#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৭]
– রাহি, আমি তোমার সেই ভালোবাসা নই, যা তুমি আজিবন চেয়েছো।
কথাটা বলেই কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় রাহনাফ। রাহনাফ চলে যেতেই পিটপিট করে চোখ খুলে রাহি। দু-চোখের গহব্বর অশ্রুতে ভরে গেছে তার। কেবিনের ভিতরে রাহনাফকে আসতে দেখে ঘুমের ভান করে ছিলো সে। কিন্তু ওদের কাছ থেকে এমন কথা শুনবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারে নি। তাহলে কি সত্যিই তার বাবা ভালো মানুষ নয়। তাহলে কে তার বোন। আলিহান কার কথা বলছিলো, নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে তার বাবার দিকে তাকাতেই দেখে সৈয়দ নওশাদ বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাহি অশ্রুসিক্ত নয়নে সৈয়দ নওশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এটাই কি তার বাবা। আলিহান এতগুলা কথা বলল সে কোন প্রতিবাদ করলো না কেন? তাহলে কি সব সত্যি। তার আরো একটা মেয়ে আছে। তাহলে কে সে! সে কেন তাদের সাথে থাকে না। কোথায় আছে তারা? নানা প্রশ্ন এসে ভীড় জমিয়েছে রাহির মাথায়। পিছন থেকে জড়ালো কন্ঠে ডেকে উঠে রাহি,
– বাবা,
রাহির ডাক শুনে চমকে উঠেন সৈয়দ নওশাদ। ততক্ষণাৎ পিছনে ফিরে রাহির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কখন জেগেছে রাহি! আলিহানের বলা কথাগুলো কি সে শুনে নিয়েছেন। রাহিকে সরাসরি জিগ্যেস ও করতে পারছেন না তিনি। মহামুশকিলে পরেছেন।
– কখন উঠলে! না মানে কিছু বলবে?
– আমি বাড়ি যাব। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চল বাবা।
সৈয়দ নওশাদ রাহির কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
– খুব কষ্ট হচ্ছে মামনি! কেন এমনটা করতে গেলে বলতো। তোমার কি আমাদের কথা একবারও মনে পরে নি। যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে?
– বাবা, রাহনাফ।
– থেমে যায় সৈয়দ নওশাদের হাত। সে রাহির মাথা থেকে হাত সড়িয়ে বলেন,
– তুমি রাহনাফকে ভুলে যাও রাহি। আমি তোমার জন্যে রাহনাফের চেয়ে ভালো পাত্র যোগাড় করে দিবো। আমার রাজকন্যার জন্যে একটা রাজপুত্র ধরে নিয়ে আসবো।
সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে রাহির সবটুকু আশা ভেঙে যায়। সে শুধু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে।
২৭,
দুদিন ধরে বাসায় বসে বসে বোর হচ্ছে মেহের। রক্তদেওয়ার প্রথম দিন জ্বর আসলেও আজ সে সুস্থ তাহলে তাকে কেন বাসায় আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে মায়ের উপর খুব অভিমান মেহেরের। তার কলেজ পড়াশুনা লেখালেখি সবটাই অফ করে দিয়েছেন তিনি। এখন শুধু সারাক্ষণ খাওয়া আর ঘুম। এভাবে হাত পা ঘুটিয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। সৈয়দা মাহবুবাকে শত বুঝিয়েও বাহিরে যাওয়ার জন্যে রাজি করাতে পারে নি। তার এক কথা, একা সে মেহেরকে কোথাও যেতে দিবেন না। বিকালের দিকে রাহনাফ আসে ওদের বাসায়। রাহনাফ আসলে আলিহান, মৌ আর মেহেরকে নিয়ে বাহিরে যায়।
পিচডালা রাস্তায় পাশাপাশি হেটে চলেছে মেহের আর রাহনাফ। আলিহান আর মৌ সিনেমা হলে গেছে সিনেমা দেখতে। হলে নাকি আজ ভালোবাসার রং ছবি চলছে। ছবিটা নাকি হাউসফুল। মেহের স্ব-ইচ্ছায় যায়নি সেখানে। তাই মেহেরের সঙ্গ দিতে রাহনাফকে মেহেরের কাছে রেখে যায় আলিহান। এটা যেন রাহনাফের কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কিছুদূর হাটতেই মেহেরের জুতা যায় ছিঁড়ে। বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায় মেহেরের মুখ। কি আর করার এক হাতে জুতা নিয়ে পাশাপাশি হাটতে থাকে তারা। পৃথিবীর পারফেক্ট জুটি এই জুতা। একটা ছিঁড়ে গেলে অন্যটা অচল। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ মেহেরের
হাত তার হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করে নেয়। মেহের তার হাত ছাড়াতে চাইলে রাহনাফ তার মুঠি আরো শক্ত করে নেয়। মেহের ক্ষিপ্ত হয়ে রাহনাফের দিকে বাকা চোখে তাকালে রাহনাফ ভুবন ভুলানো হাসি উপহার দেয়। থেমে যায় মেহের। হাসলে ছেলেদের গালেও টোল পরে এটা রাহনাফকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। কত সুন্দর তার হাসি শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। মেহের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেহেরের এমন চাহনি দেখে রাহনাফ বলে উঠে,
– এভাবে কি দেখছেন লেখিকা সাহেবা!
মেহের নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
– আমি আপনাকে ভালোবাসি না।
– হুম জানি। আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো আমিও কাউকে এত সহজে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আপনাকে ভালোবাসতে হবে না লেখিকা সাহেবা। শুধু আমাকে ভালোবাসা সুযোগ দিন। আমি আপনাকে আমরণ ভালোবেসে যাব।
– সেটা হয় না।
– কেন হয়না লেখিকা সাহেবা। দেখবেন একদিন আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেবেন। হয়তো আমার থেকে বেশী। আমি না হয় সেই দিনটার অপেক্ষাতে রইলাম।
– সেইদিন কি আধো আসবে?
– আসবে। খুব শিগগীর আসবে।
– লেখিকা সাহেবা আমার একটা কথা রাখবেন?
– বলুন।
– আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা আমায় দিবেন।
– কোথায় দিতে হবে?
– আমাদের বিয়ের কাবিননামায়। মনে মনে বলল রাহনাফ।
– কি হলো কিছু বলছেন না যে।
মৃদু হাসে রাহনাফ। তারপর দুজনে হাটতে হাটতে অনেকটা দূর চলে আসে। এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধা নামছে পৃথিবীর বুকে। পাখিরা সব নিজনিজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছ। হাটতে হাটতে একসময় দাঁড়িয়ে যায় রাহনাফ। হাত উঁচু করে মেহের হাতের পাচ আঙ্গুলের মাঝে তার আঙ্গুলগুলো ডুবিয়ে দিয়ে বলে,
– আমার সঙ্গ আপনার ভালো লাগে।
– সেটা কখন বললাম।
– এতদূর চলে আসলাম অথচ নিজের হাত ছাড়ানোর বিন্দু মাত্র চেষ্টা করলেন না।
রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে ততক্ষণাৎ নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। এটা দেখে রাহনাফ স্মিত হেসে বলে,
– মজা করছিলাম। চলুন আমরা ও দিকে যাই। হাতের ইশারায় সামনের দিকটা দেখিয়ে বলে। মেহের ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের উপর তারপর সে রাহনাফের আগে আগে হাটতে থাকে। পিছন থেকে রাহনাফ মেহেরকে ডেকে বলে,
– সন্ধা নেমে আসছে বাড়ি ফিরতে হবে তো।
মেহের রাহনাফের কথা কর্ণপাত না করে সামনের দিকে হাটতে থাকে। রাহনাফের আর কি করার সে হেলেদুলে মেহেরের পিছনে হাটতে থাকে।
২৮,
গাড়ি করে বাড়ি ফিরছে রাহি ও তার পরিবার। সৈয়দ নওশাদ ড্রাইভ করছেন তার পাশের সিটে বসা তার স্ত্রী আর পিছনের সিটে জানালায় হেলান দিয়ে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখছে রাহি। কোন কিছুতেই মন বসে না তার। সব কিছু তিক্ত লাগে। রাহনাফকে এত ভালোবাসার পরেও সে কেন রাহনাফের ভালোবাসা পেল না। রাহনাফ কেন তাকে মেনে নিতে পারে নি। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে তার। তার থেকেও বড় কথা রাহির বোন কে? সব প্রশ্ন এক সাথে মাথায় এসে ভর করেছে তার। সৈয়দ নওশাদের অতীত না জানা অব্ধি শান্তু হতে পারছে না সে। হঠাৎ ই তার দৃষ্টি পরে গিয়ে রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে। খড় পাতার ছাউনি যুক্ত চায়ের দোকান। পাশেই আছে বড় একটা কেরাম বোর্ড। যেখানে কয়েকজন যুবক কেরাম খেলছে। চায়ের দোকানের সামনে রয়েছে একটা বাশের বেঞ্চ। সেই বেঞ্চের উপর বসে মাটির ভারে চা খাচ্ছে রাহনাফ আর মেহের। মুহুর্তেই মধ্যেই রাহির বুকের বা পাশটায় চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো। কত সুন্দর মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্যপট। দুজন প্রেমিক প্রেমিকা পাশাপাশি বসে মাটির ভাড়ে চা খাচ্ছে। মাথার উপর জ্বলছে লাল রংয়ের একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব। লাল লাইটের আলোতে দুজনের মুখ জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে কত সুন্দর ই না লাগছে এই দৃশ্যপট। মনোমুগ্ধকর সিগ্ধ ভালোবাসায় জর্জরিত একটা মোমেন্ট। রাহির চোখের কোটর গড়িয়ে অশ্রু পরলো। ওদের উপর থেকে তার দৃষ্টি সড়াতে চেয়েও পারছে না সে। তার গাড়িটা এখানে থামাতে হলো। স্থীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
সৈদয় নওশাদ ড্রাইভিং করার সময় যখন রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে ওদের দেখতে পান তখনি তিনি গাড়ি ব্রেক করে নেন তার তাকিয়ে থাকেন মেহেরের দিকে। দৃই দৃশ্যটা রাহির মায়ের চোখ এড়ালো না। সে সৈয়দ নওশাদের দৃষ্টি বরাবর লক্ষ করে যখন মেহের আর রাহনাফকে দেখতে পান তখনি রাগে তিনি কপাল কুচকে ফেলেন। শাড়ির আঁচল খামচে ধরে সে দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, অতঃপর রাহির কথা মনে হতেই সে পিছনে ফিরে আর রাহিকেও ওদের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে দেখে তিনি সৈয়দ নওশাদকে তাড়া দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে বলেন। সৈয়দ নওশাদ রাহির দিকে এক পলক তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। চলে যায় রাহি কিন্তু তার মন পরে থাকে খড় পাতার ছাউনিযুক্ত এই চায়ের দোকানে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।