও বলল না। সর্বদা বুলি আউড়ানো ছেলেটা বুঝতে পারলো, তাঁর কথায় হয়তো মেয়েটা কোনোভাবে আঘাত পেয়েছে। কিন্তু এমন কী বলল সে? মাথা চুলকে ভাবনায় নিমগ্ন হলো শহর।
ডাইনিং টেবিলে বসে ডালের বাটি থেকে দুই চামচ নিয়ে ভাত দিয়ে খাচ্ছিলো রোদসী। কেয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনিরুল হোসেনও বাসায় আজ। দুজনই যখন বারবার একে অপরকে ইশারায় কিছু বলছে তখন রোদসী শান্ত কন্ঠে বলল,
‘কিছু বলবে তোমরা? ‘
দুজনই চমকে চুপ করে রইলো। কেয়া হাসফাস করে বললেন,
‘বলছিলাম কী, মানে ঐ.. ‘
‘এমন আঁটকে আঁটকে না বলে, কী হয়েছে বলো। ‘
মনিরুল হোসেন এবার মুখ খুললেন,
‘আমার অফিসেই উপরের পোস্টে একটা ছেলে কাজ করে। বেশ নম্র ভদ্র। তো, ওরই মা কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, পাত্রীর খোঁজ করছেন। ‘
রোদসী শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছে। মনিরুল হোসেন বললেন,
‘আমি চাই, তুমি ছেলের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখো। ‘
রোদসী কিছুক্ষণ তাকিয়ে উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে নিলো। দুজন চাতকের মতো তাকিয়ে আছে। রোদসী বলল,
‘কবে কোথায় যেতে হবে বলো? ‘
কেয়া প্রশস্ত হাসলেন। মনিরুল হোসেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। রোদসীর মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘ছেলেটা ভালো লাগবে দেখো। আর এই এলাকায় কেউ আমাদের চেনেনা। অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে, ভেবে গুটিয়ে থেকে লাভ নেই মা। কাল সকালেই ছেলেটা আসবে। এড্রেস বলে দিবো তখন। ‘
রোদসী নিরবে ঘরে ঢুকে গেলো। সারাদিন কেমন একটা গুমরে গুমরে কাটলো। কিছুতেই মন বসলো না তাঁর। তিতুসের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে রইলো। রাতে বারান্দায়ও গেলো না। প্রতিদিনকার মতো ঝগড়া হলোনা। রাত ঘনিয়ে এলো। আঁধারে জানালাটা খুলে দিয়ে চন্দ্রবিলাশ করতে থাকলো। টেবিল থেকে হাতড়ে নিজের ডায়েরিটা বের করে নিলো। পুরনো কিছু পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে কতকিছু ভাবলো! পাশ থেকে কলমটা উঠিয়ে নিয়ে চাঁদের ঝাপসা আলোয় লিখলো,
আমারও হয় মন খারাপ,
কী তিক্ত বিষাক্ত!
এক আকাশ সমান মন খারাপ।
ভীষণ বিরহে জর্জরিত!
আমি শুধু সবার মতো মুখ ভরে বলতে পারিনা,
চোখের জলে কষ্ট গুলোকে ভাসাতে পারিনা,
একেবারে সুপ্ত ভালো লাগাগুলোকে দেখাতে পারিনা,
অভিযোগের মিছিল বসাই না।
একান্তে নিরালায় নিভৃতে,
কষ্টগুলোকে জমিয়ে রাখি।
মেঘভেলায় নিরুদ্দেশ চিঠি লিখি।
তবে শোনো প্রিয়,
আমারও হয় মন খারাপ!
চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।
Group –
রোদসীর পাঠকমহল