মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-১৮

0
2534

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৮]

চন্দ্রালোকিত রাতের অপরূপ অভিনব নয়নভিরাম শোভা দেখেছে মেহের। ভাগ্যক্রমে এক শুভ্র নির্মল জ্যোৎস্নার রাতে তাঁর হঠাৎ দেখা। জ্যোৎস্নার রূপ মাধুর্য অবলোকন করতে সে যখন তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো গভীর ধ্যানে নিবিষ্ট ছিলো, অকস্মাৎ সে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো, পিছু ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল রাহনাফকে। বুকের উপর হাত গুজে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি স্থির মেহেরের মুখশ্রীতে। মেহের সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে আবার চন্দ্র দেখায় মন দেয়। রাহনাফ মৃদু হাসে। দু পা এগিয়ে সে মেহেরের পাশাপাশি দাঁড়ায়, চাদের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার মেহেরের মুখের দিকে তাকায় অতঃপর সে আনমনে বলে উঠে,

– আমি দেখি আমার চাঁদ, আর আমার চাঁদ ব্যাস্ত আকাশের চাঁদ দেখায়।

– কিছু বললেন!

– বাড়ি ফিরতে হবে।

– আর একটু থাকি না প্লিজ, ভালো লাগছে।

মেহেরের এমন কথা শুনে স্মিত হাসে রাহনাফ। আর একটু কেন, মেহের চাইলে রাহনাফ সারারাত এখানেই কাটিয়ে দিবে। আপনার সমস্ত আঙ্গা আমি পূরণ করতে প্রস্তুত লেখিকা সাহেবা। একবার শুধু বলেই দেখুন না।
ভালোবাসি আপনাকে খুব বেশী ভালোবাসি। আজকের এই মুহূর্তটা সারা জিবন স্মৃতি হয়ে থাকবে আমার কাছে। যখন বুড়ো হয়ে যাবো তখন আপনাকে এই বিকালের গল্প শুনাবো আমি। কিছু কিছু মুহূর্ত মনে রাখার জন্যেই বেঁচে থাকা।

এদিকে বাড়িয়ে পৌঁছানোর পর রাহি সোজা তার রুমে চলে যায়। সব কিছু তিক্ত লাগছে তার কাছে। যাকে এত ভালোবাসলো সেও তার ভালোবাসাটা বুঝলো না। আবার তার বাবার নামে আলিহান এতগুলা কথা বলল অথচ তার বাবার কোন প্রতিবাদ কেন করলো না। কিছু ভালো লাগছে না। রুমে গিয়ে সোজা চলে যায় ওয়াশরুমে। শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে বসে থাকে কিছুক্ষণ।

বাড়ি ফিরে ড্রয়িংরুমের সব কিছু ভাংচুর করতে থাকে রাহির মা আফিয়া আহমেদ। সৈয়দ নওশাদ সুফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে তা দেখে নিলে কিছুক্ষণ। হুটহাট রেগে যাওয়া, জিনিসপাতি ভাংচুর করা এটা নতুন কিছু না। আফিয়া আহমেদ এমনটা প্রায়ই করে থাকেন। তাই সৈয়দ নওশাদ বসে বসে নিরব দর্শকের মতো দেখে নিলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু যখন দেখলেন ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে আফিয়া আহমেদের রাগ কমার পরিবর্তে বেড়ে চলেছে তখন সৈয়দ নওশাদ উঠে তার কাছে গেলেন এবং তাকে থামানোর চেষ্টা করলেন। আফিয়া আহমেদ তাকে উপেক্ষা করে সব কিছু ভাংচুর করতে ব্যাস্ত আর সৈয়দ নওশাদ ব্যাস্ত তার স্ত্রীকে আটকাতে। এভাবেই চলে কিছুক্ষণ তারপর আফিয়া আহমেদ সৈয়দ নওশাদের শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁত চেপে বলে,

– কবে থেকে চলছে এসব! কেন ঠকাচ্ছো তুমি আমাকে?

– আফিয়া, তুমি শান্ত হোও। পরে তোমার সব কথা শুনবো।

আফিয়া আহমেদ সৈয়দ নওশাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় অতঃপর বলে,

– আগে বলো তুমি কেন আমাকে ঠকালে। এতই যদি বউ আর মেয়ের উপর দরদ তোমার তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলে।

– কিসব বলছো তুমি আফিয়া। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি!

– হ্যাঁ ঠকাচ্ছো, তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো নওশাদ। তুমি অস্বীকার করতে পারবে মেহের তোমার মেয়ে নয়। তুমি পিতার অধীকারে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াও নি।

আফিয়া আহমেদের কথা শুনে থেমে যায় সৈয়দ নওশাদ। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বলেন,

– হ্যাঁ গিয়েছিলাম আমি মেহেরের কাছে। গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এর সাথে তোমাকে ঠাকানোর কথা আসছে কোথা থেকে। মেহের আমার মেয়ে এটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নাই আমার।

– আর রাহি,,,

– রাহিও আমার মেয়ে। আমি ওদের দুজনকেই ভালোবাসি। ওদের দুজনের শরীরে আমার রক্ত বইছে এই সত্যিটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নাই আমার। তুমি প্লিজ এসবের মাঝে মেহেরকে টেনো না। মেহের তো আমাকে বাবা হিসাবে মানে না। ও ঘৃনা করে আমাকে। ওর চোখে আমার জন্যে ঘৃনা বয় আর কিছুই দেখতে পাই না আমি। কথাগুলা বলে বড় করে স্বাস ত্যাগ করলেন সৈয়দ নওশাদ। আফিয়া আহমেদ সৈয়দ নওশাদ কলার চেপে বলে উঠেন,

– তুমি এমটা করতে পারো না নওশাদ। তোমার শুধু একটাই মেয়ে। তুমিই তো বলেছিলে তোমার প্রথম স্ত্রী আর তার সন্তান কোন দিনও আমাদের জিবনে আসবে না তাহলে আজ কেন মেহেরের জন্যে তোমার এত দরদ।

– কারন মেহের আমার প্রথম সন্তান। আফিয়া আহমেদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হনহন করে উপরে তার রুমে চলে যান সৈয়দ নওশাদ। আফিয়া সুফায় লাথি মেরে বলে,

– এটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। মেহেরের ছায়াও তোমার জিবনে থাকবে না। আমি আজ অব্ধি যা চেয়েছি সব পেয়েছি। শুধু একজনকেই পাইনি। ভালোবাসা হাড়ানোর কষ্ট আমি জানি। আমি আমার মেয়েকে সেই কষ্ট কিছুতেই পেতে দিবো না। পৈশাচিক হাসি হাসে আফিয়া আহমেদ।

পানির বোতল খামচে ধরে দু-পা পিছিয়ে যায় রাহি। চোখ থেকে তার অঝড়ে অশ্রু ঝড়ছে। মেহের তার বোন। এতদিন যাকে শত্রু ভেবে এসেছে আজ জানতে পারলো সেই তার বোন। বড় বোন। পানি নিতে নিচে আসছিলো সে আর তখন বাবা মায়ের কথোপকথন শুনে দাঁড়িয়ে যা রাহি। বোতলাটা ফেলে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায় সে।

২৯,
পরেরদিন কলেজে যখন মেহেরে সাথে দেখা হয় রাহির তখন সে মৃদু হেসে মেহেরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ মুখে তার খুশির ঝলক রেখে স্থির দৃষ্টি স্থাপন করে মেহেরের মুখের দিকে। অধোরে তার হাসি ঝুলানোই থাকে। রাহির এমন আচরন দেখে মেহের অবাক চোখে তার দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে উঠে,

– এই মেয়েকে কি জ্বিনে ভর করলো নাকি। এই মেয়ে ঠিক আছো তুমি।

মেহেরে প্রশ্নের কোন জবাব দেয়না রাহি। আকস্মিক ওকে জড়িয়ে ধরে। রাহির এমন কান্ডে মেহের এতটাই অবাক যে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। রাহি নিজেই মেহেরে ছেড়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে ভুবনবুলানো হাসি দিয়ে বলে,

– আই এম সরি আপু। রাহির মুখে আপু ডাক শুনে মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে ফেলে। রাহি আবার বলে উঠে, আসলে আমি তো আমার ছোট বোনের মতোই তাই না। এবার মেহের তার হাত শক্ত মুঠি করে নেয়। অতঃপর রাহি বলে, আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ আচরন করেছি আমাকে কি মাফ করে দেওয়া যায় না। ছোট বোন মনে করে আমাকে ক্ষমা করে দিবে প্লিজ।

– তোমার উপর আমার কোন রাহ নেই রাহি। তবে হ্যাঁ তুমি আমাকে আপু ডেকো না। আমার কোন ছোট বোন নেই। আমার একটাই বোন, মৌ। বলেই উলটোদিক হাটা শুরু করে মেহের। রাহির স্মিত হাসে। মনে মনে সে বলে উঠে,

– যতই তুমি অস্বীকার করো আপু, একদিক ঠিক তুমি আমাকে ছোট বোন বলে মেনে নিবে।

সেদিনের পর কেটে যায় এক সপ্তাহ । সামনে মেহেরের একটা ডিবেট প্রতিযোগী রয়েছে। সেটা নিয়েই এখন ব্যাস্ত সে। তারউপর একটা বই লেখছে। এবারের বই মেলাতে তার প্রথম বই বের হবে। এক সপ্তাহ রাহির সাথে দেখা হয়নি তার। রাহনাফের সাথে দু এককবার হয়েছিলো কিন্তু সেটাও ক্ষণিকের জন্যে। রাহনাফ তার জাপান যাওয়া ক্যান্সেল করে দিয়েছে গত কাল। সৈয়দ নওশাদের মানসিকতার উপর ঘৃনা ধরে গেছে তার। এক সময় যাকে নিজের বাবার জায়গায় বসিয়েছিলো তার তার উপরই ঘৃনা জমে গেছে তার। একটা মানুষের মন কতটা নিচু করে সে গায়ের রং বিচার করে। বাহিরের সুন্দরর্য তো লোক দেখানো। আসল সুন্দর তো সে যার মনটা সুন্দর। আফিয়া আহমেদ মেহেরকে অনেক শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনটাই কাজ দিচ্ছে না তার। এই তো সেদিন, অনেক মানুষের ভীরে মেহেরের জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তু্লেছিলেন তিনি। সেখানে মেহের মাথা উচু করে বলে এসেছে, আমার মা সিঙ্গেল মাদার। অনেকে এসব নিয়ে হাসাহাসি করলেও মেহের সেদিকে পাত্তা দেয়না। হাসুক না এদের কাজই তো পরের পরচর্চা করা। এখানে হাসবে সেখানে গিবত করবে। এটাই তো আমাদের সমাজ। সমস্যাটা সমাজের নয়, সমস্যাটি হচ্ছে আমাদের দেশের। কারন এদেশে সিঙ্গেল বাবা মায়ের প্রচলন নেই। খুব করে দরকার সিঙ্গেল বাবা মা শব্দের প্রচলনের। মানুষ ঘর ভাঙ্গার কাহিনীটা জানে না কিন্তু খোচা মেরে কথা বলতে পারে। পরিবার ভাঙ্গা সংসার ভাঙ্গা বাবা মায়ের বিচ্ছেদ একটা সন্তানের উপর কতটা প্রভাব ফেলে সেটা যদি বাবা মা রা বুঝতো তাহলে তারা অনেক কিছুই ত্যাগ করতে পারতো। আমি খুব করে চাই আমাদের দেশের সিঙ্গেল বাবা মায়ের প্রচলন আসুক। আমরা মাথা উচু করে বাঁচি। সন্তানের একটা উজ্জল ভবিষ্যৎ হোক। সিঙ্গেল বাবা মায়ের প্রচলন আসলে হয়তো পথ শিশুর সংখ্যাও কমে আসবে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here