মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৪৫

0
3017

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৫]

হলুদ পাঞ্জাবি পরে কেবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে রেদওয়ান। ওর সামনেই রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহি। রাহির ইচ্ছে করছে সামনে থাকা ছেলেটার গলা চেপে ধরতে। দাত কটমট করে হাত উঁচু করেও পরে সেটা নামিয়ে নেয়। রেদওয়ান কেবলার মতো দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। রাহির এমন রেগে যাওয়ার কারন সে বুঝতে পারছে না। রাহি তো হলুদ টিশার্ট পরতে বারণ করেছে তাইতো সে টিশার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরেছে তাহলে রাহি এখনো কেন রেগে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস টেনে একটু সাহস যোগিয়ে নিলো সে। দু কদম এগিয়ে রাহির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় রেদওয়ান অতঃপর বলে,

– আমি তো টিশার্ট খুলে ফেলেছি তাহলে আপনি রাগ কেন করছেন।

রেদওয়ানের করা প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে রাহি নাক ফুলিয়ে হাত উঁচু করে ওর গলা চেপে ধরতে নেয়। রেদওয়ান তখন একটু পিছনের দিকে ঝুকে যায়। রাহি, রাগ করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে রেদওয়ান বলে উঠে,

– আপনি থেকে যান না। নিজের মতো করে সবটা সাজিয়ে নিন।

থমকে দাঁড়ায় রাহি। পিছনের দিকে ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেদওয়ানের দিকে। রাহি কিছু বলতে যাবে তখনি রেদওয়ানের লেপটপে একটা মেইল আসে। দুইজনেই লেপটপের দিকে তাকায়। রেদওয়ান লেপটপের কাছে গিয়ে মেইলটা ভিউ করে নেয়। তখন রাহি গিয়ে দাঁড়ায় রেদওয়ানের পাশে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মেইল এসেছে। কিছুূদিন আগে রেদওয়ান বিভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছে এডমিশনের জন্যে। দেশের বাইরের কোন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স কম্প্লিট করতে চায় রেদওয়ান তাই সে এপ্লাই করে। মেইলটা দেখে সাথে সাথে ডিলিট করে দেয় রেদওয়ান। সে উঠে দাঁড়াতেই রাহি তাকে প্রশ্ন করে,

– আপনি মেইলটা ডিলিট কেন করলেন? এত বড় একটা ইউনিভার্সিটিতে চাঞ্চ পেয়েছেন আর সেটা হেলা করছেন।

রাহির চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে রেদওয়ান। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বলে,

– জয়েনিং ডেট দেখেছেন তো?

– হ্যাঁ। সাতদিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে।

– তাইতো ডিলিট করে দিলাম। আপনি তো আটদিন পর চলে যাবেন। আপনাকে দেখার জন্যে একটা দিনও আমি হাতছাড়া করতে চাইনা। এই আটটা দিন আমার নামে করে দিননা।

রেদওয়ানের এমন বেখেয়ালি কথা শুনে রাহি কি বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা এমন কেন? তার এমন খেয়ালিপনা আর ড্রেসকোট কোন কিছুই ভালো লাগে না রাহির। অথচ রাহনাফের সবকিছুই মনে ধরতো রাহির। আর রাহনাফ আর তারই বোনের সাথে প্রেম করেচে কিছুদিন পর তাদের বিয়ে। নিজেই নিজের কপালে হাত রাখে রাহি। ছিহ্, কিসব ভাবছে সে। রেদওয়ান দিকে কিছুক্ষণ শক্তচোখে তাকিয়ে থেকে সে প্রস্তান করে।

৫৫,
লেপটপে একটা প্রজেক্ট দেখছিলো রাহনাফ।(WAB) এর পাশেই একটা হসপিটাল তৈরী করতে চায় সে। Woman Association এর যে সকল নরীরা থাকবে তাদের সুচিকিৎসার জন্যে এই হসপিটাল নির্মাণ করতে চায় রাহনাফ। বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে লেপটপে হসপিটালের বিল্ডিং এর মডেলগুলোই দেখছে সে। তখনি তার বাসার কলিং বেল বেজে উঠে, লেপটপটা ওভাবে রেখেই উঠে যায় সে। ব্লাকহোলে তাকিয়ে আগন্তুক দেখে নেয় রাহনাফ। আগন্তুকদের দেখে থমকে যায় রাহনাফ। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দরজা খুলার কথা ভুলে গেছে সে। আবারও কলিং বেল বেজে উঠে। রাহনাফ কিছুক্ষণের জন্যে তার চোখ বন্ধকরে রেখে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে তারপর সে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে সামনে দাঁড়াতেই আগন্তুক এসে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরে। রাহনাফ স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা তুলে সামনে দাঁড়াতেই তার দৃষ্টি সংযোগ হয় মেহেরের সাথে। মেহের চোখের ইশারায় রাহনাফ স্বাভাবিক হতে বলে। রাহনাফ আগের ন্যায় দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে আগন্তুকের মাথায় হাত রাখে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসে মেহের।

বিছানার উপর বসে আছে রাহনাফের মা। আর রাহনাফ তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পাশেই বসে আছে মেহের। রাহনাফের মা রাহনাফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

– এত অভিমান তোর? আমার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিস তুই। কোথায় কোথায় খুঁজেছি তোকে। কেউ হাড়িয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু যদি কেউ ইচ্ছেকৃত ভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তাহলে তাকে ফিরে পাওয়া মুশকিল। কেন নিজেকে আড়াল করে রেখেছিস বাবা। ভাগ্যিস, মেহের তোর সাথে ছিলো। আশ্রমের লোকদের কাছে কতকরে তোর ঠিকানা চেয়েছি, কেউ বলতে পারেনি।

রাহনাফ তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কোন কথা বলছে না সে। আজ কতগুলো বছর পর সে তার মায়ের কোলে মাথা রেখেছে। পাশ থেকে মেহের বলে উঠে,

– আন্টি আপনি আমাকে চিনেন কি করে?

– তোমাকে কে না চিনে মেহের। মৃদু হাসে রাহনাফের মা। তোমার প্রতিভা আর যুক্তিগত কথার কাছে সমাজের প্রাচিন নিয়মও হার মেনেছে। সবাই তোমাকে এক নামে চিনে, মেহেরুন্নেছা মেহের। একজন একক মায়ের সন্তান। আশ্রমের বাচ্চাদের কাছেই জানতে পারি তোমার আর রাহনাফের রিলেশনের কথা।

মেহের আর রাহনাফের মা দুজনে কথা বলা বলছে আর এদিকে রাহনাফ তলিয়েছে গভীর ঘুমে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমালে নাকি প্রশান্তির ঘুম হয়। রাহনাফও সেই শান্তির ঘুৃম ঘুৃমাচ্ছে। মেহের কিংবা রাহনাফের মা কেউই রাহনাফকে ডাক দিলো না। রাহনাফের মা রাহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

____________________
এরপর কেটে যায় কয়েকটা দিন। রাহনাফের মা এখন রোজ রাহনাফের বাসায় আসে তাকে দেখতে। সেদিন রাহনাফের মা রাহনাফকে বলে, তাদের সাথে থাকতে। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রাহনাফের খুব করে বলতে ইচ্ছে করে, তোমার অন্য সন্তানদের ভীড়ে আমাকে সময় দিতে পারবে তুমি মা। তোমার সময় হবে মা এই সন্তানের জন্যে। না মা তুমি পরবে না সেটা। তুমি এখন অন্য কারোর মা। যদের ছোট থেকে আদরে আদরে এত বড় করে তুলেছো তুমি। তাছাড়া তোমার অন্য ছেলেমেয়ে গুলো তোমার ভাগ দিবে আমায়। আমি তো পারবো না মা। আমার সামনে সবাই যখন তোমাকে মা বলে ডাকবে! তুমি তাদের আদর করবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো না। আমি যে মা কাঙ্গাল। মায়ের স্নেহ ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে চাই না। তারচেয়ে ভালো তুমি তাদের সাথেই থাকো। মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে একটু আদর করে দিও।

মেহেরের সামনে এক্সাম। পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়েছে মেহের। রাহনাফ ও এখন তাকে আর বিরক্ত করে না। মেহেরের এক্সামের পরই ওদের বিয়ে হবে। আজ রাহির সিঙ্গাপুর যাওয়ার ফ্লাইট। এতদিন রেদওয়ান রাহির সাথে থাকলেও আজ আসে নি। এমনকি সে একবারের জন্যেও রাহিকে কল করেনি। রাহি বারংবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে রেদওয়ান কল করছে কি না। ইচ্ছে করছে রাহির নিজেরই কল করতে।
নিজের ব্যাগ পত্র ঘুছিয়ে সৈয়দ নওশাদ আহমেদের কাছে যায় বিদায় নিতে। মেয়ের এমন অভিমানে চলে যাওয়ার কারনে সৈয়দ নওশাদ শুধু চোখের জলই ফেলছে।রাহির চলে যাওয়ার কারনে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরক্ষ ভাবে যে সেও দায়ী। নিঃপলক রাহির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার জল চিকচিক করছে। ভাগ্য তাকে আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। নিজের ভালোবাসার মানুষগুলো তাকে ছেড়ে চলে যাচ্চে আর সে কিছুই বলতে পারছে না। দাদি রাহিকে আজও চলে যেতে বারণ করে। রাহি তার কথায় কান না দিয়ে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে রাহি। এই বুঝি রেদওয়ান আসবে। শেষ বারের মতো তাকে এক পলক দেখতে আসবে। এভাবে দেখতে দেখতে সে চলে যায় বিমানবন্দরে। সেখানে গিয়েও রাহি অপেক্ষা করে রেদওয়ানের জন্যে। কিন্তু রেদওয়ান আসে না।

৫৬,
মৌ-য়ের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় মেহেরের। সকাল সকাল মৌ-কে নিজের রুমে দেখে বেশ রাগ হয় মেহেরের। মেহের আধোশুয়া হয়ে বসে, ভ্রুদ্বয় কুঁচকে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– তুই সকাল সকাল আমার রুমে কি করছিস? তোর কিছু প্রয়োজন হলে আমায় ডাকতে পারতিস।

– এইটুকু হাটাচলা তো আমাকে করতেই হবে মেহু। সারাক্ষণ প্রতিবন্ধির মতো রুমে বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি। মুখ গোমড়া করে বলে মৌ।

– ভালো না লাগলেও আপনাকে থাকতে হবে বোইন। এখন বলেন সকাল সকাল আমার রুমে কি করছেন?

মৌ মেহেরের সামনে একটা খাম ধরে বলে,

– এই নে ধর, তোর নামে চিঠি আসছে।

মেহেরে খামটা হাতে নিয়ে সেটা এপিট ওপিট করে দেখতে থাকে। কারন এখনে কোন প্রেরকের নাম দেওয়া নেই। তাহলে প্রেরক কে! কে পাঠালো এই চিঠি।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here