মেঘের দেশে রোদের বাড়ি
মোর্শেদা হোসেন রুবি
[দুই]
মাত্র কয়েক গজের দুরত্ব। অথচ এটুকু পথ পরিক্রমাতেই বিগত এক বছরের সমস্ত দৃশ্য চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠলো ফিজার চোখে। মুভি দেখতে বসে রিওয়াইন্ড বাটন প্রেস করলে যেভাবে মাত্র কয়েকটি দৃশ্যে অনেক পেছনে চলে যাওয়া যায় ফিজারও হঠাৎ তেমনই হলো। শফিক স্যারের চেহারা দেখামাত্রই স্মৃতিরা সব জীবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ফিজার চোখের সামনে এখন শফিক স্যারের চেম্বার, সেখানে ওর প্রথম দিন , তৌহিদের সাথে পরিচয় আর তা থেকে প্রণয়ের সুরে ব্যয়িত কিছু মুহূর্ত। সেদিন স্যারের চেম্বারটা খুঁজে বের করা যতটাই শ্রমসাধ্য ছিলো ততটাই মধুমাখা ছিল তৌহিদের মাধ্যমে তা খুঁজে পাবার পর পথে ব্যয় করা অণুক্ষণ। তারপরে থেকেই তৌহিদ হয়ে উঠেছিলো বিশেষ কেউ। অথচ সেই তৌহিদ ফিজার জীবনের সবচে কঠিনতম দিনটিতেই নিজের লেজ গুটিয়ে নিয়েছে। বরং সেদিন বাবার মৃত্যু সংবাদের সান্ত্বনা হিসেবে নিজের বিয়ের খবরটা মেসেজ করে ক্ষমা চেয়েছিলো তৌহিদ। আর ফিজা, বাবার মৃত্যুশোক সামলানোর পাশাপাশি নিজের ভেতর জন্মাতে থাকা বিশ্বাসের মৃত্যুর শোকটাকেও ভালোভাবেই সামলে নিতে পেরেছিলো। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ফিজা। জীবনে আর কোনদিন প্রেমের মড়া হবেনা। নইলে সারাজীবন ভেসেই থাকতে হবে। ডুবে ডুবে জল খাবার দিন গত হয়ে গেছে। এখন সবাই ভাসমান প্রেমেই অভ্যস্ত। ওর মতো বোকারাই কেবল ডুবে যায়। কাজেই এই ছলনার শহর ঢাকায় আর নয়। যে ঢাকা ওকে কেবল একরাশ দীর্ঘশ্বাস উপহার দিয়েছে সেই ঢাকা শহরকেই কাল গুডবাই জানাবে ফিজা। সেকারণেই শফিক স্যারের চেম্বারে আর ফিরে না যাবার সিদ্ধান্ত। কিন্তু স্যারকে এতোসব জানানো যাবেনা। জানলে তিনি হয়তো যেতে দেবেন না। আর ফিজার পক্ষে সম্ভব না তৌহিদের ছায়াটুকু সহ্য করা।
সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শফিক স্যারের দিকে এগিয়ে গেলো ফিজা। স্যারের ডাকার সেই পুরোনো ভঙ্গি আর স্নেহমাখা প্রশান্তির হাসি ফিজার আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিকারের বড় আসলে এরাই। বড়ত্ব যাদের কাছে এসে ছোট হয়ে যায়। কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে সালাম দিলো ফিজা। শফিকুল ইসলাম হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ” কী অবস্থা তোমার মামনি ? আমি তো দুর থেকে তোমাকে চিনতেই পারিনি। বাড়ির খবর কী ? ” আন্তরিক ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন শফিকুল। ফিজার সুশ্রী মুখে মুখে বেদনার ছায়া ঘনাতে দেখে দ্রুত রাশ টেনে বললেন ,” আচ্ছা, চলো ভেতরে গিয়ে কথা বলা যাক। ”
ফিজা কিছু বলার চেষ্টা করলে শফিকুল ঘাড় ফেরালেন ,” কোন সমস্যা আছে ?”
” স্যার, আমি বাস থেকে নেমেই সবার আগে আপনার কাছে এসেছি। ভেবেছি আপনার সাথে দেখা করেই আপুর বাসায় চলে যাবো। আমাকে আবার কাল সকালেই বাস ধরতে হবে। বসতে চাচ্ছিনা স্যার।”
” সেকি, তুমি ঢাকা থাকছো না ? ” শফিকুল স্থির হয়ে দাঁড়ালেন এবার। ফিজার চোখের তারার চাঞ্চল্য চোখে পড়লো তার। “এনিথিং রং ? ”
ফিজা নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাঁকালো কোনরকমে, ” নো, স্যার। এভরিথিং ইজ ওকে। ”
” তাহলে ভেতরে এসো। তোমার কথাগুলো শুনতে চাইছি আমি। মিসবাহের শেষ সময়ে আমি যেতে পারিনি ব্যপারটা আমার জন্য কষ্টের। তবে ও মারা যাবার আগে ওর সাথে কথা হয়েছে আমার। আই ডিডন্ট ফরগেট দ্যাট।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শফিকুল। তারপরেই তার সাথে ভেতরে যেতে ইশারা করলে ফিজা কাতর স্বরে জানালো ওর বেশ দেরি হয়ে যাবে।
শফিকুল কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। ওর সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। তাঁর মনে হলো মেয়েটা যেন কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা। শফিকুল কিছুটা বিস্মিত হলেন।
” তুমি কী এখান থেকেই ফিরে যেতে চাচ্ছো ? ”
” জি, স্যার। আমি আসলে খুব ক্লান্ত স্যার। বাসায় আপু চিন্তা করবে।”
” বুঝলাম তুমি ঢাকায় থাকছোনা। এখানে প্রাকটিসও করছো না। তারমানে ধরে নেয়া যায়, তুমি বগুড়া বারে জয়েন করছো, রাইট ?”
” জি, স্যার। অনেকটা এরকমই। ”
” সেক্ষেত্রে ঢাকার লোকজনকে কিছুটা সময় দেয়া উচিত তোমার। কী বলো ? উই ডিজার্ভ ইট জুনায়না। ”
ফিজার অস্বস্তি দ্বিগুণ হলো। স্যারের সাথে ভেতরে যাওয়া মানে দ্বিতীয়বার ঐ ছোকরাটার সম্মুখীন হওয়া। যেটা সে হতে চাচ্ছেনা। ছোকরা আস্ত একটা বেয়াদব। যতটা না আত্মগর্বে গর্বিত তারচেয়ে বেশি যেন পিতৃগর্ব। নইলে ভিজিটর শুনে ঐরকম অনাকাঙ্খিত বাক্যবাণ ছোঁড়ার কোন মানে হয়না। এ ধরণের পরিস্থিতি ফিজার জন্য নতুন। বিশেষ করে এরকম সাদামাটা বোরকা পরার পর থেকে কিছু লোকের চোখে সে ক্ষেত আর আনকালচার্ড উপাধি পেয়েছে সে। যেন পৃথিবীর তাবৎ কালচার সবই পশ্চিম থেকে উড়ে এসেছে। কারো নিজের কোন কালচার ছিলনা, থাকতে নেই। অভদ্র একটা। ছেলেটার অমন আচরণে ফিজা প্রচন্ড অপমান বোধ করতে গিয়েও করেনি। নিজের চেষ্টায় স্বাভাবিক থেকেছে। অপমানটুকু গায়ে মাখেনি। বরং ঐ সময় বাবার একটা কথা মনে পড়ে গেছে ওর। বাবা বলতেন, সম্মান জিনিসটা পৃথিবীতে তৈরী হয়না। এটা তো পুরোটাই ওপরওয়ালার দান। কেউ নিজে নিজে যেমন কখনও সম্মানিত হতে পারেনা ঠিক তেমনই কেউ চাইলেই কাউকে অসম্মানিতও করতে পারেনা। বরং ওটা করতে গিয়ে সে নিজেই ছোট হয়ে যায়। অবশ্য ফিজার হাতে এতো সময় নেই যে বসে বসে ঐ দাম্ভিক ছোকরার অপমান হতে দেখবে। সে যে কাজে এসেছে সেটা করে সসম্মানে চলে যেতে পারলেই বাঁচোয়া। পথ চলতে গেলে ওরকম হাজারো মানুষ সামনে আসবেই। তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আর আচরণগত ত্রুটির কারণে ওকে কেন লজ্জিত হতে হবে। অবশ্যই ফিজার লজ্জিত হবার কিছু নেই। সে কারো ধার করা সংস্কৃতির চর্চা করেনি যে লজ্জায় পড়তে হবে। ভাবনাটা স্বস্তি দিলো ফিজাকে। শেষ পর্যন্ত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলতে হলো ,” জি, স্যার।”
” দেন প্লিজ কাম। দেরি হলে ভাবনার কিছু নেই। ফিরোজ তোমাকে পৌঁছে দেবে। ” বলেই শফিকুল আর দাঁড়ালেন না। লম্বা লম্বা পা ফেলে ভেতরের দিকে হাঁটা ধরলেন। বাধ্য হয়েই ফিজাকে তার পিছু নিতে হলো। পোশাকের ব্যপারটা যতোই ভুলে থাকার চেষ্টা করছে ততই চোখ চলে যাচ্ছে ওটার দিকে। কিন্তু কিছু করার নেই। স্যারের সাথে কথা শেষ না করে সে ইস্তফা দিতে পারবে না। হাজার হোক ফিজার কর্মজীবনের সূচনা তার মাধ্যমে। সবকিছুরই শোভন অশোভন বলে একটা কথা আছে। তাছাড়া স্যারের ওয়াইফের সাথেও দেখা করা দরকার। ফিজার আনকোরা শহুরে দিনগুলোতে উনি না হলে সেগুলো পার করা অত সহজ হতো না।
সুদৃশ্য ড্রইংরুমে ঢোকার মুখে সেই যুবকদের মুখোমুখি হলো ফিজা। অজান্তেই গুটিয়ে গেলো সে। ঐদিকে ছেলেকে দেখতে পেয়ে শফিকুল ইসলাম অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। দুহাত বাড়িয়ে দরাজ কণ্ঠে ” ও, মাই বয় ” বলে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলের পেছনে অনুগত ভৃত্যের মতো ঘুরঘুর করতে থাকা ছেলেটাও বিগলিত হাসিতে পিতাপুত্রের মিলনদৃশ্য দেখে হাসতে লাগলো। সম্ভবত সে ঐ বেয়াদবটারই বন্ধু স্থানীয় কেউ হবে, অনুমান করলো ফিজা। পুত্রের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে ফিজার দিকে ফিরলেন শফিকুল। ওকে বসতে বললেন তিনি। নিজেও কিছুটা দুরত্বে বসলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আব্বু, আমি একটু কথা শেষ করি তারপর তোমার সাথে বসবো। ওকে ? ” ছেলেটা কিছুটা বিস্মিত চাহনীতে ফিজাকে দেখলো। হয়তো এই পোশাকের কাউকে কখনও এতোটা প্রশ্রয় পেতে দেখেনি। তবে এবার সে নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো। ফিজার দিকে একবার তাকিয়ে ‘ওকে’ বলে বেরিয়ে গেলো।
ওরা দুজন বেরিয়ে গেলে শফিকুল ইসলাম ফিজার দিকে তাকালেন। ফিজার মনে হলো স্যার এইমাত্র ওকে ভালভাবে লক্ষ্য করলেন। তিনি বললেন ,” ইটস হার্ড টু রিকগনাইজ ইউ। বোরকায় তো তোমাকে চেনাই যাচ্ছেনা। যাই হোক, এবার বলো তুমি ঢাকা কেন ছাড়ছো ?”
” আসলে স্যার, আপনি তো জানেন বাবা শেষের দিকে বগুড়াতেই সেটেলড হয়েছিলেন। সেখানে বাবার চেম্বার আছে, কিছু পেন্ডিং মামলা আছে। আবার আমার আম্মাও সেখানে পুরোপুরি একা। সবমিলিয়ে আমাকে সেখানে থাকতে হবে স্যার। ” থেমে থেমে বুঝেশুনে কথাগুলো বললো ফিজা। শফিক স্যার বিচক্ষণ লোক। যা খুশি বলে তাকে বুঝ দেয়া যায়না। ফিজার কথায় ফোঁকড় থাকলে তিনি ঠিক ধরে ফেলবেন। তিনি বললেন,
” আম্মাকে নাহয় বোঝাও, ওনাকে ঢাকায় নিয়ে এসো। এখানে তোমার ফিউচার যথেষ্ট ব্রাইট জুনায়না। মফস্বলে পড়ে থাকতে চাচ্ছো কেন ? ”
” আম্মা এখন কিছু শোনার মতো মানসিকতায় নেই স্যার। তাই আমারও আর কোন উপায় নেই।” আংশিক সত্যটাকেই চরম সত্য বলে তুলে ধরে প্রবল অস্বস্তিতে কপালে টিস্যু চাপলো ফিজা। এরকম পাশ কাটানো কথা বলে অভ্যস্ত নয় সে। পেশাগত কারণ ছাড়াও সরাসরি আর সত্যভাষণে অভ্যস্ত ফিজা। শফিকুল ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন তারপর মাথা নাড়লেন।
” হম, বিষয়টা সত্যিই দুঃখজনক। দোয়া করি তিনি শোক কাটিয়ে উঠুন। আসলে এমন চমৎকার ক্যারিয়ার ছেড়ে তুমি হঠাৎ সব ক্লোজ করছো ব্যপারটা অগ্রহনযোগ্য। যাই হোক, খুব খারাপ লাগলেও তোমার ইচ্ছেকে সম্মান জানাই। বাট এ্যাজ আই টোল্ড, ক্যারিয়ারই শেষ কথা নয়। সম্পর্কের দাবি তারচে অনেক বেশি গুরুত্বের দাবিদার। কিপ ইট আপ। ”
চাপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিদায় নেবার আশায় সবে মুখ খুলতেই যাচ্ছিলো ফিজা। তার আগেই শফিকুল ইসলাম অনুচ্চ স্বরে কাজের মেয়েটাকে ডাকলেন। তাকে আদেশ করলেন ফিজাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। আপত্তি জানিয়ে কিছু বলার আগেই স্যারের পরের কথাটা শুনে সে রীতিমতো জমে গেলো। মার্জিত হাসিতে নিজের সৌম্যকান্ত মুখটা ভরিয়ে তুলেছেন তিনি। বললেন, ” তোমাকে তো বলা হয়নি, তোমার আন্টি মানে আমার স্ত্রী পুরো তিনমাস পর গত সপ্তাহে দেশে ফিরলেন। ওর সাথে আমাদের ছোট ছেলেটাও এসেছে। ও বেশ কিছুদিন থাকবে এখানে। তবে তোমার আন্টি আর যাবেন না। সে এখন থেকে বাংলাদেশেই থাকবে। সেই খুশিতে একটা ছোট্ট গেট টুগেদার পার্টি রেখেছি আমি। তুমিও ইনভাইটেড ফিজা। আশা করছি, আমার দাওয়াত কবুল করবে তুমি। তোমার আন্টি তোমাকে দেখলে খুশি হবে।”
ফিজা আরক্ত মুখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। স্যারের ওয়াইফকে সে ভালোভাবেই চেনে। চেম্বারেই দেখা হয়েছে কয়েকবার। মহিলা সম্পূর্ণ অন্যরকম মেজাজের। সদাহাস্যময়ী। সবার সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন। তিনি যে ফিজার চিন্তায় ঘুম হারাম করবেন এটা খুবই স্বাভাবিক কথা। এমন মায়াবতীর সাথে দেখা না করে পারা যায় না। ফিজা সম্মতির হাসি দিলো।
শফিকুল ইসলামের আদেশে একজন মহিলা ফিজাকে ভেতরে পৌঁছে দিলো। শফিকুল সাহেবের স্ত্রী মারিয়া আসলেই চমৎকার একজন মহিলা। ফিজাকে দেখেই চিনতে পারলেন তিনি। ওকে পেয়ে এমনভাবে হাত ধরে টানলেন যেন অনেকদিন পর কোন আপনজনকে ফিরে পেয়েছেন। পুরোনো বান্ধবীর মতো গুটগুট করে গল্প করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিজার আদ্যোপ্যান্ত সব খবরই জেনে নিলেন। ফিজাও তাকে অনেকটাই বলতে বাধ্য হলো। কিছু মানুষ থাকেই এমন যাদের সংস্পর্শে এলে মনের ভেতরকার জমানো উত্তাপগুলো বেরোনোর পথ খুঁজে পায়। মারিয়া আন্টি তেমনই একজন। তার সাথে সময়টা মন্দ কাটলো না ফিজার।
সন্ধ্যের ঠিক আগে আগে আলমারী খুলে একটা প্যাকেট বের করলেন তিনি। জানালেন এটা কানাডা থাকাকালীন কিনেছেন। ফিজাকে এই শাড়িটা গিফট করতে চান তিনি। ফিজা মুগ্ধ হয়ে গেলো শাড়িটা দেখে। তবে মারিয়া আন্টির এমন উপহার ফিজার জন্য নতুন কিছু নয়। চেম্বারের নিয়মিত সদস্য হিসেবে ফিজা সহ বাকি সবাই জানে যে ব্যারিস্টার স্যার যতবারই বিদেশ ভ্রমনে গেছেন ততবারই চেম্বারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য কিছুনা কিছু এনেছেন। ফিজা নিজেও দুবার দুটো গিফট পেয়েছে। কিন্তু শাড়ির মতো এতো বড় গিফট এবং তা মারিয়া আন্টির পক্ষ থেকে এই প্রথম। হয়তো সে ঢাকা ছাড়ছে বলেই আন্টির এই উপহার। ফিজা আপত্তি করার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। মারিয়া একা একাই বলে চললেন, ” সবাইকে যার যার গিফট দেয়া হয়ে গেছে। তুমি ছিলে না বলে তোমারটাই রয়ে গেছে। আর তোমার কী ভাগ্য দেখো, ঠিক সময় মতোই কাজে এলো উপহারটা। শাড়িটা কিন্তু চমৎকার। তোমাকে দারুণ মানাবে। আমি খুব খুশি হবো যদি এটা তুমি আজ সন্ধ্যায় পরো।” মারিয়া হাসলেন। ফিজা আতঙ্কিত বোধ করলো। এই ঘর্মাক্ত কলেবরে শাড়ি ? ক্ষীণ কণ্ঠে বললো, ” আজ এটা না পরলে হয়না ? আমার খুব আনইজি লাগবে।” বলার মতো আর কোন কৈফিয়ত না পেয়ে যা মনে এলো বলে দিলো ফিজা। মারিয়া সাথে সাথেই দুশ্চিন্তামুক্ত করলো ওকে।
” বাইরের কেউ নেই। সব্বাই আমাদের ফ্যামিলি মেম্বার। আমার সব বোনেরা আসছে আর তোমার স্যারের কিছু ক্লোজ রিলেটিভস। ব্যাস, এই তো। তোমার অস্বস্তির কোন কারণ নেই ফিজা। ”
এরপর আর আপত্তি করাটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। অনুরোধ হিসেবে বলা হোক বা আদেশ। তা অমান্য করাটা ফিজার পক্ষে বেআদবি। তবে ওর ঢাকা ছাড়ার কথাটা শুনে স্যার ওকে আটকে ফেলবেন জানলে কথাটা অন্য কোনভাবে জানাতো। এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় পার্টি এটেন্ড করতো না।
শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যের পর পার্টিতে যোগদান করতে হলো ফিজাকে। আন্টির সহায়তায় যতটা সম্ভব নিজেকে পরিপাটি করে নিলো ফিজা। তবে ক্ষীণ একটা ভয় ছিলো ফিজার মনে। পার্টি শুরু হবার পর সেটাই সত্যি হয়ে গেলো। পুরো চেম্বার তো বটেই, তৌহিদও এখানে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত। ফিজার সত্যি সত্যিই কান্না পেলো এবার। সব ছেড়ে ছুড়ে জীবন থেকে পালাতে চাওয়ার অর্থ কী এই যে ঘুরেফিরে বারবার মলাটে ফিরে যাওয়া ! ফিজাকে এখন পুরোটা সময় প্রানপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক এবং নির্বিকার দেখানোয় তৎপর থাকতে হবে।
পার্টি ঘরোয়া বলে চালানো হলেও এর জাঁকজমকে কোন কমতি নেই। স্যারের বাড়ির পেছনের বিশাল উঠানে ত্রিপলের নিচেই সাজানো হয়েছে চা চক্রের যাবতীয় আয়োজন। ব্যারিস্টার স্যার একবারই এদিকটায় ঘুরে গেছেন আর ফিজাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন, ” দেরি হলেও ভয় পাবার কিছু নেই। ফিরোজকে বলা আছে। সে তোমাকে পৌঁছে দেবে। তুমি শুধু বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দাও যে তুমি এখানে আছো। ”
সান্ধ্য আয়োজন শুরু হবার পর অতিথিরা একে একে আসতে শুরু করলেন। একফাঁকে স্যারের বেয়াদব ছেলেটাও এলো। ফিজাকে বিস্মিত করে দিয়ে সে নিজেই পরিচিত হলো। নাম তার মুরাদ। ভঙ্গিটা পরিচয় পর্বের হলেও উদ্দেশ্য যে ক্ষমা চাওয়া তা তার ভাষাভঙ্গিই বলে দিচ্ছিলো। তার ক্ষমাপ্রার্থনাতেও ছিল ফ্ল্যাটারির সুর। ইতোমধ্যেই সে কয়েকবার বলে ফেলেছে , ” আমি সত্যিই তখন বুঝতে পারিনি যে আপনি বাপির কলিগ।” ফিজা স্তম্ভিত। কলিগ শব্দটা বাড়তি মর্যাদা বহন করে। ছেলেটা জুনিয়র না বলে কলিগ বলায় বাক্যের যোগ্যতা অনেকখানি বেড়ে গেছে। ফিজা নিজেকে কখনও ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলামের কলিগ ভাবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারবেনা।
সে মুচকি হাসলো, ” না না ঠিক আছে। অমনটা হতেই পারে। অপরিচিত কাউকে এলাউ করাটা আজকাল ঝুঁকিপূর্ণই বটে।” সংক্ষেপে বলে থেমে গেলো ফিজা। ভেবেছিলো এতটুকু বলে খালাস করে দিবে ছোকরাকে। কিন্তু লাভ হলোনা। কথা বলার পর তার ঘূর্ণন যেন আরো বাড়লো। প্রতি পাঁচমিনিট অন্তর সে আহ্নিক গতির অনুসরণে ফিজাকে একবার করে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে দিয়েছে। ব্যপারটা টের পেয়ে প্রমাদ গুনলো ফিজা। এক তৌহিদের আঘাত কী যথেষ্ট নয় যে আরেকজন ওকে শহীদ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। অফকোর্স বোরকা ইজ দা বেস্ট। এতোক্ষণ তো বেশ ছিল। খুলতে না খুলতেই আরেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার পাঁয়তারা করছে। আম্মু ঠিকই বলে। বোরকা পরে ব্যাঙ রাজকুমারী সেজে থাকা রাজকন্যাদের উচিত কেবল উপযুক্ত রাজকুমারের সামনেই নিজের দর্শন দেয়া। নইলে সবাই রাজকন্যা পেলে তাকে সহ অর্ধেক রাজত্বের দখল নিতে চাইবেই। কেউ সবলে কেউবা ছলে বলে। অবশ্য ফিজার বাবার কোন নিজস্ব রাজত্ব নেই যা এই রাজপুত্র দাবি করবে। তার উপর বাড়িতে ঢুকেই ব্যবহারের যা নমুনা দেখেছে তাতে একে এড়িয়ে চলাই শ্রেয় নয়তো ফিজাকেই উজাড় হয়ে যেতে হবে। ফিজা এবার তাকে প্রানপণে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলো।
একপর্যায়ে মারিয়া আন্টি ওকে দুজন মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা ফিজাকে বেশ প্রশ্ন করতে শুরু করলো। অবশ্য খুব ভদ্রভাবেই তা করলো যেন তাদের আগ্রহ টের না পাওয়া যায়। কিন্তু ফিজার মনে হলো মারিয়া আন্টি তার চিরাচরিত স্বভাবানুযায়ী ওকে নিয়ে ভাবতে বসে গেছেন। নইলে এই অকারণ ইন্টারভিউ কিসের। একসময় গোমড় ফাঁস হলো। মারিয়া আন্টি ওকে আলাদা ডেকে জানালেন ব্যপারটা। তাঁর ভাষ্যমতে, ” ওরা তোমাকে খুব পছন্দ করেছে। তাই আমি বলি কী, তুমি একবার ছেলেটাকে দেখো । আমার মনে হয় হি ইজ পারফেক্ট ফর ইউ। সৎ, নির্লোভ এবং কর্মঠ। অনেকদিন থেকেই শিক্ষিত আর ঘরোয়া একটা মেয়ে খু্ঁজছে। তুমি এসেছো শুনেই আমি ওনাকে ইনভাইট করি। তোমার স্যারও চান পুরোনো বন্ধুর হয়ে কিছু করেন। তোমার বাবাকে কথা দিয়েছেন তিনি।”
” কিন্তু আন্টি….আমি তো এখন।”
” তুমি এখন কী ?” ফিজাকে থামিয়ে দিলেন তিনি। ” বিয়ে করবেনা, এই তো ?”
” জি। আমার ক্যারিয়ার….!” ফিজা বলতে শুরু করলে ঠোঁটের কোনে হাসলেন মারিয়া। যেন শিশুর অবোধ বাক্যালাপ শুনছেন। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ” শোনো আম্মু, একটা সত্যি কথা তোমাকে বলি, মাথায় গেঁথে রাখো। পৃথিবীতে কোন জিনিসই একা একা তার পূর্ণ ক্ষমতা দেখাতে পারেনা। সামান্য যে ফটোফ্রেম আছে তারও পেছনে ঠিকে দিতে হয় নয়তো সে হেলে পড়ে যায়। নারী সবসময়ই পুরুষ ছাড়া অচল, তেমনই পুরুষ অচল নারী ছাড়া। নারী তবু যেটুকু পারে পুরুষ তো সেটুকুও পারেনা। তবে নারীর পারায় ক্ষতি বেশি, পুরুষের পারায় কোনো ক্ষতি নেই লাভ ছাড়া।”
” মানে ? আমি বুুঝিনি আন্টি।” ফিজা মনে মনে অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলো। এই মারিয়া আন্টিতো তার পেছনেই পড়ে গেছেন। বিয়ে করতে রাজি করানোর জন্য এতো যুক্তি প্রয়োগের আদৌ দরকার আছে কী। ফিজা কীভাবে বলবে যে তৌহিদের পর পুরুষ জাতিকে বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছে সে।
[ দুঃখিত, আরেকটা পর্ব বেড়ে গেলো ]