মোহঘোর”পর্বঃ১৩

0
700

#মোহঘোর
#পর্বঃ১৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

মায়ের আর্ত চিৎকারে ঘুম ভাঙে ইনজাদের। কাউচে শুইয়ে তার হ্যান্ডেলের ওপর পা উঠিয়ে রেখেছে। মুখে ওপর চেপে রাখা কুশন সরিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে জড়ানো গলায় বলল—

“সকাল সকাল কী শুরু করলেন আম্মা? গ্রামের মানুষ কই মোরগের ডাকে ঘুম থেকে উঠে আর আমরা ভাঙা রেডিওর।”

তমালিকা চিৎকার করে বললেন—

“দেখেছিস, দেখেছিস তোরা! একদিনে আমার ছেলেকে ঘরের বাইরে বের করে ছেড়েছে! কত বড়ো অপয়া ওই মেয়ে ভেবে দেখেছিস!”

ইনজাদ ঘুম ছাড়াল। তাজা স্বরে বলল—

“আম্মা, আপনার কী আর কোনো কাজ নাই? কেন শুধু শুধু মনগড়া কথা বলছেন?”

“আমি মনগড়া কথা বলছি? বউ ঘরে তুই বাইরে কেন? ওই মেয়ে তোকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে তাই না?”

ইনজাদ ক্লান্ত চোখে তাকাল। ত্রিমুল বোনের কাঁধে হাত দিয়ে বলল—

“শান্ত হ আপা। সকাল সকাল কী শুরু করলি?”

“আমি শুরু করেছি, আমি? তোর চোখ কী বন্ধ? দেখতে পাচ্ছিস না কিছু? ওই মেয়ে আরাম করে বিছানায় ঘুমাচ্ছে আর আমার ছেলে এই সোফায়!”

ইনজাদের মামি সুরমা মৃদু গলায় কৌতূহল নিয়ে বললেন—

“কী হয়েছে বলোতো ইনজাদ? তুমি এখানে কেন?”

ইনজাদ নীরস গলায় বলল—

“তেমন কিছু না মামি। আমার রুমে ডিম লাইট নেই। রেহাংশী অন্ধকারে ঘুমাতে পারে না। আর আলোতে আমার ঘুম আসে না। তাই আমি নিজেই এখানে এসে শুয়েছি।”

তমালিকা চোখ বড়ো বড়ো করে তাজ্জব গলায় বললেন—

“বউ অন্ধকারে ঘুমাতে পারবে না তাই তিনি বসার ঘরে এসে ঘুমাচ্ছেন! দেখেছ, কীভাবে আমার ছেলেটাকে বশ করেছে? আমি এখনো বলছি এই মেয়ে আমার সব শেষ করে ছাড়বে।”

ত্রিনা মুখ চিপে হাসছে। সুরমা তাকাতেই হাত নামিয়ে আনে মুখ থেকে। সটান দাঁড়িয়ে হাসি মিলিয়ে নেয় হাওয়ায়। নিরস্ত্র গলায় বলল ইনজাদ—

“আম্মা, কেন শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছেন?”

“তুই চুপ কর।”

দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই সপ্রতিভ হয় ইনজাদ। ব্যগ্র গলায় বলল—

“সাতটা বেজে গেছে! আমাকে বের হতে হবে।”

তমালিকা বিড়বিড় করেই যাচ্ছেন। পারভেজ মির্জা কোনো শব্দই করলেন না। আপাতত চুপ থাকাই সমীচীন মনে করছেন তিনি। ইনজাদ টলতে টলতে নিজের কক্ষের দিকে হাঁটা ধরে। অবারিত গলায় বলল—

“সাবধান আম্মা! আমাকে তো শুধু বশ করেছে, ও কিন্তু কালো জাদু জানে আই মিন ব্ল্যাক ম্যাজিক। দেখেছেন না রাতের বেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। দূরে থাকবেন ওর থেকে। কখন কী করে বসে! এইজন্য-ই তো সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”

খিলখিল করে হেসে উঠে ত্রিণা। তার হাসিতে তাল মেলালো পারভেজ মির্জা। না চাইতেও হেসে ফেলল ত্রিমুল। জ্বলে উঠলেন তমালিকা। সুরমা থতমত খেয়ে শান্ত গলায় বললেন—

“আপা কিছু মনে করবেন না। ও তো…।”

আড় চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন সুরমা। ততক্ষণে নিজের কক্ষে প্রবেশ করেছে ইনজাদ। দরজা লক করে দিয়েছে।

দরজার পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। পরনে বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি। ইনজাদ সহিষ্ণু গলায় বলল—

“আম্মার কথা শুনছিলে? কিছু মনে করো না। আম্মা এমনি এসব বলে। দু’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম।”

“রাতে কী বিছানায় যুদ্ধ করেছিলে না কি? শাড়ির এ অবস্থা কেন?”

রেহাংশী নিজের দিকে তাকাল। নতুন সুতি শাড়িতে ভাঁজ পরে গেছে। ইনজাদ আদেশের সুরে বলল—

“শাড়িটা চেঞ্জ করে বাইরে যাবে।”

‘হুম।”

“কী হু, হু। হ্যাঁ বলতে পারো না। আর তাড়াতাড়ি করো। বের হতে হবে আমাদের।”

রেহাংশী মনমরা গলায় বলল—

“ও বাড়িতে জানাবেন না?”

“সময় নেই। নুহাশকে কল করেছি। যাওয়ার সময় দেখা করতে আসবে। আর ঝামেলা করতে পারব না। এমনিতেও একটু পর ঝড় শুরু হবে।”

রেহাংশী ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে বলল—

“কেন?”

“কেন আবার! তোমার হবু বর আসবে না। তার একমাত্র হবু বউকে বিয়ে করে নিয়েছি।”

“তাই বুঝি পালিয়ে যাচ্ছেন?”

চট করেই রেহাংশীকে বুকের মাঝে টেনে নেয় ইনজাদ। কোমরে চাপ দিয়ে পিষে ধরে নিজের সাথে। দম্ভ করে বলল—

“আমার জিনিসের দিকে চোখ দিলে সেই চোখ তুলে নেবো। এখন শুধু সময় নেই বলে।”

রেহাংশীর দুই হাত ইনজাদের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। পূর্ণ নজরে তাকিয়ে বলল—

” এই জন্য বুঝি চুপ করে ছিলেন?”

“অন্যায় সয়ে নেওয়ার শিক্ষা আমার পরিবার আমাকে দেয়নি। তবে সম্মান আর অনুরক্তির মাঝে পার্থক্য আছে। সেইটা তোমাকে বুঝতে হবে বিষবাণ। আমরা যা চাই তা সবসময় ঘটে না। জগতে তাই ঘটে যা আল্লাহপাক চান।”

“যদি সত্যিই বিয়ে হয়ে যেত?”

ইনজাদের দৃষ্টি নরম হয়। কণ্ঠে নমনীয়তা আসে। আরেকটু চেপে ধরে রেহাংশীকে। তার গলায় নাক ঘষে বলল—

“ভাগ্য বলে মেনে নিতাম। আর ভাগ্যে তাই ছিল যা হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তাই করেন যা তার বান্দাদের জন্য সঠিক।
পবিত্র কুরআনে আছে-“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না। সে যা ভালো কাজ করেছে তার ফল পাবে এবং যা খারাপ করেছে তা তার বিরুদ্ধে যাবে।
“ও আমাদের রব, আমরা ভুলে গেলে বা ভুল করে ফেললে আমাদের পাকড়াও করেন না।
ও আমাদের রব, আগেকার লোকদের উপর যেমন কঠিন বোঝা দিয়েছিলেন, আমাদের উপর তেমন বোঝা দিয়েন না।
ও আমাদের রব, যে বোঝার ভার বইবার সামর্থ্য আমাদের নেই , সে-ই বোঝা চাপিয়ে দিয়েন না। আমাদের অপরাধগুলো মাফ করে দিন। আমাদের পাপগুলো গোপন করে দিন। আমাদের উপর দয়া করুন। আপনিই তো আমাদের রক্ষাকর্তা। তাই অবিশ্বাসী লোকগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” [আল-বাক্বারাহ ২৮৬]
বুঝলে বিষবাণ। জলদি করো, দেরি হচ্ছে আমার।”

রেহাংশীকে ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ইনজাদ। কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে রেহাংশী। ভাগ্য সবসময় তাকে ধোঁকা দিয়েছে। তাই আজ সে ভাগ্যকে।”
,
,
,
ভাইয়ের পাশেই বসেছে ত্রিণা। খাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। ইনজাদ গাঢ় চোখে তাকিয়ে তার হাসির কারণ উদঘাটন করার চেষ্টা করছে। ধমকে উঠে বলল—

“হাসছিস কেন?”

“ফুফু আম্মু কী বলেছে তোমাকে!”

আবারও ঝুমঝুমিয়ে হাসে ত্রিনা। একটা গাঢ় নীল রঙের জামদানি পরেছে রেহাংশী। ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল সুরমার সামনে। প্রগাঢ় মায়ায় তাকে কাছে ডেকে চেয়ারে বসালেন তিনি। ত্রিণা বাচ্চাদের মতো হেসে হেসে বলল—

“তোমাকে তো খুব মিষ্টি লাগছে!”

চোখে হাসে রেহাংশী। সুরমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল–

“আপার কথায় কিছু মনে করো না। সে মানুষটা কঠিন কথা বললেও মনটা নরম। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“আরে তুমি জানো না, ফুফু আম্মু এমনিতেই রাগ করে। কিন্তু মনটা খুব ভালো। দেখবে তার সব রাগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে। এই তুমি লিপস্টিক দিয়েছ?”

ঢোক গিলে রেহাংশী। অপ্রস্তুত হয় সে। ইনজাদ চাটি মারে ত্রিণার মাথায়।

“গাধি! এইটা কী ধরনের প্রশ্ন? এইটাকে বিয়ে দিচ্ছ না কেন মামি?”

“বিয়ে করব না আমি। তাতে তোমার কী?”

“এইটাকে ছোটো বেলায় ডানো না খাইয়ে একটু খাঁটি গরুর দুধ খাওয়াতে তাহলে মাথায় ঘিলু হতো।”

ন্যাকা গলায় চিৎকার করে উঠে ত্রিণা—

“আম্মু, তুমি কিছু বলছ না কেন?”

“কী বলবে রে, গাধি!”

“আব্বু তোমার বোনের ছেলেকে কিছু বলবে?”

ত্রিমুল পারভেজ মির্জার সাথে কথা বলছিলেন। কথার মাঝখানে মেয়ের চিৎকার করা কণ্ঠে বিরক্ত হলেন। মেয়েটা এত বড়ো হয়েও বাচ্চাদের মতো আচরণ করে! অতি আহ্লাদে এমন অবস্থা। তমালিকা গাল ফুলিয়ে বসে আছেন নিজের কক্ষে। উটকো রাগ হচ্ছে তার। একে তো বিয়েটা হয়েছে তার অনিচ্ছায়। এখন এই মেয়েটা তার ছেলের সাথেই শহরে চলে যাবে। কী হবে, কীভাবে থাকবে তা নিয়ে ভীষণ ভাবনায় মগ্ন তিনি।

সুরমা চমৎকার গলায় বললেন—

“ঢাকা গিয়ে আবার আমাদের ভুলে যেয়ো না। সময় করে বউকে নিয়ে আসবে কিন্তু।”

ইনজাদ একগাল হেসে বলল—

“যাব। তোমরা এখন যেয়ো না। কয়েকটা দিন আম্মার কাছে থাকো। আম্মার এই রাগ কমলে যেয়ো।”

ত্রিনা নাক ফোলায়। প্রতিবাদ করে বলল—

“এই তুমি একদম যাবে না আমাদের বাসায়। শুধু রেহাংশী যাবে।”

“এই রেহাংশী কী রে?”

জোড়া লাগানো ওষ্ঠাধর এপাশ ওপাশ করে ভেঙচি কাটে ত্রিনা। প্রসন্ন হেসে বলল—

“রেহাংশীকে আমি মিষ্টি বউ বলে ডাকব। ওকে?”

রেহাংশী লাজুক চোখে তাকায়। চোখের পাতায় লজ্জা নিয়ে মাথা নিচু করে। এতকিছুর মাঝে নিজের বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে তার। মানুষগুলো তার সাথে যাই করেছে, কিন্তু আগলেও রেখেছে। তার বাবার মতো ছেড়ে তো দেয়নি। জুলহাস খন্দকারকে খুব মনে পড়ছে রেহাংশীর। খাওয়া থমকে যেতেই উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুড়ে সুরমা—

“না খেয়ে বসে আছ কেন?”

রেহাংশীর ভাবনা কাটতেই দেখে তার পাশে ইনজাদ নেই। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসতে আসতে উচ্চ গলায় বলল—

“চিন্তা করো না। আমি না খাইয়ে রাখব না। কিন্তু চাকরিটা ছুটে গেলে না খেয়েই থাকতে হবে। তাড়াতাড়ি করো রেহাংশী। সময় নেই আমার হাতে।”

রেহাংশী নম্র গলায় সুরমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—

“আমি আর খাবো না।”

তিনি চমকে উঠে বললেন—

“খাবে না কেন? না খেলে হবে! শোনো, আগের নিজের শরীর ঠিক রাখবে। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তারপর বরের চিন্তা।”

রেহাংশী হালকা করে মাথা ঝাঁকায়। পূনরায় বলল তার খেতে ইচ্ছে করছে না। মাথার ঘোমটা আরেকটু ঠিক করে ফিরে যেতেই উদ্যত হলে সকলের চক্ষুর অগোচরে আলতো করে রেহাংশীর হাত চেপে ধরে ইনজাদ। চাপা স্বরে বলল—

“ডোন্ট ওয়ারি। তোমার শরীর আর মন দুটোর-ই খেয়াল রাখব আমি। কারণ, দুটোর-ই মালিকানা চাই আমার। একটাতে পোষাবে না।”

টেনে হাত ছাড়িয়ে নেয় রেহাংশী। নাকের উপর চশমাটা ঠিক করে তীর্যক চোখে তাকায় ত্রিনা। ঝিলমিল করা গলায় বলল—

“মিষ্টি বউয়ের কানের কাছে কী বলছ তুমি?”

ইনজাদ বিব্রতকর কণ্ঠে বলল—

“নিজের হুলিয়ার সাথে সাথে চশমার পাওয়ার চেঞ্জ কর গাধি।”

সুরমা মেয়েকে নিভিয়ে দিয়ে বললেন—

“সবকিছুর মধ্যে তোর কথা বলতে হবে কেন? যা ঘরে যা।”

“ভ্যা।”

ইনজাদ ঠোটভর্তি হেসে নিজের কক্ষে ফিরে আসে। রেহাংশী বিছানায় স্থির বসে আছে। মন ভার হচ্ছে তার। কেন এমন হচ্ছে তা সে জানে না। ইনজাদকে দেখেই শশব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চট করে বলল—

“চলুন না ও বাড়িতে। সবাইকে একবার দেখে আসি।”

টেবিলের ওপর থেকে হাত ঘড়িটা নিয়ে শক্ত চোখে তাকাল ইনজাদ। রেহাংশী নির্বিকার।

” বললাম তো সময় নেই। মামা সিএনজি এনেছে। দুপুরের আগেই আমাকে ঢাকা পৌঁছাতে হবে। জলদি এসো। আরেকটা কথা, বাস জার্নির অভ্যাস আছে?”

রেহাংশী ঋণাত্মক সুরে বলল—

“না। নানু বাড়িতে হয় রিকশাতে গিয়েছি আর না হয় সিএনজিতে।”

“তাহলে আম্মার কাছ থেকে দুটো বমির ট্যাবলেট নিয়ে খেয়ে নাও। এসব করে আমার ঝামেলা বাড়িয়ো না। সহ্য করতে পারি না আমি।”

রেহাংশী ক্ষুণ্ণ চোখে তাকায়। বমি করার অভ্যাস তার নেই।
তমালিকা রুষ্ট। কিছুতেই তিনি ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন না। তার পা ধরে বসে আছে ইনজাদ। অনুনয় করেও রেহাংশীর দিকে মন গলাতে পারল না। কিন্তু ছেলে বাড়ি থেকে বের হতেই ঝরঝর করে কেঁদে বাতাস ভারী করে তুললেন।
,
,
,
জানালার ফুরফুরে বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছে ইনজাদ। বাস চলছে তার নিজ গতিতে। রেহাংশী নীরব চোখে চেয়ে আছে জানালা দিয়ে। সাঁই সাঁই করে সব পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে বাস। চেনা রাস্তা, ওই আকাশ, এই যে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা রেইনট্রি! সব মাড়িয়ে ইট-পাথরের শহরে চলে যাচ্ছে সে। এখন আর বৃষ্টি এলেই মৃত্তিকা ভেজা গন্ধ আসবে না, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নৃত্য দেখা হবে না, ঘুম ভাঙলেই শোনা হবে না পাখির কিচিরমিচির। মন খারাপ হলে ওই ছাদে যাওয়া হবে না, পাড়ার বাচ্চাদের সাথেও দেখা হবে না। প্রতিবেশী চাচিদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই গেইটে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে বর দেখা হবে না, বলা হবে না বর এসেছে, বর এসেছে। শীতের রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ যখন মিহি কুয়াশায় ত্বরান্বিত হবে, থরথর কাঁপনে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখা হবে না ওই দূরের তালগাছ। ইচ্ছে হলেই নদীর ধারে যাওয়া হবে না। বুক ভারী হয়ে উঠে রেহাংশীর। কান্না পাচ্ছে তার। আপন মানুষগুলো চোখের অপ্রিয় হলেও, বুকের কাছে তারা।

নির্বিঘ্নে চোখের পাতা মুদন করে তন্দ্রা-বিলাসে মত্ত ইনজাদ। টিকেট নিতে আসা লোকটার দিকে ক্ষুদ্র চোখে চাইল রেহাংশী। তাদের সামনে সিটেই সুপারভাইজার দাঁড়ানো। রেহাংশী হালকা করে নাড়া দিলো ইনজাদকে। আঁখিপক্ষ্ম মেলে তাকায় ইনজাদকে। বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করল—

“কী?”

“টিকেট নিতে এসেছে।”

ঘাড় নাড়ালো ইনজাদ। বুক পকেট থেকে টিকেট বের করে দুই আঙুলের মাঝে চেপে সামনের সিটের হেডবোর্ডের ওপর রাখে। রেহাংশীর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল—

“খিদে পেয়েছে?”

“উঁহু।”

“ওয়াশরুম?”

ব্রীড়াময় চাহনিতে না বোধক উত্তর করে রেহাংশী। ইনজাদ ঘুমে কাতর স্বরে বলল—

“কিছু লাগলে আমাকে বলো। চুপ করে থেকো না। আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে রেহাংশী।”

“আপনি ঘুমান।”

সুপারভাইজার ততক্ষণে তার কাঙ্ক্ষিত অংশ কালেক্ট করে নিয়েছে। নির্ভয়চিত্তে আবারও ঘুম জড়িয়ে আসে ইনজাদের চোখে। তার ঘুমন্ত মুখশ্রীতে প্রগাঢ় চোখে অল্পক্ষণ চেয়ে থাকে রেহাংশী। ক্লান্ত চোখেও যেন সজীবতার দ্বার খুলে রেখেছে ইনজাদের ভরাট মুখ, ওই ঠোঁট। হালকা বাতাসে ইনজাদের সামনে চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। বাসের জঙ্গমতায় তার মাথা দুলছে তবে তাতে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে না। আনমনেই ইনজাদের বাজুর দিকটায় মাথা রাখে রেহাংশী। খুব যতন করে, আবেশিত চিত্তে। মাথাটা ঘোরাতেই তার নাক ঠেকে ইনজাদের বাজুতে। একটা অকৃত্রিম, ক্ষীণ, মিষ্টি পুরুষালী ঘ্রাণ ধাক্কা মারে রেহাংশীর নাকে। রেহাংশী বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই স্থির হয়ে থাকে। আজ তার ভয় লাগছে না, ঘৃণাও না। বাবার পরে সব পুরুষকে ঘৃণা করার মাঝে শুধু জুলহাস খন্দকারকেই বিশ্বাস করত রেহাংশী। আজ এক অচেনা, অজানা, অজ্ঞাত পুরুষ তার কত আপন হয়ে গেছে যে, সে তার সাথে সুদূর পথ পাড়ি দিচ্ছে। সংসার নামক গন্তব্যে। চিকচিক রোদ ঢুকছে জানালা ভেদ করে। তা খরখরিয়ে পড়ছে ইনজাদের বুকের ওপর। পর্দা টেনে দেয় রেহাংশী। যে তার শরীর ও মনের দায়িত্ব নিয়েছে তাকে যত্ন করাও তার দুর্দমনীয় অধিকার।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here