#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৩৬(প্রথম অংশ)
লিখা: Sidratul Muntaz
চারদিন পরের ঘটনা। শ্যানিন এই মুহুর্তে একটি এয়ারকন্ডিশনার যুক্ত রুমে বসে আছে৷ সে অপেক্ষা করছে এডভোকেট আমানত শিকদারের জন্য। তিনি খুব বিখ্যাত একজন প্রবক্তা৷ শায়িখ সাহেব শ্যানিনকে আমানত সাহেবের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিয়েছেন। শ্যানিন বাবার কাছে বলেছিল তার খুব বিশেষ একজন মানুষকে পুলিশ বিনা দোষে গ্রেফতার করেছে। সেই ব্যক্তিটি যে নির্দোষ, শ্যানিন এই ব্যাপারে নিশ্চিত। বিনা দোষে কারো শাস্তি হোক শায়িখ সাহেব নিজেও সেটা চান না। তাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এডভোকেট আমানত সাহেবের কাছে তিনি মেয়েকে পাঠিয়েছেন। আমানত সাহেব কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথেই শ্যানিন দাঁড়িয়ে সালাম দিল। আমানত সাহেব হাসি মুখে শ্যানিনকে বসতে বললেন। অতঃপর কক্ষের উত্তর পার্শ্বে গিয়ে সাজানো বইয়ের তাক থেকে কিছু নথিপত্র বের করতে করতে বললেন,
” তোমার পুরো নামটা কি যেনো মা?”
” শ্যানিন তাসনিম।”
” সুন্দর নাম। তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। যাকে তুমি জামিন করাতে চাইছো সে তোমার সম্পর্কে কি হয়?”
” বন্ধু।”
আমানত সাহেব নথিপত্র থেকে চোখ সরিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে একপলক শ্যানিনকে দেখে নিলেন। শ্যানিন অস্বস্তিবোধ করলো। আমানত সাহেব খানিক হেসে বললেন,
” সাতাশ বছরের একজন যুবক তোমার বন্ধু?”
শ্যানিন মিষ্টি করে হেসে বললো,
” বন্ধুত্বের জন্য বয়সের ব্যবধান নির্দিষ্ট হওয়া কি জরুরী আঙ্কেল?”
আমানত সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,” একদম না। বরং আমি তো ভাবছি কোনো যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া কিভাবে এই ছেলেটির জামিনের আবেদন করবো? সে তো আসলেই দোষী। তার এগেইন্সটে কমপ্লেইন করা ব্যক্তিও যেনো তেনো মানুষ নয়। শিল্পপতি ইউসুফ হক। একদম প্রতারণার মামলা করেছেন। আর এই ছেলেটি তো উনার আত্মীয় হয়। কেইসটা কিন্তু জটিল আছে।”
” কেইস যতই জটিল হোক। আমি জানি আপনি চাইলেই উনাকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারেন। তাছাড়া অর্ণভ ভাইয়া আসলেই কোনো দোষ করেননি। ইউসুফ সাহেবের মেয়ে নিশিতার বয়স বাইশ বছর। সে স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে। অর্ণভ ভাইয়া শুধু সাহায্য করেছেন। এখানে তো আমি দোষের কিছু দেখছি না। অন্তত মামলা করে জেলে আটকানোর মতো কিছুই হয়নি।”
” যাদের হাত লম্বা তারা চাইলে বিনা দোষেও সাধারণ মানুষকে জেলে আটক রাখতে পারে। এটা তাদের জন্য কেবল এক চুটকি বাজানোর মতো ব্যাপার। ”
” সেটা আমি জানি আঙ্কেল। আর আমি এটাও জানি আপনার মতো একজন প্রবক্তার কাছে অর্ণভ ভাইয়ের জামিনের ব্যবস্থা করাও এক চুটকি বাজানোর মতোই ব্যাপার। এজন্যই আমি আপনার কাছে এসেছি।”
আমানত সাহেব মাথা নিচু করে হাসছিলেন। এরপর দিনই অর্ণভের জামিন কার্যকর হলো। সুমনা থানার বাহিরে দাঁড়িয়ে অনবরত কাঁদতে লাগলো। সবকিছুর জন্য সে এখন নিজেকেই অপরাধী ভাবছে। সে অর্ণভের জীবনে আসার পর থেকে একটার পর একটা ঝড় এসে মানুষটার জীবন এলোমেলো করে দিচ্ছে। শুধু তার জন্য মানুষ তিনদিন জেল খেটে ফেললো। আসামীর খাতায় তার নাম উঠে গেল। শ্যানিন সুমনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
” কেঁদো না সুমনা। সব ঠিক হয়ে গেছে।”
অর্ণভ বাহিরে এসে সুমনার সাথে শ্যানিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কঠিন মুখভঙ্গিতে ভ্রু কুচকালো। তার এখন আর কিছু বুঝতে বাকি নেই। এর মানে শ্যানিনের জন্যই তার জামিনটা হয়েছে। শ্যানিন কি তাকে দয়া করলো? শ্যানিন অর্ণভের সামনে এসে বললো,
” কংগ্রাচুলেশনস। জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আমাকে ধন্যবাদ দিবেন না?”
” আমাকে এভাবে দয়া দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।”
” দয়া দেখিয়েছি? এটা ভাবলেন কি করে? আপনার চিন্তা-ভাবনায় সমস্যা আছে। সুমনা অনেকগুলো দিন আমাদের বাড়িতে অতিথির মতো ছিল। ওর সাথে আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। সেই খাতিরেই আমি ওকে সাহায্য করেছি। কারো প্রতি দয়া দেখাইনি।”
” আমার চিন্তা-ধারায় সমস্যা? আর তোমাকে কে বলেছিল আমাদের সাহায্য করতে? আমরা কেউ কি তোমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলাম?”
শ্যানিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সুমনা বললো,
” আমি গেসিলাম শ্যানিন আপার কাছে।”
অর্ণভ এবার সুমনাকে উদ্দেশ্য করে কঠিন স্বরে বললো,
” আমার অনুমতি ছাড়া কেনো গেছিলি তুই?”
সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
” আমি ভয় পাইয়া গেসিলাম।”
শ্যানিন ফিসফিস করে অর্ণভকে বললো,” বিয়ের খবর আমাকে জানালেন না কেনো? কি ভেবেছিলেন আপনাদের সম্পর্কে আমি অন্তরায় হবো? শ্যানিনকে আজও চিনতে পারলেন না।”
শ্যানিন এই কথা বলেই চলে গেল। সুমনা ডাক দিতে চাইলো। কিন্তু অর্ণভের ভয়ে ডাকলো না। অর্ণভ শ্যানিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,” সবাই টাকার গরম দেখায়।”
হালিমা তেজস্বী কণ্ঠে বললেন,” হঠাৎ বিয়ে করবি না কেনো? তোরা ভাই-বোন মিলে কি শুরু করেছিস? আমাদের কবরে পাঠাতে চাস? তোর বাবা এই কথা শুনলে এখন স্ট্রোক করবে। সবকিছু তো আগে থেকেই ঠিকঠাক ছিল তাহলে হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেনো? তোর যা ইচ্ছা তাই করবি নাকি? ভাই-বোন মিলে ভালোই তো নাটক শুরু করেছিস। একজন কাজের মেয়ে নিয়ে পালাবে অন্যজন বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হওয়ার পর বিয়েতে নিষেধ করে দিবে। মানে তোরা কেউই আমাদের মান-সম্মানের ধার ধারিস না তাই তো? মানুষের সামনে যেনো আমরা মুখ দেখাতে না পারি সেই ব্যবস্থা করতে উঠে পরে লেগেছিস। ভয়ংকর কোনো পাপ না করলে তোদের মতো কুলাঙ্গার সন্তান জন্ম হয় না।”
হালিমা চেচামেচি করে অরিনের ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। অরিন নির্বিকারভাবে জানালায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল। একটু আগে সুমনা ম্যাসেজ করে অরিনকে জানিয়েছে অর্ণভের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার খবর। মা-বাবা এই বিষয়ে কিছুই জানেন না। অর্ণভ জেলে গেছে জানতে পারলে অর্ণভের বাবা হয়তো কিছু ভাববেন না কিন্তু মা ভেঙে পড়বেন। তাই অরিন বাসায় কিছু জানায়নি। বাসন্তী খালাদের সাথে আপাতত তাদের তুমুল ঝগড়া চলছে। একেবারে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। এই বাড়ির মানুষ ওই বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। নিশিতা আর নাসির পালিয়ে সেদিনই বিয়ে করে ফেলেছিল। সাজেকের একটা হোটেলে ওরা মাত্র একরাত অবস্থান করতে পেরেছে। এরপরদিনই ধরা খায়। অরিন ইলহানের সাথে ঝগড়া করে সেদিন বাসায় ফিরে এসেছিল।তারপর বিকালেই নিশিতা আর নাসিরকে তুলে আনা হলো। ইউসুফ সাহেব আগেই অর্ণভকে সন্দেহ করেছিলেন। তাই ওদের সাথে গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন। আর অর্ণভের মোবাইলও বন্ধ ছিল৷ নিশিতা নিজের মোবাইল বাসায় ফেলে গেছিল। এদিকে গুপ্তচরের থেকেও জানা গেল ওরা বান্দরবান যায়নি। আবার সুমনাও বাড়িতে নেই। অরিনও বাড়ি ফিরে এসেছে সুমনাকে ছাড়াই। ইউসুফ সাহেব দুয়ে দুয়ে চার করে ফেললেন। তারপর নিশিতার ফোন থেকে নাসিরের মোবাইল নাম্বার ট্র্যাক করে ওদের অবস্থান বুঝে ফেললেন। নিশিতা আর নাসির ধরা খাওয়ার পর অর্ণভও ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হলো। ইউসুফ সাহেব নিজের মেয়ের জামাইকে কিছুই বললেন না। তাঁর সমস্ত খোভ প্রকাশ পেল অর্ণভের উপর। ক্ষমতার বড়াই দেখাতে তিনি অর্ণভকে জেলে পুরে দিলেন। আজকে শ্যানিনের মাধ্যমে অর্ণভ ছাড়া পেয়েছে। শ্যানিনকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। কিন্তু অরিন ধন্যবাদ দিতে পারছে না। তার খুব অস্বস্তি লাগছে। শ্যানিন যদি ইলহানের সাথে ঝামেলার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে তখন অরিন কি জবাব দিবে? ইলহানের সাথে অরিনের দেখা হয় না প্রায় পাঁচদিন। কথাও বন্ধ হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। লুকিয়ে বিয়ে করার পরদিন তাদের মধ্যে ভয়ানক একটা ঝগড়া হয়। তারপর দুইজন দুই পথে চলে যায়৷ এখন না ইলহান অরিনের মুখ দেখতে চাইছে আর না অরিন ইলহানের মুখ দেখতে চাইছে। দুজনই পরিবারের কাছে বিয়ের ব্যাপারে নাকচ করে দিয়েছে। এজন্যই এতোক্ষণ হালিমা অরিনের ঘরে এসে চিৎকার চেচামেচি করে গেছেন। কিন্তু অরিনের এতে কিছুই যায়-আসেনা৷ ইলহানকে বিয়ে করা তার পক্ষে এখন অসম্ভব।
চলবে