মেঘের আড়ালে চাঁদ
(১৪)
আকাশ ভেঙে মুষলধারে যেমন বৃষ্টি পড়ে ঠিক তেমনই আমার মনের ভেতরের আকাশ বিদীর্ণ হয়ে অঝোর ধারায় কান্না ঝরছে, আমি ভালোবাসলাম তাও এমন একটা মানুষকে?
একটা খুনিকে? খুনের সহযোগী কে তো খুনিই বলে তাইনা?
অথচ যখন ভুলের বয়স অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের অন্য ডিপার্টমেন্টের শিশির যখন আমার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে চিরকুট পাঠাতো, আমি এত এত প্রতিবন্ধকতা জেনে প্রথমে ও কে ফিরিয়ে দেই, আমার অনার্স শেষ পরীক্ষার দিন সে আমায় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়, মাঝে আমার সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টা করেনি, সেদিন রাতেই ওর বাবা আসেন আমাদের বাড়িতে, আমার বাবা তখন বেঁচে ছিলেন, গরীবের বাড়িতে হাতির পা বলে মনে হচ্ছিল, বাবা কোথায় বসতে দিবেন, কি খেতে দিবেন হুলুস্থুল কান্ড!
শিশিরের বাবা বসলেন, শান্ত কন্ঠে আমাকে ডেকে পাঠালেন,
আমি বিনা সাজে তার সামনে গেলাম, মা খুব চেষ্টা করেছিল শাড়ি পরাতে কিন্তু পারেনি…..
আমি সালাম দিয়ে বসলাম তার সামনে,
•শিশিরকে ভালোবাসো
•দেখুন….
•কোন ব্যাখ্যা না! এক শব্দে উত্তর, হ্যা অথবা না!
•হ্যা!
•তাহলে এতদিন ওর সাথে এমন ব্যবহার কেন করেছ?
•আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক পার্থক্যের জন্য।
•এসব কি ভালোবাসার চাইতে বড়?
•আমার মা বাবার সম্মানের কাছে সব তুচ্ছ, আমিও তুচ্ছ
শিশিরের বাবা আর একটা কথা না বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক জোড়া বালা বের করে আমায় দিলেন।
•পরে নাও মা। আমার বাবা কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
মেয়ে আজ থেকে আমার। আমার ছেলেটা সবে পাস করল, আমার টাকার অভাব নেই, কিন্তু আমি চাই এরাও জীবনে কিছু করুক। তাই অন্তত ছয় মাস শিশির আমার কোম্পানি তে কাজ করুক, তারপর বিয়েটা হবে।
•আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মা রে এবার একটু আমার পাগল ছেলেটার সাথে কথা বার্তা বলিস। আমি জানিনা সেদিনও আমি এভাবেই কেঁদেছিলাম! পাগলী মা আমার বলে আশীর্বাদ করেছিলেন বাবা। আমার দুই বাবা দুই দিক থেকে আমার কান্না সেদিন মুছে দিয়েছিলেন।
তার কিছুদিন পর জানলাম শিশিরের মায়ের মত নেই এই বিয়েতে, আমি হন্য হয়ে চাকরি খুজছি, শিশির মন দিয়ে ব্যবসা সামলাচ্ছে, বাচ্চাদের পত্রিকায় চাকরি পেলাম। ছড়া লিখতে হবে, প্রুফ দেখতে হবে, সামান্য বেতন, কিন্তু আমার কাছে অসামান্য সম্মানের। ক্লাসের অনেকেই মাস্টার্সে ভর্তি হল, আমি চাকরি তে লেগে রইলাম, কথা অনুযায়ী ছয় মাস পর আমাদের বিয়ে হয়, শিশির কাজে প্রচুর মেহনত করে, আমরা অসাধারণ একটা হানিমুনে গিয়েছিলাম……
আর আজ? এ কি ভুল হল আমার দ্বারা? নিলয় বলল এটা একটা হাইপোথিসিস মাত্র। মোবাইল কোম্পানির সাহায্য ছাড়া প্রমাণ অসম্ভব। কিন্তু মোবাইল অপারেটররা পুলিশকে অবশ্যই সাহায্য করবে। একদিন ঐ গ্যাং ধরা পড়বেই, সাথে মিজান ও….. কেন এটা করতে গেল ও? জানের বদলে জান! এত সহজ? কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে গেছি, ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে বাবার কল,
•মারে কেমন আছিস?
•এইত….
•এমন শোনাচ্ছে কেন গলা?
•কিছু না বাবা, ঘুমিয়েছি দেরিতে
•আচ্ছা , যা বলতে ফোন করেছি, তোমার মা আর বাকিদের নিয়ে আমরা দু চার দিনের মধ্যেই চলে আসব। বিয়ে পড়াতে, তোমার ভাবী সব শপিং ও করে ফেলেছে, আর মিজানের বাবার সাথে আমি কথা বলেছি, অমায়িক মানুষ, এ জন্যই ছেলে এত চমৎকার! কিছু বল মা?
•আপনি খুশি?
•আরে কি বলিস? এতটা বছর ধরে আমি শিশিরের অর্পণ করে যাওয়া দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি, এত বছর পর দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাব…. হাহা!
•কি যে বলেন বাবা
•মা রে তুই সুখী হবি । দেখে নিস এই বুড়ো বাপের কথা, মিলিয়ে নিস। আল্লাহ সব সুখ জমিয়ে রেখেছিলেন, এখন সব সুখ তুই পাবি।
•বাবা? আমি কি ভুল করতে যাচ্ছি? শিশিরের আত্মা কি কষ্ট পাবে বাবা?
•পাগলী মেয়ে আমার! ওর আত্মা ভীষণ খুশি হবে, যে খুশি, যে সুখ থেকে তুই এত বছর নিজেকে দূরে রেখেছিস, এবার সব সুখ, সব খুশি লুটিয়ে পড়বে তোর পায়ে…. তোর মনে আছে? তোকে দেখতে যাওয়ার দিন কিরকম পাগলের মত কাঁদলি?
•হ্যা বাবা
•এবার কাঁদিস না একদম
•জি বাবা
•তুই সুখী হবি
•তাই যেন হয় বাবা….
মিজান তলে তলে সব নিজের পক্ষে করে নিয়েছে, এখন চাইলেও আমি মুক্তি পাব না, কিংবা ঐ সংগঠনেরই প্ল্যান এটা, আমি যাতে মুখ না খুলি, এভাবে বারবার আমার ভালোবাসার পরীক্ষা কেন দিতে হয়? একবার বিয়ের দুই বছরের মাথায় হারালাম শিশির কে এবার মিজান হল খুনের সহযোগী!
নিলয়কে ফোন করলাম,
•হ্যালো
•আপু অনেক অনেক শুভকামনা!
•আমাকে আশরাফুন্নেসার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে?
•আরে আপু, আমি আপনার বিয়ের জন্য ছুটির জন্য দৌড়াচ্ছি, আংকেল, এমনকি শিমুল ভাই পর্যন্ত বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত! আর আপনি আছেন ঐ কেস নিয়ে?
•এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতেই আমাকে দেখা করাও
•বেশ কাল ভোর চারটায় তৈরি থাকবেন, তপু যাবে, আপনাকে দেখা করিয়ে আনবে, আমি মুভ করলে আর ছুটি পাব না।
•তোমার ধারণা বিয়েটা হচ্ছে?
•হবে ইন শা আল্লাহ, আপু।
•আচ্ছা, আমি তৈরি থাকব।
পরদিন রাত আড়াইটায় এলো তপু, ডিউটি সেরেই গাড়িতে উঠেছে, তাকে ঘুম আর বিশ্রামের জন্য একটা কটেজ খুলে দিল শোভন, মিজান জেগে ছিল, খুব অবাক হল,
•কি ব্যাপার? তপু ভাই? এখানে?
•একটু বের হব।
•আমাকে তো বললেন না, পুরো দিনেও
•ও আসতে পারবে শিওর ছিলাম না
•আচ্ছা
কোথায় যাব জিজ্ঞেস করল না মিজান, তপু ফ্রেস হয়ে বের হলে গল্প করতে করতে রাতের রিসোর্ট দেখিয়ে আনল, তপু বেশ জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করে রওনা হল। আমি ভেবেছিলাম মিজান কিছু বলবে, কিন্তু সে আমাদের বিদায় দিয়ে ঘুমাতে চলে গেল।
আমরা নারায়ণগঞ্জ এর বেশ ভিতরে এসেছি, সকাল সাতটা বাজে, সবুজ পাতার আড়ালে সকালের সূর্য কিরণ খেলা করছে, গাড়ির দুলুনিতে ঘন্টা দুয়েক নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আমার বেশ ফুরফুরে লাগছে। বাসাটা খুব ভেতরে, তপুর বারবার শুনে নিতে হচ্ছে, অবশেষে আধাপাকা বাড়ির সামনে আমরা পৌঁছে গেলাম, পুরাতন আধময়লা জামা পরা তিনটা মেয়ে উঠানে,
ছোটটা মুড়ি খাচ্ছে আর মাটিতে ফেলছে, মেঝজন উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে আর বড় খড় দিয়ে মাটির চুলায় ভাত রান্না করছে। চালের উপর আম গাছে আম ঝুলে আছে, সকল জীর্ণতার সাথে যেন একাই যুদ্ধ করছে আম গাছটা, মেঝজন এগিয়ে এলো,
•আপনারা?
•তোমার মাকে ডাক ,তপু জবাব দেয়
আমরা বিধবা মানেই সাদা থান বুঝি, কিন্তু অন্তরের শূন্যতা বোধহয় সাদা শাড়িতে না প্রকাশ হয় চোখে, মহিলা যে প্রথম সন্তান আর স্বামী হারিয়ে নিঃস্ব তা তার চোখেই স্পষ্ট, উনি বাইরে এসে আমাদের ঘরে যেতে বলেন, দুই ঘরেই চৌকি পাতা। আসবাব তেমন নেই, বাশের আলনা মত, তাতে কিছু পুরাতন কাপড়, থালাবাসন মেঝেতেই রাখা, একটা টেবিলে কিছু বাচ্চাদের বই, আমি আর তপু চৌকিতে বসলাম,
কিছু খাবার, ফলমূল এনেছিলাম, আশফির মা আবার রাগ করেন কিনা সেটা ভেবে খুব বেশি কিছু আনিনি, শ্রীমঙ্গলের চা পাতা ছিল, উনি বললেন ভাত হয়ে গেছে, চারটা ভাত তাদের সাথে খেয়ে নিতে৷ আমরা সম্মতি দিলাম। খেয়েদেয়ে বসলাম, বড় মেয়ে চা আনল।
•ও ফয়জুন্নেসা আমার মেঝ মেয়ে, বললেন আশফির মা
আমার তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল আমি এতক্ষণ ওকেই বড় ভেবে এসেছি ! আসফির কথা ভুলেই গেলাম?
•কেউ আসেনা বড় একটা, বলা ভালো আমিই চাইনা কেউ আসুক, যে ঝড় গেছে, যা হারিয়েছি তা ফিরে পাবো না, আমার মেয়ের অসম্মান হোক সেই কাজ আমি আর করব না।
•আমি কেস রিওপেন করতে অনুরোধ করতে আসিনি। শুধু আপনারা কেমন আছেন সেটা সচক্ষে দেখতে এসেছি, কেসের জন্য মিজানের ও অনেক ক্ষতি হয়েছে, আর নতুন করে, এদেশে কি বিচার হবে?
•বিচার তো হয়ে গেছে….! শুনেছি আপনার আর মিজানের বিয়ের কথা চলছে ?
•হুম
•কি কপাল করে জন্মেছেন! যে ছেলে পাড়াতো বোনের জন্য এত দুর্ভোগ পোহালো, সে নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য পুরো বিশ্বের বিপক্ষে দাড়াতে পারবে!
•বিচার করার জন্য আইন আছে, আদালত আছে…
•আমি জানি আপনি কি বলতে চাইছেন, আমিও দেখেছি এক দোকানদারের মোবাইলে ,ঐ লাশ, কি বিভৎস…… কিন্তু আমার মেয়েটাকে আমি ফিরে পাব? পাব না। কিন্তু যদি একটা রেপ, একটা খুনও কমে তাতেই আমি খুশি।
•মিজান কি এসবের সাথে জড়িত?
•আমি পুরোটা জানিনা৷ তোমার আংকেলের সাথে কারা যেন কথা বলত…. সে এসে একদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, তারপর আবার হাসল, হেসে বলল, আমার মেয়েটা ফিরবে না, কিন্তু দেখ আগামী ছয় মাস এই হায়েনাদের বুক কাঁপবে কোন মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে!
•তারপর?
•উনি আমাদের গ্রামে পাঠালেন, বাচ্চাদের পরীক্ষার উসিলা করে, কিন্তু গ্রামে এসে শুনি পরীক্ষার দেরি আছে, সেটা শুনে বোনের বাড়ি যাই, ওখানে আশরাফুন্নেসার ঘর, জামা, পুকুর পাড়ে বসে ওর বিকেল গুলো….. জানো বিকেলের কনে দেখা আলোয় আমার মেয়েটাকে অপুর্ব লাগত….. কি ভীষণ মিষ্টি ছিল আমার মেয়েটা…..
জড়িয়ে ধরলাম ভদ্র মহিলাকে, উনি হু হু করে কাঁদলেন মেয়ে তিনটাও হাজির, ওদের চোখেও পানি!
কিছুক্ষণ পর সুস্থির হয়ে আমাকে একটা শাড়ি বের করে দিলেন, বেশ দামী!
•এটা নেবে? আমার আশরাফুন্নেসার পাত্র দেখার আগে কেনা, ও পরেনি কোনদিন, ওর বাবা স্বল্প আয়ের মানুষ, অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে শাড়িটা কিনেছিল…..
•নিশ্চয়ই পরব।
•উনি শাড়ি ভাজ করে আমার মাথায় দিয়ে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, অনেক সুখি হবে মা। তুমি করে বলে ফেললাম।
•মা তো মেয়েকে তুই তুমি করেই বলে, আপনি যা বলতে চান বলুন, কোন সমস্যা নেই।
•আরেকটা কথা, যদি পার আমায় কোন কাজ দিও, কিন্তু এভাবে টাকা, খাবার দিও না,
•আচ্ছা
•কিছু মনে করলে না তো?
•না মা, আমি কিছু মনে করিনি। আজ থেকে আমি আপনার বড় মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেবেন।
•অবশ্যই দিব মা।
•আমি গাড়ি পাঠাবো। কার্ড তো নেই, আর মা কে কিসের কার্ড?
•ঠিক বলেছ মা
• বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসবেন, আমি গাড়ি পাঠাবো।
•আচ্ছা মা!
ওরা চারজন আমাদের গাড়ি পর্যন্ত বিদায় দিতে আসল, যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়, দাঁড়িয়ে রইল। আমরা সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম। তপু রাত এখানেই কাটাবে সিদ্ধান্ত নিল। আমরা অনেক রাত অব্দি আড্ডা দিলাম। মিজানের সাথে কদিন হল কথাই বলিনি, আজ এত হালকা মনে কথা বলতে দেখে মিজান খুব অবাক হল। আমারও বিশ্বাস আমি সুখি হব।
(চলবে)