#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৬]
আমার জিবনটা সিনেট্যিক্স হয়ে গেল না। না হলে কি আর আমি নিজেই নিজের মাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। আপু, জানি এই নামে ডাকার অধিকারটা তুমি আমায় দাওনি। তাই বলে তো আমাদের সম্পর্ক মিথ্যে নয়। তুমি না মানলেও আমি তোমারই ছোট বোন। আপু, প্রথম যখন তোমাকে আমি রাহনাফের সাথে দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমার প্রতি আমার ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। কেন জানো! রাহনাফকে আমি ভালোবাসতাম। আজও হয়তো বা! যাই হোক, পরে যখন জানতে পারি রাহনাফ ও তোমাকে ভালোবাসে তখন আমি সুই*সাইড করতে গিয়েছিলাম কারন রাহনাফকে ছাড়া আমার পক্ষে বেচে থাকা অসম্ভব ছিলো। সেদিন তুমি আমায় রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে দাও। তুমি না চাইতেও আমার জিবন বাঁচিয়েছ। জানো আপু, সেদিন হসপিটালে আমি একটা সত্যি জানতে পারি। যে সত্যিটা আমার পুরো জিবনটাই বদলে দেয়। আলিহান ভাই আর রাহনাফ আমাকে দেখতে যায় আমার কেবিনে। তখন বাবা আর আলিহান ভাইয়ের মাঝে কথা হয় তোমাকে নিয়ে। আমি সেদিন জানতে পারি তোমার কথা। তুমি আমার বোন! তোমার আর আন্টির সম্পর্কে যেদিন জেনেছি সেদিন থেকেই বাবার প্রতি ঘৃনা জন্মেছে আমার। যে বাবাকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতাম তার মেন্টালিটি এত নিচু ভাবতেই বুক কেপে উঠতো। চলে যাই রাহনাফের থেকে দূরে। তোমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো নি। আচ্ছা অন্যায় তো করেছে আমার বাবা, এখানে আমার দোষটা কোথায়! তারপর রইলো আমার মায়ের কথা!! বাবার অতীত জানার পর ভেবেছিলাম আমার মা অনেক ভালো। আমার সেই ধারণাটাও বদলে যায় তোমার ফাইনাল ডিবেটের দিন। যেদিন রাস্তায় তুমি ছুড়িঘাত হয়েছিলে। তোমাকে মারার জন্যে শহরের এক নামকরা কিলারকে সুপারি দিয়েছিল আমার মা। হ্যাঁ তোমার ওই অবস্থার জন্যে দায়ী আমার মা। সেদিন সব জানার পর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই। কিন্তু আলিহান ভাই আমাকে থামিয়ে দেয়। বলে মা বাবা যতই খারাপ হোকনা কেন তাদেরকে কষ্ট দিও না। তুমি তাদের ভুলগুলো শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করো। আলিহান ভাইয়ের কথা মতো আমিও সেটাই করছিলাম, দাদিকে আশ্রম থেকে ফিরিয়ে আনি। বাবা মাকে সময় দেই। এর মাঝে বাবা আর মা দুজনে ঝগড়া করে, মা বাড়ি থেকে চলে যায়। বাবা সেদিন রাতে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যায়। তার চিকিৎসা নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম আমি। সারাদিন রাত ছুটাছুটি করতাম হসপিটালে। এর মধ্যে একদিন সকালে রাহনাফ এসে হাজির হয় আমার মাকে নিয়ে। রাহনাফ আমার মাকে কোথায় পেল? আমি কোন প্রশ্ন করিনি। কারন সেদিন রাহনাফ চোখ দেখে আমি প্রশ্নগুলো করার সাহস পাইনি। পরে রাহনাফ আমার সাথে হসপিটালে আসে। মাকে হসপিটালে রেখে আমরা দুজনে একটা রেস্টুরেন্টের চলে যায়ই। আর সেখানে জানতে পারি আমার মায়ের পরিচয়। তার অতীত। জানো আপু, যে মা আমাকে তার গর্ভে ধারন করেছে সে একজন খুনি। ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃনা ধরেছে আমার। রাহনাফের বাবার খুনি আমার মা। যে রাহনাফ তার রাজত্ব আর বিলাসি জিবন ছেড়ে আশ্রমে বড় হয়েছে সেই রাহনাফের বাবার খুনি আমার মা। একদমই ভেঙে পড়েছিলাম আমি। তারপর আমার জিবনে আসে এক হলুদ প্রেমি। তাকে দেখলে তুমিও অবাক হবা আপু।সে হিমুকে ভালোবেসে হলুদকে ভালোবাসে। তার সবগুলা ড্রেসই হলুদ রংয়ের। সবসময়ই হলুদ পরে। এমনি সে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হলেও ব্রাজিলের জার্সি পরে। তাই আমি তার নাম দিয়েছি হলুদ পঙ্খি। মাঝে মাঝে তার কথা ভাবলে আমার হাসি পায়। ছেলেটা খুব অদ্ভুত।
আর ভিষন ভালো। জানো আপু ছেলেটা আমার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি তাকে না করে দিয়েছি। আমি তো দেশ ছেড়ে চলেই যাচ্ছি তাহলে কেন শুধু তার প্রতি মায়া বাড়াবো বলতে পারো। যদি কোনদিন তার সাথে তোমার দেখা হয় তাহলে তাকে বলে দিও, রাহিও তাকে মিছ করবে। তোমার হাতে যখন এই চিঠি পৌঁছাবে তখন আমি হয়তো তোমার থেকে অনেক দূরে থাকবো আপু। তবুও বলবো আমি তোমায় অনেক মিছ করবো। আর যদি পারো বাবাকে একবার দেখে এসো। এতে বাবারও ভালো লাগবে। বাবার তো তার করা ভুলের শাস্তি পাচ্ছে তাকে আর শাস্তি দিওনা আপু।
তুমি অনেক লাকি আপু, আন্টির মতো একজন মা পেয়ে। যাকে নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাচতে পারবে তুমি। যারা শুধু বাহ্যিক সুন্দরর্য দেখে মানুষকে বিচার করে, তাদের বলতে ইচ্ছে করছে, তাদের মতো বোকা প্রানি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মানুষের বাহিরের সুন্দরর্য না দেখে তার মনটা দেখুন কেমন। তাহলেই প্রকৃত মানুষ চিনতে পারবে। অবশেষ তোমায় একটা কথা বলি আপু, তুমি না চাইলেও আমি তোমায় আপু ডাকবো। দয়া করে আমার থেকে এই অধিকার কেড়ে নিও না। আর যদি পারো আমার মা-কে ক্ষমা করে দিও। ইতি, তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত বোন।
মেহেরের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো চিঠির উপর। মেহের চিঠিটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়ায়। মৌ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। তারও খুব খারাপ রাহির জন্যে। রাহি এতটা কষ্ট পেয়েছে। সত্যিই তো যা কিছু হয়েছে এতে রাহির দোষটা কোথায়? কেন রাহিকে এতটা কষ্ট পেতে হলো। কেন ওকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলো। মেহের উড়না দিয়ে মাথা ডেকে হাতে পার্স নিয়ে বেড়িয়ে যেতে নিলে, পিছন থেকে মৌ বলে উঠে,
– কোথায় যাচ্ছিস মেহু?
– রাহনাফের বাসায়।
– এই অসময়ে!
– হ্যাঁ। মা আমাকে খুজ করলে বল আমি একটা কাজে বেড়িয়েছি।
চলে যেতে নেয় মেহের। তখন মেহেরের সামনে এসে দাঁড়ায় আলিহান। ঘুম থেকে মৌকে কাছে না পেয়ে মেহেরের রুমে চলে আসে সে। মেহেরের তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেতে দেখে আলিহান কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে প্রশ্ন করে,
– সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস!
– মৌ-য়ের থেকে জেনে নিও আমার লেট হচ্ছে। বলেই আলিহানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় মেহের। আলিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে দৃষ্টির আগোচরে চলে যায় মেহের। আলিহান তখন তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৌ-য়ের দিকে। মৌ-য়ের চোখে চিকচিক পানি দেখে আলিহান দ্রুত পায়ে ওর কাছে গিয়ে হাটু গেরে বসে, ব্যাস্ত হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে,
– তোমার কি হয়েছে মৌ! কষ্ট হচ্ছে! কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলে আমাকে?
মৌ ছলছল চোখে আলিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আলিহান, রাহি!
– কি হয়েছে রাহির?
– রাহি দেশ ছেড়ে চলে গেছে আলিহান।
মৌ-য়ের কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় আলিহান। মাথায় হাত রেখে কিচ্ছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে সে। মৌনতা ভেঙে মৌ-য়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বলে,
– কোথায় গেছে! কখন গেছে জানো কিছু?
মৌ আলিহানের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বিছানায় পরে তাকা চিঠিটা ওর হাতে দেয়। আলিহান চিঠি হাতে নিয়ে মৌ-য়ের পাশে বসে পড়তে থাকে।
চিঠি পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আলিহান। মৌ-কে নিয়ে তাদের রুমে যায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে সে বেড়িয়ে পরে আহমেদ ভিলায় যাওয়ার জন্যে।
________________________
গভীর ঘুমে নিমজ্জিত রাহনাফ। কাল রাতে কাজের চাপ ছিলো অনেক তাই ঘুমাতে পারেনি।ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। জানালার কাজ ভেদ করে সূর্যের লাল রশ্নি এসে পড়ছে রাহনাফের মুখে। এখন যদি কেউ পর্দাটা টেনে দিত। এর মধ্যে কলিং বেলটা বেজে উঠে। গভীর ঘুমে থাকায় আর উঠা হয়না। পরপর কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরেও উঠে না রাহনাফ। তাই আগন্তুক বিরতিহীন ভাবে কলিং বেল চাপতে থাকে। ঘুম উবে যায় রাহনাফের। বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে। মুখে হাত দিয়ে বড় করে হাই তুলে সে। এদিকে আগন্তুক এমন ভাবে কলিং বেলটা চেপে যাচ্ছে যে রাহনাফের কানটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুত দরজা খুলে দেয় রাহনাফ। দরজার ওপাশে মেহেরকে দেখে একটু অবাক হয় রাহনাফ। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দরজার ওপাশে থাকা মেহেরের দিকে। মেহের রাহনাফের চাহনি উপেক্ষা করে ওকে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে।
মেহের আর রাহনাফ মুখোমুখি বসে আছে। রাহনাফের দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির। অনুতাপে ভুগছে সে। রাহনাফ কখনো ভাবতেও পারেনি রাহি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। মেহের উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। মেহের রাহনাফের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে। হাতে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকায় রাহনাফ তখনি মেহের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
– চুপ করে থেকো না রাহনাফ। বল রাহির মায়ের সাথে তোমাদের কিসের সম্পর্ক। তাকে কি করে চিনো তুমি।
মেহেরের প্রশ্নের জবাবে বড়করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহনাফ। অতঃপর বলতে শুরু করে,
চলবে,,,,,,,, (ইনশাআল্লাহ)
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।