#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৪]
বিস্ময় দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। এর আগে কেউ কোনদিন মেহেরকে এভাবে সারপ্রাইজ দেয়নি। আনন্দে মেহেরের চোখে অশ্রু নেমে আসে। ডান হাতে চোখের কোন থেকে পানি মুছে অধোরে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,
– বিশ্বাস করেন রাহনাফ, আজ আমি এতটাই খুশি হয়েছি যে এর আগে কোন দিনও এত খুশি হয়নি। সত্যি বলছি, সারপ্রাইজটা দারুন ছিলো। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ। জিহ্বাহ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরে মেহের।
রাহনাফ মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কিছুক্ষণ তারপর ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। বুকের উপর হাত গুজে গিয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে হাসে অতঃপর বলে,
– শুধু থ্যাংক্স দিলে হবে না লেখিকা সাহেবা। আমার তো অন্য কিছু চাই।
রাহনাফের কথা শুনে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলে মেহের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বলে,
– আপনার আবার কি চাই!
বুকের উপর থেকে হাত নামিয়ে ডান হাতটা গালে রেখে ভাবুক ভঙ্গিতে অবস্থান করে কিছুক্ষণ তারপর মেহেরকে কাছে টেনে নিয়ে ওর মুখের সামনে মুখ নেয়। রাহনাফ এতটা কাছে আসায় মেহেরের হার্ট দ্রুত বিট করতে থাকে। চোখ মুখ খিচে বন্ধকরে নিয়ে হাতে উড়না চেপে ধরে। মেহেরের এমন অবস্থা থেকে স্মিত হাসে রাহনাফ। অধোর কামড়ে বলে উঠে,
– আমি চাই তুমি আমাকে,,,
রাহনাফের কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই চট করে চোখ খুলে মেহের। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
– আমি কি?
– তুমি আমাকে,,
– কি? বলুন কি বলতে চান? অধোর কাঁপছে মেহেরের। এই দৃশ্য দেখে রাহনাফের তৃষ্ণা পায়। পচন্ড রকমের তৃষ্ণা। তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকে মেহেরের ঠোঁটের দিকে। নিচের ঠোঁটের নিচে অবস্থানরত তিলটা তাকে বড্ড আকর্ষন করছে। মন বলছে তাকে একটু ছুঁইয়ে দিতে। আর বিবেক বলছে, না রাহনাফ! এটা অন্যায়। নিজের বিবেকের কাছে হার মেনে নিজেকে কন্ট্রোল করার প্রচেষ্টায় চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে রাহনাফ। মেহের ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে আছে রাহনাফের মুখ পানে। কিছুক্ষণ পর মেহের আড়ষ্ট কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
– কি হলো রাহনাফ আপনি কিছু বলছেন না কেন? কি বলতে চান বলুন?
চোখ মেলে সামনে তাকায় রাহনাফ। মেহেরের চোখের দিকে তার দৃষ্টি স্থাপন করে বলে,
– আপনি ভাবটা কাটিয়ে তুমিতে চলে আসনা লেখিকা সাহেবা। তুমি যখন আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে তখন মনে হয় আমি তুমার অপরিচিত কেউ। আমি দূরের মানুষ, আমার সাথে কথা বলতে জড়তা বোধ করে তা তুমি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করো।
– কিন্তু,,
– কোন কিন্তু টিন্তু শুনতে চাচ্ছি না আমি লেখিকা সাহেবা। তুমি আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করবে ব্যাস। নাও স্টার্ট। বল।
– দেখুন রাহনাফ আপনি আমার বড়। আর আমি বড়দের সাথে আপনি আগ্গে করে কথা বলবো। অন্যদিক ঘুরে তাকায় মেহের। রাহনাফ বড় করে একটা শ্বাস ত্যগ করে কোমল কন্ঠে মেহেরকে ডাক দেয়,
– মেহু।
রাহনাফ এমন আফিম মেশানো ডাকটা যেন মেহেরের মনে একটা হীম শীতল শ্রোত ভয়ে যায়। অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করে সে। তুবও সে রাহনাফের দিকে না ফেলে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের কাঁধে হাত রেখে ওর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়, মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। তবে এই হাসিটা উয্য যেটা সবার চোখে পড়বে না। রাহনাফ মেহেরের চিবুক ধরে উপরের দিকে তাক করার। অতঃপর বলে,
– একটাবার আমার নাম ধরে ডাকো না লেখিকা সাহেবা।
মেহের ইনোসেন্ট মুখ করে রাহনাফের দিকে তাকালে রাহনাফ ওকে আবারো বলে। মেহের একরকম বাধ্যহয়েই বলতে থাকে,
– রা-রাহনাফ তু-তুমি আমাকে এভাবে জোর করতে পারো না।
-ব্যাস আর কিছু বলতে হবে না। রাহনাফ মেহেরের কপালে নিজের অধোর ছুঁইয়ে দিয়ে উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ একে দেয়। তারপর ওকে নিয়ে দুজনে মিলে এক সাথে কেক কাটে। প্রথমে রাহনাফ মেহেরকে খাইয়ে দেয় পরে মেহেরে রাহনাফকে খাইয়ে দেওয়ার নাম করে ওর পুরে মুখে কেক মাখিয়ে দেয়। তারপর রাহনাফ ছুটতে থাকে মেহেরের পিছু।
পরেরদিন মেহের বেশ মনোযোগ দিয়েই ক্লাস করছিলো, ক্লাসে ছিল নতুন টিচার্স, আহসান। আহসান আজ আর ক্লাসে আসার পরপরই মেহেরের দিকে একপলক তাকিয়ে তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তারপর আর সে মেহেরের দিকে তাকায় নি সে। যদিও মেহের আড় চোখে আহসানের দিকে তাকিয়েছিল আর ভাবছিলো এই নতুন টিচার্সটা এত তাড়াতাড়ি পাল্টি খেল কিভাবে। সামনে বই খুলে কলম কামড়িয়ে কাল রাতের কথা ভাবছে মেহের আর মিটমিট করে হাসছে। তখনি ক্লাসে একজন পিয়ন আসে আর সে এসেই বলে, “মেহের ক্লাসে আছে মেহের। মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে যায় মেহের। তখন সেই পিয়নটি বলে, ‘আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে ‘। এখানে কে আসবে মেহেরের সাথে দেখা করতে কিছুক্ষণ ভাবে মেহের। রাহনাফ নাকি আলিহান! কে এসেছে? আহসানের থেকে পারমিশন নিয়ে বেড়িয়ে যায় মেহের। পিয়ন আগে চলে আর মেহের তাকে অনুসরণ করে পিছনে যেতে থাকে। সেখানে যাওয়ার পর মেহের যাকে দেখে তাকে দেখার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। অর্ধবয়স্ক এক মহিলা বসে আছে। তার গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো। চোখে চসমা আর মাথায় আধাপাকা চুল। মেহের তার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে এখানে কি করছে, আর মেহেরকেই বা চিনে কি করে! বেশ কৌতুহল জাগে মেহেরের। কৌতুহল বশত সে ভুলেই গিয়েছে লোকটা তার অপরিচিত। মেহের বলে উঠে,
– আন্টি আপনি এখানে? কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দেয় মেহের।
অর্ধবয়স্ক মহিলাটা উঠে দাঁড়ায়। চসমাটা একটু নাড়িচে বলে, তুমি মেহর, মেহেরুন্নেছা মেহের ঠিক বললাম তো।
– জ্বি। আমিই মেহের।
– বাহ, ভারি মিষ্টি দেখতে তুমি। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আমার ছেলেটার পছন্দ আছে বলতে হবে।
এতক্ষণ মেহেরের মুখে একটা হাসি লেগে থাকলেও, এই অর্ধবয়স্ক মহিলাটির কথা শুনে মেহেরের মুখের হাসি উবে যায়। হ্যাঁ মেহের সুন্দর তাই বলে এত প্রশংসা করার কি আছে। শুধু গায়ে সাদা চামড়া দেখলে মনুষটা সুন্দর হবে! তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে হবে। এটা কেমন ধারনা। আসলে তো সেই মানুষটা সুন্দর যার মনটা সুন্দর। মুখ গোমড়া করে বলে,
– আপনার কথার মানে বুঝতে পারলাম না।
– আমি কি বলতে চাইছও সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো মেহের। প্রথম দেখাতেই তুমি যে ভাবে রিয়্যাক্ট করলে তার মানে তুমি আমাকে আগে থেকেই চিনো। রাহনাফ ছিনিয়েে! প্লিট মেহের বল, রাহনাফ কোথায়! আজ কটা বছর যাবৎ ওকে খুজে বেড়াচ্ছি আমি।
মেহের কি বলছে বুঝতে পারছে না। সে অর্ধবয়স্ক মহিলাটির আরে নিকটে চলে যায়। তারপর বলে,
– আপনি শান্ত হোন আন্টি আমি আপনাকে আপনার ছেলের কাছে পৌছে দিবো।
মেহেরের কথা শুনে সে চোখ তুলে মেহেরের দিলে তাকায়। তার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে। চোখের জলের যদি কোন রং থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যেত এটা আনন্দের অশ্রু। এতদিন পর ছেলেটাকে কাছে ফিরে পাওয়ার আনন্দের অশ্রু। মেহের তার দিকে নিঃপলক তাকিয়ে মনে মনে বলতে থাকে,
– হ্যাঁ আন্টি আমি আপনার আপনার ছেলের কাছে পৌঁছে দিবো। আপনি যেমন ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল তেমনি আপনার ছেলেটাও যে তার মা-কে কাছে পাওয়ার জন্যে মরিয়া।
৫৪,
আজ কলেজে না গিয়ে সোজা রেদওয়ানের বাসায় চলে যায় রাহি। অবশ্যই রেদওয়ান জোর করেছিল বলেই সে গিয়েছে। রেদওয়ানের ছোট বোনটা রাহিকে দেখতে চেয়েছে তাই সে রেদওয়ানের বাসায় যায়। আজ রেদওয়ানকে দেখেই বিব্রত হয় রাহি। কারন আজ ওর গায়ে ছিলো বাজ্রিলের জার্সি যেটার রংও হলুদ। রাহির মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে এই হলুদের মাঝে আপনি পেয়েছেনটা কি? হলুদ রং ছাড়া কি আর কোন কালার নেই! তাহলে কেন শুধু হলুদ কালারের ড্রেস পরিধান করেন আপনি। রাহি রেদওয়ানদের বাসায় গেলে রেদওয়ানের মা ও বোন দুজনে মিলে রাহিকে অনেক আপ্যায়ন করে। রেদওয়ানের বোন ওকে ওদের পুরো বাড়ি ঘুরে দেখায়। ছয়তলা বাড়িয়ে ওরা থাকে পাচ তলাতে বাকি সবগুলা ভাড়া দেওয়া। উপরের তলার তাকে ব্যাচেলর। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখার পর রাহি চলে বসে রেদওয়ার রুমে। রেদওয়ান তখন ওয়াশরুমে ছিলো। রাহি পুরো রুমটাতপ চোখ বুলায়। রেদওয়ানের রুম দেখে রাহির হার্ট এটাক করার মতো অবস্থা। সে মাথায় হাত রেখে বিছানায় বসে পরে। জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বেডশিট সব হলুদ রংয়ের। কয়েক মিনিট পর রেদওয়ান ওয়াশরুম থেকে বের হয় শুধু মাত্র একটা টাওজার পরে। রাহি তখনও মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলো তাই রেদওয়ার উন্মুক্ত শরীর সে দেখতে পায়নি। রেদওয়ান তাড়াতাড়ি করে কাবার্ড থেকে একটা হলুদ রংয়ের টিশার্ট পরে নেয়। তারপর রাহির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে,
– মাথা যন্ত্রনা করছে? আমি টিপে দিবো। আমি কিন্তু অনেক ভালো মাথা মেসেজ করতে পারি।
রেদওয়ানের কথা শুনে মাথা তুলে সামনে তাকায় রাহি। রেদওয়ানের দিকে তাকাতেই তার মেজাজ যায় বিগড়ে। সে কাটকাট গলায় বলে,
– এই যে মিস্টার হলুদ পঙ্খী, আপনার কি হলুদ কালার ছারা অন্য কোন কালারের ড্রেস নাই।
রাহির ডাক শুনে ফ্যালফ্যাল নয়নে সে তাকায় রাহির দিকে। রাহি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাবার্ডের কাছে চলে যায়, অন্য কালারের ড্রেসের জন্যে। সে কাবার্ড খুলে সেখানেও হতাশ। কারন কাবার্ডের ভিতরের থাকা সবগুলা ড্রেসই হলুদ রংয়ের।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।