মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব:৬

0
436

মেঘের আড়ালে চাঁদ
(৬)

তারিকের মেয়ের আকিকা। অনেক সময় নিয়ে, খুব ভাবনা চিন্তা করে সালোয়ার কামিজ পরলাম, বের হতেই দেখি ফুল হাতে দাঁড়িয়ে মিজান, আমার যেন বুকের ভেতর ঝড় উঠলো! মিজান আমার চোখে চোখ রেখে ফুলটা আমার হাতে দিয়ে বলল,
বাবুর জন্য আমার উপহার, আমার তো আর…..
আমি কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম, ফুল আমিও ভালোবাসি! সে জবাব না দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, কতক্ষন হয়েছে জানিনা, সে চোখ সরিয়ে বলে, ওড়নাটা মাথায় দিন,গ্রাম দেশ!
আমি কথা মত ওড়না মাথায়, আকাশী নীল ওড়না, হালকা গোলাপি কামিজ। শিশির চলে যাওয়ার পর ধুসর হয়ে গেছিল পৃথিবীটা, মা একটু উজ্জ্বল রঙ পছন্দ করে, এটা মায়ের দেয়া , আমি মিজানের দৃষ্টি অনুভব করছি, সে গেটের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছে, তারিক বাইরে রিক্সা ডাকতে গিয়েছিল, এইমাত্র এলো, তারিককে উপেক্ষা করেই মিজান দেখছে আমায়, আকাশী নীল ওড়নাতে সাদা ফুল তোলা, মিজানের মন সাময়িক আকৃষ্ট, আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু না বলে এই সাময়িক সুখটুকু বুকে আগলে রাখছি, আবার যখন আমার জীবনে বসন্ত শেষ হবে তখনকার পাথেয়, এই ভালোবাসাটুকু বাকি জীবনের মরুদ্যানের তীব্র তৃষ্ণার জল….

রিক্সা থেকে নামতেই ঘিরে ধরে গ্রামের বৌ ঝিরা, তারিক আলগা ধমক লাগায় বৌকে, ভিতরে নিতে বলে আমাকে, গিয়ে দেখি আয়োজন সীমিত, কিন্তু আন্তরিকতা অপরিসীম, খুব ভালো লাগে আমার, তারিকের মা কে সালাম দিলাম, আমি পায়ে ঝুকে সালাম করিনা, এটা নিয়ে ফিসফিস শুনলাম। ফিসফিস শুনেই মেয়েরা বড় হয়, তবু যে কেন কান এগুলো শুনতে পায়? বুঝিনা! অ্যান্টিবায়োটিক এর মত রেজিস্ট্যান্ট হয়না কেন?

আমাকে নাম রাখতে বলা হল, বুদ্ধি করে, দায়িত্ব দিলাম তারিকের মা কে, তিনি তৈয়বা রাখলেন, আমি উচ্চারণ শুদ্ধ করে তাইয়েবা রাখলাম, ডাক নাম এটাই, স্কুলে দেওয়ার সময় বাকিটা ভেবে নেওয়া যাবে, আমার ঘুমের রুটিন কিছুটা শুধরে গেলেও পুরোটা ঠিক হয়নি, বারবার হাই উঠছে, একটা কাঠের চেয়ারে সটান বসে আছি সকাল থেকে, আয়োজন দেখছি, অথচ সংসারের এই আয়োজন আমি বুঝি না, কিন্তু সম্মান, ভালোবাসা বুঝি, তাই এক বাক্যে তারিকের দাওয়াতে চলে এসেছি, আজ মিজানের ঘুম দিবস, খাবার পাঠাবে তারিক।
কিন্তু আমি জানি সে ঘুমাবে না, আমার বইয়ের একটা করে কপি আনিয়েছে সে, এগুলো পড়ে নাকি সে আমাকে বুঝবে! আমি অবশ্য জিজ্ঞেস করিনি, আমাকে কেন বুঝতে চাও? ক্ষণিকের ভালো লাগা থেকে আমি নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইনা। ওর গাছের দেখভাল করবে, অনেকটা জায়গা জুড়ে মিজানের ফল আর সবজির গাছ বেড়ে উঠছে, আমার কথা ভুল প্রমাণিত করে, গাদা আর ডালিয়া গুলোও বেঁচে আছে!
তৌফিক কোথা থেকে কিছু পাতাবাহারের ডাল জোগাড় করেছে সেগুলো বোতলের জলে ভিজিয়ে রেখেছে আমার ঘরের এখানে সেখানে, রান্নাঘরের তাকেও!

–আফা চা! তারিকের স্ত্রীর হাত থেকে চা নিলাম। আমি নাম মনে রাখতে পারিনা। মেয়েটার নাম গতানুগতিক গ্রামের মেয়েদের মত না। লাবণ্য সম্ভবত, এত লোকের মাঝে যার মেয়ের আকিকা খেতে এসেছি তার নামই জানিনা! নিজেরই হাসি পাচ্ছে। চিনি বেশি দিয়ে আদা চা। বেশ লাগছে। লাকড়ির চুলার একটা বিশেষ গন্ধ। বাড়ি ভর্তি মেহমান, এলাকার মানুষ, আমাকে সবাই চেনে,
পিছনে গুনগুন শুনছি,

•বিধবা, একলা একলা থাহে, বাচ্চা নাই, বিয়া করে না ক্যা?
•কি কইতাম? হ্যায় বলে বই পুস্তুক ল্যাহে!
•পড়ার বই?
•নাহ, পেরেম পিরিত, বেহায়া মেয়ে মানুষ!
•তারেক ঐ ঘরের চাকরি করে, জোয়ান পুলা, হ্যারে ঘরে রাইখা ক্যামনে থাহে, বেডির শরম ও নাই।
•পুস্তুক লেইখা কি ট্যাকা পায়?
•নাইলে লিখব ক্যা?
•হ!
আমার কান ঝা ঝা করে উঠলো ,
আফা হাতের কাপ তো ঠান্ডা হইয়া গেছে, আরেক কাপ আনুম। আমার ঝাঝা করা কানে তসলিমার কথা যেন সুধা ঢেলে দিল। আপনে ভিত্রে বসেন। আসেন,
আমি চেয়ার ছেড়ে ঘরের ভিতর যাই, বাচ্চার দাদী আচ্ছামত তেল মালিশ দিয়েছে,
•খালাম্মা ডাক্তার কি মানা করেনাই?
•দুই দিনের ছেড়ি কি বুঝে?
•বই পুস্তক পড়ে কিছু তো বুঝেই মানা করছে আম্মা। তারিকের বৌয়ের ক্ষীণ কন্ঠস্বর৷
•দেখ বৌ, বেশি বুইঝা কাম নাই তোমার, মাইয়া আমার কোলে আছে যাও তুমি, পাক শাক শেষ কইরা ডুব (গোসল) দিয়া আস। আমার কি ডুব দিয়া নামাজ পড়া লাগব না?
•জি আম্মা যাচ্ছি।
আমি ভাবছি, যখনই মানুষ যুক্তিতে পারেনা, তখনই চলে গলার জোর, এবার মিজানের যুক্তির সাথে আমাদের কন্ঠস্বর ও যুক্ত হয়েছে , এই যুদ্ধ আমাদের জিততেই হবে….

নিলয় বাসায় এসে দুটো অমলেট করে, এক মগ ব্ল্যাক কফি নিয়ে টিভির রিমোট হাতে এলোমেলো টেপাটেপি করে, ক্লান্ত হয়ে খেয়ে ঘুমানোর আয়োজন করল, ঠিক তখনই ফোন। সে অন ডিউটি না, তবুও তাকে কেস সিমিলার বলে ক্রাইম সিনে ডাকছে সাব ইন্সপেক্টর রুদ্র৷
নিলয় তড়িঘড়ি করে বাইকের চাবি নিয়ে, বাসা লক করে নেমে গেল, পুলিশ স্টেশনে ওরা রেডি, নিলয় যোগ দিতেই ক্রাইম সিনে হাজির হল, মেয়েটার শরীরে একটা সুতোও নেই, তবে তেমন কিছু পাবেনা, ভয়ংকর ভাবে পচন ধরেছে, ব্রুটালি রেইপ উইথ মার্ডার! ফরেনসিক টিম আগেই কাজ শুরু করেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে, মেয়েটার লাশ কে আগে দেখেছে, এত রাতেই কেন এটা উদঘাটন হল?

প্রতিবেশীরা কমপ্লেইন লিখিয়েছে তিন দিন আগে, অসম্ভব বাজে গন্ধ আসছে এই ফ্ল্যাট থেকে, কিন্তু কেউ আসেনি, কেবল অপারেটর কোম্পানির লোক আজ তারের জটলা খুলতে দড়ি বেয়ে বিল্ডিংয়ে উঠেছিল , সেই দেখে, কেবল ঢুকানোর ছিদ্র দিয়ে দুর্গন্ধ যুক্ত তরল বের হচ্ছে, সেটা বাকি কেবলেও লেগে গেছে, আঠালো এই দুর্গন্ধ যুক্ত তরল আর কিছুই না, এই মেয়েটার লাশ থেকে বের হওয়া তরল…. জানায় রুদ্র।
•কিন্তু এত রাতে কেন?
• দারোয়ান নাকি জানালায় কাউকে দেখেছে, বারবার কলিং বেল চাপছিল কিন্তু বরাবরের মতই কেউ দরজা খোলেনি, কিন্তু এই হই হুল্লোড়ে পাশের বিল্ডিংয়ের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ঐ দারোয়ানের নামে পুলিশ কমপ্লেইন করতে গিয়ে দেখা যায়, আগেই কমপ্লেইন এসেছে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে, কিন্তু পাত্তা পায়নি।
•কি যে অবস্থা….
•মানুষ ফানি কল করে। কি করা যাবে। মিসিং কমপ্লেইন ছিল না, এই এলাকায়
•তাও দায়িত্ব এড়ানো যায়? যাই হোক। মেয়েটার আত্মা শান্তি পাক।
•তা আর পাবে কিভাবে?
•কেন?
•রুদ্র টেনে সরায় নিলয়কে বলে,
সে জন্যই আপনাকে ডাকা, কি যে করি….

•ঐ বাসায় রাতেও কেউ গিয়েছিল, রেপ তো আগেই হয়েছিল, তারপর কি লাশের সাথেও…..
•না, এত পচা লাশের সাথে সম্ভব না, কেউ প্রমাণ মেটাতে যেতে পারে, মেয়েটার মুখে কিছু দিয়েছে, মুখের পচন ক্রিয়া দ্রুত, শরীরের তুলনায়, বাকিটা ফরেনসিক তদন্তের উপর নির্ভর করছে…..
•হুম, কিন্তু এই প্রেসার…. কি যে করি।
•পিছনে হোমড়াচোমরা কেউ আছে। দেখ যতটা পার….
•আপনার কেসের অগ্রগতি কি ভাই?
•আমার কেস এখন জাতির হাতে!
•মানে?
•দিল্লির জ্যোতি সিং মানে নির্ভয়ার কেসের মত যদি পুরো দেশ জ্বলে ওঠে তবেই সম্ভব৷
•হুম! হুজুগে বাঙালি, কি শেয়ার করা উচিত, কোনটা সত্যি মিথ্যা সেটাই বোঝেনা!
•যেটা দরকার তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। তুমিও দেখি আমার মত সততার বলয়ে আটকে যাচ্ছ!
•নাহ! এই ডিপার্টমেন্ট ১০০% সৎ থাকতে দেয় কই, চেষ্টা করছি, সেদিন বাসায় বিশাল শোল, বোয়াল, হাওড়ের মাছ প্যাকেট করে কুরিয়ার করেছে কে যেন, মা আর ভাবী মনে করেছে আমি অর্ডার দিয়ে ভুলে গেছি, তারা আরামসে রান্না করেছে, পরে আমি ফিরে মাথায় বাজ!
•হাহা! ভালো তো!
•পরে বকা দিলাম, আমাকে না জানিয়ে কোন পার্সেলে যেন হাত না দেয়!
•কে দিয়েছে জানতে পারলে?
•আরে এলাকার এক বুড়ো ভাম, এই বয়সে কল গার্ল বাসায় এনে…. বৌ বাপের বাড়ি গেছিলো, বৌ তো হাতেনাতে ধরে কেস করবে, জেলে পুরবে! আমাকেই ডেকেছিল মহিলা ,আমিই মিটমাটের ব্যবস্থা করি। ভদ্রলোক স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়েছে, এই ধরনের কাজে আবার জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে যাবতীয় সম্পত্তি তার স্ত্রীর!
•হা হা হা হা….
•হাসি থামাতে পারছেনা নিলয়, একটু সামনেই একটা লাশ, ডাক্তার দেখলে তাদের দুজনকেই পাগলাগারদে পুরে দিত।
• তারপর?
•কি আর? দুজনেই খুশি!
•সেই বুড়ো মাছ পাঠালো?
•আরে নাহ তার বৌ!
•জব্বর কেস শোনালে ভাই, মাছটা উপহার! ঘুষ না!কিন্তু এটার কি করবে?
•উপর থেকে চাপ আসছে, আত্মহত্যা বলে, কেস ক্লোজ করতে।
•হুম
•ভাই এই কেস সলভ না করে, আমার ঘুম আসবে না।
•হুম! না আসাই উচিত। তুমি সব ডাটা কালেক্ট কর, মেয়ের মোবাইল পেলে?
•না, নেই
•তাহলে খুনি মোবাইল নিতেই এসেছিল।
•হতে পারে
•নম্বর জোগাড় করে অপারেটর কে দিয়ে সব ডাটা দ্রুত দিতে বল
•আর ফরেনসিকের সুমনকে রিপোর্ট তৈরি করতে বল।
•আচ্ছা ভাই।আপনি বাসায় যান, আমি এদিকটা দেখি, আর সুমনকে একটু বলে দিয়েন।
•আচ্ছা আমি কল দিচ্ছি, গেলাম তাহলে
•জি ভাই
পকেটে অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে, আরে রহমত আলীর কল। মিজানের পরিবার কে দেখার জন্য যে কনস্টেবল নিয়জিত।
•হ্যালো
•স্যার আসসালামু আলাইকুম
•ওয়া আলাইকুম আসসালাম।
•স্যার একটা দুঃসংবাদ আছে
•কি?
•স্যার মিজানের বোনের অবস্থা খুব খারাপ, মিজান কে কি জানাবেন?
•উহু, আমি মিতু আপুকে জানাই, দেখি ওখানে পরিস্থিতি কেমন। কোন সমস্যা হলে রাত যতই হোক তুমি আমাকে কল করবে।
•আচ্ছা স্যার।
ফোন কেটে অন্যমনস্ক হয়ে হাটছে নিলয়। ভোরের আলো ফুটেছে, লিফট চালু ছিল না আসার সময়, এখন চালু পেয়ে উঠে গেল, খুব অভিজাত ফ্ল্যাট মেয়েটির…. একা থাকত? নাকি তার সঙ্গীই খুন করে পালিয়েছে? পকেটে ফোন বাজছে,
ইন্দোনেশিয়া থেকে বাচ্চারা ভিডিও কল দিয়েছে। বেড়াতে বের হওয়ার আগে ওরা কল দেয়, বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে ,পুলিশের গাড়িতে বাসায় ফেরে নিলয়,
বাসায় ফিরে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে, দিনের ভারি মিলটা খায়, ওটস ভিজিয়ে , কফি মেশিন চালিয়ে দিল, ফ্রুটস সালাদের উপকরণ সাজিয়ে চপিং বোর্ডে ঝড় তুলে দুই মিনিটে বিশাল এক বোল ফ্রুটস সালাদ বানানো শেষ, ওটস ভিজে গেছে এক চামচ মুখে নিয়ে, কফি ঢেলে নিল, মিতু আপুর পাঠানো ঘটনা, আর তার নিজের জোগাড় করা উপাত্ত সাজাচ্ছে, মিজানের মনোবল একবার ভেঙে গেলেই শেষ! আর দাড় করানো যাবেনা। সম্ভবত মিজানের বোনের খারাপ কিছু হয়েছে, নাহলে ভোরে কল দেয়ার মানুষ না রহমত।

নিলয়ের একবার মনে হল না, রহমতকে কল দিয়ে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতে, হয়ত জানতে পারত, বাচ্চাটাও আর নেই, মা, বাচ্চা কাউকেই বাচানো যায়নি।

( চলবে)

প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
কিছু লিখুন ☹️
ভালো লাগছে কিনা, কিভাবে বুঝব?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here