মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব:৫

0
512

মেঘের আড়ালে চাঁদ
(৫)

আজ আবার বসেছি আমরা,
মিজানের ইচ্ছায় বাইরে বসেছি, তারিক ঘুমাচ্ছে তার ঘরে, বসন্তের এলোমেলো বাতাসে ঝরা পাতা গুলো দিক ভুলে আমাদের ছুয়ে যাচ্ছিল, আমি কিছুটা আনমনা, ল্যাপটপে চার্জ দিতে ভুলে গেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই লো ব্যাটারির গান শুরু হবে!
মিজান বেশ উত্তেজিত, কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে গুছিয়ে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে,
মিজানের ভাষায়,
আমি তাবলীগের দলে ভীড়ে গেলাম, ওদের সাথেই এই মসজিদে আসা, ওরা যে কদিন ছিল আমিও ইবাদত করে কাটিয়ে দিলাম, এবার ওদের যাওয়ার পালা, ওরা ঢাকা ফিরবে, অসহনীয় ঠান্ডা, এই ঠান্ডার মধ্যে আরো কিছু মসজিদে যাওয়ার কথা থাকলেও তা, শীত কমার জন্য অপেক্ষা করবে, আবার আসবে, আমি ঢাকা ফিরতে পারব না। ঐ রাত মসজিদের বারান্দায় কাটালাম। মুয়াজ্জিন সাহেব সেদিন ঠান্ডায় অজ্ঞান অবস্থায় পান আমাকে ফজরের ওয়াক্তে, তিনি ইমাম সাহেবকে সব বলেন, আমি আগা গোড়া সবকিছু ইমাম সাহেবকে খুলে বলি, তিনি একটু সময় চাইলেন, সে সময়ে আমার আশ্রয় হল, মুয়াজ্জিনের ঘর, তীব্র জ্বর, আমি কিছুতেই ডাক্তার দেখাবো না, তারাও জোর করেননি। ইমাম সাহেবের বাসা থেকে খাবার এলো, দুইদিনে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি, ইমাম সাহেব তারিক ভাইকে সবকিছু জানালে, তারিক ভাই তার বাসায় নিয়ে যান, সেবা যত্ন করেন, কিন্তু ওষুধ খাওয়া হয়নি, তাই দিন দিন ফুসফুসের সংক্রমণ বাড়তে থাকে আমি রংপুর মেডিকেলে এ যেতে অস্বীকার করি, এদিকে ভাবীর প্রসব বেদনা শুরু হয়….বলে এক ঢোক পানি খায়।
•আমি বললাম চা নিন।
সে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি দিন দিন অসাধারণ চা বানানো শিখে গেছেন, আমার বড় বোনের মত। ওর নাম মেঘনা, আপনার বয়সী। প্রেগন্যান্ট!
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, ও কি আমাকে বড় বোনের দৃষ্টিতে দেখে? আর আমি কিসব ভাবছি!
ছি! ছি!

আবার বলতে শুরু করে, আমি এই ফাকে ল্যাপটপ চার্জের জন্য মাল্টি প্লাগ জুড়ে দিয়ে বারান্দা থেকে ল্যাপটপের চার্জার কর্ড লাগিয়ে নিয়েছি! এবার নিশ্চিন্ত!

হ্যা যা বলছিলাম,
ভাবীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটাছুটি শুরু, এদিকে আমার শরীর খুব খারাপ, তৌফিক ভাই ও বাসায় থাকেন না, শুধু তাসলিমা আর আমি, তাসলিমা আমার বোন মোহনার মত, ভীষণ যত্ন করেছিল আমার, কিন্তু গ্রামের কিছু প্রতিবেশী মহিলাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে,
ওরা আমাকে এক রাতে ধরে ধরে তারিক ভাইয়ের রুমে আনে, মেঝেতে বিছানা পেতে নিজে ঘুমায়, আমি ঘুমাই বিছানায়, সব ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, দিনের বেলা আমি আরাম মত হালকা হাটাহাটি করতে পারি, কিন্তু রাতে বিন্দুমাত্র শব্দ করা যাবেনা, আমি সেটাই মেনে নেই, কিন্তু তারিক ভাইয়ের রুম সংলগ্ন বাথরুম জ্যাম হয়ে যায়, ফলে আমাকে পিছনের পুরাতন বাথরুমে যেতে হয়, আমি চেষ্টা করতাম দিনেই সেরে নিতে, কিন্তু…. দুইদিন রাতে বের হয়েছি, দেখি একটা রুমে লাইট জ্বলে, টুকটাক শব্দ ও হয়, আমি দুর্বল শরীরে চেষ্টা করছি শব্দ না করতে কিন্তু শুকনো পাতায় পা পড়তেই মড়মড়ে শব্দ হয়, আপনি একবার উঁকি দিলেন বোধহয়, আমি তাড়াতাড়ি বাথরুমে গেলাম। আপনি বের হননি,
•আমিও ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। বলে উঠলাম।

তারপর আমার আর বিশেষ মনে নেই, বাকিটা তো আপনি জানেন, কিভাবে কি হল….
তারিক এসে দাড়িয়েছে,
•আপা একটু বাড়িতে কাজ ছিল।
•কি কাজ?
•ঐ তাসলিমা কে বিরক্ত করে একদল ছেলে, তার বিচার।
•চলেন ভাই আমিও যাব। জ্বলে ওঠে মিজানের চোখ!
আমি বুঝতে পারি, মিজানের আবেগ, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এটা একেবারেই নিরাপদ না। আমি আর তারিক মিলে মিজানকে সামলে নিলাম।

#
নিলয়ের দিনকাল,
সারিকা রেপ এন্ড মার্ডার কেসের সফলতার পর আসরাফুন্নেসার কেস তার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং, ইইন্দোনেশিয়া ঘুরতে যাওয়ার সব ঠিক ঠাক তখনই মিতু আপুর ফোন, মিতু আপু মানুষটা খুব ভালো, কারো সাতে পাঁচে থাকেনা, তাকে হয়ত হুটহাট বৃদ্ধাশ্রম না কোন চ্যারিটি কাজে দেখা যায় না, কিন্তু সে মানুষের বিপদে হাত বাড়ায়। আজ তার বোন নন্দীতার বেচে থাকাই তার প্রমাণ, ছুটি ক্যান্সেল করে, কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ তাহিয়া আর তোহফা একটু মন খারাপ করেছিল, কিন্তু তারা নিলয়ের ছোট ভাই অলিন্দকে ম্যানেজ করে চলে গিয়েছে, রোজ রোজ তাদের সেলফি ভিডিওতে মেসেঞ্জার ভরে যায়। তাহিয়া অশান্তি করার মেয়ে না। নিলয় ভাগ্যবান।
পুলিশের সব ডকুমেন্টস নকল, তা প্রমাণ করা খুব সহজ, নিলয় সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে, মিজানের বলা প্রতিটি তথ্য সত্য, শুধু ফরেনসিক রিপোর্ট নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল, ডোমকে টাকা দিতেই আসল অটোপসি রিপোর্ট চলে এলো, কিন্তু ডাক্তারের সই, সিল নেই! এটাও জোগাড় করাই যাবে!

নিলয় সাধারণত সিস্টেমের বাইরে যায়না, সে তামিল হিরো না! ফিটনেস থাকলেও সে একা এতজনের সাথে লড়ে পারবে না। আর সে কোনভাবে তার পরিবারের ক্ষতি হতে দেবেনা। সেই সাথে মিজানের পরিবারকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে, মিজানের বড় বোন মেঘনা আইসিইউ তে, খবর পেলেই মিজান ছুটে যাবে, এবং এবার হয়ত খুন হবে! কিন্তু একটা গ্রামের গরীব মেয়ের রেপ, মার্ডার হল, ঐ মেয়ের বাবার তেমন কিছুই করার ক্ষমতা নেই! তাহলে এরা এত ভয় পাচ্ছে মিজানকে? নাকি আরো ঘটনা আছে, নিলয় তার বিশ্বস্ত কিছু খবর সংগ্রাহক দের জানিয়ে দিল, খুব গোপনে কাজ সারতে হবে! অফিসে অনুপম ছেলেটা মনে হয় সাহায্য করতেও পারে, কথা বলার চেষ্টা করবে সে….

অনুপম, নিলয় একটা সাধারণ কফিশপে বসে আছে,
ওদের আগেই চ্যাটে ঠিকানা আদান প্রদান হয়েছে, কথার বিষয় বস্তু ও জানে অনুপম, শুধু নিলয়ের আসল পরিচয় জানেনা। ক্লোজড কেস নিয়ে আইনের কোন লোক কথা বলবেনা, আগ্রহী হবে সাংবাদিক তাও গতানুগতিক না! ট্যাবলয়েড সাংবাদিক, রং চং
মিশিয়ে অন্য আরেকজনের নগ্ন ছবি দিয়ে, লেখা ছাপাবে আসফির! এটাই বুঝেছে অনুপম, কিছু টাকাও পাবে সে, এতে সে কোন দোষ দেখছে না! সে ঐ রাতে ঐ তিন জনের সাথে গাড়িতে দেখেছে আসফি কে! এটা সত্য, মেয়ে ভালো হলে কি এমন হত? কালো টি শার্ট, আর নীল জিন্সে নিলয়কে কোনভাবেই আইনের লোক মনে হচ্ছে না, ইচ্ছা করেই সে একটু বেশি তরুণ সেজেছে!
কোণার টেবিলে বসা, ফর্সা স্লিম কিন্তু চোখের নিচের কালি, গর্তে চলে যাওয়া চোখ, খোচাখোচা দাড়ি, নিলয়ের পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি, এত দূর থেকেও সে বুঝে গেছে, এই ছেলের অনেক সমস্যা, তবে এর কাছ থেকে অনেক তথ্য বের করা যাবে বলেই মনে হচ্ছে, খুব বেশি গভীর জলের মাছ হলে টোপ গিলত না!

•হাই আমি নিলয়
•অনুপম, নিলয়ের বাড়ানো হাতে আলগোছে করমর্দন করল নিতান্ত অনিচ্ছায়।
•কোন সমস্যা বস? নিলয় পাড়ার পোলাপান সাজার চেষ্টা করছে।
•অনুপম নিলয়ের অভিনয় সুক্ষ্ম চোখে বোঝার চেষ্টাই করছে না!
•কেন ডেকেছেন?
•ঐ কেস, মানে ঐ ব্যাপারে কথা বলতাম আর কি….
•কোন ছবি আছে মেয়েটার?
•অনুপম পকেট থেকে ফোন বের করে, ছবি খুজছে, অফিসের প্রোগ্রামের ছবিতেই আছে।
•ফোনের কভার ভাঙা, ফোনের প্রতি কোন নেশা নেই? ভালো স্যালারির জব করে, তাহলে পোশাক, ফোনের ব্যাপারে সৌখিনতা নেই কেন? নিলয় ভাবছে।
•একটু পরে একটা হিজাব পরা ফরসা, হ্যাংলা পাতলা মেয়ের ছবি বের করে দিল অনুপম,
•হাত বাড়িয়ে ফোন নিচ্ছে নিলয়, হাত কাপছে কেন?
•বস ঠিক আছ?
•আই য়্যাম ফাইন বলে কপালে ঘাম মুছে নিল অনুপম, যদিও বেশ ঠান্ডা জায়গাটা, এসির শীতল বাতাস তাদের মাথার উপরেই….
•নিলয় বাইরে তাকালো, ঘসা কাচ তাও গ্রীষ্মের বিকেলে সূর্য বিদায় বেলায় সর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছে, যত আগুন তাপ আছে তার ভেতরে, যদিও বাংলা নতুন বছর এখনো আসেনি, শেষ রাতে পাতলা কাথা লাগে…. কাজ করতে এসে এসব সাহিত্য আওড়ালে চলে? অবশ্য এই সাহিত্য প্রীতির কারণেই মিতু আপুর সাথে পরিচয়, তার সবগুলো বই, বইমেলা থেকেই কিনেছে নিলয়, বাংলাদেশে এরকম লেখিকা খুব কম,
অনুপম নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে,
কফি এলো, অনুপম নিয়েছে কোল্ড কফি, আইসক্রিম আর চকলেটে ভরপুর! নিলয় ব্ল্যাক কফি খেলেও আজ লাটে নিয়েছে, নিজেকে অন্যরকম দেখাতে গেলে একেবারেই অন্যরকম করে প্রেজেন্ট করতে হয়।
•শুরু করুন। অনুপম বলল, গলা পরিস্কার করে।
•ঐদিন কি কি হয়েছিল?
•মিজানের প্রোমোশন সেলিব্রেশন পার্টি ছিল, আমরা একটু আগে বেরিয়ে পরেছি,
•আমরা কে কে?
•আমি, মিজান, রিফাত আর সিহাব।
•আচ্ছা! তারপর?
•আমরা উবার ডেকেছি, বারবার ক্যান্সেল করছিল শালারা, স্যরি ফর দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ!
•আরে কি বলেন?
•ঐ চারজন গাড়িতে করে, নিয়ে গেল আসফি কে….
•কোন চারজন?
•ফারহান শিকদার, কনক হাসান, আহসান হাবীব, নামগুলো কিন্তু আসবে না।
•হ্যা শুধু মেয়েটার নাম থাকবে। কিন্তু মেয়েটার কোন হট পিকচার তো দিন, নিলয় চোখে মুখে লাম্পট্য প্রকাশের চেষ্টা করছে৷
•নেই
•মানে? এত বাজে মেয়ে?
•না না! ও বাজে মেয়ে না। ওর ছোট বোন, অসুস্থ বাবা, ওর জবটা খুব দরকার ছিল, তাই বস যা বলেছে, ও তাই করেছে।
•আচ্ছা! দোষ বসের?
•না…… মানে হ্যা !
•আচ্ছা!
•মেয়ে খারাপ না হলে তো স্টোরি কাটতি পাবে না অনুপম দা! নিলয় বলে হতাশ কন্ঠে।
•আমিও জানি, এই স্টোরি কোন কাজের না আপনার জন্য, কিন্তু আমি বলতে এসেছি মন হালকা করতে, আমার বিয়ে ভেঙে গেছে, মিজান কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা….. সিহাব আর রিফাত ও খুব মুষড়ে পড়েছে।
•কেন?
•আমরা কেউ পুলিশের কাছে সত্যি কথা বলতে পারিনি। চাকরি হারানোর ভয়ে…. তাছাড়া আরো বিষয় ছিল, তা প্রকাশিত হত, যদি পুলিশ তদন্ত শুরু করত।
•কি বিষয়?
•আমি আরেকদিন বলব। ভীষণ জ্বর জ্বর লাগছে। আপনি কি একটু নামিয়ে দেবেন আমাকে?
•শিওর, চট করে উবার ডাকে নিলয়, বাইক টা রেস্তোরাঁয় রয়ে যায়, রাতে তার বাসায় দিয়ে যাবে, রেস্তোরাঁ মালিক তার বন্ধু, একেবারে বাসার ঠিকানা পেয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি নিলয়। খুশি মনে উবারে ওঠে দুজন। উবারের এসিতে গা এলিয়ে দেয় অনুপম। ছেলেটা আসলেই খুব অসুস্থ !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here