#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৬]
সৈয়দ নওশাদ আবেগ প্রবণ হয়ে মেহেরের মাথায় হাত রাখতে গেলে মেহের তার হাত সড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে,
– ছুঁবেন না আমাকে। আপনি আমাকে স্পর্শ করলে আমি নিজেও নোংরা হয়ে যাবো।
মেহেরের কথা শুনে সৈয়দ নওশাদ তার চোখ বন্ধকরে হাত শক্তমুঠি করে নেয়। পাশ থেকে রাহনাফ বাকা চোখে ওদের দিকে তাকায়। স্যার মেহেরকে আগে থেকে চিনতো, ওরা এভাবে কথা বলছে কেন? কই মেহের কিংবা স্যার তো আগে কখনো বলেনি তারা একে অপরের পরিচিত। রাহনাফের ভাবনার ছেদ ঘটে সৈয়দ নওশাদের কথায়।
– একবার বাবা বলে ডাক মা।
– আমার কোন বাবা নেই। প্লিজ আপনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যায়। আলিহান ভাই এই লোকটাকে আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলো। চিৎকার করে বলে মেহের।
– চাচা আপনি কি করছেন, চলে যান এখান থেকে। কেন শুধু শুধু মেহুর শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আবার তাজা করে তুলছেন। কি সুখ পান বলুনতো এই পিচ্চিটাকে কষ্ট দিয়ে। এগিয়ে এসে বলে আলিহান। আলিহানের কথা শুনে সৈয়দ নওশাদ ছলছল চোখে তার দিকে তাকায়।
– গুড্ডু, তোরও এত অভিমান।
– কি করবো বলুন, আপনি তো মানুষটাই এরকম। কাউকে আপন করে নিতে জানেন না, কারো কষ্ট বুঝেন না শুধু নিজেরটা ছাড়া। তাইতো দাদি আজ বৃদ্ধা আশ্রমে। আপনি কি পারতেন না দাদিকে বৃদ্ধাশ্রম যাওয়া থেকে আটকাতে। সুন্দরী বউয়ে এতটাই মোহ যে তার কথায় উঠছেন বসছেন। তার কথা শুনে নিজের মাকে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে রাখলেন। ছোটমনি একা নিজের সাথে লড়াই করে মেহেরকে বড় করছে। আর মেহু বাবা থাকতেও বাবার পরিচয়হীন ভাবে বাঁচতে হচ্চে ওকে। চোখের সামনে বাবা থাকতে তাকে বাবা বলে ডাকতে না পারার কষ্টটা আপনি জানেন স্যার। জানেন না, কারন আপনার সব আছে। সুন্দরী বউ সুন্দরী কন্যা বাড়ি গাড়ি সব আছে।
রাহনাফের কথা শুনে ছলছল চোখে মেহেরের দিকে তাকায় সৈয়দ নওশাদ। মেহের তারদিকে ঘৃনা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে । রাহনাফ এগিয়ে এসে আলিহানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– এসব তুই কি বলছিস আলিহান! মেহের স্যারের মেয়ে?
– হ্যাঁ। মেহু শুধু আমার শলিকা নয়, সে আমার ছোট বোন। এই নওশাদ আহমেদের প্রথম সন্তান মেহু।
আলিহানের কথা শুনে রাহনাফের মাথা ঘুরে যায় সে করুন দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকায়। মেহেরের দৃষ্টি তখন ছিলো নিচের দিকে।
সৈয়দ নওশাদ আহমেদ আবার বলে উঠে,
– মেহের তুই কি আমাকে কোন দিনও ক্ষমা করবি না মা।
– ক্ষমা, কিসের জন্যে ক্ষমা করবো আপনাকে বলতে পারেন। গর্ভাবস্থায় আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করার জন্যে, আপনার আরেকটা বিয়ে করার জন্যে নাকি জন্মের আগে আমাকে পিতার পরিচয় থেকে বঞ্চিত করার জন্যে। কোনটার জন্যে ক্ষমা করবো আপনাকে। যেখানে সব শিশুর বেড়ে উঠা হয় তার বাবার হাত ধরে, তাকে হাটিহাটি পায়ে হাটা শিখানো, মা বকলে সন্তান যখন গাল ফুলিয়ে বসে থাকে তখন বাবা তার সন্তানকে চুপিচুপি আদর করে সেই রাগ ভাঙিয়ে, সেই বয়সে আমি জানতামই না আমার বাবা কে? কি আমার বাবার পরিচয়। লোক মুখে কটু কথা শুনে বড় হয়ে উঠেছি। আমার মাকে দেখেছি সে কি করে আমাকে বাবা আর মা দুটোর আদর দিয়েছে তাই এই বয়সে এসে আমার বাবাব কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে আমার মায়ের আদরকে অসম্মান করা হবে। আপনি চলে যায় সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। আর কোন দিন বাবার অধীকার নিয়ে আমার সামনে আসবেন না। আমি কোন দিন আপনাকে বাবা বলে মানতে পারবো না। আমার কোন বাবা নেই আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার।
মেহেরের কথা শুনে সৈয়দ নওশাদের চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। সে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো মেহেরের দিকে। মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে মৌ-য়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরে। রাহনাফ এখনো তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। এই মেহেরকে দেখে বুঝাই যায় না তার মনের ভিতরে এতটা কষ্টা লুকিয়ে রাখা আছে। কতটা হাসিখুশি ভাবে সকলের সাথে সহজে মিশে যায় সে। মেহের মাথা তুলে সামনে তাকাতেই রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তখনি কথা বলতে বলতে কেবিনে প্রবেশ করে সৈয়দা মাহবুবা,
– মেহু কোথায় কি হয়েছে ওর!
সৈয়দা মাহবুবার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই দরজার দিকে তাকায়। সৈয়দ নওশাদ মাথা ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। কিন্তু এই কালো মহিলাকে দেখে অবাক হওয়ার কারনটা তিনি জানেন না। আচ্ছা মাহবুবা কি আগের থেকে আরো বেশী কালো হয়েছে দেখতে আরো খারাপ দেখায়? সৈয়দা মাহবুবার দৃষ্টি স্থির কেবিনের বেডের উপর। যেখনে আধো শোয়া হয়ে বসে আছে মেহের। তিনি সেদিকে এগিয়ে যায়। তখন মেহের বলে,
– আমার কিছু হয়নি মা। মাথাটা ব্যাথা করছে। তবে চিন্তার কোন কারন নাই। রক্ত দেয়ার পর কিছুটা মাথা ঘোরাবে এটাই স্বাভাবিক। তুমি বসো এখানে। তোমার কি অবস্থা ডক্টর কি বলল!
মেহেরের প্রশ্ন শুনে সৈয়দা মাহবুবা বড় করে শ্বাস ত্যাগ করলেন। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। তিনি মেহেরের পাশে বসতে বসতে বললেন,
– কিছু হয়নি আমার। আমি একদম সুস্থ। তোদের আগেই বলছিলাম, ডক্টরের কাছে যেতে হবে না কিন্তু তোরা তো কেউই আমার কথা শুনিস না। এই দেখ আমার রিপোর্ট।
মেহের তার মায়ের হাত থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে দেখতে লাগলো। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,
– এমন অনিয়মিতভাবে রক্তদিলে চলবে। নিজের দিকটা দেখেছিস একবার।
– আমি ঠিক আছি মা। রক্তের অভাবের কারণে প্রতিবছর বহু রোগীর প্রাণ সংকটের মুখ পড়ে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। এই অল্প সময়ে চাইলেই একজনের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। আমার সামর্থ্য থাকা সত্তেও কেন একজনের প্রাণ বাঁচাবো না বলো।
মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবার চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। তবে এটা সুখের অশ্রু। তিনি পেড়েছে তার মেয়েকে মানুষ করতে। পাশেই দাঁড়িয়ে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন। হাত দুটো শক্ত মুঠি করা তার। কত সুন্দর মা মেয়ের সম্পর্ক। তিনি চাইলে আজ এদের সুখের কারন হতে পরতো। মেহের তার মাকে বাহুডোরে আগলে রাখতে পারতেন তিনি। সৈয়দা মাহবুবা কথা বলার ফাঁকে লক্ষ করলেন কেবিনের ভিতরে সৈয়দ নওশাদ আহমেদের উপস্থিতি। তাকে দেখা মাত্রই থমকে যায় সৈয়দা মাহবুবা। চোখ-মুখ শক্তকরে বলে উঠেন,
– এই লোকটা এখানে কি করছে? কি হলো কেউ কথা বলছো না কেন? বলো এই লোকটা কি করছে এখানে?
– মাহবুবা আমি,,, আবেগী কন্ঠে কিছু বলতে চায় সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। তার কিছু বলার আগেই সৈয়দা মাহবুবা তার হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
– আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি।
– ছোটমনি, মেহু ওনার মেয়েকে রক্ত দিয়েছে তাই উনি এখানে এসেছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। পাশ থেকে বলে আলিহান।
আলিহানের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহেরের দিকে তাকালে মেহের হাত দিয়ে তার কান স্পর্শ করে বল মৃদু সুরে বলে, সরি, আমি জানতাম না। সৈয়দা মাহবুবা তার দৃষ্টি শক্তকরে নেয়। তারপর বলে,
– উনাকে এখান থেকে যেতে বলো।
সৈয়দা মাহবুবার কথা শুনে অধোর চেপে মৃদু হাসার চেষ্টা করে নওশাদ আহমেদ। তারপর কেবিনের সবাইকে অবলোকন করে নিয়ে দু পা পিছিয়ে উল্টোদিক ঘুরে চলে যায় কেবিনের বাইরে। নওশাদ আহমেদ যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন তাকে দেখে কেউ কেবিনের দরজার আড়ালে লুকিয়ে যায়। সৈয়দ নওশাদ চলে যেতেই সে দরজাটা খামচে ধরে। এতক্ষণ দরজার আড়ালে তাদের কথা শুনছিলো সে। সে দরজার আড়ালে মুখ লুকিয়ে অস্ফুটভাবে বলে উঠে,
– আমি কিছুতেই আমার অধীকার ছাড়বো না। প্রয়োজনে আরো একজনের প্রান যাবে। তারপর সে লম্বা পা ফেলে সেখান থেকে চলে যায়।
২৬,
মেহের তার মা-কে নিয়ে হসপিটাল থেকে চলে যায়। যাওয়ার আগে ডক্টর মেহেরকে পই পই করে বলে দিয়েছে তার ফুল বেড রেস্ট। সাথে ফলমূল তো আছে। ফলমূল খাওয়া কথা শুনে নাক সিটাকায় মেহের। এটা দেখে ডক্টর মৃদু হাসলেও রেগে যায় সৈয়দা মাহবুবা। রাহনাফ আর আলিহানও ওদের সাথে বের হয়ে যায়। কিছুদূর চলে আসার পর মনে হয় রাহির কথা। আলিহান আর রাহনাফ ওদের তিনজনকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে ওরা আবার ফিরে আসে হসপিটালে। তারা সোজা চলে যায় রাহির কাছে। রাহির মা বাসায় চলে গেছে এখন রাহির পাশে আছে শুধু সৈয়দ নওশাদ । রাহনাফকে দেখে সৈয়দ নওশাদ বলে,
– তুমি এখান থেকে চলে যাও রাহনাফ। রাহি তোমাকে দেখলে আরো কষ্ট পাবে। তুমি চলে যাও রাহিকে আমরা সামলে নিবো।
– কিন্তু স্যার,,
– কোন কিন্তু টিন্তু শুনতে চাচ্ছি না আমি। চলে যাও তুমি। আর কোনদিন যেন তোমাকে রাহির সাথে না দেখি।
সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে আলিহান বলে উঠে,
– সৈয়দ নওশাদ আহমেদ ও তাহলে কারো জন্যে কষ্ট পায়। আমি তো ভেবেছিলাম সে শুধু তার নিজের কথা ভাবে।
– তুমি কি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ ভাবো আলিহান। প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সৈয়দ নওশাদ।
– নাহ, স্বরন করিয়ে দিলাম আপনার আরো একটা মেয়ে আছে। আপনার প্রথম সন্তান। তাকেও কি রাহির মতো ভালোবাসেন নাকি সবটাই লোক দেখানে। আপনি তো আবার লোক দেখানো কাজ করতে বেশী পছন্দ করেন। শেষ বাক্যটা বিরবির করে বলে আলিহান। কিন্তু সেটা সৈয়দ নওশাদের কানে পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছালো। সে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে আলিহানের দিকে তাকাতেই আলিহান রাহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– রাহি ঘুমিয়ে আছে। চল পরে আবার আসবো। উল্টোদিকে হাটা শুরু করে আলিহান। রাহনাফ চলে যাওয়ার আগে ঘুমন্ত রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে বলে উঠে,
– আমি তোমার সেই ভালোবাসা নেই রাহি, যা তুমি আজিবন চেয়েছো।
রাহনাফ বড় করে শ্বাস নিয়ে চলে যায় কেবিনের বাইরে।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।