মেঘের পরে রংধনু পর্ব-২৮ ২

0
796

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৮(মূল অংশ)
লিখা: Sidratul Muntaz

রেস্টুরেন্টটি সম্পূর্ণ অন্ধকার নয় আবার আলোকিতও নয়। চারদিক হালকা নীল এবং রঙিন আলোর সমারোহে জ্বলছে-নিভছে। অরিনের হৃৎস্পন্দনও সেভাবে জ্বলছে-নিভছে। তার ঠিক বামপাশেই একটা বিশাল কাঁচের দেয়াল। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাহিরে থেকে বৃষ্টি পড়ার অমায়িক দৃশ্য। কত সুন্দর জায়গা! সুন্দর আবহাওয়ায় বৃষ্টির ঝরে পড়ার শব্দটা অসাধারণ শোনাচ্ছে। কিন্তু অরিন এই চমৎকার মুহুর্ত একফোঁটাও উপভোগ করতে পারছে না। বরং সে চাইছে এই দূরবস্থা থেকে মুক্তি। এতো ভয়, এতো আতঙ্ক, বুকের অস্বাভাবিক হৃদকম্পন, এসব নিয়ে অরিন কিভাবে এতো সময় ধরে বসে থাকতে পারছে? কেনো অচেতন হয়ে যাচ্ছে না? অরিনের এখন সত্যি সত্যি অচেতন হতেই মন চাইছে। তাহলে অন্তত এই জঘন্য পরিস্থিতি সহ্য করা থেকে বেঁচে যেতে পারবে। অরিন চোখ বুজলো। তার অন্ধকার ভীতি আছে বটে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অন্ধকারেও ততটা ভয় লাগবে না যতটা ভয় এই ভয়াল আলোকিত জায়গায় বসে লাগছে। এই আলোটুকুও তার সহ্য হচ্ছে না একদম। এমন আলোয় ইলহানের লোমহর্ষক চেহারা অরিন একটুও দেখতে চাইছে না। কিছুক্ষণ আগে ইলহান সেন্টার টেবিলের ওই মাথায় দাঁড়িয়ে গিটার হাতে গান গাইছিল। একটা হিন্দি গান। কি যেনো নাম? অরিনের মস্তিষ্কে গানের সুর বেজে উঠলো,’ তুঝহে কিতনা চাহনে লাগে হাম।’ হ্যাঁ এই গানটাই গাইছিল ইলহান। গাইতে গাইতে সে ধীর গতিতে অরিনের কাছে এগিয়ে আসলো। হাতটা বাড়িয়ে দিল। হয়তো চাইছিল অরিন তার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াক। তার গানের সাথে তাল মিলিয়ে ডান্স করুক। কিন্তু অরিন সেই অবস্থাতে নেই। তার নজর বার-বার রেস্টুরেন্টের খাদ্যমঞ্চে সাজানো বড় বড় পাত্রের দিকে আটকে যাচ্ছে। অরিনের অবচেতন মন কল্পনা করছে এই বুঝি ইলহান তাকে মেরে ফেলবে। কেটে টুকরো করে ওই সকল বড় পাত্রে ঢেলে রাখবে। অরিনের খন্ড-বিখন্ড শরীর হবে আগামীকাল রেস্টুরেন্টে আসা সকল গেস্টের ব্রেকফাস্ট। এসব ভেবে অরিনের শরীর ভয়ে কাঁটা দিচ্ছে। এজন্যই কি ইলহান তাকে মাঝরাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে? আচ্ছা, অরিনকে মেরে ফেলার আগে কি ইলহান তার সাথে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটি করবে? অরিনকে কি সে শারিরীকভাবে বিধ্বস্ত করবে? চার দেয়ালের মাঝে অরিনের আত্মচিৎকার শোনার জন্য একটা মানুষও কি থাকবে না? অরিন চোখ বন্ধ করতেই তার স্মৃতিপটে গত একঘণ্টা যাবৎ ঘটমান দূর্ঘটনাগুলো প্রথম থেকে পুনরায় মনে আসতে লাগলো। ইলহান যখন তার গলায় আচমকা চাকু চেপে ধরেছিল তখন অরিন ভয়ে, ত্রাসে, শিহরণে হাত-পা ছেড়ে দূর্বলভাবে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু ইলহান তাকে পুরোপুরি রাস্তায় পড়ে যেতে দিল না। দুইহাতে আঁকড়ে ধরে কোলে তুলতে নিল। ওমনি অরিন ইলহানের ডানহাতের কবজির গোড়ায় শক্ত কামড় মেরে ছুটে দৌড় দিল। ইলহানও কয়েক মুহুর্তে নিজেকে স্বাভাবিক করে অরিনের পেছনে ছুটে গেল। ওকে ধরে পাঁজাকোলায় নিয়ে গাড়িতে বসাতে ইলহানের দুইমুহুর্তও সময় লাগলো না। অরিন কাঁদতে থাকলো নিরবচ্ছিন্নভাবে। কাঁপতে থাকলো অজানা ভয়ে। ইলহানের হাত থেকে গলা অবধি খামচে একাকার করে ছাড়লো। ইলহান ভয়ংকর একটা ধমক দিয়ে বললো,
” জাস্ট স্টপ দিস কিন্ডা থিংস। তুমি কি চাও আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি? আমি কিন্তু মোটেও চাইছি না সেটা। তাই বাধ্য করো না। ডোন্ট ফোর্স মি টু বি রুড উইদ ইউ।”
ইলহান কথাগুলো এতোটা উচ্চস্বরে বলেছিল যে অরিন তখন থেকে এখন পর্যন্ত আর একবারও চিৎকার করে কাঁদার সাহস পায়নি। ইলহানের শেষ কথাটা তাকে বারংবার ভাবালো। ‘ডোন্ট ফোর্স মি টু বি রুড উইদ ইউ।’ অর্থাৎ ইলহান অরিনের সাথে রুড হতে চায় না। তাহলে এখন যেগুলো করছে সেগুলো কি? স্বাভাবিক আচরণ? এসব যদি স্বাভাবিক আচরণ হয় তাহলে রুড হওয়া কাকে বলে? ইলহান অরিনকে পাশে বসিয়ে যখন গাড়ি চালু করছিল তখন অরিন মুখ ফুটে একবারও জিজ্ঞেস করতে পারলো যে তারা কোথায় যাচ্ছে। অরিন তার কণ্ঠে কোনো শক্তি খুঁজে পায়নি। শুধু আবিষ্কার করেছে অ্যাংকারের সাহায্য ছাড়া নিজের দূর্বলতা। ইলহান মাইক্রোফোনটা ছিনিয়ে নিয়েছে মানে অরিনের শক্তির আঁধার ধ্বংস করে দিয়েছে! অ্যাংকারের সাথে কথা বলতে না পারলে অরিন যে সম্পূর্ণ অচল! এর আগে কখনও মাইক্রোফোনে অ্যাংকারের উপস্থিতি ছাড়া অরিন ইলহানের সামনে আসেনি। তার ভীতু মনটা চরম সাহস দেখিয়ে দিনের পর দিন ইলহানকে অবহেলা করতে পেরেছে শুধুমাত্র অ্যাংকারের উৎসাহে। এখন সেই অ্যাংকার নামের আত্মশক্তি অরিনের সাথে নেই। তাই অরিন বর্তমানে নিষ্ক্রিয় এক বস্তুর মতো। যে পাথরমূর্তি সেজে ইলহানের পাশে গাঁট হয়ে বসে আছে। ইলহান প্রশ্ন করলো,
” বলো অরিন, কে ছিল? কে তোমার সাথে কথা বলছিল মাইক্রোফোনে? তুমি এই পর্যন্ত যতবার আমার সামনে এসেছো সবসময় ওই মাইক্রোফোনটা তোমার সাথে ছিল। আমি কখনও প্রশ্ন করিনি। কিন্তু আজকে আমি না বলে পারছি না। প্লিজ বলো কে সেটা? আমাদের মাঝে কেনো বার-বার ওই তৃতীয় ব্যক্তিটি চলে আসছে? হোয়াই অরিন?”
অরিন একটুও জবাব দিল না। সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল। ইলহান প্রচন্ড গতিতে গাড়ি ঘোরাতে শুরু করলো। ইচ্ছে করেই খুব জোরে জোরে গাড়ি এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে আবার একই জায়গায় ফেরত আসতে লাগলো। অরিন এতো ঝাঁকি সহ্য করতে না পেরে লাফিয়ে ইলহানের সিটে উঠে তার বুক আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আর কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করলো,
” প্লিজ ইলহান প্লিজ, এরকম করো না। আমার অনেক ভয় লাগছে।”
ইলহান থেমে গেল সাথে সাথে। অরিন তাকে ‘তুমি’ করে ডেকেছে! ইলহানের দূর্বল হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। ইলহান অরিনের কম্পনরত চেহারা স্পর্শ করে খুব নরম কণ্ঠে বললো,
” তোমার-আমার মাঝখানে যদি একটা পিঁপড়াও আসে আমি তাকে আঙুল দিয়ে পিষে ফেলবো অরিন। সেখানে আস্তো একটা মানুষ কিভাবে সহ্য করি বলো? আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহুর্তে সেই মানুষটি কেনো তোমার সাথে কথা বলবে? কে দিল তাকে এতোবড় অধিকার?”
অরিন ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে রইল। অতিরিক্ত কান্নার কারণে তার হিঁচকি উঠছে বার-বার। ইলহান লোভাতুর দৃষ্টিতে অরিনের কান্নারত উজ্জ্বল চেহারা, ভেজা ঠোঁট, সিক্ত দৃষ্টি অবলোকন করলো। প্রত্যেক মুহুর্তে অরিনের ডাগর চোখের কালো ও মোহময় সৌন্দর্য্যে ঘায়েল হতে হতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ ইলহান একটা ভুল করেই বসলো। অরিনের কোমল ঠোঁট দু’টো শক্ত ও রুক্ষভাবে কামড়ে ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু অরিন সেই মুহুর্তেই সরে গেল। নিজের ঠোঁট নিজেই হাত দিয়ে চেপে ধরলো। ইলহানকে কিস করার সুযোগ দিল না। ইলহান আশাহত গলায় তীব্র রোষ মিশিয়ে বললো,
” তুমি কি আমাকে ধোকা দিচ্ছো অরিন? এখনও কি রায়হান নামের সেই ছেলেটিকে ভালোবাসো? নাকি সে অন্যকেউ? যদি সত্যিই তোমার জীবনে অন্যকেউ থাকে তাহলে বলে দাও প্লিজ!”
অরিন কান্নারত কণ্ঠে মিনমিনে স্বরে বললো,” বলে দিলে কি করবেন?”
ইলহান চোয়াল শক্ত করে বললো,” আগে তাকে শেষ করবো৷ তারপর তোমাকে সহ নিজেকেও শেষ করে ফেলবো!”
অরিন ভয়ে খামচে ধরলো ইলহানের বুক। হু হু করে কেঁদে বললো,” আমি কিচ্ছু বলবো না আপনাকে। কখনও কিচ্ছু বলবো না।”
অরিন কাঁদতেই থাকলো। ইলহান কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে দেখলো অরিনের কান্না। তারপর একহাতে অরিনের পুরো শরীর বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল। অরিনও আরও নিজেকে গুটিয়ে ইলহানের বুকে মাথা গুজে একটানা কেঁদে যেতে লাগলো৷ তার ভীষণ ইচ্ছে হয় ইলহানকে ভরসা করতে, ইলহানের দেহকে নিজের আশ্রয় ভাবতে কিন্তু..কিন্তু সে পারে না। অ্যাংকারের বিষাক্ত কথাগুলো অরিনের কানে অবিশ্রান্ত হানা দিতে থাকে। সে নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করতে বাধ্য হয় তখন। ইলহানের অপরিসীম ভালোবাসাময় নিষ্কলুষ আবেদনকেও প্রত্যাখান করতে হয়। ইলহান অরিনের চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল। তারপর অরিনের মাথায় চুমু দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,
” অন্যকাউকে ভালোবাসার অধিকার তোমার নিশ্চয়ই আছে। এটা জরুরী নয় যে আমি তোমাকে সর্বহারার মতো ভালোবেসেছি বলে তুমিও আমাকে একইভাবে ভালোবাসবে। বরং তোমারও নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে। অন্যকাউকে নিয়ে তুমি স্বপ্ন দেখতেই পারো। কিন্তু আমার স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে তুমি এটা কিছুতেই করতে পারো না অরিন। যেখানে মাত্র দুই দিন পর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা সেখানে আজকে তুমি আমাকে জানাচ্ছো যে তুমি অন্যকারো হতে চাও? আমি এটা কিভাবে মেনে নেই বলো? যদি সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকো তাহলে তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।”
অরিন মাথা উঠিয়ে অবাক হয়ে বললো,” আমাকে শাস্তি দিবেন আপনি?”
” নিশ্চয়ই দিবো। ভালোবাসি বলে কি শাস্তি দিতে পারবো না ভেবেছো? এতোটা মহান আমি না।ইলহানকে ঠকানোর পরিণাম কি হতে পারে সেটা তুমি আজ জানবে।”
অরিন শুকনো কণ্ঠে ঢোক গিলার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বললো,” কি করবেন আপনি আমার সাথে?”
ইলহান সামান্য হেসে ভ্রু নাড়িয়ে বললো,
” নিজেই দেখো কি করি?”
অরিন আরও কিছু বলতে গেলে ইলহান টুপ করে অরিনের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে দিল। ফিসফিস করে হিম কণ্ঠে বললো,” নো মোর কুয়েশ্চন।”
অরিন সাথে সাথে ইলহানের কোল থেকে নেমে নিজের সিটে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। ইলহান এতে একদম বাঁধা দিল না। বরং সে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। অরিন নিজের হাতব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখলো ব্যাগটা সামনে থেকে অনেকটুকু ছিঁড়ে গেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো, চাকুটার কারণেই ব্যাগ ছিঁড়েছিল। ছেঁড়া ব্যাগ থেকে চাকুর মাথাটা বেরিয়ে ছিল। সেটা দেখেই ইলহান ব্যাগের ছেঁড়া অংশটুকু থেকে সম্পূর্ণ চাকু টেনে বের করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। অরিন ভেবেছিল সে ইলহানের কাছে ধরা পড়ে যাবে। ইলহান হয়তো জেনে গেছে যে অরিন তাকে খুন করতে চায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ইলহান কিছুই জানেনি। অ্যাংকারের বিষয়টাও ঘূনাক্ষরেও টের পায়নি৷ সে শুধু মনে করেছে অরিন তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। কারণ তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও অন্য একটা ছেলের সাথে অরিন সম্পর্ক রেখেছে। এতেই এতো রাগ। তাহলে আসল সত্যি জানতে পারলে কি করতো? সেই কথা চিন্তা করতে গেলেও অরিনের হৃৎস্পন্দন গতি হারায়। কিন্তু ইলহানের মিথ্যে ধারণা তো অরিনের জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে গেল। এখন হয়তো ইলহান বিয়ের মিথ্যে অভিনয়টাও আর করবে না। সে সরাসরি অরিনের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার বাহানায় নিজের কার্য হাসিল করবে। এই নিয়ে তাকে কোনো ঝামেলাও পোহাতে হবে না। কারণ সে এখন চাইলেই অরিনকে দ্বিতীয় সম্পর্কটা নিয়ে ব্লেকমেইল করতে পারে। অরিনের এই সম্পর্কের কথা তার পরিবারকে জানানোর হুমকিও দিতে পারে। আর সবার কাছে তো এখন ইলহানই চোখের মণি। তার কথা কে না বিশ্বাস করবে? বরং অরিনের কথাই আর কেউ বিশ্বাস করবে না। সে কাউকে কোনোদিন বুঝাতে পারবে না ইলহান মানুষ হিসেবে আসলে কতটা নিকৃষ্ট ছিল। অরিন গাড়িতে বসে চিন্তা করছিল ইলহান এইবার কি করবে? তার শাস্তির ভয়াবহতা আঁচ করতে গিয়েও অরিন শিউরে উঠছিল।ইলহান অরিনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এই আলিশান রেস্টুরেন্ট বেছে নিয়েছে। প্রথমদিকে রেস্টুরেন্টটা ভেতর থেকে লক ছিল। ইলহান একটা অপরিচিত লোককে ফোন করার পর সে এসে দরজা খুলে দিয়েছে। হয়তো লোকটি এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জাতীয় কিছু ছিল। অরিন রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করেই বুঝলো সবকিছু আসলে পূর্ব পরিকল্পিত। তাদের মধ্যে এই ঝামেলাটা না হলেও ইলহান তাকে এখানে নিয়ে আসতো। তাই সে আয়োজন করে রেস্টুরেন্ট আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছে। অরিন স্পষ্ট অনুভব করলো তার শরীরের সব রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। ঠিক এই মুহুর্তে অ্যাংকারের অনুপস্থিতি খুব করে অনুভব করছে অরিন। অ্যাংকার থাকলে কি অরিন নিজেকে বাঁচাতে পারতো? ইলহানের অদ্ভুত কান্ডে অরিনের ভয় আরও বেড়ে যাচ্ছে। ইলহান প্রথমেই টেবিলে ডিনারের আয়োজন করলো। কিন্তু অরিন সন্দেহবশত একটা খাবারও মুখে দেয়নি। তার ধারণা এসব খেলেই সে অচেতন হয়ে পড়বে। অরিন খাবার প্রত্যাখ্যান করার পরেও ইলহান হাল ছাড়লো না। গিটার এনে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিল। অরিন গান শুনতে একদমই আগ্রহ প্রকাশ করলো না। কিন্তু ইলহান গান গাইলো। আবেদনের দৃষ্টিতে অরিনের দিকে চেয়ে মাতাল করা সুরে গান গাইলো। ইলহানের গানের অসম্ভব কমনীয় কণ্ঠটাও অরিনকে একটু আকৃষ্ট করতে পারলো না। ইলহান গান গাইতে গাইতে জোর করে অরিনকে টেনে নিয়ে ডান্স করালো। অরিন বাঁধা দিতে গিয়েও পেরে উঠলো না। তাকে নাচতেই হলো ইলহানের সাথে। সে যেনো ইলহানের হাতের পুতুল বনে গেছে আজ। ডান্স করতে করতে যখন অরিন ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসতে চাইলো তখন ইলহান গিটার রেখে টুপ করে অরিনের কোলে এসে শুয়ে পড়লো। আদেশের মতো বললো তার চুলে বিলি কেটে দিতে। অরিন কাঁপা কাঁপা আঙুল নিয়েই ইলহানের ব্রাউনিশ চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। আর ইলহান মনের সুখে গুণগুণ করে গান গাইতে থাকলো৷ কি চলছে ইলহানের মনে? অরিন আন্দাজও করতে পারছে না। তার শুধু ভয় হচ্ছে। অনেক নাম না জানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠছে। কান্না আসছে। ইলহান অনেকক্ষণ পর হঠাৎ করেই উঠে বসলো৷ তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ অরিনের ছোট্ট আত্মায় ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এবার ইলহানের উঠে বসা দেখে ভয়ে আরও বেশি আড়ষ্ট হয়ে গেল অরিন। সে শুধু অপেক্ষা করছে তার সর্বনাশের শেষটুকু দেখার। ইলহান টেবিল থেকে কাচি তুলে আনলো। তারপর অরিনের সোফার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। অরিন ফোলা ফোলা চোখে অসহ্য কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইল। ইলহান কি করবে এখন তার সাথে? ইলহান কতক্ষণ অরিনের চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে দিল। ঠোঁটের হাসি বজায় রেখেই কাচিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
” জানো অরিন, তোমাকে আমি যতটা ভালোবাসি ঠিক ততটাই নিজের করে পেতে চাই। কিন্তু তুমি কখনও আমার হতে চাও না৷ বার-বার শুধু রিজেক্ট করে আমার মন ভেঙে দাও। একটাই তো মন। কতবার ভাঙতে চাও এটা? বলো? দেখো আমার মন ভাঙার জন্য আমি তোমাকে শাস্তি দিবো না, বিশ্বাস করো। তোমাকে শাস্তি দিবো আমাকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখানোর জন্য। অন্যকাউকে ভালোবাসা দোষের কিছু না। কিন্তু একজনকে ঠকিয়ে অন্যজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাওয়াটা অবশ্যই দোষের। তুমি কি জানো তুমি আজকে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছো আমাকে? বিয়েটা নিয়ে আমার এতো স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস, আনন্দ ছিল তা এক নিমেষে ধূলিস্যাৎ করে দিতে তোমার কি একটুও মায়া লাগলো না অরিন? মেয়ে মানুষ বুঝি এতোটা কঠিন হতে পারে? আজকে তুমি আমাকে বলছো তুমি অন্য আরেকজনকে ভালোবাসো? কেনো অরিন? যদি আরেকজনকেই ভালোবাসবে তাহলে আমাকে মিথ্যে স্বপ্নটা কেনো দেখালে? কেনো এইভাবে আঘাত করে আমার হৃদয়ের ক্ষতটা আরও সহস্র গুণ গাঢ় করলে? ”
ইলহান একহাতে ভিজে আসা চোখের কোণ মুছে নিল। তারপর শ্বাস টেনে বললো,” আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুব সুন্দর হওয়ার কথা ছিল অরিন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তোমারই ভুলের জন্য আজকের এই রাত হবে সবচেয়ে সর্বনাশের এবং ধ্বংসের। তোমাকে মারাত্মক শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সেই শাস্তি ভোগ করার সময় এসে গেছে। আজকে আমি তোমার এমন হাল করবো যে তোমার এই মুখ আমি ছাড়া অন্য কাউকে দেখাতে পারবে না তুমি। আই এম স্যরি অরিন। আজকের পর থেকে তুমি শুধুই আমার অরিন হবে। আমারই থাকবে। শুধুই আমার!”
ইলহান কথা শেষ অরিনের কপালে একটা চুমু দিল। তারপর টলমল দৃষ্টি নিয়েই অরিনের সাদা কামিজ একপাশ থেকে কাচি দিয়ে কাটতে শুরু করলো। অরিন চোখ-মুখ খিচে নিয়ে একমনে বলে উঠলো,
” হে আল্লাহ, আমাকে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি দাও তুমি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here