মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৪৩

0
1965

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৩]

আরওয়ান শিকদারকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয় আফিয়া আহমেদকে। পুলিশ যখন আফিয়া আহমেদকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন সৈয়দ নওশাদ আহমেদ নিঃপলক তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। এতদিন যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে, চোখ বন্ধ করে যাকে ভরসা করেছে, যাকে ভালোবেসে নিজের বিবাহিত স্ত্রী ওর অনাগত সন্তানের কথা না ভেবে তাকে ঘরে তুলেছে। নিজের স্ত্রীর সম্মান দিয়ে ঘরে তুলেছে। শুধু মাত্র আফিয়ার কথা ভেবে নিজের সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানের কথা একবারও মাথায় আনে নি, সে একজন খুনি। আফিয়া আহমেদ একজন খুনি ভাবতেই সৈয়দ নওশাদের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠছে। ডক্টর বলেছে সৈয়দ নওশাদ যেন কোন কিছু নিয়ে চেনশন না করে তাহলে তার ব্রেন স্টোক করার সম্ভবনা আছে। আর এতে তিনি মারাও যেতে পারেন। এমতাবস্থায় সৈয়দ নওশাদের টেনশন না করার কোন উপায় আছে বলে আমার মনে হয়না। তিনি যতবার আফিয়া আহমেদ কথা ভাবছেন ততবারই তার চোখের সামনে সৈয়দা মাহবুবার অশ্রুসিক্ত নয়ন ভেসে উঠছে। অস্থির হয়ে উঠছেন সৈয়দ নওশাদ।

ড্রয়িংরুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে রাহি। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। আফিয়া আহমেদ যতই অপরাধ করুক না কেন! দিন শেষে সে রাহির মা। অধোর কামড়ে হাত দুটি শক্ত মুঠি করে নেয় রাহি। মনে পড়ে আফিয়ার আহমেদের স্নেহের কথা। এক মাত্র মেয়ে বলে তাকে কতটা স্নেহ করেছে, আদর ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলো তাকে। আর আজ সেই মা-কে রাহি নিজে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। রাহির থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে রেদওয়ান। মূলত রেদওয়ান আফিয়া আহমেদের সব কৃর্তির কথা জানে। রাহি তার সাহায্য নিয়েই এসব করেছে। রেদওয়ান গিয়ে রাহির পাশে দাঁড়িয়ে ওর মুখপানে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রাহির দৃষ্টি এখনো মেই। ডোরের দিকে। যেখানে সে শেষবার আফিয়া আহমেদকে দেখেছিল। রেদওয়ান অধোর কামড়িয়ে দু হাতের তালু ঘষে নেয়। অতঃপর বলে,

– আমি আসছি রাহি। নিজের খেয়াল রেখ।

রাহি তার দৃষ্টি নামিয়ে সেটা রেদওয়ানের দিকে নিক্ষেপ
করে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে রেদওয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে কিছু না বললেও মন বলছে ুত তাড়া কিসের! থেকে যাওনা আর কিছুক্ষণ। রাহির এমন চাহনি দেখে রেদওয়ানের ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্চে। সে কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে সেখান থেকে চলে আসার জন্যে পা বাড়ালে রাহির দাদি এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– এখন কোথায় যাচ্ছো তুমি। এখন তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। রাহিকে নিয়ে গল্প করো ওর মনটা ভালো নেই।

দাদির কথা শুনে রেদওয়ান কপালে দুটো মাত্র ভাজ ফেলে রাহির দিকে তাকায়। রাহি এখনো সে আগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেদওয়ানের দিকে। রেদওয়ান রাহির মুখের দিকে মৃদু সূরে বলে উঠে,

– আমি তো চাই সবসময় রাহির পাশে থাকে কিন্তু সে পথটা যে রাহি বন্ধ করে দিয়েছে। দাদি তুমি একটু ওকে বুঝাও না। কেন সে চলে যাচ্ছে?

রেদওয়ানের কথা শুনে রাহি একটু অবাক হয়। তার চোখ মুখে বিস্ময়ের ছাপ।

-চলে যাচ্ছে মানে! কোথায় চলে যাচ্ছে রাহি?

দাদির করা প্রশ্নে হালকা টনক নরে রাহির। সে দাদির দিকে তাকিয়ে তাকে কিছুক্ষণ তার দৌড়ে সোজা উপরে চলে যায়। রেদওয়ান নিঃপলক তাকিয়ে তাকে রাহির চলে যাওয়ার দিকে। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে রাহি কাঁদছে। চক্ষুদ্বয় কিছু সময়ের জন্যে বন্ধ করে নিল রেদওয়ান। না রাহির এই চাপা কস্ট সে আর নিতে পারছে না। যে করেই হোক রাহির মান ভাঙাতে হবে। তাকে এক সুন্দর হাসি খুশি প্রাণবন্ত জিবন উপরহার দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাহি কি মেনে নিবে রেদওয়ানের কথা।

দাদির করা প্রশ্নে রেদওয়ানের ভাবনার ছেদ ঘটে,

– কোথায় যাচ্ছে রাহি?

রেদওয়ান নিভু নিভু কন্ঠে বলে,

– নেক্সট ওইকে রাহি সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছে। অভিমানে সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্চে।

তারপর রেদওয়ান চলে যায় রাহির পিছু। রাহির দাদি সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। তার কানে প্রতিধ্বনির ন্যায় এখনো রেদওয়ানের বলা কথাটা বেজে যাচ্চে।

৫৩,
এলমাদের বাড়ি যেতে যে মুদির দোকানটা সামনে পরে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। তার পাশের কয়েকজন মাধ্যবয়স্ক লোক বসে বসে তাস খেলছে আর একে অপরের সাথে কথা বলছে। তারা তাস খেলার পাশাপাশি রাজ্যের যত খবর আছে সেটা নিয়ে আলোচনা করে। সৈয়দা মাহবুবা দোকানটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তখনি তিনি তাদের মধ্যে একজনের মুখে শুনতে পান, আফিয়া আহমেদের গ্রেফতার হওয়ার কথা। কথাটা শুনে সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে যান সৈয়দা মাহবুবা। তিনি একবার ভাবলেন, তাদের জিগ্যেস করবে, কেন আফিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ! পরক্ষণে মনে পরে, যা হওয়ার হোক তাতে তার কি আসে যায়। তাছাড়া তার সাথে তো সৈয়দ পরিবারের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। সৈয়দা মাহবুবা নিজে সৈয়দ নওশাদ তার এই মিথ্যে সম্পর্কের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাকে তার সুন্দরী বউ আর তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে বিলিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এটাই চেয়েছিল সৈয়দ নওশাদ। লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে দোকানে গিয়ে কিছু পিঁয়াজু কিনে নেয় রাহির জন্যে। তারপর সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, সুন্দরী রুপরবী গুণবতী সে কেন আজ পুলিশ হেফাজতে।

বাড়িতে এসে মেহেরকে আফিয়ার গ্রেফতার হওয়ার কথা বলেন সৈয়দা মাহবুবা। আফিয়ার গ্রেফতার হওয়াতে মেহের একটু কষ্ট পায় তার কারন রাহি। কিছুূদিন আগে তার বাবা অসুস্থ হয়েছিলো আর এখন মা পুলিশ হেফাজতে। যে মেয়েটা ছোট থেকে সবার আদরে আদরে বড় হয়েছে সে এই কষ্ট কি করে সহ্য করবে কি করে। রাহি তো এখন ওদের বাসায় ও আসে না। রাহির জন্যে খুব খারাপ লাগছে মেহেরের। তাছাড়া আফিয়া আহমেদ কেন গ্রেফতার হলো সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে মেহেরের। তাকে দেখে তো ভালোই মনে হয় তাহলে গ্রেফতার হওয়ার কারনটা কি? মেহের কল করে আলিহানকে। আলিহান কিছু জানালেও জানতে পারে। আলিহান আর রাহির তো গলায় গলায় ভাব। আলিহানের কথা মতে সে এই ব্যাপার কিছুই জানে না। মন খারাপ হয়ে যায় মেহেরের। বড্ড ইচ্ছে করছে রাহিকে বুকে টেনে নিতে। তাকে আপন করে নিয়ে বড় বোনের ভালোবাসায় আগলে রাখতে। বড় বোনরা নাকি মায়ের মতো হয়। মেহেরেরও ইচ্ছে করছে রাহিকে তার কাছে এনে রাখতে।

সেদিন বিকালে আলিহান বাসায় ফিরার আগে আগে আহমেদ ভিলায় যায়। সৈয়দ নওশাদের সাথে কিছুক্ষণ বিজনেস সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। তবে আফিয়ার কথা জিগ্যেস করে না। আফিয়ার গ্রেফতার হওয়া নিয়ে এমনিতেই আর মানুষিক অবস্থা খারাপ তাই আলিহানও চায়নি তাকে আরো পেশার দিতে। তাই সে রাহির সাথে কথা বলার জন্যে রাহির রুমে যায়। আলিহান যখন রাহির রুমে যায় তখন রাহি তার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। আলিহান রাহিকে রুমে না পেয়ে সোজা তার বেলকনিতে চলে যায়। মন খারাপের বেশীর ভাগ সময় সে বেলকনিতেই কাটায়। ছোট বেলায় রাহি বেলকনিতে বরফ দিয়ে খেলা করতো এটা নিয়ে প্রায়ই আলিহান আর রাহির মাঝে ঝগড়া হতো। আলিহান গিয়ে রাহির পাশে দাঁড়াতেই রাহি আলিহানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। আলিহান ও তার ছোট্ট বোনটাকে দু-হাতে আগলে নিয়ে মাথাা হাত বুলাতে থাকে। সেদিন রাতে রাহির বায়না মেটাতে আলিহান তাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।

রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই, গভীর নিদ্রায় শায়িত মেহের। স্বপ্নযোগে মনে হলো কেউ তাকে গভীর ভাবে নিরক্ষণ করছে। কারো উত্তাপ শ্বাস পড়ছে মেহেরের মুখের উপর। গভীর নিদ্রায় আছন্না থাকায় চোখ মেলে তাকানো হলো না তার। কিছুক্ষণ পর মনে হল সে হাওয়াতে ভাসছে। এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় তার মনে জুড়ে। জোড় কদমে আখি খোলে সে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অস্পষ্ট এক এক ছায়ামূর্তি। যার ছায়াটাও তার চেনা। বড্ড চেনা। অস্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে চাইলে ছায়ামূর্তি তাকে থামিয়ে দেয়। মেহেরও মাথা নাড়িয়ে ভদ্র মেয়ের মতো চুপ হয়ে যায়। তারপর ছায়ামূর্তি তাকে নিয়ে চলে যায় ছাদে।

ছাদে রং বেরঙ্গের লাইটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় মেহের। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদকে থাকা লাইটিং দেখছে সে। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে বুকের উপর হাত গুজে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহনাফ। অধোরে তার মুগ্ধকর হাসি। মেহের রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,

– এসব কে করেছে ;আপনি! অধোরে তার স্মিত হাসি।

মাথা চুলকিয়ে স্মিত হাসে রাহনাফ। মেহেরের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

– চোখ বন্ধ করো লেখিকা সাহেবা?

মেহের প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায় রাহনাফের দিকে। রাহনাফের স্থির দৃষ্টি মেহেরের মুখ পানে। মেহের রাহনাফের দৃষ্টির দেখেই তার চোখদুটো আবেশে বন্ধ করে নেয়। তারপর রাহনাফ দু-হাতে আলতো করে মেহের চোখ ধরে ওকে নিয়ে যায় ছাদের অন্যপান্তে। সেখানে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মেহেরের চোখ খুলে দেয়। চোখ মেলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায়, দূর ওই আকাশে একটা বাজি ফুটে আর তাতে স্পষ্ট লেখা,

– হ্যাপি বার্থডে লেখিকা সাহেবা।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here