১,
আমার স্বামি যখন তার দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা বলে তখন ছিলো আমার গর্ভাবস্থার শেষ সময়। নয় মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলাম আমি। এই সময় আমার যার সাপোর্ট সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, সে কিনা আবার বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে। করুন চোখে তাকালাম তার দিকে। সে আমার চাহনি উপেক্ষা করে মোবাইল চালাতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো। আমি আমার দৃষ্টি নামিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। দু-ফোটা অশ্রু কোটর গড়িয়ে পড়লো। চোখের জল! অতো বড় শূন্যতা শুধুমাত্র কয়েক ফোঁটা জলে পূর্ণ হয় আদৌ! আমারতো সেরকমটা মনে হয়না। সেটি কেবলমাত্র দূর্বলতা বৈ কিছু নয়। আমি দুর্বল হবো না। যেই মানুষ আমাকে কোন দিন স্ত্রীর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়নি সেই মানুষটা দ্বিতীয় বিয়ে করলো কি করলো না সেটা নিয়ে আমি কেন কষ্ট পাবো। অধরোষ্ঠ চেপে হাসার চেষ্টা করলাম আমি। অতঃপর বললাম,
– কবে বিয়ে করছেন?
-সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই করে নিবো।
– ওহ। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
তার ঠিক তিনদিন পর আমার স্বামি নওশাদ আবার বিয়ের পিরিতে বসেন। হাতে মেহেদী পরে, নতুন শেরওয়ানী পরে মাথায় বরটুপি নিয়ে মুখে রুমাল চেপে লজ্জায় নত হলেন। দেখতে একেবারে নতুন বরের মতোই লাগছিলো তাকে। এই দৃশ্য দূর থেকে দেখে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম আমি। চোখ দিয়ে অঝোড় ধারায় বন্যা শুরু হয়েছিলো। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। আমার শ্বশুর গত হয়েছে মাত্র তিন মাস হলো। এর মধ্যেই তার ছেলের দ্বিতীয় বিয়ের স্বাদ জাগে। আমার শ্বাশুড়ি ননদরা সবাই মিলে আনন্দের সহিত নওশাদের দ্বিতীয় বিয়ে দিচ্ছিলেন। দিবেই না কেন? নওশাদের মতো অমন ফুটফুটে ছেলের পাশে কি আর আমার মতো কালো মেয়েকে মানায়! দূর থেকে নওশাদকে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ও বাড়ি ছেড়ে চলে আসি আমি। কিন্তু এই অবস্থায় কোথায় যাব আমি! আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে কার কাছে আশ্রায় নিবো। বাপের বাড়ি যাব! কিন্তু আব্বার এই অভাব অনটনের সংসারে আমি গিয়ে আবার বোঝা বাড়াবো। মন শায় না দেওয়া সত্তেও আমি আমার বাপের বাড়িতে ঠাই নেই।
তার ঠিক দুই সপ্তাহ পর আমি একটা কন্যা সন্তান জন্মদেই। প্রসব ব্যাথার যন্ত্রণার থেকে সেদিন প্রিয়জনকে হাড়ানোর যন্ত্রণাটা বেশী ছিলো। মায়ের মুখে যখন শুনলাম আমার মেয়ে হয়েছে তখন আমি খুব কেঁদেছিলাম। আল্লাহর কাছে বারবার ফরিয়াদ করছিলাম আমার মেয়েটা যেন আমার মতো কালো না হয়। কালো মেয়েদের অনেক কষ্ট। তাদের কপালে না আছে সুখ আর না আছে প্রিয়জনের ভালোবাসা। আজ আমি কালো বলেইতো আমার স্বামি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। কারন তার সুন্দর বউ লাগবে। আল্লাহ সেদিন আমার ডাক শুনেছিলো। আমার মেয়ের বয়স দুই মাস যেতে না যেতেই তার গায়ের রং পাল্টে সে তার বাবার মতো দেখতে হয়েগেলো। তার বাবার মতো দুধে আলতা গায়ের রং হয়েগেলো তার। চোখদুটি হুবহু তার বাবার মতো। শখ করে মেয়ের নাম রাখলাম মেহের। মেহেরুন্নেছা মেহের। আমার এই মেঘলা আকাশে এক চিলতে রোদ্দুর মেহের। ছোট্টথেকে মেয়েটা আমার বড্ড্ চঞ্চল।
– কিরে মেহু তুই এখনো রেডি হোসনি? ওদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে প্রায়।
মেহেরকে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করলো মৌ। মৌয়ের ডাকশুনে তড়িৎগতিতে ডাইরিটা বন্ধকরে নিলো মেহের। তারপর সেটা বালিশের নিচে লুকিয়ে দু-হাতে আলতো করে চোখের পানি মুছে মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুুলল সে। মৌ এসে মেহেরের পাশে বসতে বসতে বলল,
– আন্টির ডাইরি পড়ছিলি তুই।
– না তো।
– মিথ্যে বলিস না মেহু। আমি জানি তুই এখন আন্টির ডাইরি পড়ছিলি।
মৌ বালিশের নিচ থেকে ডাইরিটা বের করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর সে ডাইরির উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে সেটা বুকশেলফে রেখে দিলো। মেহের মৌয়ের দিকে নিঃপলক তাকিয়ে রইলো। মৌ মেহেরকে তাড়া দিয়ে বিছানা থেকে তুলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরেই পতাকা উত্তোলন করা হবে আর এই মেহের এখনো রেডি হয়নি।
২,
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো মেহেরদের কলেজে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শহীদদের স্মরণে দিনটিতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও শোকের কালো পতাকা উড়ানো হচ্ছে। । সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ছাড়াও প্রচার করা হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার। দিবসটি উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, নান্দনিক হস্তাক্ষর লেখা প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
কয়েকটা কাগজ উল্টিয়ে দেখতে দেখতে অডিটোরিয়ামের দিকে যাচ্ছে মেহের। কিছুক্ষণ পর শুরু হবে মেহেরদের নৃত্য পরিবেশ। বেশ তড়িঘড়ি করেই অডিটোরিয়ামের দিকে যাচ্ছিলো সে। শাড়ির কুচিতে পা লেগে নিচে পরে যেতে নেয় মেহের তখন দু-চোখ বন্ধকরে কিছু একটা খামচে ধরে নিজেকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নেয়। কিন্তু কি ধরেছে কাকে ধরেছে সেটা জানেনা মেহের। বেশ কিছুসময় সে এভাবেই থাকে সে। তারপর যখন নিজের মুখের উপর কারো উত্তপ্ত শ্বাস অনুভব করে তখন পিটপিট করে চোখ খুলে সে। চোখের সামনে একটা সুদর্শন যুবককে দেখে হাজার ভোল্টিজের শক খায় মেহের। যুবকটাকে ধাক্কাদিয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে সরে যায় সে। ঘটনাক্রমে যুবকা পরে যেতে নিলে একটা যুবতী মেয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে। মেহের যুবক যুবতীকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নেয়। তারপর সে নীচু স্বরে বলে,
– সরি।
– সরি, কিসের সরি হ্যাঁ। যুবতী মেয়েটা এগিয়ে এসে বলে। আর একটু হলে রাহনাফ নিচে পরে যাচ্ছিলো। তোমার একটা সরি বলাতে কি হবে।
– তাহলে কি কানে ধরে নাচবো, উঠবস করলে হয়তো কম হয়ে যাবে! নাচবো কানে ধরে। নাকি নাক খত দিবো! বলুন কি শাস্তুি দিবেন?
মেহেরের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়েটি। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটির মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে কানে ধরে নাচে কিভাবে! অপরদিকে রাহনাফ বড় বড় চোখ করে বুকের উপর হাত ভাজ করে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। মেহেরের এমন কাটকাট জবাব শুনে তার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠে । মেহের রাহনাফের দিকে বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যেতে নেয় তখন মেয়েটি মেহেরের হাত ধরে টেনে ওকে অডিটোরিয়ামে নিয়ে যায়। তারপর সে মেহেরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
– গলায় তো খুব তেজ তোমার। এখন দেখি কি রকম কথা বলতে পারো তুমি। অবশ্য তোমাদের মতো মেয়েরা শুধু কথায় দিয়ে সব জয় করতে পারে। দেখি তুমি শুধু কথা দিয়ে কি করে পরিস্থিতি সামাল দাও। স্মিত হাসে মেয়েটি তার সে মেহেরকে অডিটোরিয়ামে রেখে চলে আসে। মেহের অডিটোরিয়ামের চারিপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্কুলের ডিবেট ক্লাবে মেহেরের একটা নাম আছে। কিন্তু কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়া কি করে বক্তব্য রাখবে সে। কিছুসময়ের জন্যে চক্ষুদ্বয় বন্ধকরে নিয়ে মনের মধ্যে সব কথা গুছিয়ে নিলো সে।
এদিকে মেয়েটা মেহেরকে রেখে রাহনাফের পাশে এসে দাঁড়ায়। রাহনাফের দৃষ্টি এখনো মেহেরের মধ্যে স্থির। চোখ-মুখে তার বেশ উৎসাহ মেহেরের বক্তব্য শুনার জন্যে। মেয়েটা রাহনাফের এক হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
– এখন মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। দেখো কেমন ভিতুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
– এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতি রাহি। রাহনাফ রাহির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।
– তুমি কি ও থার্ডক্লাস মেয়েটাকে সাপোর্ট করছো?
– কারো ক্লাস মাপার বয়স তোর হয়নি এখনো। ভুলটা তুই করেছিস। তোর ওকে সরি বলা উচিৎ।
চলে যেতে নেয় রাহনাফ কিন্তু মেহেরের গলার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ায় সে। সামনে তাকিয়ে দেখে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বক্তব্য রাখছে মেহের। মুহূর্তেই চোখমুখ উজ্জল হয়ে যায় রাহনাফের।
মাত্র সারে চার মিনিটের বক্তব্য শুনে পুরো অডিটোরিয়াম জুরে করতালির বন্যা বয়ে যায়। সবাই মেহেরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একটা স্যার এগিয়ে আসে মেহেরের কাছে। মেহেরকে সবাই এই কলেজের একজন ছাত্রী হিসাবেই জানে এর বাহিরে আর কিছুই জানে না কেউ। সকলের মতো স্যারদের ও উৎসাহ মেহেরকে জানতে। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যার তো ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে নেক্সট ডিবেট প্রতিযোগীতায় তারা মেহেরকে নিবে। একটা স্যার এসে মেহেরের পাশে দাঁড়িয়ে মেহেরকে জিগ্যেস করে,
– তুমি কোন ডিপার্টমেন্টের?
– বাংলা। ফাস্ট ইয়ার।
– তোমার পরিচয়?
– আমি মেহেরুন্নেছা মেহের। পাশের গলিতেই থাকি। আমার মা একজন স্কুল টিচার।
– আর তোমার বাবা কি করেন?
স্যারের এই প্রশ্ন শুনে থামকে যায় মেহের। নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জবাব দেয়,
– আমার বাবা নেই।
স্যারসহ উপস্থিত সকলে ধরে নেয় মেহেরের বাবা মারা গেছে। তাই তারা সকলে আল্লাহর কাছে মেহেরের বাবার আত্নার মাগফেরাত কামনা করে। মেহের কিছু বলে না। ছলছল চোখে সবটা দেখতে থাকে শুধু। বুকের ভিতরের যে গভীর একটা হৃদয় আছে সেখান থেকে কেউ বলে উঠে,
– তোমরা আমার জিবন্ত বাবার আত্নার মাগফেরাত কামনা করছো আর আমি কিছুই বলতে পারছি না। কতটা অভাগা মেয়ে আমি।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহের।
নিঃশব্দে প্রস্থান করে মেহের। সম্মানিত অতিথি বৃন্ধুদের আসনে বসে চোখ মিটমিট করে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। এখানে সকলে তার আত্নার মাগফেরাত কামনা করছে আর সে বলতেও পারছেনা মেহেরের বাবা মারা যায়নি। মেহের আমার মেয়। কারন সে অধীকার মেহের তাকে দেয়নি। নওশাদ নিঃপলক তাকিয়ে রইলো মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে। মেয়েটা তাকে বড্ড ঘেন্না করে। এদিকে রাহনাফ ও মেহেরকে ফলো করতে করতে ওর পিছু পিছু গেলো।
চলবে,,,, [ইনশাল্লাহ]
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০১]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
[আসসালামু আলাইকুম। অনেক দিন পর আবার গল্প লেখলাম। গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়লে সকলের ভালো লাগবে, ইনশাআল্লাহ। আশাকরি সকলে মনোযোগ দিয়েই পড়বেন। ধন্যবাদ সবাইকে ]