#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৮]
১৫,
পাশাপাশি বসে আছে মৌ আর আলিহান। মেহের মৌ এর পাশে বসে মোবাইলে গেইম খেলছে। রাহনাফ চলে গেছে পার্কের বাহিরে বাদামের দোকানে। দুইজন প্রেমিক প্রেমিকা যখন পার্কে বসে কথা বলে তখন তাদের মুহূর্তটা আরো বেশী মেমোরিবল করার জন্যে নাকি বাদাম চাই। তাই মৌ এর কথামতো রাহনাফ বাদাম কিনতে গেছে। এদিকে মৌ এর পাশে মেহের বসে থাকার কারনে আলিহান পরছে বিভ্রান্তিতে। সে মৌ-য়ের সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারছে না। মৌ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও সে মেহেরকে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুক্ষণ পর দুটো কাগজে করে বাদাম নিয়ে আসে রাহনাফ। একটা সে মৌ-য়ের হাতে দেয় অন্যটা নিজের কাছে রাখে। রাহনাফ আলিহানের বিষন্নমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যে মৌ-য়ের সাথে দেখা করার জন্যে সে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তাকে কাছে পেয়েও এমন মুখ ভার করে বসে আছে কেন? আলিহান তার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালো। তখনি রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয় আর রাহনাফ চোখের ইশারায় জানতে চায় আলিহানের মন খারাপের কারন। তখন আলিহান তার চোখের ইশারায় মেহেরকে দেখিয়ে দেয়। রাহনাফ মৃদু হেসে আলিহানকে শান্ত হতে বলে মৌ-য়ের পাশে গিয়ে বসে তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,
– আপনাকে না সত্যিই নভেল দেওয়া দরকার। নভেল দিলেও বোধহয় কম হবে, আপনাকে তো Alfred Nobel কেই দিয়ে দেওয়া উচিৎ।
রাহনাফের কথা শুনে ভ্রুযুগলে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের। মোবাইলটা ব্যাগে পুরে রেখে শান্ত গলায় বলে,
– ঠিক কি কারনে আমাকে নভেল দেওয়া হবে শুনি?
– কেন আবার! এখনে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা বসে আছে একটু গল্প করবে বলে, আর আপনি ওদের মাঝে এলাচি হয়ে বসে আছে। আপনার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই।ওদের তো একটু স্পেস দেওয়া দরকার তাইনা। পারসোনালিটি বলে কিছু আছে না-কি?
– এক সেকেন্ড, এদের আবার কিসের পারসোনালিটি, বিয়ে হয়েছে নাকি, এরা কি স্বামি স্ত্রী যে পারসোনাল কথা থাকবে। দৃঢ় কন্ঠে জবাব দেয় মেহের।
– আপনার মতো ঘাড়ত্যারা ত্যজি ইঁদুরকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।
রাহনাফের বলা শেষ বাক্যশুনে মেহেরের রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে যায়। সে রাগে দাত কটমট করতে থাকে। তারপর বলে,
– কি বললেন আপনি? সাহস থাকে তো আবার বলে দেখুন। উঠে দাড়িয়ে যায় মেহের। মৌ মেহেরের হাত ধরে ওকে থামাতে যায় কিন্তু তার আগেই রাহনাফ বলে উঠে,
– ঘাড়ত্যারা ত্যাজি ইদুর। মেহের মৌ-য়ের থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে নিয়ে তাড়া করতে থাকে রাহনাফকে। রাহনাফ দৌড়ে ওদের থেকে অনেকটা দূরে চলে যায় আর মেহের রাহনাফের পিছনে ছুটতে থাকে। আলিহান ওদের কান্ড দেখে না হেসে পারে না। ফিক করে হেসে দেয় সে। মৌ আলিহানের হাসির দিকে তাকিয়েই থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আলিহান মৌ-য়ের সামনে তুরি বাজিয়ে বলে,
– কোথায় হারালেন ম্যাডাম?
থতমত খেয়ে যায় মৌ। সে যতটা সম্ভব তার দৃষ্টি নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনাতেই ডুবে থাকি সারাক্ষণ। আমার সকল ভাবনা জুরে শুধু আপনার বসবাস আলিহান। স্মিত হাসে আলিহান, সে মৌ-য়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
এদিকে অনেক্ষন যাবৎ রাহনাফের পিছনে ছুটে হাপিয়ে উঠেছে মেহের। সে হাটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বড় করে বারকয়েক শ্বাস নেয়। রাহনাফ ওর থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেয়েটা বড্ড বাচ্চা স্বভাবের। যাই হোক তাকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা মোটেও ঠিক না। রাহনাফ স্ব-ইচ্ছায় মেহেরের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর তখনি মেহের ঝপিয়ে পরে রাহনাফের উপর।এলোপাথাড়ি রাহনাফকে মারতে থাকে সে। সুযোগ বুঝে রাহনাফ মেহেরের হাত দুটো ধরে পিছনে নিয়ে নেয়। যার ফলে মেহেরের পুরো শরীরের ভর গিয়ে পরে রাহনাফের গায়ের উপর। অনেকটা কাছাকাছি এসে যায় দুজনে। যতটা কাছে আসলে একে অপরের হৃদস্পন্দর শুনতে পায় ততটা কাছাকাছি। দুজন দুজনের অক্ষির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মেহের নিজের হাত ছুটানোর জন্যে ছটফট করতেই রাহনাফ মেহেরের চোখে চোখ রেখে বলে,
– আশেপাশে সবাই আমাদের দেখছে। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করুন লেখিকা সাহেবা। রাহনাফের কথা মতো আশেপাশে তাকায় মেহের। সবাই কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তখন রাহনাফ মেহেরকে ছেড়ে ওকে থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দেয়। অতঃপর বলে,
– চলুন আমরা ওদিকটায় যাই।
– কিন্তু মৌ।
– আলিহান আছে তো। আপনার কোন ধারনাই নেই লেখিকা সাহেবা ওরা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আমার বন্ধু থাকতে আপনার বোনের কোন ক্ষতি হবো না। চলুন লেখিকা আজ আপনাকে নতুর কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় মেহের। রাহনাফ তার হাতের ইশারায় পার্ক থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটা ভবন দেখায়। অতঃপর বলে,
– চলুন লেখিকা আমরা ওইদিকে যাই।
– ওটা তো চাইল্ড এন্ড ওন্ডএজ কেয়ার হোম।
– হ্যাঁ। শুধু কল্পনার জগৎ নিয়ে লেখলে চলবে লেখিকা! বাস্তবতা দেখুন, আমাদের চারিপাশের এই প্রকৃতিকে মন দিয়ে উপভোগ করুন। তবেই আপনি একজন স্বর্থক লেখক।
এই প্রথমবার রাহনাফের কথা ভালো লাগে মেহেরের। মেহের মুগ্ধ দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর তারা দুইজনেই চলে যায় দূরের ওই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোম।
মায়ের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের সেবামূলক কার্যক্রমের কথা অনেক শুনেছে মেহের। নির্ধারিত সময়ে এখানে পৌঁছে বন্ধুবৎসল সেবাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা দারুণ লাগছে মেহেরের । তাঁরা পেশাদার আর কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। রাহনাফ তো এখানে এসেই কোথাও যেন উধাও হয়ে গেছে। মেহের একা একা ঘুরে ঘুরে দেখছে এই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ হোম। কিছুক্ষণ পর কয়েকটা বাচ্চাএসে মেহেরকে ঘিরে ধরে। মেহের বাচ্চাগুলো সাথে হেসে খেলে কথা বলে তারপর চলে যাই আশ্রমের অন্যপ্রান্তে। সেই প্রান্তে ছিলো বৃদ্ধাদের বসবাস। প্রথমেই তার চোখ আটকে যায় একটা বেঞ্চের উপর বসে থাকা দুজন বৃদ্ধা নর-নারীর উপর। যারা একে অপরের সাথে খাবার ভাগ করে খাচ্ছে। বয়সের ভারে শরীরে চামড়া কুচকে গেছে, বাড়ি ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে তবুও তাদের ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি। মেহের তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উল্টোদিকে হাটা শুরু করে তখনি পিছন থেকে কেও মেহেরের নাম ধরে ডাক দেয়।
– মে-মেহের।
জাড়ানো কাপা কন্ঠে এই আশ্রমে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় মেহের। পিছনের দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পায় একজন বৃদ্ধা মহিলা তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। বৃদ্ধাকে দেখে কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পরে যায় মেহেরের। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে বলে,
– আপনি আমাকে ডাকছেন?
মেহেরের কথার কোন জবাব দেয়না বৃদ্ধা। সে একপা দু-পা করে এগিয়ে আসতে থাকে। বৃদ্ধাটি মেহের নিকটবর্তী আসলে মেহের খেয়াল করে তার চোখ পানিতে জ্বলজ্বল করছে। বৃদ্ধার চোখের নোনাজল দেখেই মেহের তার বুকের বা পাশে হালকা ব্যাথা অনুভব করে। বৃদ্ধাটি মেহেরের কাছে চলে আসে তার তখন তার দু-চোখ থেকে কয়েকফোটা অশ্রু গাল বেয়ে পরে। মেহের বৃদ্ধার চোখে জল দেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধাটি মেহেরের গালে হাত রেখে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বৃদ্ধার হাতের ছোঁয়া মেহেরের ভালো লাগে। কেন জানি তাকে নিজের বলে মনে হচ্ছে তার। মেহের বৃদ্ধার হাতের উপর হাত রেখে বলে,
– কে আপনি? আপনি আমার নাম জানেন কি করে??
মেহেরের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বৃদ্ধা বলে উঠে,
– কি মিষ্টি দেখতে হয়েছিস তুই। যেন শরীরে টুকা দিলেই রক্ত বের হবে। বলতো আমি তোকে কি করে চিনলাম, বলতে পারলি না তো। বেশ তাহলে আমিই বলছি, আমি তোকে চিনতে পেরেছি তোর চোখদুটো দেখে।
বৃদ্ধার কথা শুনে মেহের তার গাল থেকে বৃদ্ধার হাত সরিয়ে দেয়। কেউ তার গায়ের রং নিয়ে কথা বললে তিক্ত লাগে মেহেরের। সে যে তার গায়ের এমন দুধ সাদা রংকে অপছন্দ করে এটা কি কেউ জানেনা নাকি। তারপরেই কেন সবাই তার গায়ের রংয়ের এত প্রশংসা করে বৃদ্ধাকে রেখে চলে আসে সেখান থেকে। পিছন সে অনেক ডেকেছে কিন্তু ফিরে তাকায়নি মেহের।
এদিকে মেহের রাহনাফকে খুজে যাচ্ছে। এই ছেলেটা সেই এসে কোথায় উধাও হয়ে গেল এখনো তার দেখা মেলে নি। বেশ রাগ লাগছে এখন মেহেরের। কতটা সময় কেটেগেল এখানে। এখন কলেজ ছুটি হওয়ার সময়, বাসায় ফিরে যেতে হবে। ওদিকে মৌ কি করছে কে জানে? এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেহের।
– কাকে খুঁজছেন লেখিকা সাহেবা!!
চেনা এই কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকায় মেহের। পাশে তাকাতেই দেখতে পায়, কৈশোর বয়সের কয়েকজন ছেলেমেয়ের সাথে বসে বসে গল্প করছে রাহনাফ। মেহেরের খুব রাগ হয়। এই স্টুপিড ছেলেটাকে সে কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছে। আর সে সময় ভুলে, এখানে বসে গল্প করছে। মেহের দ্রুত পায়ে রাহনাফের কাছে যায়। গলার স্বর শক্ত করে বলে,
– আপনি এখানে, আর আমি আপনাকে কোথায় কোথায় খুঁজে যাচ্ছি।
– এত খুজার কি প্রয়োজন কাউকে জিগ্যেস করলেই পারতেন।
– কাউকে জিগ্যেস করতেন। রাহনাফকে ব্যাঙ্গ করে বলে মেহের। কাকে জিগ্যেস করবো আমি। না কেউ আমাকে চিনে আর না আপনাকে। তাহলে জিগ্যেস করে লাভটা কি??
– রাইট। আপনাকে এখানে কেউ চিনে কিন্তু আমাকে তো চিনে।
– আপনি এমন ভাবে বলছেন মনে হচ্ছে আপনিও এই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমে থেকেছেন।
– আপনার ধারনা ভুল নয় লেখিকা সাহেবা। সামনে তাকিয়ে সবার সাথে গল্প করায় মনোযোগ দেয় রাহনাফ। মেহের অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের পানে।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
[অসুস্থতার মাঝে কি থেকে কি লেখেছি নিজেও জানিনা। ভুলত্রুটি মার্জনীয় ]