#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৫]
রাহির হাত থেকে রক্তের স্রোত ছুটছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার রুম। রুমের সব জিনিসপাতি লণ্ডভণ্ড হয়ে পরে আছে। ড্রেসিংটেবিলের আয়নাটা ভেঙে চুড়মার হয়ে পরে আছে। তার সামনে ফুলদানিটা কয়েক টুকরা হয়ে পরে আছে। বিছানার বালিশ চাদর এলোমেলো ভাবে নিচে পরে আছে। রাহি ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে দু-চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ওর হাতের রক্ত বিছানায় পরে সাদা চাদরটা লাল বর্ণ ধারন করেছে। ওদিকে রাহির মা অনেক্ষন যাবৎ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সে বিরতিহীনভাবে রাহিকে ডেকে চলেছে।মেয়ের জন্য খুব টেনশন হচ্ছে তার। সকাল হতেই রাহনাফ আসে রাহির সাথে দেখা করতে। রাহি রাহনাফকে নিয়ে সোজা তার রুমে চলে আসে তারপর দুজনে প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ কথা বলে। দুই ঘন্টা পর রাহনাফ চলে গেলেও রাহি তার রুম থেকে বের হয়নি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল রাহি তবুও তার রুম থেকে বের হলো না। রাহিকে রুমের বাহিরে আসতে না দেখে রাহির মা বুঝে যায় দুজনের মাঝে কিছু প্রবলেম হয়েছে। রাহনাফ রাহিকে উল্টাপাল্টা কিছু বলছে তাই হয়তো রাহি রাগ করে রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে।বন্ধ রুমে থাকলে কি আর সমস্যায় সমাধান হবে। যে কোন সমস্যা আসলে আগে সমস্যাটির মোকাবিলা করতে হবে। রাহির মা রাহিকে ডাকতে আসে। দরজার ওপাশে দাড়িয়ে অনবরত রাহিকে ডেকে যান তিনি। কিন্তু রাহির কোন রিসপন্স -ই পাচ্ছে না। রাহির তার ডাকের সারা দিচ্ছে না। একটু ভয় পেয়ে যায় রাহির মা। দৌড়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে সৈয়দ নওশাদকে কল করে সব বলে তারপর একটা সার্ভেন্টকে ডেকে নিয়ে যান রাহির রুমের সামনে। সার্ভেন্ট দরজার লক ভেঙে দেয় তারপর রাহির মা রুমে প্রবেশ করে। রুমের ভিতরে প্রবেশ করতেই রুমের অবস্থা দেখে থমকে যায় রাহির মা। নিঃপলক সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর যখন সে বিছানার দিকে তাকায় তখনি চিৎকার করে উঠেন তিনি। লম্বা পা ফেলে রাহির কাছে যেতে চাইলে একটা কাচের টুকরো তার পায়ে ফুটে যায়। আহঃ শব্দ করে নিচে তাকাতেই ভাঙা আয়নায় নিজের মুখ দেখেন তিনি। কেপে উঠে রাহির মা। লোক মুখে শুনেছেন তিনি ভাঙ্গা আয়নার মুখ দেখলে নাকি বিপদ আসে যদিও এই আধুনিক যুগে এই প্রথা মানে না কেউ। তবে আজ কেন জানি মানতে ইচ্ছে করছে। সামনে দিকে তাকিয়ে রাহিকে এক পলক দেখে নেন। তারপর ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– নাহ আমার রাহির কিছু হবে না। আমার রাহির কিছু হলে কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকে না।
নিজের একাধিক প্রতিবিম্ব ভাঙ্গা আয়নাতে দেখে নিলেন তিনি। ততক্ষণ কয়েকজন সার্ভেন্ট রাহির কাছে চলে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন রাহির কাছে বসে অন্যজন রাহির হাত ধরে নেয়।
– আপামানি তার হাতের রগ কাইটা ফালাইছে ম্যাডাম।
একজন সার্ভেন্টের কথায় রাহির মা চমকে উঠে। দ্রুত রাহির পাশে বসে কান্না করতে থাকেন তিনি। অপর সার্ভেন্ট বলে,
– আপামনিকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়্যা যাইতে অইবো। না হলে তাকে বাচান যাইবো না। সার্ভেন্ট রাহিকে পাজা কোলে তুলে নেয়। তারপর ড্রাইভার ডেকে রাহিকে নিয়ে চলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
২৫,
করিডোরে নিজের মাকে নিয়ে বসে আছে মেহের। তার পাশেই বসে আছে মৌ। মৌ করিডোরে বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর একটু পরপর হাই তুলছে। মৌ-য়ের এমন অবস্থা দেখে মেহের রাগে ফুসছে আর মনে মনে মৌ-কে গালি দিচ্ছে। ঘুমাবি যখন তখন না আসলেই পারতি, দরদ দেখিয়ে হসপিটালে আসার কি দরকার ছিলো শুনি। সৈয়দা মাহবুবা তাকিয়ে আছে মেহেরের রাগিরাগি মুখের দিকে। মেহের যখন রাগ করে তখন সে ঠোট কামড়ায় আর নাক ফুলায়। নাক ফুলানোর সময় মেহেরে নাকে যে তিনটা আছে সেটা বড় হয়ে যায় দেখতে খুব ভালো লাগে। মেহেরের মা মেহেরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,
– এটা আমার মেয়ে অথচ আমিই তার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। কি দরকার ছিলো এত সুন্দর হওয়ার। সবাই তো আমার মেয়ের দিকে নজর দেয়। আল্লাহ দেখো কারো বদ নজর যেন না পরে আমার মেয়ের উপর। বড় করে শ্বাস নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। সুন্দর হলে একটাই সমস্যা, সকলের নজরে পরতে হয়। আর কালো মেয়েদের জিবনের প্রতিটা পদে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কালো মেয়েরাও সকলের নজরে পরে। কালো মেয়েদের কপালে ভালোবাসা জুটে না। তাদের অনেক কষ্ট। যেটা সৈয়দা মাহবুবা তার জিবন থেকে জানতে পারেছে। সে কালো বলেই তো তার স্বামি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কারন তার সুন্দর বউ লাগবে।
মৌ নিজের ঘুম তাড়ানোর জন্যে হাটার সিদ্ধান্ত নেয়। বসে থাকে ঘুমপরিরা বেকে বসে। এবার সে হাটবে তাহলে যদি ঘুৃম দূর হয়। তবে এত বড় হসপিটালে একা হাটতে গিয়ে যদি হাড়িয়ে যায় তাহলে! আচ্ছা মৌ হাড়িয়ে গেলে কি আলিহান আবার বিয়ে করে নিবে। ওকে ভুলে যাবে আলিহান। সে নতুন বউ নিয়ে সুখে সংসার করবে তাকে আদর করবে ভালোবাসবে। নো নো এটা হতে পারে না। আলিহান শুধু মৌ-কে ভালোবাসবে। মাথা নাড়িয়ে সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দেয়। মেহেরের দিকে তাকাতেই দেখে মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাচ্ছে। মৌ ততক্ষণাৎ মেহেরের পাশে গিয়ে বসে মেহেরের এত হাত নিজের হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করে নেয়। মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে প্রশ্নের দৃষ্টিতে মৌ-য়ের দিকে তাকাতেই মৌ বলে উঠে
– চলনা ওদিকে একটু হেটে আসি।
অনেকক্ষণ বসে থেকে মেহেরের ও বোরিং লাগছে তাই সে আর আপত্তি করে না। সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মা তুমি একটু বসো আমরা আসি।
– কোথায় যাবি তোরা?
– সামনের দিকটায়। তুমি বসো ভাইয়াও হয়তো এখনি চলে আসে।
অতঃপর মেহের আর মৌ হাটতে হাটতে চলে যায় অন্য একটা ওয়ার্ডে। পাশেই পরপর দুটো ওটি রাখা। যার একটাতে এখনো লাইট জ্বলছে। এদিকে ওদিক থেকে ডক্টর নার্সের ছুটাছুটি। মেহের আর মৌ হেটে হেটে সবটা দেখছে। হঠাৎ একটা নার্সের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় দুজনে।
– পেসেন্টের হাত থেকে প্রচুর পরিমানে রক্ত ঝড়ছে। ইমিডিএটলি এ প্রজেটিভ রক্ত লাগবে।
– আপনারা যে করেই হোক রক্তের ব্যাবস্থা করে দিন। আমাদের আপামনিকে বাচান। যত টাকা লাগে সব দিবো শুধু আপামনিকে বাচিয়ে দিন কালো টিশার্ট পরিহিতা লোকটা বলল।
– টাকা থাকলেই সব হয় না। আপনারা রক্তের ব্যাবস্থা করুন। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে এ প্রজেটিভ রক্ত শেষ হয়েছে। আপনারা যেখান থেকেই হোক রক্তের ব্যাবস্থা করে দিন। কথাগুলো বলে নার্স চলে যেতে চাইকে পিছন থেকে মেহের তাকে ডাক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– রক্ত আমি দিবো। আমার ব্লাডগ্রুপ এ প্রজেটিভ।
মেহেরের কথা শুনে মৌ-য়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে অবাক চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুই রক্ত দিবি মানে! কিছুদিন আগেই তো ব্লাড ডোনেট করছি, আজ আবার দিবি। এরকম চলতে থাকলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।
– আমার একটু রক্তের বিনিময়ে যদি একটা মানুষের প্রন বেচে যায় তাহলে ক্ষতি কি। মেহের নার্সের দিকে তাকিয়ো বলে,
– আপনারা আমার কি কি টেষ্ট করাবেন করে নিন। অতঃপর নার্স মেহেরকে নিয়ে চলে যায়। মৌ মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
রক্ত দেওয়া শেষে যখন চলে আসছিলো মেহের তখন একটা নার্স মেহেরকে বলে,
– আপনার আর পেসেন্টের রক্তের সব দিকটাই ম্যাচ করেছে। আশ্চর্য! এটা মিরাক্কেল। তা নাহলে দুজন অপরিচিত মানুষের মাঝে এতটা মিল থাকতে পারে না।
নার্সের কথাশুনে মৃদু হাসে মেহের তারপর সেখান থেকে চলে আসে।
দুহাতে মাথা চেপে ধরে করিডোরে বসে আছে মেহের। ওর পাশেই বসে আছে মৌ আর আলিহান। রাহনাফ মেহেরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না রাহনাফ। দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়সীর দিকে। সৈয়দা মাহবুবা গেছেন ডাক্তারের চেম্বারে। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ ধীর পায়ে মেহেরের পাশে এসে দাঁড়ায়। আলিহান ওকে বসতে বললে, রাহনাফ চোখের ইশারায় বলে দেয় ঠিক আছে। মেহেরের পাশে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে রাহনাফ। রাহনাফের বড্ড ইচ্ছে করছে মেহেরকে দু-হাতে তার বুকে জড়িয়ে নিতে। মেহের মাথার গভীর চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করছে তার। আচ্ছা মেহেরে কি কোন দিনও তাকে সেই সুযোগ দিবো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা কথা ভাবতে থাকে রাহনাফ। এর মধ্যে একজন ডক্টর আসে মেহেরের কাছে। ডক্টরকে দেখে মেহের দাঁড়াতে গেলে মাথা ঘুরে নিচে পরে যেতে নেয় আর তখনি রাহনাফ দু-হাতে মেহেরকে আগলে নেয়। তবে কিছু সময়ের জন্যে সেন্সলেস হয়ে যায় মেহের। রাহনাফ মেহেরকে পাজা কোলে নিয়ে একটা কেবিনে নিয়ে যায়। আলিহান আর মৌ ওদের পিছনে যায়। আলিহান যাওয়ার সময় ডক্টরকে ওদের সাথে নিয়ে যায়। মেহেরের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নেওয়া হয়েছে যার ফলে ওর শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। ডক্টর ওকে রেস্ট নিতে বলে। আর একটা লোককে ওদের কেবিনে ডাকে। লোকটাকে দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। মেহের বেড থেকে নামতে চাইলে মৌ ওকে আটকিয়ে দেয়। রাহনাফ তার চক্ষুদ্বয় সংকোচিত করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। আলিহান তাকে দেখা মাত্রই তার দৃষ্টি ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকায়। কারন তাদের সামনে কোটসুট পরে দাড়িয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ। ডক্টরের কথায় শুনে সকলের সকলে আরো বেশী অবাক হয়।
– স্যার এই সেই মেয়ে, যে আপনার মেয়েকো রক্ত দান করেছে।
অবাক হয়ে যায় মেহের। অজান্তেই কাকে রক্ত দিয়েছে সে। তাছাড়া কি হয়েছে রাহির। রাহনাফের চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়, সকালে তো রাহি ভালোই ছিলো। এইটুকু সময়ে কি হলো তার। সৈয়দ নওশাদ ডক্টরের কথা উপেক্ষা করে বলেন,
– মেহের।
তারপর সে পুরো কেবিনে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আলিহানকে দেখে তার অধরে হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু আলিহান তার দিকে থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
[রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম]