ইন্টারভিউতে যাবার দুদিন আগে রাতে নিলুফারের শাশুড়ি বললেন,”আমার বাড়ির বউ হয়ে থাকতে হলে কোনো চাকরি করা যাবে না,আর চাকরি যদি করতে হয় সংসার ছাড়তে হবে তোমার।”
শাশুড়ির কথা শুনে নিলুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।মাথা ঝিমঝিম করছে যেনো।
জবাবে কী বলবে সে?
সে কী বলবে যে আপনার তো স্বামী আছে, চার ছেলে আছে রোজগার করার মতো ,তাই আপনি জানেন না সংসারে অভাব কাকে বলে,আমার মায়ের মতো যদি ঘরে ৪টা মেয়ে থাকতো,বিধবা হতেন তবে বুঝতেন সংসারে অভাব কাকে বলে?
গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা কান্নার জন্য নিলু বলতে পারে নি কিছু।
শাহেদ বাসায় ফিরলো রাত ৯টায়।বাজারে ওর একটা কনফেকশনারি আছে।বাসায় এসেই চড়া গলায় নিলুকে ডাকতে শুরু করলো।শাহেদের গলার আওয়াজ পেয়ে নিলুর অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো।নিলু জানে এখনই ওর শাশুড়ি ফুঁসতে থাকবেন রাগে।
শাহেদ ঘরে ঢুকেই নিলুকে বললো,”তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দাও নিলু,আমি চেঞ্জ করে নিচ্ছি এই ফাঁকে। ”
নিলু মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে গেলো।চা বানিয়ে কাপে নিবে সেই মুহুর্তেই ঘরে বিস্ফোরণ ঘটলো যেনো।
শাশুড়ির চিৎকারে নিলুর হাত থেকে চা’য়ের পাতিল পড়ে গেলো।
নিলু জানে উনি এখন কি বলবেন। ভয়ে,লজ্জায় নিজের দু’কান চেপে ধরলো নিলু যাতে ওনার কথাগুলো শুনতে না পায়।
কিন্তু নিস্তার পেলো না,রান্নাঘর থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলো শাশুড়ি বলছেন,”একে তো বাঁজা মেয়ে,তার উপর এখন আধিখ্যেতা দেখাচ্ছে চাকরি করবার,আরে তোর বউয়ের এসব রংঢং কি আমি বুঝি না ভাবস তুই?”
শাহেদ কাতর স্বরে আবেদন করে বললো,”আল্লাহর দোহাই লাগে মা,আস্তে কথা বলো।নিলু শুনতে পেলে কষ্ট পাবে খুব।ওকে বাঁজা বলো না তুমি,তোমার পায়ে পরি।ডাক্তার বলেছে ওর কোনো সমস্যা নেই,বাচ্চা হতে এমনিতেই দেরি হচ্ছে।আর চাকরি করতে আমি ওকে নিষেধ করে দিব মা,তবুও ওকে নিয়ে এসব কথা বলো না।ওর চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলো না।আমার নিলু এরকম মেয়ে না।”
“হ,তোর নিলু তো দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা,এখন কি আমার তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো লাগবো?
এই বাঁজা মাইয়ারে আমার শুরু থাইকাই পছন্দ না,তুই কি দেইখা দেওয়ানা হইলি আমি বুঝি না।বিয়ার ৩ বছর হইছে এখনো বাচ্চা দিতে পারে নাই।তারে আবার আমার সম্মান দিয়া কথা কইতে হইবো এখন?তার ভয়ে আমারে বিলাইয়ের মতন মিউমিউ কইরা কথা কইতে হইবো?
তোর বউ কি প্রিন্সেস ডায়না নাকি?
এই রেহানা বেগম কাউরে ভয় খায় না,কাউরে কর দিয়া চলে না।”
শাশুড়ির উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ নিলুর হৃৎপিণ্ড কে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে যেনো।
নিলুর মনে হচ্ছে ও যেনো কোনো পশু,যে বাচ্চা দিতে পারে না বলে এভাবে কথা শোনানো হচ্ছে। নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না নিলুর এরকম কথা শুনে।
শাহেদ যেনো কান্না করে দিবে,শাহেদের এরকম অসহায় কণ্ঠ নিলু আগে কখনো শোনে নি।শাহেদ মিনতি করে বলছে,”মা,আমি যদি সন্তান ছাড়াই নিলুকে নিয়ে খুশি থাকতে পারি তবে কেনো তুমি এরকম করছো?
আমার তো কোনো সমস্যা নেই এটা নিয়ে।”
রেহানা বেগম ক্রুদ্ধস্বরে বললো,”তুই তো আর পুরুষ মানুষ নাই রে শাহেদ,তুই তো তোর বউয়ের চাকর হইয়া গেছস,এজন্যই বুঝস না বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া জীবনের কোনো দাম নাই।তাইলে তুই কি করতে দোকান চালাস আমারে ক তো,তুই শাড়ি পইরা বাড়িত থাক,তোর বউয়ের যখন রাস্তায় উঠার শখ,তোর বউ দোকান চালাক।আমার চাইর পোলার মইধ্যে তোর মতো বউয়ের গোলামী কোনো জন করে না।
কতোবার কইরা কইছি আমার ছোট ভাইয়ের মাইয়া সুরমারে বিয়া করনের লাইগা,শুনলি না।মাইয়াডার কপাল পোড়া দেইখাই অল্প বয়সে বিধবা হইছে।তোরে কতো পছন্দ করতো।আমার ভাইয়ের হইলো গিয়া হাত খোলা,পুরা বাড়ি সাজাইয়া দিতো আমার ভাই।বিয়া করতে গেলি এতিম মাইয়া,কি দিতে পারছে ওই মাইয়া এখন তোরে?
বাপের বাড়ি থাইকা একটা সুতাও আনতে পারে না যেই মাইয়া,বাচ্চা দিতে পারে না যেই মাইয়া,তার কতো আধিখ্যেতা আবার।”
শাহেদের এসব অপমান নিলুর সহ্য হচ্ছে না।
মনে মনে আল্লাহ কে বললো,”দুনিয়ায় এতো মানুষের মরণ হয় খোদা,আমার কেনো হয় না?
আমাকে কেনো আজরাইল চোখে দেখে না।আমাকে নিয়ে এই রকম আর খেলো না,আমাকে নিয়ে যাও এই দুনিয়া থেকে।আমার জন্য আমার স্বামীর এতো অপমান হয়,তাকে আর অপমানিত করো না।”
ভিতরে কাঁচের কিছু একটা ভাঙার ঝমঝম আওয়াজ ভেসে এলো।নিলু দৌড়ে নিজের রুমের দিকে গেলো।রুমে গিয়ে দেখে শাহেদ রাগের মাথায় টেবিলের উপর থেকে জগ নিয়ে আছাড় মেরে ফেলে দিয়েছে।রাগে,জিদে শাহেদের মুখ রক্তাক্ত হয়ে আছে।
ভয়ে নিলুর চেহারা পাংশুটে হয়ে গেলো।
নিলুকে দেখার সাথেসাথে রেহানা বেগমের কাঁটা গায়ে যেনো কেউ লবণের ছিঁটা দিলো,ছুটে এসে নিলুর গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে চিৎকার করে বললেন,”বহুত সহ্য করছি তোগো এসব,আর সহ্য করমু না।হয় তুই বান্দীর মাইয়া এই বাড়ি থাকবি,না হয় আমি এই বাড়ি থাকমু।এরকম বাঁজা মেয়েছেলের লগে এক ছাদের নিচে আমি থাকমু না।”
পুরো পৃথিবী যেনো নিলুর চোখের সামনে ঘুরতে লাগলো। কখন যেনো মাথা ঘুরে নিলু পড়ে গেলো বুঝতেই পারে নি।
জ্ঞান ফিরতেই দেখে শাহেদ পায়ের কাছে বসে আছে। নিলুকে উঠে বসতে দেখে শাহেদ মাথার কাছে এসে বসলো।নিলু কিছু বুঝে উঠার আগেই শাহেদ নিলুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
নিলু কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।
ভাগ্যে যদি সন্তান না থাকে তবে কে পারে সন্তান দিতে?
আল্লাহ যদি সন্তান না দেয় কার ক্ষমতা আছে সন্তান দেয়ার?
কেনো আম্মা বুঝে না এটা?
নিলু জবাব খুঁজে পায় না এসব প্রশ্নের।
দরজায় কারো টোকা পড়তেই শাহেদ নিলুকে ছেড়ে উঠে গেলো। নিলু বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলো।
কিছুক্ষণ পর নিলুর ফোনটা বেজে উঠতেই নিলু বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ফোন ধরলো।
দেখে মা ফোন দিয়েছে।
নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে নিলুর মেজো বোন শিলু বললো,”আপা,কেমন আছিস?”
“ভালো আছি রে,তুই কেমন আছিস শিলু?”
“আপা,আমাকে শিলু বলবি না প্লিজ,শিলু বললে কেমন নিজেকে শেয়াল শেয়াল মনে হয় আমার।”
শিলুর কথা শুনে নিলু হেসে উঠলো।শিলুটা সবসময় কেমন মজা করে কথা বলে।
শিলু বললো,”আপা,আমার টেস্ট পরীক্ষা ও তো শেষ,এইচএসসি ঘনিয়ে এলো,বলছিলাম কি,আমার না ফিজিক্সে একটু সমস্যা আছে,ফাইনালের আগে যদি দুটো মাস প্রাইভেট পড়তে পারতাম আমি।”
শেষের কথাগুলো বলার সময় শিলুর গলা ধরে এলো,নিলু স্পষ্ট বুঝতে পারছে শিলুর চোখ ভিজে উঠেছে।
ওকে অভয় দেয়ার জন্য বললো,”ভাবিস না,পড়িস তুই।আমি ম্যানেজ করে নিবো সব।”
আমতাআমতা করে শিলু বললো,”তোর শাশুড়ি যদি এবারও জানতে পারে তবে….”
শিলু আর কথা শেষ করলো না।নিলুর বুকের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুন আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
মনে পড়ে গেলো দুবছর আগের কথা।শিলুর মেট্রিক পরীক্ষার আগে ও ঠিক এরকম হয়েছিলো,শিলুর হায়ার ম্যাথে প্রব্লেম ছিলো।
শাহেদ কে নিলু বলার সময় ওর শাশুড়ি শুনে ফেলে,আর তারপর উনি যা বলেছেন সেসব কথা মনে পড়লে এখনো নিলুর শরীর শিউরে উঠে।
একটা চাকরি ভীষণ দরকার নিলুর।
শিলুর কথার মাঝেই নিলুর মা সাবিনা বেগম ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে নিলো।তারপর নিলুকে বললো,”নিলু,মা আমার,তুই শিলুর কথা পাত্তা দিস না।আমি ওর প্রাইভেটের ব্যবস্থা করবো।তুই ভাবিস না মা।জামাইকে আবার বলতে যাস না।তোর সংসারে আমাদের নিয়ে যেনো অশান্তি না হয়।”
নিলু মনে মনে বললো,”মা তুমি তো জানো না,কি সুখের সংসার আমার,কি সুখে আমি আছি।কিচ্ছু জানো না মা তুমি,কিচ্ছু না।”
#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব: ০১
জাহান আরা
#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০২
জাহান আরা
শাহেদ রুমে এলো রাত ১২টার দিকে।কেমন বিধ্বস্ত,ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো ওকে।শাহেদের মুখে যেনো আষাঢ়ের মেঘ জমে আছে।
নিলুর মন কু ডাক ডাকতে শুরু করলো। মনে মনে দোয়া ইউনুস জপে যাচ্ছে নিলু।
শাহেদ রুমের দরজা লাগিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো।নিলু বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেলো শাহেদের কাছে।শাহেদের পুরো শরীর অনবরত কাঁপতে লাগলো।
নিলু কিছু বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এসব।শাহেদ এরকম করছে কেনো?
শাহেদকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কী হয়েছে,শাহেদ নির্বাক হয়ে রইলো।
নিলুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো নিলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।নিলু টের পাচ্ছে শাহেদের চোখের জলে নিলুর ব্লাউজের পিঠের দিক ভিজে যাচ্ছে।আর নিলুর চোখের জলে শাহেদের শার্টের পিছনের দিক।
দুজনেই কাঁদছে।
শাহেদের কান্না থামার পর নিলু শাহেদকে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে তোমার? ”
শাহেদ বললো,”মা রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছে।”
নিলু হতভম্ব হয়ে গেলো শুনে।কি বলছে শাহেদ এটা?
সত্যি সত্যি উনি বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে?
নিলুর কি অপরাধ এতে?
নিলুর চাকরি করতে চাওয়া?
নিলুর সন্তান না হওয়া?
নিলুর বাবার বাড়ি থেকে কিছু দিতে না পারা?
এই দোষ ছিলো নিলুর?
এই দোষের শাস্তি রেহানা বেগমের শাশুড়ির গৃহ ত্যাগ?
শোকের তীব্রতায় নিলু স্তব্ধ হয়ে গেলো।
শাহেদ নিলুর বিবর্ণ মুখ দেখে বুঝতে পারলো নিলুর উপর দিয়ে কী যাচ্ছে। নিজের মায়ের এরকম ব্যবহার দেখে শাহেদ ও হতভম্ব। কিন্তু কি করবে শাহেদ?
মা তো,যা-ই বলুক,মায়ের জন্য সাত খুন মাফ।মা’কে তো আর দোষী বলা যায় না।
শাহেদ মনে মনে ঠিক করলো,আগামীকাল দুজনে গিয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বাসায় নিয়ে আসবে।
নিলুকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালো শাহেদ,নিজেও বসলো নিলুর পাশে,তারপর কোমল স্বরে বললো,”বাদ দাও নিলু,মা যখন চায় না তোমার চাকরির জন্য চেষ্টা করতে হবে না।তুমি চাকরির চিন্তা বাদ দাও।”
শাহেদের এই নির্দয়তা নিলুকে হতভম্ব করে দিলো,কাঁপা কাঁপা গলায় নিলু বললো,”কী বলছো তুমি এসব?
তুমি জানো না একটা চাকরি আমার কতো দরকার,বাড়তি ১হাজার টাকা পেলেও সেটা আমার মায়ের জন্য এখন ১ লক্ষ টাকার মতো। আমার তিনটা বোন আছে,ওদের লেখাপড়া,ওদের খরচ,সংসারের খরচ,মা একা একজন রোগা মানুষ, তুমি জানো মা বারোমাস অসুস্থ থাকে,এই শরীর নিয়ে ওনার একার পক্ষে সম্ভব না সংসার চালানো।মায়ের রোজগারের উৎস তো একটাই,বাবার রেখে যাওয়া এক টুকরো জমি।
আমাদের সংসারের এই দুরবস্থা তুমি আগে থেকেই জানো,সেখানে তুমি আমাকে বলছো আমি চাকরি না করতে?”
শাহেদ বিরক্ত হলো নিলুর এরকম কথা শুনে।নিলু এতো নির্বোধ কেনো?
নিলুকে বুঝানোর জন্য বললো শাহেদ,”দেখো নিলু,তোমার আগে নিজের সংসার বাঁচাতে হবে,তুমি এখন ওনাদের পরিবারের কেউ না,এখন তুমি এই পরিবারের বউ,তোমার চিন্তা থাকবে আমাদের সংসার নিয়ে।মা যখন চায় না তখন তোমার চাকরির চিন্তা মাথায় আনার ও দরকার নাই।চাকরি করা মেয়েরা স্বামীদের দাম দেয় না,নিজেকে নিজে অনেক বড় মনে করে,সংসারে মন থাকে না তাদের।মেয়েদের চাকরি হচ্ছে নিজের রান্নাঘর,নিজের সংসার। শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করা,সন্তানের সেবা করা,স্বামীর সেবা করা,এর চাইতে বড় চাকরি আর কি?”
শুকনো হেসে নিলু বললো,”এসব কথা কবে থেকে শিখলে শাহেদ?
আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমার মা,বোনদের প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই?
বিয়ের আগে কি আমি তোমাকে বলি নি এসব কথা,না-কি তুমি তখন জানতে না আমার চাকরি করতে চাওয়ার কথা?
তুমি নিজে তখন বলেছিলে আমি চাইলে চাকরি করতে পারবো,কোনো আপত্তি থাকবে না তোমার পরিবার থেকে।এমনকি যেখানে তোমার বড় দুই ভাবী দুজনেই কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করে।”
নিলুর কথা শুনে শাহেদ খুব বিরক্ত হলো।নিলু কবে থেকে এসব ভাগ করতে শুরু করেছে বড় ভাবীদের সাথে শাহেদ ভেবে পেলো না।শাহেদ রেগে গিয়ে বললো,”ভাবীরা দুজন থাকেন স্কুলে,বাসায় মা একা,রাহাতের বউ থাকে বাপের বাড়ি,তাহলে সারাদিন মায়ের সাথে থাকবে কে?
বাসায় কাজকর্ম করবে কে তুমিও যদি চাকরিতে যাও?
রান্নাবান্না,ঘরের কাজ এসব কি মা করবে?
তোমার মায়ের সংসারের জন্য এখন আমার মা’কে দিয়ে কাজ করাতে চাও না-কি তুমি নিলু?”
নিলুর ভীষণ হাসি পেলো শাহেদের কথা শুনে।কষ্টের হাসি।হেসে উঠলো নিলু।
শাহেদ জিজ্ঞেস করলো,”হাসছো কেনো এরকম?”
“তোমার লজিক শুনে হাসছি শাহেদ।”
“কী?”
“তোমার কথার মানে হচ্ছে তোমার ভাবীরা সবাই বড়লোকের মেয়ে,তারা কোনো কাজ করতে পারবে না।তারা চাকরি করবে,বাপের বাড়ি থাকবে।
কেনো?
কারণ তাদের বাবার বাড়ি থেকে খাট,ফার্নিচার,টিভি,ফ্রিজ আনতে পেরেছে।
আমি এতিম মেয়ে,আমার মায়ের সামর্থ্য নেই কিছু দেয়ার,আমি বাঁজা মেয়েও,তাই আমাকে থাকতে হবে দাসীর মতো। শাহেদ একটা কথা বলো তো,তুমি কি আমাকে বউ করে এনেছো,না-কি কাজের মেয়ে এনেছো?”
শাহেদ খুঁজে পেলো না নিলুর কথার কি জবাব দিবে সে?
সে তো এসব ভেবে বলে নি কথাটা।মায়ের কথা ভেবেই বলেছে এই কথা।এসব কথার এই অর্থ বের করবে নিলু,শাহেদ তা বুঝে নি।নিলু এরকম গুছিয়ে জবাব দিবে তাও শাহেদ ভাবে নি।
নিলুর বলা প্রতিটি কথা শাহেদকে তীরের মতো বিঁধলো।বিশেষ করে নিলুর নিজেকে বাঁজা মেয়ে বলা।
শাহেদ কখনোই সন্তান না হওয়াকে নিলুর দোষ দেয় নি।নিলু কেনো তবে এসব কথার মধ্যে সন্তানের কথা টেনে আনলো?
কেনো নিলু নিজেকে বাঁজা বললো?
নিলু কি জানে না শাহেদ এই কথা সহ্য করতে পারে না?
শাহেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”নিলু,তোমাকে আমি আগেও বলেছি,কখনো সন্তান না হওয়ার জন্য নিজেকে দোষারোপ করবে না,নিজেকে বাঁজা মেয়েছেলে বলবে না,আমার এসব পছন্দ না।আমি সারাজীবন সন্তান ছাড়া থাকতে পারবো তুমি থাকলে,তবে কেনো আমাকে কষ্ট দিতে এই কথাটা বললে নিলু?”
নিলু বললো,”এটুকুতেই এতো কষ্ট হলো শাহেদ?
আর আমি যে উঠতে বসতে এই কথাটা শুনি তখন আমার কেমন লাগে?”
শাহেদ আর কথা বাড়ালো না।প্রসঙ্গ বাদ দিতে বললো,”কাল আমরা মা’কে আনতে যাবো,তুমি গিয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বলবে,চাকরি করবে না।দেখবে মায়ের রাগ কমে যাবে।”
নিলু সোজাসুজি জবাব দিলো,”অনেক হয়েছে শাহেদ,আর না।
আমি যাবো না কাল আম্মা কে আনতে,আর আমি এমন কোনো অপরাধ করি নি যে ওনার পা ধরতে হবে আমার।অপরাধ তোমার মা করেছে,বিনা অপরাধে আমাকে থাপ্পড় মেরেছে।
আর আসল কথা হচ্ছে,পরশু আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবো।মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না।”
নিলুর এরকম চ্যাটাংচ্যাটাং কথা শাহেদের সহ্য হলো না,রেগে গেলো শাহেদ নিলু যখন বললো,সে কোনো দোষ করে নি,দোষ শাহেদের মা করেছে।
নিলুর গালে সজোরে চড় মেরে বললো,”এতো বড় সাহস তোর,আমার সামনে বসে বলছিস আমার মা অপরাধ করেছে,এখনই তোর এতো বাড় বেড়েছে,চাকরি করলে তো তুই ধরা কে সরা জ্ঞান করবি না।”
চড় খেয়ে নিলু চুপ হয়ে গেলো।আর একটা কথাও বললো না।বিছানার এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। শাহেদের দেওয়া চড়ে নিলু যে ব্যথা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছে শাহেদের ব্যবহারে। শাহেদ নিলুর গায়ে কখনো হাত তুলতে পারে নিলু কখনো কল্পনা ও করে নি,এরকম রেগে গিয়ে তুইতোকারি করতে পারে তাও নিলু জানতো না।
এজন্য অন্য এক শাহেদ,নিলুর চেনা সেই শাহেদ না।যে শাহেদ গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে হাতড়ে দেখে নিলু কোথায়,অন্য বালিশ থেকে তুলে এনে নিজের বুকের উপর শুইয়ে দেয় নিলুকে,তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়,এই সেই শাহেদ না। কিছুতেই না।
চলবে….?
#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০৩
জাহান আরা
রেহানা বেগম এবার পুরো আটঘাট বেঁধে নেমেছেন।বড় ভাইয়ের বউয়ের থেকে খবর পেয়েছেন সুরমার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। এতোদিনে সুরমার মত করতে পেরেছে সবাই। খবরটা শোনার পর থেকে রেহানা বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন।তার উর্বর মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে চমৎকার পরিকল্পনা করে ফেললেন তিনি।
ভাইয়ের বাড়ি এসেই তিনি মরাকান্না জুড়ে দিলেন।
রেহেনা বেগমের ভাই রফিকউল্লাহ,স্ত্রী সালেহা রেহানা বেগমের এই কান্না দেখে আশ্চর্য হলেন।রেহানা বেগমের ভরা সংসার। ছেলেরা সবাই ভালো রোজগার করে,সংসারে অভাব নেই,তাহলে এই কান্নার কারণ কি কেউ বুঝতে পারলেন না।
সোফায় বসে সুরমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফুফুকে দেখছে।সুরমার ৪ ফুফুর মধ্যে রেহানা বেগম সবচেয়ে বেশি আদর করেন সুরমা কে।যদিও তার পিছনে ফুফুর স্বার্থ আছে একটা,সেটা সুরমা জানে।জানার পরেও এই মহিলাকে তার ভাল্লাগে।
শুধুমাত্র শাহেদের মা বলেই সুরমার এই মহিলাকে ভাল্লাগে।
কতোদিন শাহেদ কে দেখে না সুরমা!
বুকের ভিতর একটা গোপন কষ্ট সুরমা কে সারাক্ষণ কাঁদায়।কেনো শাহেদ তাকে ভালোবাসে নি?
কি দিতে পারতো না সুরমা তাকে?
রূপ-যৌবন কোনটার কমতি ছিলো সুরমার?
আজও সুরমা অপেক্ষা করছে শাহেদের।যদি একবার শাহেদ কে পেতো।
মাঝেমাঝে সুরমার ভীষণ যন্ত্রণা হয়,কেনো নিরুর কপাল এতো ভালো?
কেনো মেয়েটা শাহেদ কে পেলো?
রেহানা বেগম বিলাপ করে বললেন,”আমার শাহেদ একটা ডাইনী আনছে ঘরে রে ভাই,আমার সুখের সংসার তছনছ কইরা দিছে ওই ডাইনী।
আইজ আমারে ঘর থাইকা বাইর কইরা দিছে।আমি কই যামু,কে আছে আমার তোরা ছাড়া? ”
সুরমা খুশি হলো,নিরুর নামে অপবাদ শুনলে সুরমার আনন্দের সীমা থাকে না।
রফিক মিয়া হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি কস তুই,তোরে বাইর কইরা দিছে কেমনে?
তোর পোলা কই আছিলো,সুমনের বাপেরে (রেহানা বেগমের বড় ছেলে সুমন) কস না তুই?
রেহানা বেগম আরো জোরে বিলাপ করে বললেন,”হ্যায় তো বিদাশে-বিঘাটে থাকে,বাড়ি থাকলে না হয় একটা বিহিত করতো,আমি আসার সময় বইলা আসছি ফোন কইরা।আমার বুঝি কপাল পুড়লো রে ভাই।”
সুরমা কটাক্ষ করে বললো,”খোঁজ খবর না নিয়া পোলা বিয়া করাইয়া আনসো,মাইয়ার স্বভাব চরিত্র কেমন তার খবর ও লও না।দ্যাশে কি মাইয়ার রাট(অভাব) পইরা গেছিলো নি?”
রেহানা বেগম ফোৎ করে নাকে সর্দি ঝেড়ে বললেন,”তাবিজ করছে রে মা,ওই ডাইনী আমার শাহেদরে তাবিজ করছে,মাইয়া দেখতে গেছে যখন অই সময় আমার শাহেদরে চিনি পড়া দিয়া শরবত বানাইয়া খাওয়াইছে,পান পড়া খাওয়াইছে,এর জন্যই তো আমার শাহেদ এতো দেওয়ানা হইছে।”
সুরমার মা আফসোস করে বললেন,”থাউক আপা,কাইন্দেন না,আসছেন যখন কয়েকটা দিন বেড়ান।”
রেহানা বেগম কন্ঠে কাঠিন্য এনে বললেন,”এই বার আমি সিদ্ধান্ত নিয়াই আসছি,হয় ওই বাঁজা মাইয়ারে আমার পোলা ছাইড়া দিবো,আর নাইলে ওই মাইয়ার উপরে আমি শাহেদরে আবার বিয়া করামু,আমার সুরমা মা’র মতন লক্ষ্মী একটা মাইয়ারে বিয়া করামু আমি ওরে,ওর বান্দীদ মাইয়া সতীনের ভাত খাইবো”
কথাটা শুনে সুরমার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো খুশিতে।এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।
সুরমার মনে আনন্দ আর ধরে না।এতোদিনের স্বপ্ন কি এবার সত্যি হবে?
★
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শাহেদ গোসল করে রেডি হলো,নিলু চুপচাপ নাশতা বানিয়ে এনে শাহেদের সামনে রাখলো।
শাহেদ রেডি হতে হতে বললো,”তাড়াতাড়ি রেডি হও নিলু।”
নিলু ঠান্ডা গলায় বললো,”আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি,আমি যাবো না কিছুতেই।”
নিলুর এই বাড়াবাড়ি রকমের জেদ শাহেদের কাছে অচেনা লাগলো। বরাবরই নিলুকে দেখেছে শান্ত থাকতে,তবে কেনো আজ সেই নিলু এতো কঠোর হলো?
শাহেদের মনে হলো হটাৎ করে যে নিলু কি বদলে গেছে?
পরক্ষণেই মনে পড়লো,নিলু যফি বদলায় ও তারজন্য শাহেদ দায়ী,শাহেদের পরিবার দায়ী।
নিলু শাহেদের এই নীরবতা দেখে বললো,”আমি আজ বাড়ি যাবো।”
শাহেদ প্যান্টের বেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো,”কোনো দরকার নেই,তোমার সংসার এটা,এখানেই তোমার বাকী জীবন কাটাতে হবে।”
নিলুর সহ্য হলো না এরকম স্বার্থপরের মতো কথা।আর একটা কথা ও না বলে নিলু সোজা গিয়ে ব্যাগ গুছাতে লাগলো।
শাহেদ হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বললো,”তুমি কোথাও যাবে না।”
নিলু জোর গলায় বললো,”আমার বাপের বাড়ি আমি একশো বার যাবো,৬মাস ধরে বাড়ি যাই নি,আমার বুকের ভিতর কি পরিমাণ কষ্ট জমে আছে তা তুমি জানো না।আমাকে যেতেই হবে মায়ের কাছে।বাবার কবর দেখে আসবো,নিজের ভিতরে জমে থাকা কষ্ট সব বাবার কবরের কাছে বলে আসবো।”
নিলুর এসব কথা শুনে শাহেদের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। কি এমন কষ্ট পাচ্ছে নিলু যে এভাবে বলছে।কিসের এতো কষ্ট?
নিলুকে জিজ্ঞেস করলো শাহেদ,”কি এমন কষ্ট তোমার?এখানে কি তোমার ভাত কাপড়ের অভাব,নাকি কিসের অভাব?”
নিলু মুখের উপর জবাব দিলো,”মায়ের অভাব এখানে আমার।”
“আমার মায়ের এটুকু তুমি সহ্য করতে পারো না নিলু?”
নিলু কিছু বললো না।শাহেদ তো জানো না যতক্ষণ শাহেদ বাসায় থাকে ততক্ষণ নিলুকে কতো অপমান হজম করে যেতে হয়।
নিলু এই প্রসঙ্গে কিছু বললো না।শাহেদের মনে নিজের মায়ের সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাক নিলু তা চায় না।তার জন্য মা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরুক নিলুর তা কাম্য নয়।
নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো নিলু।শাহেদ অবাক হয়ে গেলো নিলুর এই সাহস দেখে।শাহেদের কথা অমান্য করছে নিলু আজ?
গোসল করে নিলু একটা হালকা গোলাপি সুতি শাড়ি পরে বের হলো।হালকা একটু সেজে নিলো মুখে ক্রিম,পাউডার,কাজল আর লিপস্টিক দিয়ে।
শাহেদের প্রচন্ড রাগ হলো।শাহেদ নিলুকে সবসময় বলতো,নিলু যাতে বাহিরে বের হবার সময় একটু ও না সাজে,নিলুর এই অপরূপ সৌন্দর্য অন্য কেউ যাতে না দেখে,অথচ নিলু কি-না সেজেছে!
রাগে চিৎকার করে শাহেদ বললো,”কার জন্য এতো সেজেগুজে বের হচ্ছো তুমি?
কাকে দেখাতে যাচ্ছো?
আমি নিষেধ করার পরে ও তুমি সেজেছো কেনো,তবে কি মায়ের কথাই ঠিক?
এসব রংঢং করতেই তুমি চাকরি করতে চাইছো?”
প্রতিবাদের কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না নিলু,নিলু ভেবেছিলো সাজলে শাহেদে নিজেই এগিয়ে আসবে নিলুর কাছে,হয়তো এসে নিলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে,আর তাতেই নিলুর মনের সব কষ্ট মুছে যাবে।কিন্তু এখন দেখছে বিষয় টা অন্যরকম ভেবে নিয়েছে শাহেদ।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো নিলু,”তবে শাহেদ কি আমাকে অবিশ্বাস করছে?”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো নিলুর এটা ভাবতেই।না আর একটা কথা ও বলবে না সে শাহেদের সাথে।
নিলুকে চুপ দেখে শাহেদ বললো,”নিলু,আমার একটা কথা শুনে রাখো,মনের কষ্ট দূর হলে ফরে আসবে বুঝলাম,তবে জেনে রাখো আমি চাই না তুমি চাকরি করো।কোনোভাবে তুমি ইন্টারভিউ দিতে যাবে না কোথাও।২ দিন থেকে চলে আসবে বাড়িতে।যে চাকরি নিয়ে এতো অশান্তি সেই চাকরি আমি তোমাকে করতে দিবো না। ”
নিলু দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলো,”আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি একাউন্টিং থেকে,একটা ভালো রেজাল্ট করেছি,আমার যোগ্যতা কে রান্নাঘরে আর হাড়ি পাতিলে সীমাবদ্ধ করে রাখার জন্য নয়,যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে।আমার বাবা নেই,ভাই নেই।সংসারের হাল আমাকে ধরতে হবে।
৩টা বোনকে মানুষ করতে হবে।তার জন্য যা করতে হয় আমি করবো শাহেদ,যদি তোমার মায়ের কথা অনুযায়ী সংসার ছাড়তে হয় তাতেও আমি রাজি।”
শাহেদ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিলু ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলো।
হতভম্ব শাহেদ দাঁড়িয়ে নিলুর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে…..?
(রিচেক দিই নি,টাইপিং মিস্টেক হলে দুঃখিত)