#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৫)
সায়লা সুলতানা লাকী
ঘুম ভাঙলো সকালে রিংটোন শুনে। অনবরত রিং বেজেই চলছে। একবার চোখ খোলে দেখে নিল নাম্বারটা তারপর আবার চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। কয়েকবার বেজে থেমে গেল। এবার বেশ আয়েশি মুডে শুয়ে রইল চোখ বুজে যা চেয়েছে তা হয় কি না দেখার জন্য লাবন্য। হুমম বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওর আম্মু এসে হাজির ওর রুমে।
“এই লাভ, লাভু ওঠ, ওঠ বলছি, কি অবস্থা! একেবারে একটা বন্য হয়ে গেছে মেয়েটা! বড়পা এতক্ষণ কল দিলো ধরলি না কেন ইডিয়ট মেয়ে? ওঠ বলছি!”
“উফফ আম্মু সকালে এমন বকাবকি করে ঘুম থেকে না ওঠালেই কি নয়? সকালে বাচ্চাদেরকে আদর করে ঘুম থেকে ওঠাতে হয়। তোমাকে আর কত শিখাবো, বলোতো?”
“ওরে আমার পন্ডিতরে! এবার দুইটা থাপ্পড় দেই পাছায়, তাহলে আরও জ্ঞান আসবে মাথায়।” বলতে বলতে লাবন্যর কাছে যেতেই লাবন্য হুড়মুড় করে ওঠে বসল।
“আম্মু মুখের কথায় কাজ হলে আবার হাত চালানোর দরকার কি? এইতো ওঠলাম।”
“বড়পা এত রেগে আছে কেন? কি করছিস তুই ? ”
“তাইতো বলি ম্যাডাম সক্কাল বেলা সক্কালে এত খুশি কেন? বোনের কল পেয়ে আনন্দে গদগদ করছে একেবারে। ”
“বোন কল দিলে, খুশিতো হবই। কিন্তু বোন আমার এত চ্যাঁতা কেন? কি করছিস?”
“তাতো জানি না। বোন তোমার এমনি সবসময় চ্যাঁতে থাকে এ আর নতুন কি? ”
“মোটেও না বড়পা খুব মায়াবতী মানুষ।শুধু শুধু রাগেন না। আচ্ছা শোন তোকে দেখা করতে বলছে আপা। নাস্তা করে দেখা করে আসিস। ”
কথাটা শেষ করে রেশমা চলে গেল নিজের কাজে। লাবন্য বিছানায় বসে মায়ের খুশি খুশি মুখটা চোখ বন্ধ করে আরেকবার মনোচক্ষু দিয়ে অবলোকন করল। নানা বাড়ির কেউ ওর আম্মুর সাথে একটু যোগাযোগ করলেই ওর মায়ের সেদিনটা খুব আনন্দের হয়। এটা ও যেদিন থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছে সেদিন থেকেই চেষ্টা করে এই আনন্দটা মা’কে দেওয়ার জন্য। হঠাৎ মনে পড়ল খালামনিকে ঠান্ডা করতে এখনোই যেতে হবে। খালুজি চলে গেলে স্বার্থ সিদ্ধি হবে না, আর তা ভাবতেই দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল।
“আসসালামু আলাইকুম খালামনি, কেমন আছো?আমাকে দেখা করতে বলছো?”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম, তোর যন্ত্রণায় কি আর কারো ভালো থাকার জো থাকে? তুই কাউকে শান্তিতে থাকতে দেস?”
“আহ রেহেনা! বহুদিন তোমাকে বলছি সকালে তোমার এই ক্যাটক্যাট শুনতে ভালো লাগে না। একটু বোঝো আমার কথাটা! পারলে থামো।”
“খালুজি খালামনিতো এখনও শুরুই করেননি, আর আপনি থামতে বলছেন!”
“এক চড় দিব বেয়াদব মেয়ে। মায়ের শিক্ষা না পেলে মেয়ে এমনই বেয়াদব হয়। হ’তি যদি আমার মেয়ে শিখতি আদবকায়দা কি জিনিস?”
“ওওও কে তুমিই শিখিয়ে দাও আদব কায়দা, ঠিক আছে গুরু।”
“ইচ্ছে করতেছে এখন সত্যি সত্যিই একটা চড় বসিয়ে দেই গালে অসভ্য মায়ের অভদ্র মেয়েটাকে।”
“রেহেনা আগে নিজে কিছু শিখো পরে মেয়েটাকে শিখাও।”
“আচ্ছা আচ্ছা, সব বাদ এখন বলো কেন ডাকছো?”
“এই তুই হিমেলের কাছে টাকা চেয়েছিস কেন?”
“কারন ভাইয়া আমাকে চুরি করতে বারন করেছে। আর চুরি না করলে আমি টাকা পাব কোথায়? ”
“টাকা দরকার হলে তোর আব্বুকে বলবি, আমার ছেলের কাছে চাইবি কেন? ও টাকা পাবে কোথায়। ”
কি আশ্চর্য খালামনি, তা আমি জানি কি? ভাইয়া আমাকে বলছে যা লাগে তা চেয়ে নিতে, তাইতো চেয়েছি। এখানে দোষটা কোথায় পাচ্ছো আমার?”
“তোর আব্বু কি মরে গেছে যে তুই অন্যের কাছে টাকা চাচ্ছিস?”
“আল্লাহ মাফ কর! কি যে বলো না খালামনি তুমি? আব্বুর কাছে এই মুহুর্তে টাকাটা কিভাবে চাই? দুদিন পরে এমনতেই ভর্তির জন্য কয়েক লাখ টাকা লাগবে।এর মধ্যে আবার এই কয়টা টাকা চাই কীভাবে?”
“তাই বলে তুই আমার ছেলের কাছে চাইবি? ও দিবে কোত্থেকে? আর এই কয়টাকা বলছিস কি? পাঁচ হাজার টাকা কি কম?”
“পাঁচ হাজার না তো? পাঁচ হাজার সাতশো টাকা। কি করবো খালামনি বলো তোমরা ছাড় আর কে আছে আমার? আমিতো আর সরাসরি খালুজির কাছে টাকাটা চাইতে পারি না, আগে কখনও চাইনি। একটু লজ্জাতো করতেই পারে তাই না খালুজি? আর তুমিতো জীবনও আমাকে এক টাকাও দিবা না।তো আর বাকি থাকে কে? হিমেল ভাইয়া। তাই তার কাছেই চাইছি, আর সে-তো বলছে লাগলে চেয়ে নিতে।”
“আমার সহজসরল ছেলের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার ইচ্ছে ভুলে যা। হিমেল তেকে কোনো টাকা দিতে পারবে না। সাবধান করে দিলাম ওকে টাকার জন্য জ্বালাতন করবি না।”
“আচ্ছা করবো না।”
“এখন যা বাসায় যা। তোর মা’কে বলিস তোকে একটু আদবকায়দা শিখাতে, নিজের সমস্যা নিজের ঘরেই মিটাতে হয় অন্যের কাছে হাত পাতার অভ্যাস ছাড়। ”
লাবন্য সুবোধ বালিকার মতো সবটা বুঝেছে তেমন একটা ভাব নিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে এল মাথা নিচু করে। হিমেলকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। ও পড়ছে পড়ুক। যে কাজের প্ল্যান করেছিল তা এতক্ষণ পর্যন্ত সুন্দর মতো ধারাবাহিক ভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এখন বাকিটা কি হয় তা দেখার অপেক্ষায় রইল।
বাসায় ফিরতেই রেশমা নানান জেরা শুরু করল কিন্তু লাবন্য বিশেষ কিছুই বলল না। মুখটা ভার করে নিজের রুমে ঢুকে গেল, কারন ওর ধারনা হিমেল কিছুক্ষণ পরেই একটা কল দিবে। অন্তত ওর সিক্স সেন্স তাই বলছে। এই সময়তে মায়ের ঝারি খেতে মায়ের পাশে দাঁড়ালেই বিপদ। সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে, তাই কোন রকমে কেটে পড়ল। এতদিনে এতটুকু বুঝেছে মা’কে কীভাবে নরম করা যায়। মেয়ের মলিন মুখটা রেশমাকে কাবু করে ফেলে। তাই মেয়ে প্রয়োজনে সেটাই কাজে লাগায়। আগে এমনটা করতো না ইদানীং করে, কিন্তু কেন করে তা প্রায় সময়তেই ও বোঝে না।
কিছুক্ষণ পর ঠিকই হিমেলের কল এল। লাবন্য তড়িঘড়ি করে রিসিভ করল
“হ্যালো”
“টাকা দিয়ে কি করবি?”
“ট্যুর দিব।”
“মানে?”
“এত মানে মানে করো কেন? আমার বুঝি মনে শখ থাকতে পারে না? আমরা বন্ধুরা এক সাথে ট্যুরে যাওয়ার একটা প্ল্যান করেছি। একটা ট্যাভেল এজেন্সি আছে ওইটা বেশ বিশ্বস্ত। তাদের সাথে যাব।একসাথে বারো বছর থাকলাম এখন কে কোথায় ভর্তি হই, কার কি ঠিকানা হয় তা কে জানে? তাই উলোটপালোট হওয়ার আগে একটু ঘুরে আসি বন্ধুরা মিলে।”
“তা কোথায় যাচ্ছিস?”
” আপাতত সেন্ট মার্টিন। ”
“তোর মাথা খারাপ হয়েছে? খালামনি একা একা তোকে ওখানে যেতে দিবে না কি?”
“ইন্না-লিল্লাহ আঠাস জনের এক টিম যাচ্ছে সেখানে বলে কি না আমি বলে একা একা যাচ্ছি।”
“তোর মাথা ঠিক আছে? আমাকে আর জ্বালাইস নাতো। পরীক্ষার সময় এত টেনশন নিতে পারব না।
এইসব ট্যুরের ভুত মাথা থেকে ঝেরে ফেল। এগুলোতে অনেক সময় অনেক রিস্কও থাকে।”
“মোটেও কোন রিস্ক নাই। আমার বন্ধুদের বড় আপু ভাইরা প্রায় সময় এসব ট্যুরে যায় তাদেরই পরিচিত এই টিম। খুব ভালো করে জেনেই পথ বাড়িয়েছি। দুইটা ফ্যামেলী যাচ্ছে আমাদের সাথে।তারাও আমাদের পরিচিত। ”
“অসহ্য, যা খুশি তাই কর। বাসায় এসে টাকা নিয়ে আমাকে মুক্ত কর। আব্বু আমার কাছে রেখে গেছেন।”
“আমি এখন ব্যস্ত, তুমি এসে দিয়ে যাও।”
“তোর মতো এত গিরিঙ্গি বুদ্ধি আমার নাই যে কোন একটা খাটিয়ে এখন বাসা থেকে বের হব। তোর আছে তুই এসে নিয়ে যা। ওরে বাপরে কি বুদ্ধি খাটিয়ে টাকা মেনেজ করলি!”
“এক্সকিউজ মি, কোন কষ্টই করতে হয়নি আমার, তুমিই বলছো তুমি গোসলে গেলে খালামনি তোমার মোবাইল চেক করেন। ব্যস আমি সেই সুযোগে মেসেজ দিছি টাকা চেয়ে। আর তাতেই কাজ হয়ে গেছে।” বলে হিহিহি করে হেসে উঠল লাবন্য ।
“দিনদিন কি হচ্ছিস তুই তা কি জানিস?” বলেই রেগে গিয়ে হিমেল কলটা কেটে দিল।
“হ্যালো হ্যালো, আসল কথাটাইতো বলা হলো না। আরে শোনোওওওও।”
মোবাইলটা হাতে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল।মেইন কাজটাতো বাকি রয়ে গেল। এখানে যদি ঘাপলা
থেকে যায় তবেতো সব কষ্টই নষ্ট হয়ে যাবে। রেগে কলটাতো কেটে দিল এখন তারে বাকি বুদ্ধিটা জানাই কি করে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে পথ একটা বের করল। যা যা হিমেলকে বলার তা ভয়েস রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিল। একটু সময় অপেক্ষা করে রেকর্ড সীন হতেই নিজের লাইন বিজি করে ফেলল বন্ধুদের কল দিয়ে সব কনফার্ম করতে, যাতে হিমেল কল দিলে আর ওকে ফ্রী না পায়।
রাতে লিখন আর রেশমা যখন খেতে বসল। ঠিক তখনই লাবন্য রুম থেকে বের হয়ে তাদের দুজনের সামনে এসে বসল।
“কিরে কিছু বলবি?”
“জি আব্বু। ”
“বলে ফেল, শুনলাম তোর মুড নাকি অফ ছিল সকালে।কিছু উত্তমমাধ্যম সয়েছিস না কি?”
“আব্বু সমস্যা সেখানে না সমস্যা তোমার আর আম্মুকে নিয়ে। আমি –”
লাবন্যের কথা শুনে রেশমার হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠল। মনে মনে বলল মেয়ে কি বলতে চায়?
“সরাসরি বলে ফেল, আব্বু আম্মুর কাছে বলবি নাতো কার কাছে বলবি?”
” তাইতো! সেই ভরসাতেইতো সবাইকে জানিয়ে দিলাম। কিন্তু এখন ভয় হচ্ছে যদি তোমরা রাগ কর—”
“আহা লাভ, এত ভনিতা না করে আসল কথা বল।”
“আম্মু রেগে যাচ্ছো কেন? তাহলেতো ভয় পাই।”
“আচ্ছা বল, ভয়ের কিছু নাই। তোর আম্মু কিছু বলবে না।”
“হিমেল ভাইয়ার পরিচিত একটা টিম আছে, যারা দেশের বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটগুলোতে নিজেদের গাইডে ট্যুরের ব্যবস্থা করে —”
” হুমম, হুম এমনটা আমিও শুনেছি। আমার পরিচিতও কয়েকটা টিম আছে। তা ওই ছেলে কি ওর পরীক্ষা রেখে সেরকম কোন টিম নিয়ে কাজ শুরু করল নাকি?”
“আরে নাহ আব্বু, তার এত সাহস আছে না কি? সে ব্যস্ত তার পরীক্ষা নিয়ে। তবে সে একটু সাহস করেছিল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। নিজের যাওয়ার জন্য একটা সীট বুকিং দিয়েছিল। কিন্তু তারতো সাহস কম তাই ভয়ে এখন সেই কথা কাউকে বলতে পারছে না। এখন আমাকে বলছে তার ওই সীটে ট্যুরে চলে যেতে। কারন সে ফুল পেমেন্ট করে ফেলেছে আর সে টাকাটা আর ফেরত তুলতে পারবে না। আমি না গেলে তার টাকাটা নষ্ট হয়ে যাবে। খুব আকুপাকু করে বলল– লাবন্য আমারতো পরীক্ষা, তাই আমার হয়ে তুই ঘুরে আয়, কোন রিস্ক নাই। মেয়েদের জন্য প্রচন্ড রকমের সেইভ। আর তোরতো এখন পড়ার চাপও নাই।তাছাড়া এমন সুযোগ আর পাবি না, ভর্তি হয়ে গেলে জীবনে শুধু প্যারাই প্যারা পাবি। এখনই সময় একটু ঘুরে আয়।”
“কিন্তু তুই একা—-”
“আরে নাহ আব্বু, ভাইয়া আমাকে অফারটা দিতেই আমি আমার বন্ধুদের জানিয়েছি। আমি যাবো শুনে সব আন্টিরাই পারমিশন দিয়ে দিয়েছেন। আমরা মোট ষোলজন। সবাই একসাথে ওয়ান থেকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছি একসাথে। এরপর কে কোথায় ভর্তি হয় কার জীবন কেন দিকে মোড় নেয়, এসব ভেবে সবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি।”
“এগুলো কতদিন যাবৎ চলছেরে লাভ?”
“এইতো মাত্র চারপাঁচ দিন ধরে। ”
“বড়পা এইজন্যই ডেকেছিলেন?”
“আম্মু তুমি এত কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করছো তাতেতো আমার কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ”
“আহা রেশমা! এত সিরিয়াস হচ্ছো কেন? এই বয়সটাইতো এমন! হিমেল যেখানে সব ঠিক করে দিয়েছে সেখানেতো কোন সমস্যা থাকার কথা না। তারপরও আমি হিমেলের সাথে কথা বলে দেখছি। ওরা ষোলজন যাচ্ছে। ব্যাপারটা কিন্তু সহজ না। এত বড় টীম, কোথায় যাচ্ছে, কি ব্যবস্থায় যাচ্ছে সব খবর নিয়েই পারমিশন দিব। শুধু শুধু মেয়ের পিছনে লেগো না। আমি একটু সময় নিচ্ছিরে লাবু।”
“জি আব্বু, তুমিতো তা নিবেই, আমি তা জানি। এই নাও ওই গ্রুপের কার্ড।” বলে হাতের কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে এল। জোরে একটা শ্বাস নিল। সম্পূর্ণ কাজটা সুন্দর মতো প্ল্যান মোতাবেক শেষ হল । এখন আব্বু ভালো মতো জেনে পারমিশনটা দিলেই হল। তবে বিশ্বাস দিবে কারন হিমেল ভালো মতো বুঝিয়ে বলবে লাবন্যকে যেতে দিতে সেই বিশ্বাস হিমেলের উপর ওর আছে।
চলবে।
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1295770087604682/