মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৩০

0
1953

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩০]

রাহির চিৎকার শুনে সৈয়দ নওশাদ ও আফিয়া আহমেদ দুইজনেই উপরের দিকে তাকায়। উপরের তাকাতেই দুজনে বেশ অবাক হয়ে যায়। কেননা সেখানে রাহি অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে আফিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে। সৈয়দ নওশাদ ও আফিয়া আহমেদের কপালে ভাজ পরে যায়। রাহি কি সব শুনে নিয়েছে তাহলে! কি হবে এখন। ভাবছে সৈয়দ নওশাদ। আফিয়া আহমেদের চোখ কিছুটা সংকোচিত হয়ে যায়। সে ভীতু চোখে রাহির দিকে তাকায়। ধীর পায়ে রাহি নীচে নেমে আসে। পায়ের সাথে পা লেগে নিচে পরে যেতে নেয় রাহি। সৈয়দ নওশাদ তাকে ধরতে গেলে সে হাত উঠিয়ে তাকে আটকে দেয়। আর বলে,

– আমি নিজেকে সামলাতে জানি সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। রাহির শক্ত কণ্ঠস্বর।

রাহির মুখে এমন কথাশুনে অবাক হয়ে নিঃপলক ওর দিকে তাকিয়ে থাকে সৈয়দ নওশাদ। এর আগে কোন দিনও রাহি তার নাম ধরে ডাকে। সৈয়দ নওশাদ রাহিকে কিছু বলবে তার আগেই সে তাকে পাশ কাটিয়ে আফিয়া আহমেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আফিয়া আহমেদ করুন চোখে তাকিয়ে আছে রাহির মুখ পানে। অতঃপর রাহি বলে উঠে,

– এটা তুমি কেন করলে মা। আমি- কি তোমাকে একবারও বলেছি রাহনাফ কে আমার চাই। রাহনাফকে এনে দাও। তাহলে এমনটা কেন করলে তুমি মা। আজ যদি আপুর কিছু হয়ে যেত তাহলে! তাহলে কি হতো তার মা আর বোনের সেটা একবারও ভেবে দেখেছো। মাহবুবা আন্টির কথা ভেবেছো ুএকবার। আপু ছাড়া তার আর কে আছে! মা, তুমি কাজটা ঠিক করোনি। তার থেকে তুমি আমায় মেরে ফেলতে। কারন ওদের দুজনের মাঝে আমি এসেছি। তোমাকে মা বলে ডাকতে ঘৃনা হচ্ছে আমার। কান্নামিশ্রত কন্ঠ রাহির।

– রাহি,,, ধমকের সুরে বলে আফিয়া আহমেদ। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছো তুমি। মুখ সামলে কথা বলো। ভুলে যেওনা আমি তোমার মা।

– আমি ভুলি নি তুমি আমার মা, তাইতো এখনো ভালো ভাবে কথা বলছি। আর যদি ভুলতে পারতাম তাহলে সবচেয়ে বেশী খুশি হতাম আমি। একটা খুনি কখনো আমার মা হতে পারে না।

রাহির মুখে খুনি শব্দটা শুনে কেপে উঠে আফিয়া আহমেদ। প্রতিধ্বনির ন্যায় বারবার শব্দটা তার কানের কাছে বাজতে থাকে। ধপ করে সুফায় বসে পরে সে। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বসে। কানের কাছে তখন শুধু একটা কথাই বাজতে থাকে “একটা খুনি কখনো আমার বোন হতে পারে না ” বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। নাহ, বিকট শব্দ করে চিৎকার করে উঠে আফিয়া আহমেদ। উঠে দাঁঠিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

– আমি খুনি নই। আমি এমনটা করতে চাইনি। খুনি নই আমি। তারপর দৌড়ে সে উপরে চলে যায়। রাহির তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখ-মুখে ঘৃনা উপচে পড়ছে। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সে। অতঃপর বলে,

– ঘৃনা করি তোমাদের। তোমাদের সবাইকে ঘৃনা করি আমি। জানো মা আমার এখন খুব আফসোস হয় কেন মাহবুবা আন্টি আমায় পেটে ধরে নি। তাহলে তো তোমার মতো খুনিকে মা বলে ডাকতে হতো না।

রাহির বলা কথাগুলো শুনছিলো সৈয়দ নওশাদ। সে রাহির কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সৈয়দ নওশাদ। মাহবুবাকে মা হিসাবে চায় রাহি এটাও তার শুনতে হচ্ছে। রাহি চলে যাওয়ার জন্যে সামনের দিকে এক পা বাড়াতেই পিছন থেকে সৈয়দ নওশাদ তাকে ডেকে উঠে,

– রাহি,,

থমকে দাঁড়ায় রাহি। পিছনের দিকে ঘুরে সৈয়দ নওশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলে,

– কিছু বলবেন আপনি?

– এভাবে কথা বলছিস কেন মা?

রাহি তার ডান হাতটা উচু করে বলে,,

– চুপ করুন আপনি। আপনি কারো বাবা হতে পারেন না। যে নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে পারে না। তাকে নিজের পরিচয়ে বড় করতে পারে না। সে আবার বাবা হয় কি করে। কি ভুল ছিলো মেহের আপুর। কান্নামিশ্রত কন্ঠে প্রশ্ন করে রাহি। সৈয়দ নওশাদ অবলার মতো তাকিয়ে থাকে রাহির দিকে। রাহি তো কিছু ভুল বলছে না। সত্যিই তো মেহেরের তো কোন ভুল ছিলো না। তবুও তাকে কেন আমি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হলো। সৈয়দ নওশাদের ভাবনার মাঝেই রাহি বলে উঠে,

– আজ আপুর সাথে সেটা হয়েছে সেটার জন্যে আপনি দায়ী। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভাবে আপনিই দায়ী।সুন্দরী বউয়ের মোহে পরে অন্ধ হয়ে গেছেন আপনি সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। আপনি জানেন আপনার বউ আমার আপুকে মেরে ফেলতে চেয়েছে তবুও আপনি তাকে বিরুদ্ধে কোন একশন নেন নি। একজন বাবা হয়ে এমনটা কি করে করতে পারেন আপনি। আসলে আপনি কারো বাবা হতে পারেন না। কারো বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই আপনার সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। না ভালো বাবা হতে পরেছেন আর না হতে পরেছেন ভালো সন্তান। বউয়ের কথা শুনে নিজের মা-কে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছেন। এমনটা করবেন না। এখনো সময় আছে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিন। কথাগুলো বলা শেষে রাহির চোখের কোটর গড়িয়ে অশ্রু বের হয়। তবুও সে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে সৈয়দ নওশাদের দিকে। একদিন এই মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতো। আর আজ তাকে শুধু ঘৃনা করতে ইচ্ছে করছে। বাবা হিসাবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে রাহির।

সৈয়দ নওশাদ নির্বিকায় রাহির মুখ পানে তাকিয়ে আছেন। রাহির বলা প্রতিটা কথাই ঠিক। সে ভালো বাবা হতে পারেনি। বাবা না থাকার কারনে আজও মেহেরকে নানা কথা শুনতে হয়। মেহেরের কোন দায়িত্বই সে নেয়নি। মেহের যে তার সন্তান সেটা সমাজ সমাজের মানুষ তারা কেউও জানেনা বললেই চলে। কিন্তু সে তো মেহেরকে জন্ম দিয়েছে। তাহলে সে কোথায় বাবা হতে পেরেছে। রাহুর দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে।

৪০,
মেহের ঘুমাচ্ছে আর ওর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে ঝিমুচ্ছে রাহনাফ। মেহের কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে তখন রাহনাফ ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথায় জাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারপর সে ঘুমন্ত মেহেরের মুখপানে কিছুক্ষণ অবলোকন করে কপালে নিয়ে ওষ্ঠদ্বয়ের শীতল স্পর্শ দিয়ে দেয়। রাহনাফ মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠে,

-যত দেখি তোমায় তত লাগে ভালো,কি এমন মায়া তোমার মাঝে বল? আমিতো চাইনি প্রেমের জালে জড়াবো কভু,তোমার ভালোবাসায় মজনু হলাম তবু।মন আমার নিজের ঠিকই, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আর আমার হাতে নেই,তোমার সৌন্দর্যের সম্মোহনী শক্তির বলে,
আষ্টেপৃষ্টে আমায় জড়ালে!দু চোখ শুধু তোমায় খুঁজে, মন চায় তোমায় পেতে, শুধু এ জীবনে নয়, মরণের পরেও চাই তোমায়।

ঝিমুতে ঝিমুতে পরে যেতে নেয় রাহনাফ তখনি সে চমকে উঠে। আশপাশ একপলক তাকিয়ে আবারও সামনে তাকায় সে। মেহের এখনো গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। রাহনাফের এক হাত জড়িয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। নাকটা হালকা ফুলিয়ে কি সুন্দর করে শ্বাস নিচ্ছে মেহের। ঘুমন্ত মেহেরকে আজ একটু বেশীই আকর্ষণীয় লাগছে। ইচ্ছে করছে মেহেরের অধোরের নিচে থাকা ওই বাদামি তিলটাতে অধোর ছুঁইয়ে দিতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও তো সে সম্ভব নয়। সে নিজের চোখটা নামিয়ে নিচের দিকে নিক্ষেপ করলো।

সেদিনের পর আজ প্রায় সপ্তাহ খনেক কেটে গেছে। রাহি নিজেকে তার ঘরে বন্ধি করে রেখেছে। বাসা থেকে বের হচ্ছে না সে। এমনকি মেহেরকে দেখতেও পর্যন্ত আসেনি। দুদিন আগে মেহেরকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। রাহনাফ রোজ বিকালে মেহেরকে দেখতে আসে। সৈয়দা মাহবুবার রাহনাফকে খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি মনে মনে এমন একটা ছেলেকেই তো চেয়েছেন মেহেরের জন্যে।যে মেহেরকে ভালোবাসবে যত্ন নিবে ভরসা হয়ে ওর পাশে থাকবে। রাহনাফকে দেখে তার মনে হয়ে এটাই যেন মেহেরের জন্যে যোগ্য পাত্র। তিনি মনেমনে ঠিক করে ফেলেছেন মেহেরের বিয়েটা রাহনাফের সাথেই দিবেন।

রাহির মেহেরদের বাড়িতে আসছে না দেখে বেশ অবাক হচ্ছে মেহের সহ পরিবারের বাকি সবাই। সৈয়দা মাহবুবা তো আজ সকালে বলেই ফেলছেন, রাহি কেন আসছে না তার খোজ নিতে। মেয়েটার শরীর ঠিক আছে। মায়ের কথা শুনে মৃদু হাসে মেহের। মনে মনে বলে,

– তুমিও না মা পারোও বটে। রাহিকি আর রোজ আমাদের এখানে আসবে। অট্টোলিকার মানুষ ও। বিলাসিতায় বড় হয়েছে। ওর মন যখন যা বলে তাই করে।ও কি আর আমাদের সাথে এই চিলেকোঠায় মিশতে পারে। আবেগের বসে দুদিন এসেছে এটাই অনেক।

রাহিকে কয়েকবার কল করে আলিহান। প্রতিবারই ওর মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে তাই বাধ্যে হয়ে নিজের জেদ ভেঙে ওদের বাড়িতে পা রাখে সে। নিজের জন্যে না হলেও রাহির জন্যে আবার সৈয়দ আহমেদ বাড়ির দরজায় পা রাখে আলিহান।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here