#মোহঘোর
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত শামিয়ানায় আচ্ছাদিত জায়গাটুকু। প্রতিটি বাঁশের সাথে লাগানো সফেদ রঙের টিউব লাইট। মাঝে যেখানে স্টেজ করা হয়েছে তার দুইপাশে দুটো বড়ো আকৃতির গোলাকার লাইট লাগানো হয়েছে। বেলি আর গোলাপ ফুলের গন্ধে মোহিত সেই প্রাঙ্গন।
ছোটো ছোটো বাচ্চাদের কিলিবিলি। গিজগিজ করছে গ্রামের মানুষদের পদচারনায়। বর এসেছে খানিক আগেই। সকলে ব্যস্ত। অভাবিতরূপে শুরু হলো হট্টগোল। মামুন জিনিস ছোড়াছুড়ি করছে। ক্ষিপ্ত বাঘের মতো আচরণ করছে। বারবার একই বুলি আওড়াচ্ছে।
“নুপূর, নুপূর। বিয়ে হবে না, বিয়ে হবে না। চলে যাবে, চলে যাবে।”
ক্যাটারিং এর লোক ভয়ে সিদিয়ে গেল। খাবারের বড়ো ডেক নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে উপরে ফেলে দিলো মামুন। পুরোপুরি না হলেও অনেকটা খাবার বিছিয়ে গেল মৃত্তিকার বুকে। উত্তেজনা সৃষ্টি হলো সকলের মাঝে। ভয়ে থিতিয়ে গেল ছোটো বাচ্চারা। ক্রোধে, আক্রোশে জ্ঞান শূন্য মামুন। তাকে কেউ বলেছে নুপূরের বিয়ে হলেই সে এখান থেকে বরের সাথে চলে যাবে। তার বর তাকে নিতে এসেছে। এসব শুনেই ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো আচরণ শুরু করে মামুন। বাড়ির বড়োরা আর সমাজস্থ বয়স্ক লোকেরা উদ্বিগ্ন। তারা স্থির হয়ে আছে। ইনজাদ কিছুই বুঝতে পারছে না। সহসা মামুন তেড়ে এসে গলা চেপে ধরে ইনজাদের। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সংক্ষুব্ধ গলায় বলল—
“নুপূরকে নিয়ে যাবে? দেবো না, দেবো না। মেরে ফেলব, মেরে ফেলব।”
শ্বাসরোধ হয়ে আসে ইনজাদের। নুহাশ, ত্রিমুল শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে ছাড়িয়ে নেয় মামুনকে। কেঁশে উঠে ইনজাদ। ঘটনার পরিব্যাপ্তিতায় পাথর বনে যায় সব। ক্রোধানলে দাউ দাউ করে জ্বলছে মামুনের ভারী দেহ। কোথা হতে তটস্থ হয়ে ছুটে আসে রেহাংশী। ছোটো ছোটো শব্দে বলল—
“মামুন ভাই শান্ত হও। নুপূর আপু কোথাও যাবে না। কোথাও না।”
ফোঁস ফোঁস করছে মামুন। তার নাসারন্ধ্র দিয়ে তপ্ত লাভা বের হচ্ছে। রেহাংশীকে দেখে চপল পায়ে তার কাছে এসে দাঁড়ায় ইনজাদ। হট করেই তার বাজু চেপে ধরে। রেহাংশী ক্ষুব্ধ চোখে তাকায়। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে বিতৃষ্ণা হয়ে বলল—
“ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি।”
ত্রিমুল, পারভেজ মির্জা- সহ বাকি সকলে কেমন অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ইনজাদকে দেখছে। সে ছাড়া তো দুর, আরো শক্ত করে চেপে ধরল রেহাংশীর বাজু। নুহাশ গরম চোখে এসে ছাড়িয়ে নেয় ইনজাদকে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ইনজাদ। তার প্রশস্ত বুকের পাটা উঠানামা করছে। গম্ভীর, ভারী আনন। রেহাংশীর হাত বগলদাবা করে নেয় মামুন। পাখির ছানার মতো লেপ্টে যায় তার গায়ের সাথে। রেহাংশী হাত গলায় মামুনের চুলে। চোখের তাপ বাড়তে থাকে ইনজাদের। তার শরীরে কম্পন শুরু হয়েছে। দৈবাৎ পায়েলের ভয়াতুর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে সবাই।
“আব্বু, নুপূর আপু দরজা খুলছে না। তাড়াতাড়ি এসো।”
সকলে আরেক ধফা ধাক্কা খেল। কিন্তু ইনজাদের দৃষ্টি নড়ল না। বিবশ, স্তব্ধ, নিশ্চল, তেজী চাহনি। রেহাংশী সশব্দে বলে উঠে–
“মামুন ভাই পাগল হলেও ভালোবাসার জন্য লড়তে জানে। যান পরদেশী, আপনার হবু স্ত্রীর এখন আপনাকে প্রয়োজন।”
মামুনের হাতে দোল খেলছে রেহাংশীর শাড়ির আঁচল। কাতর চোখে চেয়ে আছে সে। রেহাংশী আহ্লাদী গলায় বলল—
“চলুন মামুন ভাই, খাবেন চলুন। ”
খিদের জ্বালায় কাতর বাচ্চাদের মতো রেহাংশীর পেছন পেছন যেতে লাগল মামুন।
,
,
,
কিছুতেই দরজা খুলছে না নুপূর। ভেতর থেকে কোনো শব্দও আসছে না। ঝিনুক বেগম লাগাতার দরজায় আঘাত করে যাচ্ছেন। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। ভয়ে আচ্ছন করে ফেলেছে তাকে। অজ্ঞাত কারণেই কাঁদতে লাগলেন তিনি। রওশন আরাও তার ক্যাটক্যাটে গলায় চিৎকার করে যাচ্ছেন। বাইরে থেকে যখন সবাই এলো তখন সরে আসলেন ঝিনুক বেগম। জুলহাস খন্দকার বিপদের আভাসে সংকুচিত হলেন। ধীরে ধীরে দরজায় আঘাত করে ডাকতে লাগলেন।
“নুপূর, নুপূর!”
কোনো সাড়া এলো না। তিনি আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তার বুকের উচাটন বাড়তে লাগল। নুহাশ দ্রুত পায়ে এসে দরজায় থাবা বসাল। গর্জন করে বলে উঠল—
“নুপূর, এই নুপূর! দরজা খোল।”
কোনো শব্দ হলো না। ইনজাদ, পারভেজ মির্জা-সহ তাদের ঘনিষ্ঠ সকল আত্মীয় সেখানে উপস্থিত। ইনজাদ নরম পায়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। সরল গলায় ডাকল।
“নুপূর, এই নুপূর! দরজা খোলো।”
আচমকা হাউমাউ করে উঠলেন ঝিনুক বেগম। তার ধারণা ভয়াল কিছুর। তিনি জোরে শব্দে করে কাঁদতে লাগলেন। তার সাথে তাল মিলিয়ে বিলাপ শুরু করলেন রওশন আরা। অপ্রস্তুত হলেন পারভেজ মির্জা। দিকবিদিক শূন্য হয়ে দরজা ভাঙার প্রস্তাব করলেন জুলহাস খন্দকার। নুহাশ আর ইনজাদ মিলে ধাক্কাতে লাগল দরজা। একসময় দরজা লক আলগা হয়ে যায়। ধপাস করে মেঝের বুকে আছড়ে পড়ে কাঠের দরজা। হুড়মুড়িয়ে সকলে ভেতরে প্রবেশ করে।
পা ঝুলিয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে কেউ। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে নুপূর। বাবাকে দেখে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে থাকা পুরুষটি উঠে বসে। জুলহাস খন্দকার বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললেন—
“এহসাস, তুমি? তুমি এখানে কী করে এলে?”
এহসাস চমৎকার হাসল। ঝরা গলায় বলল—
“চিনতে পেরেছেন তাহলে শশুড় আব্বা। আমি তো ভেবেছি ভুলেই গেছেন।”
হতভম্ব হয়ে গেল উপস্থিত সকলে। তাদের উৎসুক চাহনি, কৌতূহলী মন। ইনজাদের বিস্ময় আকাশ ছুঁল। সে চমকিত গলায় বলল—
“কে আপনি?”
এহসাস বিগলিত হেসে ইনজাদের সামনে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াল। খোশমেজাজে বলল—
“শশুড় আব্বা আমাকে জেলে দেওয়ার খুশিতে মেয়ের সাথে আমার ডিভোর্স করাতে ভুলে গিয়েছিল। সেই হিসেবে আমি এখনো নুপূরের লিগ্যাল হাজবেন্ড। তাই না নুপূর?”
নুপূর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এত সময় আটকে রাখা চোখের বানে তার কপোল প্লাবিত হয়। এহসাস মৃদু হেসে ফিচেল গলায় বলল—
“আপনি তাহলে দুলহে রাজা! ইশ! কী ভালো কাজটা করেছি বলুন তো! আরেকটু হলেই তো আপনাকে সেকেন্ড হ্যান্ড মাল ধরিয়ে দিচ্ছিল।”
ইনজাদ রাগি স্বরে বলল—
“ভাষা সংযত করে কথা বলুন। এসবের মানে কী? নুপূর, এই লোকটা যা বলছে তা কী সত্যি?”
“ও কী বলবে? ওর বলার কিছু নেই। আর ভাষার কথা বলছেন, এদের মতো মেয়েদের সাথে আবার ভাষা! কী বলেন শাশুড়ি আম্মা? চিনতে পেরেছেন তো আমাকে। না কি বিপি হাই হওয়ার সাথে সাথে আমাকেও ভুলে গেছেন?”
ঝিনুক বেগম কিছু বলতে পারলেন না। তিনি মূর্ছা গেলেন। ব্যস্ত হয়ে পড়ল সকলে। নুহাশ তাকে তার শয়নকক্ষে শুইয়ে দিয়ে আসে। তার কাছে রেখে আসে পায়েলকে। রওশন আরাকেও সরিয়ে নেওয়া হয়।বাড়তি লোকদের বাইরে বের করে দেয় নুহাশ। বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন জুলহাস খন্দকার। তাকে কক্ষের বাইরে এনে একটা চেয়ারে বসানো হয়। রেহাংশী তার পাশে বসে। হাঁসফাঁস করছে জুলহাস খন্দকার। তাকে ধরেই অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে নুপূর। ইনজাদ সরোষে বলল—
“এসব কী হচ্ছে নুপূর! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
নুপূর ত্রস্ত পায়ে কাছে আসতে চাইলেই ধমকে উঠে ইনজাদ—
“ডোন্ট টাচ মি। এই লোকটা যা বলছে তা কী সত্যি? তুমি বিবাহিত!”
এহসাস শান্ত সুরে বলল—
“বলো নুপূর। আজ তোমার ভয় নেই। তুমি সত্য বলতে পারো। কাবিননামা আমি সাথে করে নিয়েই এসেছি।”
তমালিকার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। তিনি বুঝতেই পারছেন না কী ঘটছে!
চলবে,,,