মেঘের আড়ালে চাঁদ
(৯)
রাত তিনটা,
আজ কোর্টে শুনানি ছিল। আমি ভেবেছিলাম ক্লান্তিতে ভেঙে আসা শরীর, ঘুম আসবে খুব সহজেই কিন্তু তা হয়নি, বরং সারাদিনের অবসাদ যেন আরো চেপে বসেছে আমার উপর, বিছানায় এ পাশ ও পাশ করছি, ঘুম আসছে না, কোর্টের কথা গুলো কানে বাজছে,
উকিল কি তীব্র কন্ঠে মিথ্যে বলে গেল!
আসফি আর মিজান কে জড়িয়ে…. ছি ছি!
কোর্টে,
•উকিল : এই লেখিকার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
•মিজান : আমাদের বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই।
•উকিল : তাহলে তিনি এত সাহায্য কেন করছেন? এক ছাদের নিচে কোন ভিত্তিতে বসবাস করছেন?
পক্ষের উকিলের অবজেকশন ওভার রুলড হল!
•মিজান : উনি পাবলিক ফিগার। সচেতন নাগরিক, একজন নারী হিসেবে তিনিও একজন নারীর জন্য বিচার চান।
•উকিল : এই লেখিকা, পাবলিক ফিগার?
•মিজান : আপনারা পাবলিক ফিগার মনে করেন নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকা, খেলোয়াড়দের। যারা দেশে সামান্য সমস্যা হলেই পাড়ি জমায় বিদেশে, দেশের ভালো মন্দে কোনভাবেই তারা জড়িত থাকেনা। তারাই আপনার কাছে পাবলিক ফিগার। অথচ যাদের লেখা পড়ে মানুষ হাসে, কাঁদে, অনুপ্রেরণা পায়, তারা পাবলিক ফিগার না? অদ্ভুত ব্যাপার।
•উকিল : লেখিকার সাথে থেকে থেকে ভালো কথা শিখেছেন! তা বলুন কতদূর এগিয়েছে সম্পর্ক? শুধু এক ছাদ নাকি এক বিছানাও?
এবারের অবজেকশন সাসটেইনড হল। আমার পাশে শিমুল ভাই বসা। তিনিও লজ্জায় মুখ উঁচু করতে পারছেন না, আমি কিভাবে বের হয়েছি কোর্ট থেকে জানিনা ,শিমুল ভাইয়ের বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে করে পৌঁছে দিলেন পূর্বাচলের বাড়িতে, রাস্তায় কারো সাথে কথা বলিনি।
শিমুল ভাই গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলেন,
বাজার লাগবে কিনা, মিজান খুব সহজ গলায় লিস্ট করে দিল।
রান্নার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাধে নিয়েছে মিজান। ওর দ্বারা ম্যাগি সিদ্ধ, আর চা খেয়ে বেচে থাকা সম্ভব না!
শিমুল ভাইয়ের ড্রাইভার জিনিসপত্র এনে দিলেই উনি চলে গেলেন, এতক্ষণ সিকিউরিটি গার্ড কে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন, সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেন। নিলয় ছিল, কিন্তু ও বাসা পর্যন্ত আসেনি।
শিমুল ভাই, যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
•কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছ জানো?
•না!
•বাংলাদেশের অন্যতম বিজনেস টাইকুন আশরাফ শিকদারের ছেলে ফারহান শিকদারের বিরুদ্ধে!
আমি জানিনা কি আছে আমাদের কপালে। বাবা তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করে , তাই আমিও জড়িয়ে গেলাম এসবে, জানিনা এর ফলাফল কি হবে…
•সিমি আর ভাবিকে কোথাও পাঠিয়ে দিন
•হ্যা, তোমার কেস রিওপেনের আগেই ওরা বিদেশ চলে গেছে। আমি তোমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি।
•ভয়ের কিছু নেই ভাইয়া। কিছু একটা তো হবে, সর্বোচ্চ মৃত্যু!
শিমুল ভাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। আমি উনার ভেতর আমার বড় ভাইয়ের ছায়া পেলাম। তিনি সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন বলেই নিজেই চলে এসেছেন, গাড়ি পাঠালেও পারতেন। তা করেননি।
আমি উঠে বসে আছি, ভেবে ভেবেই রাত পার হল,
ধীরে ধীরে পুব আকাশ ফরসা হতে শুরু করে আমি লাগোয়া বারান্দায় দাড়াই, কি মিষ্টি বাতাস…. সাদা, হলুদ, গোলাপি বাগান বিলাস ঝুলছে বারান্দাময়, এখন আকাশে এক সাথে চাঁদ আর উদীয়মান সুর্য, আমার জীবনের হারানো চাঁদের খোঁজ কি আমি পাব?
বেলা এগারোটা খাবার টেবিলে,
নিলয় এসেছে, ও নাস্তা কিনে এনেছে, মিজান এক কাপ চা করেছে নিজের জন্য, আর আমাদের জন্য ব্ল্যাক কফি আছে কফি মেকারে, নিলয় ও কোন কারণে ঘুমায়নি কাল ও সেও বারবার হাই তুলছে, নিলয় বলল ,
•কোর্টে এখন কাঁদা ছোড়াছুড়িই হবে, উকিলদের কাজই ঐ, আসামি একটাও আসেনি, মিজান প্রতি শুনানিতে যাবে, আর বাজে কথা শুনে আসবে…..
•এটাই হবে? বিচার হবেনা?
•আপু বাস্তবতা যে কি….. আস্তে আস্তে জানবেন।
মিজান উঠে গেল, ওর কল এসেছে।
•ওর ফোন ব্যবহার করার কথা না। নিলয় বলল
•গার্ডের নম্বরে ওর পরিবারের কেউ খোঁজ করছে বোধহয়।
•ও হ্যা, ভালো কথা, গত সপ্তাহে কিছু টাকা আমি মিজানের নাম করে পাঠিয়েছিলাম, বড় বিপদে আছে ওর পরিবার।
•আমি চেক লিখে দিচ্ছি, আরো কিছু পাঠিয়ে দিও
•কিন্তু এভাবে কতদিন?
•দেখিনা কতদূর জল গড়ায়….
•বেশ, যা ভালো মনে করেন। সবকিছু কোর্টে জমা দিয়েছি, সারা দেশ উত্তাল, তাও যদি বিচার না হয়….
•হাল ছেড়ো না।
•আসি আজ। আপনার লাইভের বক্তব্য সাজিয়ে আমাকে মেইল করুন। আর সাংবাদিক সম্মেলনে ও কি কি আলোকপাত করবেন সেটা গুছিয়ে নিন। আর হ্যা, এরাও বড্ড খারাপ, প্রচুর অশালীন প্রশ্ন করবে। একদম নার্ভাস হবেন না। আমিও থাকব।
•করুক। আমিও শেষ দেখতে চাই।
•হুম। গুড লাক।
গুড লাক! আসলেই গুড লাকের দরকার আমার ! নিলয় চলে গেলে রুমে এসে ভাবলাম, গোসল করলে হয়তো ভালো লাগবে, শিমুল ভাইয়ের সব কাজ ভীষণ পরিপাটি, ওয়াসরুমে সাবান, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল, কন্ডিশনার সব আছে, আমি কিছুই গুছিয়ে আনতে পারিনি। এখানে এসে নিজের বাসার মতই লাগছে, এর মধ্যে দুই বার জায়গা পরিবর্তন হল, পানি পরিবর্তনেই আমার হাচি হয়, খুব চুল ভিজিয়ে গোসল করতে ইচ্ছে করছে, পরে কি ভেবে চুল পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে খোঁপা করে গোসল করে, বিছানায় উপুড় হলাম, সংবাদ সম্মেলনে কি কি বলব পয়েন্ট করতে গিয়ে মনে হল, ল্যাপটপই ভালো! হাতের লেখা এত বাজে আমার!
চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি। মিজান তিনটায় ডাকল, সে টিভি দেখছে, চুলায় রান্না বসানো, আমি নামাজ পড়ে বের হলাম,
একটু পর গরম ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, ডাল শুটকি, আরেকটা কোন একটা শাক হবে আমি চিনতে পারছি না! নিয়ে এলো, সবকিছু থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে , নিজেও বসল, আমাকে বেড়ে দিয়ে নিজেও নিল, একটু ইতস্তত করে কথা শুরু করল মিজান,
•আমার মনে হয়, আমাদের কথা হওয়া উচিত।
•হুম, বল
•কাল থেকে আপনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন, রাতে খাবার খেলেন না, কোর্টে এসব কথা হতে পারে আপনি তো আন্দাজ করেছিলেন।
•কিন্তু এখন মানতে পারছি না।
•কাঁদা ছোড়াছুড়ি হবেই, আমারও মান সম্মান কিছু থাকবে না!
•হুম!
•আপনি কি ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবছেন?
•কোন ব্যাপার?
•এই যে আমরা, এক সাথে আছি….
•আমরা তো জানি, আমরা ভুল কিছু করছিনা, তাছাড়া কোর্টে ঐ উকিল যেভাবে বলল, আমরা কখনো কোথাও সেভাবে থাকিনি
•উকিলের কথার জন্য না !
•তাহলে?
•আমাদের জীবন তো এই এক কেস ঘিরে না!
•আমরা কেস না জিতলেও আমাদের জীবনে এগিয়ে যেতে হবে,
•হ্যা, তা হবে
•আমি আপনার যোগ্য না, কোন দিক দিয়েই না, কিন্তু আপনি যদি একজন সঙ্গী চান, একটা কাধ চান মাথা রাখার জন্য…. আমি….
•আমি হতবাক, মিজান আমার মনের কথা কিভাবে জানল? ও কি আমার মত ফিল করে?
আমার গাল লাল হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে খাচ্ছি,হঠাৎ ওর ফোন এলো, সিকিউরিটি আজাদ কাকা ওকে ডাক দিল, ও এঁটো হাতে ভাত ফেলে উঠে চলে গেল, মিজানের প্রায়ই ফোন আসে। কিন্তু বাসা থেকে এত কল তো করত না আগে, আমি সন্দেহ বাতিক না, কিন্তু প্রিয় মানুষের জন্য বোধহয় একটু সন্দেহ বাতিক হতে হয়। শিশির অনেক মেয়ের ক্রাস ছিল, ব্যবসায়ী পরিবারের সুদর্শন যুবক, এই নিয়ে কম অশান্তি করতাম না…. শিশিরের স্মৃতি আর মনের ভেতর কষ্টের অনুভূতি সৃষ্টি করে না, বরং অদ্ভুত পরিপূর্ণ অনুভূতি দেয়।
কল শেষ করে প্রায় আধাঘন্টা পর এলো মিজান, চোখ মুখ শক্ত, আমি অপেক্ষা করছিলাম ওর কথা শেষ করার, কিন্তু ও কঠিন মুখে খাবার ফ্রিজে তুলে রাখল , মেশিনে কাপড় দিল, ঘরের বাকি কাজ গুলো নিপুণ হাতে করে যাচ্ছে, আমি বসে দেখছি আর ভাবছি আমরা কি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম? ফোন পেয়ে নিজেকে সামলে নিল? মন ভীষণ খারাপ হল।
এঁটো থালাবাসন ধুয়ে রাখছি, পিছন থেকে মিজান বলল,
•আপনি যান, আমি করে নিচ্ছি
•তুমি আমার কাজের লোক না
•প্রিয় মানুষের জন্য কিছু করলে কেউ কাজের লোক হয়না
আমাকে সরিয়ে আপন মনে ও কাজ করতে লাগল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, রুমে চলে এলাম। ফেসবুক, ইউটিউব কিছুই খুলতে মন চাইছে না, সবখানে এক নিউজ, বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী আশরাফ শিকদারের একমাত্র পুত্র ফারহান শিকদারকে ফ্রেমিং করছেন বিশিষ্ট লেখিকা মৃত্তিকা মাহমুদ।
আর পারছি না। আমি শিশির কেও নাকি ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছি, সেই বক্তব্য নাকি আমার শ্বশুর, শিমুল ভাই দিয়েছেন! অথচ এরা কেসে আমাকে সাহায্য করছেন! নাহলে আমিও বিশ্বাস করে নিতাম, তারা এই কথা বলতে পারেন!
রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়াই, মিজান গাছে পানি দিচ্ছে, আর মালির সাথে কি নিয়ে আলাপ করছে, গাছ সংক্রান্ত তথ্য নিচ্ছে বোধহয়! আমি তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি! এই ছেলেটাকে যদি কোনদিন রাস্তায় হাটতে দেখতাম! কোন দিন আমার মনে ওর প্রতি দুর্বলতা জন্মাত? ও নিজেও তো কথা শেষ করল না, খাবার ও শেষ করল না। কথা শুরু করে নিজেই আটকে গেল। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে, সেটা ভুলতেই এত কাজ করছে!
করুক! আমি ওর চুল, পিঠ, কাধ দেখছি!
আচ্ছা! কেউ যদি উপরে তাকায়? ছি! ছি! কি মনে করবে? আমি রুমে ফিরে এলাম, ড্রেসিং টেবিলের চেয়ারে বসে নিজের দিকে তাকালাম, আমায় কি মানাবে? ওর সাথে?
ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে এ্যান্টি এজিং ক্রিম পেয়ে গেলাম। আমারই কেনা। ব্যাগ থেকে কখন নামিয়েছি মনে নেই, কেনার পর এই দ্বিতীয় বার মাখছি মুখে, ভালো মত ঘাড়, গলায় ডলে ডলে একদিনেই বয়স দশ কমিয়ে ফেলার মত অবস্থা আমার!
প্রেম! একেই কি প্রেম বলে?