মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৩৫

0
1291

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৩৫
লিখা: Sidratul Muntaz

অরিন ইলহানের কাছে যাওয়ার আগে অ্যাংকারকে একটা ফোন করলো। জীবনে সে একটাই মনের মতো বেস্টফ্রেন্ড পেয়েছে। যার নাম অ্যাংকার।তাকে না জানিয়ে বিয়ে করা অরিনের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া অ্যাংকারের থেকে পরামর্শও নিতে হবে। ইলহান তো একটা সাইকো। রাগের বশে যা ইচ্ছা করে ফেলে। তার উপর ভরসা করে বিয়েটা করে ফেলা যায় না।কিন্তু অ্যাংকারের উপর ভরসা আছে। সে বিয়েতে সম্মতি দিলে অরিন সাহস পাবে।
” হ্যালো অ্যাংকার।”
” গুড মর্ণিং অরিন, কেমন আছো?”
” ভালো নেই। ইলহানের মতো সাইকো বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কি কারো পক্ষে ভালো থাকা সম্ভব বলো?”
” কেনো কি হয়েছে?”
” ইলহান নতুন পাগলামি শুরু করেছে। সে নাকি আজকের মধ্যেই আমাকে বিয়ে করবে। আমি বাড়ি থেকে পালাচ্ছি।”
” হোয়াট? দেখো অরিন ভুলেও এইসব করো না৷ তোমাদের বিয়ে তো কয়দিন পর এমনিই হবে। শায়িখ আঙ্কেল আগে একটু সুস্থ হোক! মাত্র কয়টাদিন কি ধৈর্য্য রাখা যায় না?”
” সেটা আমি বুঝেছি। কিন্তু ইলহানকে কে বুঝাবে?”
” দেখেছো অরিন, ইলহানকে আমি এমনি এমনি সন্দেহ করি না। নাহলে তুমিই বলো, এই অবস্থায় ওর বিয়ে করার দরকারটা কি? তাও আবার লুকিয়ে? বাসায় জানলে ঝামেলা হবে না? আর বিয়ের পর কি ও তোমাকে বাড়ি ফিরে আসতে দিবে ভেবেছো? এমনও তো হতে পারে, এটাই তোমার শেষযাত্রা। আর কখনও তোমার বাড়ি ফেরাই হলো না। সাবধান করছি অরিন, এই বিয়ে করো না।”
” তুমি আবার একটু বেশিই চিন্তা করছো অ্যাংকার। দেখো ইলহানকে আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি। আমি কখনোই এটা ভাবতে পারি না যে ইলহান আমাকে ধোঁকা দিবে। ওর প্রতি আমার যতটা ভালোবাসা আছে তার চেয়েও বেশি বিশ্বাস আছে। তাই প্লিজ তুমি ওর সম্বন্ধে এমন জঘন্য এলিগেশন আর কখনও আনবে না৷ আমার খুব রাগ হয়।”
” তাই? তাহলে আমাকে ফোন করেছো কেনো? চলে যাও ইলহানের সাথে। এতোই যখন বিশ্বাস। আর যদি শুধু বিয়ের খবর জানানোর জন্য ফোন করে থাকো, তাহলে বলবো বেস্ট অফ লাক।”
” অ্যাংকার, তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো? এখন তুমিও ইলহানের মতো শুরু করেছো তাই না আমার সাথে? আমি তোমার কাছে পরামর্শ নেওয়ার জন্যই ফোন করেছি। কিন্তু তুমি ইলহানের ব্যাপারে নেগেটিভ কথা বলছো। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ অ্যাংকার, আমি যেমন ওকে বিশ্বাস করেছি তুমিও একটু বিশ্বাস করো!”
” কোন হিসাবে বিশ্বাস করবো? তুমি আমাকে একটা যুক্তি দেখাও। ও এখন কিসের জন্য বিয়ে করতে চাইছে? কারণ ওর মূল লক্ষ্য হচ্ছে তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করা তারপর প্রয়োজন মিটে গেলে সেই বিয়ে অস্বীকার করা। এখন বিয়ে করলে ফ্যামিলিগতভাবে তোমাদের বিয়েটা আর হবে না। তখন ইলহান নিজেই বিয়েতে বাঁধা দিবে। মিলিয়ে নিও।”
” না অ্যাংকার, তুমি আবার ভুল ভাবছো। আমি জানি ইলহান কেনো এখন বিয়েটা করতে চাইছে।”
” তুমি কচুটা জানো। আচ্ছা বলো তো, কি জানো?”
অরিন গতরাতে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহুর্তের ঘটনা অ্যাংকারের কাছে বর্ণনা দিল। এরপর বললো,
” বিয়ে নিয়ে আমি ওকে অনেক বড় কথা শুনিয়ে ফেলেছি। ও ভাবছে আমি ওকে বিয়ে নিয়ে খোঁটা দিয়েছি। ওকে অপমান করেছি। ওর আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। এজন্যই ও আমার উপর এক প্রকার রাগ থেকেই বিয়েটা করতে চাইছে।”
” এসব রাগ-টাগ কিছুই না। সব ওর অভিনয়।”
” তুমি এইসব কথা বলা প্লিজ বন্ধ করো। নাহলে আমিই তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবো।”
” অরিন, তোমাকে সাহসী আর চতুর ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমিও অনেক বোকা। ইলহান যদি তোমাকে আসলেই ভালোবাসতো তাহলে হসপিটালের রাতে ওইটা কখনোই করতো না। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো আমি কিসের কথা বলছি? ইলহান কিন্তু আগে থেকেই সুস্থ ছিল। ওর পায়ের ব্যথাও ভালো হয়ে গেছিল। তবুও শালা অসুস্থ থাকার নাটক করেছে। কারণ ও জানতো রাতে তুমি ওর কেবিনে থাকবে।”
অরিনের মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ হয়ে গেল। অ্যাংকার হসপিটালের সেই রাতের কথা কিভাবে জানে? তার মানে অ্যাংকার ওদের গোপন মুহুর্ত লুকিয়ে দেখেছে? নাহলে তো এই কথা কখনও জানা সম্ভব না। অরিন ঘৃণাভরা কণ্ঠে বললো,
” সেইদিন রাতের কথা তুমি জানলে কিভাবে? ছিঃ অ্যাংকার, তোমার থেকে আমি এইটা আশা করিনি।”
অরিন রাগে ফোন কেটে দিল। অ্যাংকার ছলছল দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল। অরিনের ছবি তার মোবাইলের ওয়ালপেপারে সেট করা। সে ছবিটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে মুচকি হাসলো। এতোদিন অরিন ইলহানকে ভালোবাসতে পারেনি। কারণ সে রায়হানকে ভালোবাসতো। তাই ইলহানের বিরুদ্ধে অ্যাংকারের সমস্ত নেগেটিভ কথা বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করতো। আর এখন কত সহজে অরিন রায়হানকে ভুলে ইলহানকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। ভালোবাসা কি আসলেই একজনের থেকে অন্যজনে এভাবে কনভার্ট হয়ে যায়? এখন সে আর অ্যাংকারকে বিশ্বাস করতে রাজি না। তার সব আশা-ভরসার জায়গা এখন শুধুই ইলহান। ইলহানের এক্সিডেন্টের পর অরিনের অবস্থা দেখে অ্যাংকার খুব আশ্চর্য হয়েছিল। কারণ সে ভাবেনি অরিন ইলহানকে মাত্র কয়েকদিনে এতো ভালোবেসে ফেলবে। অ্যাংকার তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইলহানের ব্যাপারে অরিনকে আর সতর্ক করবে না। বরং ইলহান-অরিনকে আলাদা করার জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা সে আড়াল থেকে করবে। কেননা তখন অরিন এমনিতেও আর অ্যাংকারের কথা বিশ্বাস করছিল না। কিছু বলতে গেলে অ্যাংকার নিজেই অরিনের শত্রু হয়ে যেতো। অরিন হয়তো অ্যাংকারকেই দোষী ভাবতে শুরু করতো। আর আজকে ঠিক তাই হলো, অরিন এখন আসলেই অ্যাংকারকে দোষী ভাবছে। আর ইলহানকে বিশ্বাস করছে অন্ধের মতো। অ্যাংকার তবুও চায় ইলহান-অরিন একসাথে ভালো থাকুক। কিন্তু অ্যাংকার নিজে কি এটা কোনোদিন মেনে নিতে পারবে?

অরিনকে বাসায় খুঁজে না পেয়ে অর্ণভ ফোন করেছিল। অরিন তখন জানিয়েছে,
” ভাইয়া, আমি একটা ইমারজেন্সী কাজে যাচ্ছি৷ আমার জন্য দোয়া করো। আর বাসার কাউকে কিছু জানিও না।”
” তোর ইমারজেন্সী কাজটা কি?”
” ফিরে এসে সব বলবো। কিন্তু এখন কিছু বলতে পারছি না। তুমি বাসায় ম্যানেজ করো প্লিজ।”
” আচ্ছা, ঠিকাছে। সাবধানে থাকিস।”
অর্ণভ ফোন রেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। আজকে অরিনের সাহায্য তার খুব দরকার ছিল। কিন্তু অরিনটা নেই। তবুও খুব একটা সমস্যা হবে না। অর্ণভ একা যেহেতু এতোকিছু ম্যানেজ করেছে, বাকিটাও পারবে। নিশিতাদের বাড়িতে খুব ঘরোয়াভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। হালিমা, ফয়সাল সাহেব, নৌশিন আর নৌশিনের মা রাখি সবাই একসাথে উপস্থিত হয়েছেন। সবাই বিয়ের খবর জানতো। শুধু অরিন আর নৌশিন ছাড়া। ইউসুফ সাহেব চালাকি করে ওদের জানাতে নিষেধ করেছেন। কারণ ওরা জানতে পারলে নিশিতাকেও জানিয়ে দিবে। তিনি নিশিতাকে আগে বিয়ের খবর জানাতে চাননি। কিন্তু তাঁর এই চালাকি খুব একটা কাজে দিল না। নিশিতা রাতেই সব জানতে পেরে গেছিল। তারপর অরিনদের বাসায় গিয়ে বিয়ে করবে না বলে কান্নাকাটি করে এসেছে। তখন হালিমা, ফয়সাল সাহেব নিশিতাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছেন। নিশিতা কারো কথায় মানেনি। কিন্তু অর্ণভ যখন নিশিতাকে ডেকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বুঝালো, তখন নিশিতা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল। সবাই এতে আরও খুশি হলো।ফয়সাল সাহেব সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন। কারণ এতোদিন পর তাঁর ছেলেটা গাঁধা থেকে মানুষ হয়েছে। নিজের ভালো বুঝতে শিখেছে। সুমনাকে ছেড়ে নিশিতাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছে। ইউসুফ সাহেব বিয়ের দিন অর্ণভকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন,
” দেখো বাবা, তোমার ভরসাতেই আমি নিশিকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। নাহলে সিংগাপুরে ওর জন্য পাত্রের অভাব হতো না। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে ডেলিভারিম্যানের কথা মাসখানেকের মধ্যে এমনিই ও ভুলে যেতো। কিন্তু বাংলাদেশে ফিরে আসায় ওর সাহস বেড়ে গেছে। ও এখন কারণে-অকারণে বাসা থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজছে৷ আমি স্ট্রং সিকিউরিটির মাধ্যমে ওর উপর নজর রাখছি। তোমার খালা আগেই তোমাদের কথা দিয়ে রেখেছিলেন যে তোমার সাথেই নিশিতার বিয়ে হবে৷ আর আমি কখনও কথার বরখেলাপ করি না। তাই নিশিতাকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আর তুমি যখন বলেছো, নিশিতাকে তুমি ভালো রাখতে পারবে তাই আমি তোমার উপরেই সবচেয়ে বেশি ভরসা করছি। ওই ছেলের নাম যেনো আর কখনও নিশিতার মুখে না শুনি। সেই দায়িত্ব তোমার।”
অর্ণভ ইউসুফ সাহেবকে আশ্বস্ত করে বলেছে,” আপনি একদম চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। শুধু একবার বিয়েটা হোক তারপর আমি নিশিতাকে নিয়ে বান্দরবান ঘুরে আসবো। এমনিই ও সবকিছু ভুলে যাবে।”
” তুমি কি আসলেই বান্দরবান যাওয়ার কথা ভাবছো?”
” জ্বী আঙ্কেল। এইযে দেখুন আমি টিকিটও কেটে রেখেছি। আজকে সন্ধ্যার টিকেট।”
” এতো তাড়াহুড়ো কিসের? আজকেই বিয়ে হবে আর আজকেই চলে যাবে?”
” আপনি না চাইলে থাক। টিকেট ক্যান্সেল করে দিবো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল এতে লাভ বেশি হতো। মানে ঘুরতে গেলে আমাদের মধ্যে ভালো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরী হতো। নিশিতা আরও সহজে এবং তাড়াতাড়ি ছেলেটার কথা ভুলতে পারতো।”
” ক্যান্সেল করার দরকার নেই। তোমরা যেও। আইডিয়া ভালো লেগেছে।”
অর্ণভ ভেতরে ভেতরে একটা স্বস্তিময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে যেরকম ভেবেছে সব ঠিক সেরকমভাবেই এগোচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেই হলো। হালিমা বার-বার অরিনের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। তখন বাসন্তী বলেছেন অরিন সুমনাকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে গেছে। সুমনার দাদী খুব অসুস্থ। মরার আগে সুমনাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি। তাই অরিন ইমারজেন্সী সুমনাকে নিয়ে পঞ্চগড় গেছে। এইটাও অর্ণভেরই পরিকল্পিত ঘটনা। সুমনা আসলে কোথাও যায়নি। সে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বসে আছে। অর্ণভ সিগন্যাল দিলেই সে নিচে নামবে। তারপর দু’জন পালিয়ে যাবে। আর নিশিতা চলে যাবে নাসিরের সাথে। যদিও এখনও সে নাসিরকে দেখেনি। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারা যাচ্ছে। অরিনের ইমারজেন্সী কাজ নিয়েও কেউ সন্দেহ করবে না। সুমনা বাড়িতে না ফিরলেও কেউ সন্দেহ করবে না। আর সবাই জানবে অর্ণভ-নিশিতা বান্দরবান গেছে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো নিশিতা নাসিরের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে। আর সুমনা অর্ণভের সাথে। কাজী থেকে শুরু করে বিয়ের সমস্ত যাবতীয় ব্যবস্থা অর্ণভ আর তার কয়েকজন বন্ধু মিলে করেছে। ইউসুফ সাহেব এই বিষয়ে অর্ণভের উপর পুরোপুরি আস্থা রেখেছেন। কিন্তু কেউ বুঝতেও পারেনি, কাজী সাহেব নকল ছিল। এমনকি বিয়ের সমস্ত কাগজ-পত্রই নকল ছিল। নিশিতা বিয়ের নকল কাগজে সই করার সময় ইচ্ছে করে কান্নার অভিনয় করেছে। এমন ভাণ ধরেছে যেনো বিয়ে করলে সে মরেই যাবে। যাতে কারো এ বিষয়ে সন্দেহ না হয়। বিয়ের সব ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে অর্ণভ- নিশিতা সন্ধ্যার মধ্যে বেরিয়ে পড়লো বান্দরবান যাত্রার উদ্দেশ্যে। সবাই হাসিমুখে ওদের বিদায় দিল। অর্ণভ গাড়িতে উঠার সময় ফিসফিস করে বলেছে,
” দ্যাখ নিশিতা, সবাই পালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কেমন ইন্সপায়ার করছে! এমন ঘটনা ইতিহাসে আগে কখনও দেখেছিস? পালিয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির লোক সব একসাথে দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দেয়?”
” প্লিজ ভাইয়া ফাজলামো করো না। ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
” আরে ভয় কিসের? আমি আছি না? তোকে তোর রামছাগলের কাছে রেখে আসতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ। তখন আবার আমাকে ভুলে যাবি না তো?”
” রামছাগল মানে?”
” তোর ক্যাটবেরির তো রামছাগলের মতো দাড়ি।”
” অসম্ভব। ওর পিউর চাপ দাড়ি।”
” আচ্ছা ঠিকাছে, আমার কথা বিশ্বাস করলি না তো? দেখার পর নিজেই মিলিয়ে নিস।”
নিশিতাদের গাড়ির ড্রাইভার অর্ণভ আর নিশিতাকে বাসস্ট্যান্ডের সামনে নামিয়ে চলে যায়। সেখানে নাসির অপেক্ষারত ছিল। সে নিশিতাকে এইখান থেকে নিয়ে সাজেক চলে যাবে। বান্দরবান যাওয়ার কথা থাকলেও ওরা যাবে না। কারণ ধরা পড়ার পর ইউসুফ সাহেব সবার আগে বান্দরবান টহল দিবেন। তাই সেখানে ভুলেও যাওয়া যাবে না। নাসিরকে দেখার পর নিশিতা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” ক্যাটবেরি কোথায়?”
নাসির অসহায় দৃষ্টিতে অর্ণভের দিকে তাকালো। অর্ণভ ইতস্তত হয়ে বললো, ” তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সেই তোর ক্যাটবেরি।”
নিশিতা চোখ-মুখ কুচকে একবার নাসিরের দিকে তাকিয়ে আবার অর্ণভের দিকে তাকালো। তারপর থমথমে কণ্ঠে বললো,
” মজা করছো?”
” নারে ভাই, তোর সাথে কি আমার মজার সম্পর্ক?”
নিশিতা তাও ভ্রুজোড়া ভাজ করে তাকিয়ে রইল। অর্ণভ বুঝানোর মতো করে বললো,” দ্যাখ, তুই ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাকে দেখেছিস আমি জানি না। কিন্তু এতোদিন ধরে তুই যার সাথে কথা বলেছিস সে এটাই। নাসিরুল ইসলাম। তোর ক্যাটবেরি।”
নাসির হাসার চেষ্টা করে বললো,” হায় নিশিতা।”
নিশিতা নাসিরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ গিয়ে চড় মারা শুরু করলো। অর্ণভ দুইহাতে নিশিতাকে ধরে থামানোর চেষ্টা করলো। নিশিতা ততক্ষণে পাঁচ-ছয়টার বেশি চড় দিয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। নাসির থতমত খেয়ে গেছে নিশিতার আচরণে। অর্ণভ বললো,
” কি করছিস?”
নিশিতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,” কতবড় প্রতারক। আমার সাথে এইভাবে মিথ্যে বললো? দিনের পর দিন শুধু মিথ্যেই বলে গেছে। ওর প্রত্যেকটা কথাই মিথ্যে ছিল।”
নাসির সাহস করে বললো,” প্রত্যেকটা কথা মিথ্যে না। তোমাকে ভালোবাসি, এটা সত্যি ছিল।”
নিশিতা নাসিরের কলার টেনে ছিড়তে ছিড়তে বললো,
” তাহলে ফোন বন্ধ ছিল কেনো? আমার সাথে যোগাযোগ করোনি কেনো?”
অর্ণভ নিশিতাকে শান্ত করার জন্য বললো,” আরে থাম, কথা শোন আগে। তোর সামনে আসতে ভয় পাচ্ছিল বেচারা। যদি তুই চেহারার জন্য ওকে রিজেক্ট করে দিস?”
নিশিতা অবাক হয়ে গেল এই কথা শুনে। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যাকে সে না দেখেই এতো ভালোবেসেছে, এতো পাগলামি করেছে তাকে শুধুমাত্র চেহারার জন্য রিজেক্ট করা যায়? এতো সহজ? কিন্তু প্রতারণার শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে। তাই নিশিতা গর্জে উঠলো।
” ওর মতো প্রতারককে রিজেক্টই করা উচিৎ। ”
নাসির সরাসরি পায়ে ধরে ফেললো।
” প্লিজ ক্ষমা করে দাও। মারো,কাটো যাই করো। কিন্তু ছেড়ে যেও না।”
নিশিতা ঝলসানো দৃষ্টিতে অর্ণভের দিকে তাকালো। অর্ণভ বললো,” মাফ করে দে বেচারাকে। একটা না হয় ভুলই করেছে। কিন্তু পরে তো বুঝতে পেরেছে। ক্ষমাও চাইছে।”
নিশিতা শর্ত দিল।
” রিলেশনের শুরুতেই এতোবড় প্রতারণার জন্য সারাজীবন তোমাকে জরুকা গোলাম(বউয়ের চাকর) হয়ে থাকতে হবে। বলো রাজি?”
নাসির বিনা বাক্যে রাজি হলো। বেশ খুশি হয়েই রাজি হলো। একদম ওর চোখে জল এসে গেল।
এই পরিস্থিতিতে আশেপাশের সবাই মনোযোগ দিয়ে ওদের ঘটনা দেখছিল৷ অর্ণভ মানুষদের ধমক দিয়ে বললো,
” এতো দেখার কি আছে? সরুন সামনে থেকে। আজিব পাবলিক।”
নাসির তার সাথে গাড়ি ভাড়া করে এনেছিল। কারণ নিশিতা বাসে চড়তে পারে না। নিশিতা গাড়িতে বসার পর নাসির বললো,
” ভাই, আমার ভয় করছে।”
” ভালোবাসা আর ভয় দুটো বিপরীত জিনিস। যারা ভালোবাসে তারা কখনও ভয় পায় না।”
নাসির হাত উপরে তুলে বললো,” স্যালুট বস। আপনার ঋণ আমি কোনোদিন ভুলবো না।”
অর্ণভ কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,” আমার বোনের যদি কিছু হয় তোমাকেও ভোগে পাঠাতে টাইম লাগবে না। তাই সাবধান!”
” বিশ্বাস রাখতে পারেন ভাই৷ কিচ্ছু হবে না।”
” বিশ্বাস করি। যাও, ভালো থেকো।”
নাসির গাড়ি নিয়ে চলে গেল। অর্ণভ এইবার সিএনজি নিয়ে নিশিতাদের বাড়ি ফিরে গেল। সুমনা অপেক্ষা করছে। নিশিতাদের ভবনের পেছন দিকে ফাঁকা জায়গায় এসে অর্ণভ সুমনাকে ফোন করলো,
” সুমনা, দ্রুত নিচে নাম।”
সুমনা ছাদের কোণায় এসে অর্ণভকে দেখে হাত নাড়লো। অর্ণভও হাত নেড়ে বললো,
” রেডি তো তুই?”
” জ্বী রেডি৷ কিন্তু নামুম কেমনে?”
” লাফ দে! আমি ক্যাচ ধরবো। সিনেমায় দেখিসনি?”
” আয়হায়, এসব কি বলেন? সত্যি?”
” ইডিয়েট। দ্যাখ পানির কলের সাথে মোটা দড়ি বাঁধা আছে। ওইটা ধরে সাবধানে নেমে আসবি। আমি আছি। আর তার আগে তোর ব্যাগপত্র দড়ির সাথে লাগানো বালতি দিয়ে নিচে ফেল।”
সুমনা তার ব্যাগ, মোবাইল সব বালতির সাহায্যে নিচে নামিয়ে দিল। কিন্তু নিজে নামার সময় বললো,
” আমার ভয় করতাসে। না পালাইলে হয় না?”
” চটকানা খাবি। ভালোয় ভালোয় নিচে নাম। ”
সুমনা ভয়ে জুবুথুবু আত্মা নিয়ে খুব সাবধানে নিচে নেমে আসলো। এই কাজ করতে পুরো বিশমিনিটের মতো সময় লাগলো৷ এই বিশ মিনিট মনে হয় সুমনার হৃৎস্পন্দন স্প্রিংএর মতো কেঁপেছে। আর অর্ণভের হৃৎস্পন্দন যেনো স্তব্ধ হয়ে গেছিল। যদি একটু উনিশ-বিশ হয়ে যায় তাহলেই তো সুমনা শেষ! জমিনে পা ফেলতেই অর্ণভ বুকে হাত দিয়ে বললো,
” আলহামদুলিল্লাহ। ”
সুমনা ভয়ের চোটে অর্ণভকে জড়িয়ে ধরলো। তার হাত-পা তরতর করে কাঁপছিল। অর্ণভ আরও শক্ত করে সুমনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” শান্তি, শান্তি!”
সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,” আমারে কেনো এতো ভালোবাসেন অর্ণভ ভাই?”
” কারণ তুই হচ্ছিস মায়াবিনী। তুই জাদু জানিস।”
সুমনাকে নিয়ে গাড়িতে উঠার সময় অর্ণভের ফোন এলো। অরিন ফোন করেছে।
” হ্যালো অরিন, বল।”
” ভাইয়া, তোমাদের কি অবস্থা?”
” এদিকে সব ঠিকাছে। তোর ইমারজেন্সী কাজ শেষ? ”
” হুম।”
” আচ্ছা, মা তোকে ফোন করেছিল?”
” হ্যাঁ, আমি মাকে বলেছি সুমনার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি।”
” ভেরি গুড। তাহলে এখন আর তুই বাসায় ফিরিস না। কোনো বন্ধুর বাসায় চলে যা।”
” কেনো?”
” আরে, আমি তো সুমনাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। এখন তুই বাসায় গেলে সবাই সুমনাকে খুঁজবে না? দুইদিনের আগে তো আমরা ফিরতে পারবো না।আর সুমনার গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে আসতে কমপক্ষে একরাত লাগে। তুই এখন বাসায় গেলে আগেই সবাই সন্দেহ শুরু করবে। আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত তুই কোনোভাবেই বাসায় ঢুকিস না। কেলেংকারী হয়ে যাবে।”
” কি বলছো এইসব? আমাকে বিপদে ফেলতে চাও তুমি?”
” বিপদে ফেললাম কই? তুই মাত্র দুইটা দিন ফ্রেন্ডের বাসায় থেকে ম্যানেজ করতে পারবি না? আরে তুই এখন বাড়ি ফিরলে তো আমরা চারজন মানুষ বিপদে পড়বো।”
” ঠিকাছে ভাইয়া। আমি মারিয়ার বাসায় চলে যাবো।”
” আর শোন, এখন আমি সিম চেঞ্জ করে ফেলবো। নতুন সিম থেকে তোকে পরে ফোন করবো। ভালো থাকিস।”
মোবাইল রেখে অরিন একটা রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো। তার আর ইলহানের বিয়ের কাজ কিছুক্ষণ আগে সম্পন্ন হয়েছে। ইলহান অনুরোধ করেছিল তার সাথে রিসোর্টে যাওয়ার জন্য। অরিন রাজি হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেতেই হবে। অরিনের ভয় লাগছে। সে মনের কোথাও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে। শেষমেষ কি হবে কে জানে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here