#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৮
লিখা: Sidratul Muntaz
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের বিরাট গর্জন শোনা যাচ্ছে আর বিদ্যুৎএর চমক দেখা যাচ্ছে। আরও দেখা যাচ্ছে, সম্পূর্ণ সড়কের এক মুহুর্তের জন্য আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। আশেপাশে মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। রাত ১টা বাজতে চলেছে। অর্ণভ টং এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। তার সর্বাঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা এসে লেপ্টে যাচ্ছে। গরম চায়ের সাথে বৃষ্টির ফোঁটা মিশতে মিশতে চায়ের পরিমাণ যে দ্বিগুণ হয়ে গেল সেদিকে অর্ণভের কোনো হুশ নেই। সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চায়ে চুমক দিচ্ছে আর গভীর চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে। নিশিতার সাথে ফোনে প্রেমালাপ চালানো ব্যক্তিটি কে? কি তার রহস্য? বিষয়টা অর্ণভকে খুব ভাবাচ্ছে। এই দুশ্চিন্তা থেকে কয়েক মুহুর্তের জন্য নিস্তার পেতে টং এর দোকানে চা খেতে এসেছিল সে। কিন্তু চা খেতে নিয়ে দেখা গেল চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। প্রতিটি চুমুকে নতুন সম্ভাবনাময় চিন্তার উদ্ভব হচ্ছে। অর্ণভ কি করবে? নিশিতাকে কিভাবে বুঝাবে? আচ্ছা, নিশিতাকে কি বলে দেওয়া উচিৎ যে তার আসল ডেলিভারি বয় প্রকৃতপক্ষে অরিনের হবু স্বামী? না, না, এই কথা বলে শুধু শুধু দুই বোনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার দরকার কি? পরে দেখা গেল কিছুই সত্যি নয়। এমনও তো হতে পারে যে নিশিতার ডেলিভারি বয় আসলে ইলহান নয় বরং অন্যকেউ! হয়তো তাকে দেখতে কিছুটা ইলহানের মতোই। এজন্য সবার মধ্যে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অর্ণভ তো আর নিশিতার ডেলিভারি বয়কে স্বচক্ষে দেখেনি। তাছাড়া যার বাপের এতো টাকা সে ডেলিভারি বয়ের চাকরি করতে যাবে কেনো? আর ইলহান যদি কখনও ডেলিভারিবয়ের চাকরি না করে তাহলে নিশিতার সাথে তার দেখা হলো কিভাবে? অর্ণভ মনের সান্ত্বনার জন্য ধরে নিল নিশিতার ডেলিভারিম্যান আর ইলহান আলাদা দুই মানুষ। হয়তো তাদের কণ্ঠ এক, দেখতেও এক কিন্তু মানুষ দুটো ভিন্ন এবং তাদের পছন্দও ভিন্ন। একজন পছন্দ করে নিশিতাকে অন্যজন অরিনকে। এমন হওয়াটা কি খুব অসম্ভব? অর্ণভের মোবাইল বেজে উঠলো। অচেনা একটা নাম্বার।
” হ্যালো কে বলছেন?”
” বড়ভাই, আমি নাসির। ভালো আছেন?”
” রামছাগল?”
” জ্বী ভাই।”
” জ্বী ভাই? এই কথার মাধ্যমে প্রমাণ করলে তুমি আসলেই রামছাগল।”
নাসির খিকখিক করে হেসে উঠলো। অর্ণভ বললো,
” কি সমস্যা? ফোন কেনো দিয়েছো? আর আমার নাম্বার তুমি পেলে কোথায়?”
” ভাই কি মজা নিচ্ছেন? আপনিই তো স্মরণ করলেন আমাকে।”
” আমি স্মরণ করলাম? কখন? আর তুমি কি প্রদীপের জ্বীন যে স্মরণ করলেই হাজির হয়ে যাও?”
” প্রদীপের জ্বীন না। কিন্তু আপনি স্মরণ করলে আমি কি হাজিরা না দিয়ে পারি? নাকের পাটায় ব্যথাটা এখনও আছে ভাই। কিন্তু ভাই, একটা সত্যি কথা বলি। একদম আপনাকে ছুঁয়ে বলতে তো পারবো না, আপনার ফোন নাম্বার ছুঁয়ে বলছি। আমি কিন্তু সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আমার মা এই কথা শুনে খুব খুশি হয়েছে জানেন ভাই? মা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কিভাবে এই অভ্যাস ত্যাগ করলাম, তখন আমি খুব গর্বের সাথে জানিয়েছি আপনার কথা। কি বলেছি জানেন?আমার এক বড়ভাই আছে। আমাকে সিগারেট খাওয়ার অপরাধে নাকে ঘুষি মেরেছে। সেই ঘুষি খাওয়ার পর থেকে আমি আর সিগারেট খাই না। বাদ,বাদ, বাদ। ভালো করেছি না ভাই?”
” খুব ভালো করেছো। ভেরি গুড। কিন্তু সেদিন আমি তোমাকে সিগারেট খাওয়ার জন্য মারিনি। মেজাজ খারাপ ছিল তাই মেরেছি। এটা আমার ভুল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে ভুল থেকেও ভালো কিছু হয়।”
” জ্বী ভাই। সিগারেট বাদ দিয়ে এখন আমি চুইংগাম চাবানো শুরু করেছি। চব্বিশ ঘণ্টা মুখে চুইংগাম। তাও নামী-দামী ব্র্যান্ডের। সিগারেটের জন্য আগে যে টাকা খরচ করতাম সেটা এখন চুইংগানের পেছনে করি। দামী চুইংগাম খাওয়ার আরেকটা বিশেষ কারণ কি জানেন ভাই? সিগারেট দেখলেও খেতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে এমন হয়, মাত্র একটা দশটাকা দামের চুইংগাম মুখে দিয়েছি। তখনই সিগারেটের নেশা চাপলো। এখন সিগারেট খেতে গেলে তো মুখের চুইংগাম ফেলতে হবে। অথচ চুইংগামটা চাবানো যাবে কমপক্ষে আধঘন্টা। এর আগে ফেলে দিলে পুরো দশটাকাই লস। তাই টাকার মায়ায় চুইংগাম ফেলা হয় না। আর সিগারেটও খাওয়া হয় না। আধঘণ্টা শেষ হতে হতে সিগারেটের নেশাও চলে যায়। নতুন করে আবার নেশা চাপার আগেই আরেকটা দামী চুইংগাম মুখে দিয়ে ফেলি। আইডিয়াটা ভালো না ভাই?”
অর্ণভ নাসিরের কথায় মনোযোগ দিতে পারছে না। সে হাঁটতে হাঁটতে তাদের গলির রাস্তাতে চলে এসেছে। ইলহানের গাড়িটা তো এদিকেই ছিল। এখন নেই কেনো? অরিন-ইলহান কোথায়? নাসির বললো,
” ভাই, চুইংগাম খাওয়ার লাভও কিন্তু অনেক। আগে সিগারেট খেলে মুখ থেকে দূর্গন্ধ আসতো। কিন্তু এখন আসে সুগন্ধ। টাটকা ফ্লেভারের সুগন্ধ। কতরকমের ফ্লেভার যে আছে। ভাই আপনিও খাবেন নাকি একটা চুইংগাম? দেখা হলে আপনাকে অবশ্যই এক বক্স চুইংগাম গিফট করবো। আপনার জন্যই তো আমি এতোবড় বদভ্যাস ছাড়তে পেরেছি।একটা গিফট তো আপনার অবশ্যই প্রাপ্য।”
অর্ণভ পাগলের মতো এদিক-ওদিক অরিনদের খুঁজছে। কিন্তু ছেলে-মেয়ে দু’টোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ইলহান তো বলেছিল এই রোডের মধ্যেই ওরা থাকবে। তাহলে এখন গেল কোথায়? অর্ণভের অবচেতন মনটা খুবই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এই অবাধ্য চঞ্চলতা কিসের লক্ষণ? ভালো না খারাপ? নাসির বললো,
” ভাই, যাদের মুখে গন্ধ থাকে তাদের জন্য যে চুইংগাম কত উপকারী সেইটা আমি এখন বুঝি। আগে তো কেউ কথা বলার জন্য আমার সামনেই আসতো না। মনে হয় সিগারেটের গন্ধ পাইতো। আর এখন কি হয় জানেন? সাইধা সাইধা মানুষ কথা বলতে আসে! ব্যাপারটা জোস না? আচ্ছা ভাই, আপনার মুখে কি গন্ধ আছে?”
অর্ণভ বিকট শব্দে বললো,” গাঁধার বাচ্চা রামছাগল!”
অতঃপর ফোন কেটে দিল। তার মেজাজটা যেমন খচে গেছে তেমন টেনশনে মাথাটাও কাজ করছে না। চারপাশে এতো কিসের নিস্তব্ধতা? মনে হচ্ছে যেনো বিরাট কোনো ঝড় নামার পূর্ব প্রস্তুতি চলছে! কেনো বুকের ভেতরে এমন তোলপাড় করা শব্দ দামাদাম বেজে যাচ্ছে? কি শুরু হয়েছে এসব?
অরিন চারদিকে তাকাতে পারছে না। তার চোখ দু’টো আকাশের নক্ষতের মতো মিটিমিটি করছে।একবার খুলছে তো পরক্ষণেই অজানা আতঙ্কে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে এই মুহুর্তে যেই রেস্টুরেন্টে আছে সেটা দেখতে অনেকটা ভয়ংকর ভুতুড়ে মহলের মতোন। বিশাল ও আলিশান এই রেস্টুরেন্টে মাত্র দু’টো মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। অরিনকে রাজকীয় ধরণের একটা সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। অরিন সেখানে বসে আছে ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া জুবুথুবু আত্মা নিয়ে। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর, থেমে থেমে আসছে তার নিশ্বাস। তার চোখ থেকে অবিরাম গড়াচ্ছে জল! ইলহান এখন অরিনের খুব কাছে, ঠিক অরিনের কোলের উপর মাথাটা রেখে বামপায়ের উপর ডানপা তুলে শুয়ে আছে আয়েশী ভঙ্গিতে। গুণগুণ শব্দে সে গান আওড়িয়ে চলেছে। এই নিদারুণ দৃশ্যটি অরিনের জন্য রীতিমতো একটা দুঃস্বপ্নের শামিল! ঘুমানোর পর আমরা যে দুঃস্বপ্নগুলো দেখি তা থেকে জেগে উঠা খুব সহজ। কিন্তু যে দুঃস্বপ্নটা আমাদের জেগে থেকেই দেখতে হয়, তা থেকে নিস্তার পাওয়া কি আসলেই এতো সহজ? ইলহান একটা অপরিচিত মিউজিকের সুর গলায় টানার চেষ্টা করছে। তার অতিরিক্ত শান্ত কণ্ঠে অরিনের থমকে থাকা হৃৎপিন্ডটি পূর্ণ স্পন্দন গতির মতো বার-বার কেঁপে উঠছে ভয়ংকরভাবে। অরিন মুক্তি চাইছে এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন থেকে। মুক্তি চাইছে জেলখানার মতো বিশাল, আলিশান তবে অত্যন্ত ভয়ংকর এই রেস্টুরেন্টের বন্দীদশা থেকে।
চলবে
( জানি কেউই কিছু বুঝবে না এখন। আচ্ছা ব্যাপারটা কালকে ক্লিয়ার করবো। আপনারা বরং ধৈর্য্য ধরে প্রেডিকশন করতে থাকুন। দেখি কার চিন্তায় কি আসে?আমি কিন্তু পাঠকদের টেনশনে ফেলতে চাইছি না। বাকি অংশ মনোযোগ দিয়ে রাতে লিখবো। কিন্তু এই সময় দেওয়ার কথা ছিল তাই এতটুকু দিলাম।)