মেঘভেলায় প্রেমচিঠি” শেষ পর্ব

0
990

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
(শেষ পর্ব)

৩০.

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেটে যায় আরও কয়েকটি মাস৷ মাথায় বেলি ফুলটা গুঁজে নেয় রোদসী। গায়ে লাল রঙের শাড়ি। দেখতে বউ বউ লাগছে। সংসার জীবনের দীর্ঘ এক বছর কেটে গেছে। আজ রোদসী ও শহরের বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে বাড়িতেও বিশাল আয়োজন করা হয়েছিলো। সারাদিন এদিকে ওদিকে ব্যস্ত সময় কেটেছে। এখন সন্ধ্যার সময় শহরের আবদার তারা লং ড্রাইভে যাবে। রোদসী প্রথমে মানা করেছিলো, কিন্তু শহর এমন মুখ করে বলল আর না করার জো নেই। রোদসী সাজগোছ করে হাফ ছাড়লো। ফোনটা হাতে তুলে বারান্দায় গেলো। ওখানে গিয়ে চোখ পড়লো তিতুসের খাঁচার দিকে। হেসে ফেললো রোদসী। তিতুস আর তিতিয়ার দুটো বাচ্চা হয়েছে।
এই তো সেই দিন শহরের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে ছিলো রোদসী। তখন শহর ওকে ডেকে বলল,

‘এই রোদি, দেখো তিতুসটা কী চেঁচাচ্ছে! ‘

রোদসী ঘুমুঘুমু চোখে উঠলো। শহর ওকে নিয়ে বারান্দায় গেলো। রোদসী অবাক হলো। মেয়ে টিয়াটা
দু’টো ডিম পেরেছে। রোদসী খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

‘শহর, দেখুন তিতিয়া ডিম দিয়েছে! ‘

শহর খাঁচার দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ তারপর রোদসীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘দেখেছো রোদচশমা! আমাদের পরে বিয়ে করে ওরা বাপ মা হয়ে যাচ্ছে। ‘

রোদসী আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

‘তো! ‘

শহর দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘তো, এবার আমাকেও বাবা বানিয়ে দাও! ‘

রোদসী মুখ ভেংচি কেটে যেতে যেতে বলল,

‘উহু, এখন না। ‘

‘তো কখন? ‘

‘দুই , তিন বছর পর। ‘

‘না না, এখনই ৷ প্লিজ বউ! ‘

রোদসী পুরনো কথা মনে করে আলতো হাসে। শহরের বায়না ছিলো কত! আজ সেটাও সত্যি হলো। রোদসী বাস্তবেই মা হচ্ছে। প্রেগ্ন্যাসির দেড় মাস। আজ সকালেই তা জানতে পেরেছে। শহরকে বলেনি এখনো। ভেবেছিলো রাতে সারপ্রাইজ দিবে। ভাবতে ভাবতেই শহর ঘরে ঢুকলো। রোদসীকে ডাক দিতেই রোদসী এসে পড়লো। শহর ওকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘দেখি বসো তো এখানে। ‘

রোদসী বুঝতে পারলো না। কিন্তু চুপচাপ হেঁটে বিছানার উপর বসলো। শহর হাসিমুখে রোদসীর সামনে এসে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। রোদসীর বোধগম্য হয়নি। শহর রোদসীর পায়ে হাত দিতেই রোদসী চমকে উঠলো। পা সরিয়ে নিতে চাইলে শহর মানা করলো। বক্স থেকে সোনালী রঙের একটা পায়েল বের করে রোদসীকে পড়িয়ে দিলো। রোদসীর ভীষণ পছন্দ হলো পায়েলটা। শহর পায়েলটা সুন্দর করে পড়িয়ে বলল,

‘এটা হচ্ছে আমার পক্ষ থেকে বিবাহ বার্ষিকীর উপহার। ‘

রোদসী মুগ্ধ হয়ে হাসলো। শহর এবার ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,

‘আমার গিফট কোথায় বউ? ‘

রোদসী ঠোঁট চেপে হাসলো। শহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘গিফট তো আছে, কিন্তু এখন বের করে দেখা যাবে না। ‘

শহর অবাক হয়ে বলল,

‘মানে! আচ্ছা বলো গিফট কোথায় রেখেছো? ‘

রোদসী শহরের হাত টেনে পেটের উপর রেখে বলল,

‘এখানে। ‘

শহর বিস্মিত হলো। নির্বাক চোখে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে রইলো। তারপর সিক্ত চোখে রোদসীকে জড়িয়ে ধরলো। রোদসী শহরকে আগলে ধরলো।
শহর ভেজা কন্ঠে বলল,

‘এটা আমার লাইফের বেস্ট গিফট রৌদ্রানী! ভালোবাসি তোমাকে। ‘

রোদসী জানে, শহর ওকে তখনই রৌদ্রানী বলে যখন
খুব বেশি খুশি হয়। শহর অনেকক্ষণ পর ছাড়লো।
চোখের কার্নিশ মুছে কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলল,

‘চলো এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘

রোদসীকে সঙ্গে নিয়ে বের হলো শহর। রোদসীকে গাড়িতে বসিয়ে পাশে বসলো। এই গাড়িটা শহরের নিজের কেনা। একসময় এসব শহরের স্বপ্ন ছিলো।
আজ তা সত্যি। অফিসেও প্রোমোশন হয়েছে শহরের।
সব দিক থেকেই আজ সবাই খুশি। রোদসী পেরেছে শহরকে ভালোবাসতে। অতীতকে ভুলিয়ে বর্তমান নিয়ে বাঁচতে। শহরের সেই রৌদ্রানী এখন শুধুই তার৷

গাড়িটা অনেকক্ষণ পর একটা জায়গায় এসে থামলো। শহর গাড়ি থেকে নেমে রোদসীর পাশের দরজাটা খুলে দিলো। রোদসী প্রথমে বুঝতে পারলো না এটা কোন জায়গা। কিন্তু বের হয়ে ওর মাথাটাই ঘুরে উঠলো৷ রোদসীর চোখ দুটো ছলছল করছে। এটা সেই হসপিটাল যেখানে দীর্ঘ এক সপ্তাহ বেদনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিলো। অতীতটা না চাইতেও মনে পড়লো। প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে শহরের দিকে তাকালো। শহর এসে ওর গালে হাত রেখে বলল,

‘সরি বউ, আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু আজকে কিছু দেখানোর জন্যই নিয়ে আসলাম তোমাকে। ‘

রোদসী ভীত চোখে শহরের হাত চেপে রাখলো। শহর একহাতে জড়িয়ে আস্বস্ত করলো। শহর ওকে হসপিটালে নিয়ে একটা কামরায় ঢুকে গেলো। বেডের দিকে তাকিয়ে কলিজাটা টান খেলো রোদসীর। বেডের মধ্যে খানে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সূর্য।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা তখন খেলো যখন দেখলো সূর্যের দুটো হাতই কনুই পর্যন্ত কাটা। মাথার অর্ধেক চুলই নেই। এই অবস্থাটা কী করে হলো তা জানতে শহরের দিকে তাকালো রোদসী৷ শহর বলতে শুরু করলো,

‘তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি একদিন অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরেছিলাম। সেদিনের ঘটনাটা লুকিয়েছিলাম আমি। সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই একটা কল আসলো। অপরিচিত কন্ঠ হলেও তারপর নাম বলায় আমি চিনতে পারি, এটা সূর্য। প্রচুর রাগ হয়েছিলো। তারপর আমাকে বলল, এই হসপিটালে একবার আসতে। কাজ শেষ করে আটটার দিকে আমি হসপিটালে আসি। ক্যান্সারে আক্রান্ত সূর্য। মাথার চুল গুলো পড়ে গেছে। আর হাতটাতেও পচন ধরার কারণে কাটতে হলো৷ ডাক্তাররা জানিয়েছে বেশি দিন বাঁচবে না আর। পরিবারের কেউ নেই। ছোট ভাই রায়হানও আর আসেনা এখন। যতদিন বেঁচে আছে কোনোরকম টাকায় বাঁচবে। ঔষধের উপর ভিত্তি করেই। প্রথমে একবার মনে হয়েছিলো যে আমার রৌদ্রানীকে এতো কষ্ট দিয়েছে তার জন্য কোনো উপকার করা উচিত না। কিন্তু মানবিক দিক থেকে পারলাম না। এতোদিন মাসে মাসে টাকা দিয়েছি। এখন ডক্টর বলে দিয়েছে, আর কয়েক দিন পরই সূর্য মারা যাবে। সূর্যের শেষ ইচ্ছে, তোমাকে একবার দেখার এবং ক্ষমা চাওয়ার। আমি না করতে পারিনি। ‘

রোদসী চোখ মুছে নিলো। সূর্যের করুণা দৃষ্টি ওর দিকে। সেই বলিষ্ঠ দেহর মানুষটার এই নিদারুণ অবস্থা দেখে খুব একটা কষ্ট লাগলো না। এইরকম ভাবেই কতগুলো দিন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো রোদসী৷ এই সূর্য নামক মানুষটার কারণেই। সূর্য বলল,

‘জানি, অনেক বেশি পাপ করেছি তোমার সঙ্গে। দেখো সাজাও পাচ্ছি। নদীর সাথে যে অন্যায় করেছিলাম, তারও শাস্তি এটা। পারলে ক্ষমা করে দিও। ‘

রোদসী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর দ্রুত বের হয়ে গেলো। আর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছেনা।

সূর্য রোদসীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এবার চিৎকার করে কেঁদে শহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘প্লিজ মেরো না আমাকে! হাতদুটো তো কেটে দিয়েছো। এখন প্রাণে বাঁচতে দাও অন্তত! তিনটা বছর ধরে বিকলাঙ্গ হয়ে আছি। ‘

শহর সূর্যের দিকে এগিয়ে আসলো। মুখটা চেপে ধরে বলল,

‘চুপ, একদম চুপ! নাহলে জিহ্বাটাও কেটে নিবো। যেই হাত দিয়ে আমার রৌদ্রানীকে আঘাত করেছিলি সেই হাতটার শাস্তি ছিলো ওটা। দু’টো দিন বেঁচে আছিস, আল্লাহ খোদার নাম নে। ‘

পকেট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা বের করে ডক্টরের হাতে ধরিয়ে শহর গম্ভীর গলায় বলল,

‘ইনজেকশনটা ওর স্যালাইনে মিশিয়ে দিয়েন৷ ৪৮ ঘন্টার চেয়ে এক সেকেন্ড বেশি বাঁচলে আপনার বাঁচাটা কঠিন হয়ে যাবে। ‘

ডক্টর তাড়াতাড়ি কপালের ঘাম মুছে বলল,

‘না না, চিন্তা করবেন না স্যার! কাজ হয়ে যাবে। ‘

শহর ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বের হলো। রোদসীকে দেখে বাঁকা হাসি সরিয়ে মুচকি হাসলো। এগিয়ে এসে একহাতে জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রাস্তায় হালকা আলোয় বাতি জ্বলছে। রোদসীর মাথাটা শহরের কাঁধে লাগানো। রোদসী হয়তো অবগত নয়, তার ভয়ানক প্রেমিকটা তারই অগোচরে স্বামীরূপে তার পাশে। শহর রোদসীর কপালে চুমু খেয়ে মনে মনে বলল,

‘রৌদ্রানী, তোমাকে যে এতোটা যন্ত্রণা দিয়েছে তাকে আমি কী করে ভালো থাকতে দেই! তুমি মামা বাড়ি যাওয়ার পরই ওই জানোয়ারটার হাত কেটে দিয়েছি। ভয়ানক যন্ত্রণা দিয়েছি। রোজ একটা করে মরণঘাতী ভাইরাসের ইনজেকশন দিচ্ছি সঙ্গে। ভালো করেছি না বলো? ‘

(সমাপ্ত)

– সকল পাঠকদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here