#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৪)
সায়লা সুলতানা লাকী
লাবন্যকে নিয়ে টেনশন করতে বারন করেছে হিমেল। ও নাকি লাবন্যের সাথে কথা বলবে একটু সময় গুছিয়ে নিয়ে। সেই ভরসাতেই বসে আছে রেশমা। ভেতর থেকে শান্তিটা শুধু ফুরুৎ ফুরুৎ করে ওড়াল দিতে চাইছে, কি যে এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগছে মনটা তা কাউকে বোঝাতে পারছে না ও। অপেক্ষা করছে হিমেল কখন কল দেয় মেয়েকে। একটা সময় অপেক্ষার প্রহর ফুরলো, সন্ধ্যার দিকে ঠিকই টের পেল হিমেলের কলটা এসেছে মেয়ের মোবাইলে। মেয়ে বেশ গদোগদো হয়ে কথা বলছে তাতেই বুঝলো। যদিও অন্য কোন সময় লাবন্যের কথায় কান পাতে না, আজ যেন কি হল ওর। সব নিয়মনীতি ভুলে মেয়ের রুমে কান পাতল–
” হ্যা বলো! কি মনে করে কল দিলে? তুমিতো আবার একজন বড়োওওও ব্যস্ত মানুষ, কেউ কল দিলেও রিসিভ করো না। তা হঠাৎ কি এমন দরকার পড়ল যে কল দিয়ে সময় নষ্ট করছো নিজের?”
“তুই থামলে আমি কিছু বলতে পারতাম।”
“হুমম, বলো। কে ধরে রেখেছে তোমাকে? শুনছিতো!”
” ঢাবিতে এডমিশন টেস্টে দিবি না কেন?”
“কি লাভ? আমি চান্স পেলে ভর্তি হব। কিন্তু তুমিতো ততদিনে আউট হয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে কী করবো?”
“মানে? আমার থাকা না থাকার সাথে তোর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সাথে সম্পর্ক কী?”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি দেশেই থাকবে, মাস্টার্সের পর ফারদার ডিগ্রির জন্য ভার্সিটিতেই থাকবে। তাই এডমিশন টেস্টের কঠিন পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত হয়েছিলাম। কিন্তু তুমিতো দেশে থাকছো না। আমেরিকায় চলে যাচ্ছো।সোওওওওও এত কষ্ট উঠানোর কি দরকার? প্রাইভেটে ভর্তি হলেই ভালো আমার জন্য। একটাই জীবন, কেন অযথা প্যারা নিব। ”
“এটা কোন কথা হল? আমি থাকলেই বা কি? তুই কি ওখানে আমার জন্য যাবি? তুইতো ওখানে পড়াশোনা করতে যাবি, বিষয়টা তাই না?”
“ঘোড়ার ডিম, পড়াশোনা করতে মানুষ যায় ওখানে। আমি কি কোন মানুষ?
আমি এক মুক্ত বিহঙ্গ ,
দুই পাখা মেলে মনের আকাশে
সারাদিন ওড়ে বেড়াতে চাই।
আকাশের নীল রংয়ের মাঝে সাদা মেঘের ভীড়ে একটা ছোট্ট নীড় গড়তে চাই।
তখন শুধু পাশে তোমাকে চাই।
আমি স্বচ্ছ পানিতে
সাঁতার কাটা এক স্বাধীন মৎস্যকন্যা।
সারাদিন লেজ নেড়ে নেড়ে ছুটবো,
সাঁতার কাটবো, জলকেলি করব,
কখনও মুখ উঁচিয়ে তেজোদৃপ্ত সূর্য স্নান করব আবার কখনও অতল গভীরে দিব ডুব।
ক্ষমতা সব মনের, সে করবে যখন যেমন সে চায় ।
তখন শুধু পাশে তোমাকে চাই।
আমি দখিনা হাওয়া।
এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক বইতে চাই,
কখনও সোনালী রোদ্দুর
কখনও জোছনার আলোয় সিক্ত হতে চাই।
কখনও ফুলের সুবাস মেখে মন রাঙাব।
কখনও উত্তরের হাওয়ায় নিজেকে হিমায়িত করব।
তখন শুধু পাশে তোমাকে চাই।
আমি কেবলি আমার প্রেমিকের মনের
তীব্র ক্ষুধা হতে চাই।
যে ক্ষুধা মিটবে না তার আজীবন।
যে ক্ষুধায় প্রেমিক শুধু আমাকেই খুঁজবে,
আমি ছাড়া অন্য কেউ তার বুভুক্ষু মনকে
তৃপ্ত করতে হবে ব্যর্থ ।
সে শুধু আমায় কাছে পাওয়ার তৃষ্ণায় ছটফট করবে,
আমি তার চোখে এক সাগর ভালোবাসার
রঙিন স্বপ্নে ডুবতে চাই।
আমি শুধু এক পসলা বৃষ্টি হতে চাই
যে বৃষ্টি মেটাবে আমার প্রেমিকের তৃষ্ণা।
আমি শীতের সকালের বিন্দু বিন্দু শিশির হতে চাই
যে শিশির শুধু ভেজাবে প্রেমিকের মন।
আমি শুধু আমার জীবনে সেই প্রেমিক রুপে
তোমাকে চাই শুধুই তোমাকে চাই।।”
“থামলি কেন? চালিয়ে যা অনন্ত কাল। আমাকে জ্বালানো এত অল্পতেই শেষ করলি ? আমার পরীক্ষা, আমার মাথাটা খারাপ করার জন্য আর কি চাই তোর?”
” দাঁড়াও! আম্মু দরজার ওপাশে, আচ্ছা আম্মুকি তোমাকে কল দিতে বলছে আমাকে?”
“মানে?”
“রাখো, পরে বলছি” বলে মোবাইলটা বিছানার উপর রেখে কুটকরে লকটা ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে হিহিহি করে হেসে উঠল লাবন্য যেনো কোন চোরের চুরি ধরে ফেলেছে সে। রেশমাও চোর ধরা পড়ার মতো মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইল যেনো মুখে কোন কথা নাই তার। চোখে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে রেশমার অস্থিরতার ছাপ। সবটা ফুটে উঠেছে দিনের আলোর মতো চকচক করে। হঠাৎ করেই লাবন্যর মনটাও খারাপ হয়ে গেল। নিজের মায়ের এমন অসহায় ভাবটা কোন সন্তানের মনকেই আনন্দ দিতে পারে না। মুহুর্তেই মুখের হাসিটা নিভে গেল। মায়ের চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলল
“ডিয়ার আম্মু, এত টেনশন নিচ্ছো কেন? টেক ইট ইজি। আমি এমন কোন আবদার করিনি যে তোমাকে এত টেনসড হতে হবে? আর কখনও এমন কিছু করব না যার জন্য তোমাকে কারউ কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমি ঠিক আছি। মাথা ভরা শুধু প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ , তাই তোমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করি। তুমি কেন এত ভয় পাচ্ছো হঠাৎ করে তাই শুধু বুঝতে পারছি না।”
“বুঝবি, সময় হোক, একদিন ঠিকই বুঝবি।” বলে রেশমা আর দাঁড়ালো না নিজের রুমে চলে এল।
লাবন্য আবার দরজা আটকিয়ে মোবাইল হাতে বিছানায় বসে পড়ল। এখন আর ওর মায়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাইলো না। হিমেলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এদিকে রেশমা নিজের রুমে আসতেই ওর ভেতরের গুমোট হয়ে থাকা অস্থিরতাগুলো একসাথে বাঁধ ভাঙা জোয়ারে রুপ নিল, বিছানার এককোনে বসে একটা সময় ডুকরে কেঁদে উঠল। নিজের কাছে নিজে অনেকটা ছোট হয়ে গেছে বলে মনে হল। এতটা নিচু মন মনসিকতা হলো কবে ওর ? আগেতো এমন ছিলো না! হঠাৎ করেই আমূল পরিবর্তনের কারন কি? মেয়ের ঘরে কেন আড়ি পাতলো ও? তেমন কিছুইতো শুনতে পায়নি, লাবন্যের কিছু কথা ছাড়া। ওর মনে কিসের এত ভয় কাজ করছে তাতো বুঝতে পারছে না নিজেই। কেন জানি আজ বারবার নিজের মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল। তিনি একদিন বলেছিলেন রেশমাকে, “যেই কষ্ট, যেই অপমান, যেই লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলেছিস তুই আমাদেরকে তা কেবল সেদিনই বুঝবি যেদিন তুই নিজেও ঠিক এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়বি। কোন কর্মই তার প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে ভুল করে না।দুদিন আগে আর পরে, কিন্তু ঠিকই প্রতিদান দেয়।”
আজ মায়ের সেই কান্নাজড়িত কন্ঠটা খুব মনে পড়ছে প্রথম যেদিন রেশমা লিখনের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে হোটেলের ফোন থেকে বাসায় কল দিয়ে মায়ের সাথে বলা বলেছিল। মা সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল আর কোন কথাই বলতে পারেননি তিনি।
তখন রেশমার চোখেমুখে ছিল রঙিন স্বপ্ন, ভালোবাসার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিল পুরো চিন্তা চেতনা ওর। নিজের মনকে ছাড়া আর কিছুই তখন চোখে পড়ত না। মনে তখন অনেক সাহস ছিল।কাউকে ভয় পেতো না। ভালোবাসার উপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে চোখ বুঝে বাবা মা ভাই বোন সব ছেড়ে লিখনের কাছে চলে এসেছিল। আজ এতবছর পর ওর সেই বিশ্বাস কোথায় হারালো? কেন আজ ওর মনে এত ভয় ভালোবাসা হারানোর। দিনদিন বিশ্বাস পোক্ত হয় মানুষের কিন্তু ওর কেন কমেছে? আর ভাবতে পারছে না। শরীর কাঁপিয়ে শুধু কেঁদেই চলছে। কত স্বপ্ন বুকে জমিয়ে রেখেছে ছেলে মেয়েকে নিয়ে। আজ মেয়েটা এমন মনমানি করাতে কিসের আশংকায় কাঁপছে হৃদয়? এর উত্তর আজ খুঁজতেও ভয় অনুভব করছে খুব ।
লাবন্য আর রুম থেকে বের হয়নি। হিমেলের সাথে কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রেশমাও ডাকেনি আর ওরও ঘুম ভাঙেনি। রাতে যখন কয়েকবার ডোর বেল বেজে উঠল তখন লাবন্যের ঘুম ভাঙল। একটু ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে জানতে পারল ওর আব্বু ফিরেছে বাসায়। খুব অবাক হল মনে মনে, এমনতো কখনও হয়নি আগে। ওর আব্বু একটা বেল দিতেই দরজা খোলা হয়। কারন সেই সময়টাতে রেশমা অপেক্ষায় বসে থাকে। আজ হঠাৎ কি হল মায়ের যে ওর আব্বুর দুই তিনবার ডোরবেল বাজাতে হল? এত বেশি চিন্তা ভেতরে পুশে রাখা ওর স্বভাব না। তাই মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল বিষয়টা জানতে। দরজার কাছে গিয়ে থমকে গেল। ভেতরে আব্বু আম্মুর কথপোকথন শোনা যাচ্ছে, ওর পা আটকে গেল —-
“রেশমা তোমার কি হয়েছে আমাকে একটা বার বলো। তুমি এভাবে কেন কাঁদছো আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না? আমার কোন ভুল হয়েছে? ”
” বললামতো আমার কিছু হয় নাই, এমনিতেই মনটা খারাপ ছিলো তাই তোমার আসার সময়টা খেয়াল করতে পারিনি।”
“রেশমা আমি রুশ না, তুমি আমাকে আবোল তাবোল বলে বোঝানোর চেষ্টা করো না। প্লিজ তুমি আমাকে বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে বলোতো কোন বিষয়ে তুমি এতটা কষ্ট পাচ্ছো যে এভাবে কাঁদছো?”
“লিখন আমিতো শুধু তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম, আর কোন কি পাপ করেছিলাম? যাতে আমাদের কোন পাপ না হয় তাই দুজনে বিয়ে করে নিয়েছিলাম। বাবা মা ওই বয়সে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলো না বলেই আমাকে সব ছেড়ে ওভাবে চলে আসতে হয়েছিল। বলো আমি কি ভুল বলছি?”
“না তুমি কোন ভুল বলোনি। কিন্তু এসব কথা তুমি এখন কেন তুলছো? তা এখন আমাদের পাস্ট। আমরা ফিউচার নিয়ে ভাববো আর প্রেজেন্টে বাস করব। এমনটাইতো কথা হয়েছিলো দুজনের তাই না?”
“কিন্তু পাস্টতো বড় কঠিন সত্য, কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না। ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে হানা দিচ্ছে। মায়ের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে।” বলতে বলতে আবারও ফুপিয়ে উঠল রেশমা।
“তাদের একটা দাবি তো অবশ্যই তোমার উপর ছিল, তা কেউ অস্বীকার করিনি তখনও এখনও। কিন্তু তারা যদি সেদিন তোমার মন বুঝে তোমার বিয়েটা আমার সাথে নিজেদের মতো করে দিয়ে দিত তবেতো কোন সমস্যাই হত না। তারাতো তাদের দায়িত্বটা ঠিক মতো পালন করেনি। তুমি কেন বারবার সব দোষ নিজের কাঁধে নিচ্ছো?”
“লিখন আমাদের লাবন্য যদি আমার মতো এমন করে একদিন চলে যায়—-”
“প্রশ্নই উঠে না এমন হওয়ার। তার আগেই আমি ওই ছেলেকে ডেকে তোমার সাজানো স্বপ্নের মতো করে ধুমধামে কন্যাদান করবো।”
“সত্যি বলছো? তোমার কষ্ট হবে না, মেয়ে যদি তোমার পছন্দের দাম না দেয়? মেয়ে যদি কোন ভুল পছন্দ করে বসে?”
“শোনো রেশমা, জীবনটা লাবন্যের, জীবন সঙ্গী নির্বাচনে ওর মতামতটাই প্রাধান্য পাবে। ধর্মীয় মতেও তাই করতে বলেছে।তাহলে আর আমার তোমার অসুবিধা কোথায়? তবে হ্যা, মেয়েকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সে ভুল আর শুদ্ধের পার্থক্য বুঝতে পারে। বাবা মা হিসেবে তুমি আমি বড়োজোর ওকে বোঝাবো তুমি যা করছো তা ভুল আর ভুলটা কেনো ভুল তাও বুঝিয়ে দিব।ডিসিশনটা হবে লাবন্যের নিজের। আর তাই মেয়েকে এমনভাবে গড়ে তুলো যাতে ও সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারে। ওর সুখেই আমাদের সুখ।ওর খুশিতেই আমাদের খুশি।”
“আজ আমি তোমার জন্য রেডি হয়ে অপেক্ষা করিনি বলে কি তুমি আমায় দেখে তোমার ভূবণ ভোলানো হাসিটা হাসতে ভুলে গেলে?”
“মোটেও কারন তা না, তুমি যখন রেডি হয়ে থাকো তখন মনে হয় আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ। তোমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে আমার বসবাস, আমায় খুশি করতে তোমার সব আয়োজন দেখে মনে হয়, আমার চেয়ে ভাগ্যবান আর কে আছে ? কিন্তু আজ যখন রুমে ঢুকলাম দেখলাম আমার বৌটা রুম অন্ধকার করে বিছানায় বসে কাঁদছে। মুহুর্তেই মনে হল আমি বুঝি পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় ভিক্ষুক, একেবারে দেউলিয়া। এখন বলোতো একজন দেউলিয়ার মুখে সুখের হাসিটা আসে কোত্থেকে? তোমার হাসি আমার সম্পদ, তোমার সব আয়োজন আমার জীবনের প্রেরনা, তোমার মন আমার কাছে অমূল্য রত্ন। তেমনি তোমার কান্না আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে শূন্য করে দেয়, নিঃস্ব করে দেয়, মনে হয় আমি বুঝি ব্যর্থ তোমাকে সুখী করতে। তুমি কি তা জানো না?”
লাবন্যের চোখ ছলছল হয়ে উঠলো। ওর ধারনাকে মিথ্যে করে দিয়েছে ওর আব্বু। তিনি সত্যি সত্যিই ওর মা’কে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আজ রেশমা না সেজেও তার স্বামীর ভালোবাসা পাচ্ছে পরিপূর্ণ ভাবে। ভালোবাসায় একে অপরকে সাপোর্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। লাবন্য আর দাঁড়ালো না ফিরে এল নিজের রুমে।
চলবে।
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1294416557740035/