#মোহঘোর
#পর্বঃ১৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
হড়বড় করে থাই গ্লাস পুশ করে ভেতরে ঢুকল ইনজাদ। সামনের ব্যক্তিকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে ওঠল। ভদ্রলোক চমকিত চোখে চেয়ে বললেন—
“এত দেরি?”
ইনজাদ থতমত খেয়ে বলল—
“সসসরি স্যার, আই এম রিয়েলি সরি।”
ব্যগ্রতা নিয়ে ঘড়ির স্বচ্ছ কাঁচে চোখ ফেলল ইনজাদ। দুটো বিশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। রেহাংশীকে ফ্লাটে একাই রেখে এসেছে। কোনো মতে হাত -মুখ ধুয়ে শার্ট চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসেছে।
‘জে. কে. সিন্ধুজা রেস্টুরেন্ট ‘ নামের নতুন একটি রেস্তোরাঁয় ম্যানেজার পদে যোগ দেয় ইনজাদ। মেহমাদের সুপারিশে স্বল্প পরিশ্রমে জবটা তার হয়ে যায়। রেস্তোরাঁর মালিক অমায়িক মানুষ। পারিবারিক কোনো কাজে আজই তাকে দেশ ছাড়তে হবে। তাই কাল বিলম্ব না করে রেস্তোরাঁর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। মিলাদের পর আশেপাশের বিভিন্ন দোকানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। রেস্তোরাঁর কাজে নিয়োজিত ইমপ্লয়িরা সবাই উপস্থিত। নতুন রেস্তোরাঁর প্রচারের জন্য আগামী এক সপ্তাহ টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট ছাড় রেখেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ।
সন্ধ্যার গাঢ় আঁধার নেমে এসেছে। কাঁচঘেরা রেস্তোরাঁর ভেতর আলোর ঝলকানি। বেলুন, তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। দিনের আলোর মতোই সব ঝকঝকে, স্বচ্ছ, স্পষ্ট। ভদ্রলোক বিদায় নিয়েছেন বিকেলেই। সমস্ত দায়িত্ব নির্ভরতার সাথে তুলে দিয়েছেন ইনজাদের একার হাতে। ইনজাদ স্টাফদের সাথে কথা বলছে। বেশিরভাগ সার্ভিস বয়-ই ছাত্র। তাই পার্ট-টাইমে কাজ করবে তারা। দুটো শিফটে। অ্যাকাউন্টেন্ট মানান বয়সে ইনজাদ থেকে একটু বড়ো হবেন। লোকটিও অমায়িক চরিত্রের মানুষ। রান্নাঘরের কাজের জন্য যেসব লোক আর শেফ রাখা হয়েছে তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি যত্নের সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছে ইনজাদ। বাঁগড়া করল তার মুঠোফোন। মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই অপ্রস্তুত হয় সে। একপাশে গিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশের মানুষের ভয় মেশানো অধৈর্য কণ্ঠ—
“তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।”
ইনজাদ কপাল কুঞ্চি করে। তার চোখের পল্লব ঘনঘন ওঠানামা করছে। বিচলিত কণ্ঠে শুধাল—
“কী হয়েছে রে?”
মেহমাদ গম্ভীর স্বরে বলল—
“রেহাংশী ঠিক আছে? ও দরজা কেন খুলছে না?”
“মানে?”
“সে আধা ঘণ্টা যাবত নক করে যাচ্ছি। কোনো সাড়া শব্দ নেই।”
এসির শিরশিরে হাওয়াতেও ইনজাদের মনে হলো সে ঘামছে। তার আশেপাশে কোথাও জ্বলন্ত কুন্ডলি আছে। যার তাপ তাকে আচানক গলিয়ে দিচ্ছে। ভীত গলায় বলে উঠে ইনজাদ—
” আরে না, মে বি ঘুমোচ্ছে।”
“দেখ ভাই, ঘুম তো আমরাও যাই না কি! সেই কখন থেকে নক করছি… দরজা খুলছেই না। আমি খাবার এনেছিলাম। ভাবলাম দিয়ে দিই।”
ইনজাদের গলা শুকিয়ে আসছে। ঢোক গিলতে পারছে না। শিড়দাঁড়া বেয়ে জলস্রোত নেমে যাচ্ছে। চোখ মেলে পুরো রেস্তোরাঁয় চোখ বোলাল। অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলল। হাতের সাহায্যে মুখের ঘাম মুছতে লাগল। শুষ্ক ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিল। ইনজাদের মনে হলো তার পায়ে কেউ কয়েক মন পাথর বেঁধে দিয়েছে। তাই সে নড়তে পারছে না। বিবশ নয়ন, বিচলিত অন্তঃকরণ, ভয়াল চিন্তায় বুঁদ হয়ে গেল ইনজাদ।
,
,
,
কলিং বেলে চাপ পড়তেই ফট করে দরজা মেলে ধরে মেহমাদ। উদ্বিগ্ন চোখে সে এক প্রাণহীন দেহকে দেখল। ইনজাদের পা চলছে না। অবিশ্বাস্য তার ভাবাবেশ। কোনো শব্দ ছাড়াই একে অন্যের চোখে দিকে তাকাল। ইনজাদের হৃৎকম্পন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। ফ্লাটে ঢুকতেই বামদিকে একটা বেডরুম। ভেতরের দিকে আরও দুটো বেডরুম পাশাপাশি যা দরজার সমান্তরালে। বামদিকের কক্ষটাই ইনজাদের। সে নরম পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আলতো হাতে দু’বার দরজায় আঘাত করে। দরজার পাটাতনে কান পাতে। না, কোনো শব্দ হলো না। ভেজা শার্ট লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। ইনজাদের শ্বাস ভারী হচ্ছে। মেয়েটা ঠিক আছে তো!
কপাল বেয়ে ঘামের নহর নামছে। অবিন্যস্ত চিন্তা-ভাবনার ইতি ঘটিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল সে। মোহনীয় গলায় ডাকল—
“রেহাংশী! রেহাংশী!”
খট করে একটা আওয়াজ হলো। দরজার পাটাতন পেছতে লাগল কক্ষের ভেতরের দিকে। মেহমাদ হতভম্ব। ইনজাদ কক্ষের ভেতরে পা রাখল। ভেতরে সম্পূর্ণ প্রবিষ্ট হতেই দরজা চেপে গেল। মেহমাদের কপালে ভাঁজ পড়ে। ঘটনার বিস্তৃত সে পরে জানবে। আপাতত তার গলা ভেজানো প্রয়োজন।
ঘাড় ঘোরাল ইনজাদ। দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। নতজানু মুখটা বিষণ্ণ, বিমর্ষ। ইনজাদ অসহনীয় শ্বাস ফেলল। কণ্ঠে তীক্ষ্মতা টেনে বলল—
“রেসপন্স করছিলে না কেন? পাগল হয়ে গেছ তুমি?”
কেঁপে উঠল রেহাংশী। বুকের কাঁপন থামিয়ে সংকীর্ণ চোখে ইনজাদের দিকে তাকাল। জলভরা সেই চোখ দেখতেই ইনজাদের অস্ফুট রাগ নিভে গেল। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল ইনজাদ—
“কেন এমন করলে বলোতো? আমার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ? ভয় পেয়ে গেছি। যদি কিছু হয়ে যেত তোমার?”
“আমি ঠিক আছি।”
রেহাংশীর মিহি কণ্ঠে ঝাঁঝিয়ে উঠল ইনজাদ। ধমকে উঠে বলল—
“তাহলে দরজা কেন খুলছিলে না?”
প্রত্যুত্তর করল না রেহাংশী। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। নিশ্চুপ, নীরব। ইনজাদ ধৈর্য হারা গলায় বলল—
“ও আমার ফ্রেন্ড। আমরা একই ফ্লাটে থাকি। তোমাকে জাস্ট…।”
“আপনার ফ্রেন্ড হলেও সে পুরুষ। আর সব পুরুষ এক নয়।”
রেহাংশীর ভয়ের কারণ প্রতীত হলো ইনজাদের মস্তিষ্কে। ছোট্ট কক্ষটায় একটা ডাবল বেড যা জানালার সংলগ্নে পাতা। বিছানার এ পাশে একটা পড়ার টেবিল আর তার সাথে চেয়ার। তারপর কক্ষ থেকে বের হওয়ার দরজা। দরজার ওপাশটায় একটা বুকশেল্ফ আর তার পাশেই ছোট্ট কাবার্ড। কোণার দিকটায় ওয়াশরুম। ইনজাদ মাথার দুই পাশ চেপে ধরে বিছানায় বসে। ঝিমঝিম করছে মাথার ভেতরে। কীভাবে সে ছুটে এসেছে ইনজাদ নিজেও জানে না। ঘর্মাক্ত মুখটা উঁচু করে তাকাল রেহাংশীর দিকে। তার দৃষ্টি নিম্নমুখী। টেবিলের দিকে চাইল ইনজাদ। যাওয়ার সময় বিরিয়ানির প্যাকেট রেখে গেছে তা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন ছুড়ে ইনজাদ—
“খাওনি কেন?”
“খেতে ইচ্ছে করছিল না।”
“কী করতে ইচ্ছে করে তোমার?”
মাথা তুলে তাকাল রেহাংশী। টলটলে চোখ। আর কিছু বলতে পারল না ইনজাদ। বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে চলে যায় সোজা রান্নাঘরে। ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে শান্ত করে। ছোটো ছোটো পা ফেলে মেহমাদের কক্ষের দিকে এগোয়। বিছানায় আধশোয়া বসে পায়ের ওপর ল্যাপটপ রেখেছে সে। খটাখট চলছে আঙুলের ক্রিয়া। ইনজাদ মনক্ষুণ্ণ গলায় বলল—
“সরি ইয়ার, আসলে ও একটু ভয় পেয়ে গেছে। এর আগে ঢাকা আসেনি কখনো।”
মেহমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো ভাবাবেশ হলো না। ল্যাপটপের স্ক্রিনে আঁখি নিবদ্ধ রেখেই বলল—
“মাঠে নামার আগে সব খেলোয়াড়রাই নার্ভাস ফিল করে। একবার মাঠে নেমে গেলে, পিচে দাঁড়ালেই সব নার্ভাসনেস শেষ। আর খেলা শুরু হলে তো কথাই নেই। ব্যাট-বলের সংঘর্ষে শুধু একটা ছক্কা! দর্শকও খুশি, ব্যাটসম্যানও খুশি। তুই নিশ্চয়ই এখনো ওপেনিং করিসনি। বেচারি তাই একটু ভয়ে আছে। ”
ইনজাদ দাঁত-মুখ খিচে এসে মেহমাদের পিঠের ওপর তাল বর্ষণ করে। দুই বন্ধুর দস্তাদস্তিতে মেহমাদের বুকের ওপর পড়ে ইনজাদ। ল্যাপটপ বিছানায় ছিটকে পড়ে। মেহমাদ ফিচেল হেসে বলল—
“কী শুরু করলি! সর আমার ওপর থেকে। এমনিতেও খেলা শুরু করতে ডিলেএ করেছিস। তোর বউ এখন এই অবস্থায় তোকে দেখলে নির্ঘাত সন্দেহ করে বসবে!”
ইনজাদ আরও কয়েকটা ডাসা কিল বসায় মেহমাদের বুকের ওপর। গলা মুক্ত করে বলল—
“শালা,অশ্লীল!”
ইনজাদ সরে আসতেই উঠে বসে মেহমাদ। শ্বাস ফেলে বলল—
“বিয়ে হতে না হতেই বাসর করার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিস, আর এখন আমাকে অশ্লীল বলছিস? শালা, এক লাথি মারব তোর পশ্চাতে।”
খলখল করে হেসে উঠে ইনজাদ। বিছানার ওপর ধপ করে শুয়ে পড়ে। বিক্ষিপ্ত আওয়াজ হয়। সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে মেহমাদের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত হাসে। উজ্জ্বল চোখে চেয়ে বলল—
“আমি সত্যিই ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
মেহমাদ পা টানটান করল। পেছন দিকে হেলান দিয়ে ল্যাপটপ তুলে নিল হাতে। হাসি হাসি মুখে বলল—
“বলেছিলাম তোকে আমি।”
“ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। বিশ্বাস কর, ওকে এক নজর দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। কিন্তু যেতে পারিনি ওর সামনে। চোখ মেলাব কী করে!”
মেহমাদ নরম করল চাহনি। শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে। ইনজাদ শূন্যে তাকাল। স্বর ভারী করল। নিভে গেল তার চোখ। বুকের শ্বাস বাড়ল। বলল—
“মেয়েটা যা করেছে আমার পরিবারের জন্য তার ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।”
মেহমাদ প্রতিবাদ করল। তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল—
“শোধ কীসের রে? ভালোবাসায় দেনা-পাওনা কীসের? ভালোবাসার বিনিময়ে শুধু ভালোবাসা দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পবিত্র। সেখানে কোনো হিসেব হবে না। ”
ইনজাদ হাসল। হৃদয় ভেজা হাসি। চোখের পাতায় দোল খেলল খুশির হাওয়া। লাফ মেরে উঠে বসে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“দুপুরে খাবার রেখে গেছি, খায়নি। ”
মেহমাদ চট করে তাড়া দিয়ে বলল—
“টুলের ওপর যে প্যাকেট আছে ওটা নিয়ে যা। ”
ইনজাদ হাত ঘড়িতে সময় দেখল। ভ্রু কুঞ্চি করে উঠে দাঁড়াল। প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। খাবার গরম করে প্লেটে করে নিয়ে একবারে ঢুকল নিজের কক্ষে। তাকে দেখেই সচল হলো রেহাংশী। শব্দ করেই টেবিলে প্লেট রাখে ইনজাদ। কঠোর দৃষ্টি তার। শার্টের বোতামে হাত লাগিয়ে বলল—
“খেয়ে নাও।”
ইনজাদ আর কোনো বাক্য নিঃসৃত করল না। শার্ট খুলে ঝুড়িতে রেখে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা চোখ ফেলে টেবিলে। খাবার ওভাবেই পড়ে আছে। ইনজাদের ভেজা চুলে তোয়ালে ছোয়ানো। ভেজা চোখচ্ছেদ প্রশস্ত করে গাঢ় গলায় বলল—
“বসে আছ কেন?”
রেহাংশী মিহি গলায় বলল—
“আপনি খাবেন না?”
“আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি না খেয়ে থাকি না। এই, তোমার খিদে পায় না? সকালেও ঠিক মতো খাওনি, দুপুরেও খেলে না। আবার এখনো চুপ করে বসে আছ।”
ইনজাদ বিছানার পায়ের দিকটায় বসে। তার পিঠ দেখতে পাচ্ছে রেহাংশী। দৃষ্টি স্থির হয়। ইনজাদের পৃষ্ঠদেশের বাঁকে তার গাঢ় সম্মোহিনী চাহনি। তার পেশিবহুল শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ফড়িংয়ের মতো ছুটছে রেহাংশীর লজ্জামিশ্রিত চাহনি। পর্বতের মতো অটল শিরদাঁড়া। ইনজাদ নিজ কাজে মশগুল। চুলের পানি মুছতে মুছতে বলল—
“নিজের খেয়াল রাখতে শেখো। সারাক্ষণ তো আমি পাশে থাকব না। বাচ্চাদের মতো জেদ ধরলে হবে না। খেয়ে নিতে হবে নিজ গরজে।”
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় ইনজাদ। পরদেশীর ভোলা মন কেন বোঝে না লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তার বিষবাণ! বিষের নেশা যে তারও লেগেছে। ইনজাদের অবিন্যস্ত চিকুর ভেদ করে ওই ভরাট দুই আঁখি বিদীর্ণ করছে রেহাংশীর কোমল নারী হৃদয়কে। তার উচ্চ গ্রীবা, প্রশস্ত বক্ষপুট, ফুলে উঠা বাহুর প্রতিটি ভঙ্গি চূর্ন-বিচূর্ণ করছে প্রিয়তমার নারীসত্তাকে। ঘোরগ্রস্ত ওই দৃষ্টিতে বেড় লাগায় ইনজাদ। তেঁতে উঠে বলল—
“এখনো বসে আছ তুমি? খাচ্ছ না কেন?”
ঘোর ভাঙ্গে রেহাংশীর। আচ্ছন্ন গলা ভেদ করে সরল উক্তি করল।
“খাচ্ছি।”
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
চেয়ার টেনে রেহাংশীর সান্নিধ্যে বসে ইনজাদ। চলাচলের জন্য তিন ফুটের খালি জায়গাটুকুই বরাদ্দ। কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্বে বসা ইনজাদের অঘোষিত প্রেমাত্মক নজরে আবৃত করে নিল রেহাংশীকে। ছোটো ছোটো লোকমা মুখে দিচ্ছে সে। তার দন্তের ঝিলিক, মেদহীন চোয়ালের বিশেষ ভঙ্গিমা, চোখের পলকের নির্দিষ্ট সীমা, পদ্মকোমল অধরের ভাঁজ। সবকিছুই অবলোকন করছে ইনজাদ। বিছানায় আসন পেতে বসেছে রেহাংশী। কোলের মাঝে থালার স্বগৌরবিত স্থান। রেহাংশীর ঠোঁট নড়ে। দুলে উঠে ইনজাদের বক্ষস্পন্দন। কম্পিত হয় তা তূরন্ত বেগে। প্রিয়তমার অধরপল্লবে নিমগ্ন হওয়ার গহন প্রয়াস তার। ইনজাদ পিঠ আলগা করে। তার শব্দহীন গতি বুঝতে সময় নিল রেহাংশী। ছোট্ট চুমু বসাল রেহাংশীর তুলতুলে গালে। শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল সে। ইনজাদ চোখের বিজলী ফেলল। একটানে রেহাংশীর খোঁপা খুলে বলল—
“এলোকেশী, অবিন্যস্ত চুলে কেড়ে ছিলে কার প্রাণ?
দোহাই তার, মুক্তি দাও, বেঁচে থাকার আহ্বান।
এলোকেশী, ঝরা কেশে জড়িয়ে ছিলে কার শ্বাস?
রজনী জাগিয়া সে তোমায় ভেবেছে অবিরাম।
এলোকেশী, বাড়িয়ে দাও তোমার দুই হাত
বক্ষপিঞ্জিরায় আবদ্ধ হয়ে সে তোমার হয়েই থাক।”
মিষ্টি করে হাসে রেহাংশী। তার চোখে ভেসে উঠে অপ্রতিরোধ্য প্রাণোচ্ছ্বাস। ইনজাদ অধরের কোণ প্রসারিত করে। চেয়ারে গিয়ে বসে পূনরায়। অনুরক্তির সুরে বলল—
“চুল খোলা রেখো। তোমায় ভালো লাগে দেখতে।”
লজ্জানত মুখে মিহি হাসি। ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—
“ভয় লাগছে? আজ কিন্তু অন্ধকারেই ঘুমাতে হবে তোমায়?”
ভুত দেখার মতো চমকিত গলায় বলে উঠে রেহাংশী—
“উহু, আমি অন্ধকারে ঘুমাতে পারব না।”
“আমি কাছে থাকলেও না?”
“কাছে? কতটা কাছে?”
“যতটা কাছে থাকলে তোমার ভয় করবে না।”
ইনজাদের অপ্রকাশিত কথার ধার বুঝতে পারল রেহাংশী। তার ছোট্ট ,গোলগাল মুখটা লাল টমেটোর মতো হয়ে ওঠল। ইনজাদ দুষ্ট হাসে।
,
,
,
সবুজাভ বাতির নরম, ম্রিয়মান, টিমটিমে আলোতে তন্দ্রালুভাবে আচ্ছন্ন দুই নর-নারী। দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে আছে রেহাংশী। জানালার পর্দা ফিরফিরে পবনে দোদুল্যমান। থাই ভেদ করে ভরাট চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণে জ্বলজ্বল করছে তার লতানো দেহ। রেহাংশীর স্থির দৃষ্টি সেই চন্দ্রিমাতে বিদ্ধ।
বিছানার এপাশটায় শুয়ে আছে ইনজাদ। তার পৌরষসত্তা বিক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, বেপরোয়া। এই ছোট্ট কক্ষটায় একসময় শুধু তার নিবাস ছিল। আজ এক জীবন্ত নারীদেহ তার পাশে। চিরায়ত পুরুষালী স্বভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখা এতটা সহজ নয়। সে এতটাও শুদ্ধ পুরুষ নয় যে বিবাহিত স্ত্রীকে পাশে রেখে হাওয়ায় চোখ বুলিয়ে যাবে! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। নিষ্পেষিত অন্তরিন্দ্রিয়তে উচাটনে বিধ্বস্ত ইনজাদ উঠে বসে। তার এহেন কার্য হেতু ঝট করে ভীতিকর এক পরিস্থিতির অনুমান করে উঠে বসে রেহাংশী। ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল—
“কী হয়েছে?”
এ মেয়ে বোকা? কিছু বোঝে না? না কী বুঝেও না বোঝার কঠোর প্রচেষ্টা! অকপট, অবিমিশ্র, শুদ্ধ ছল!
ইনজাদ তাকাল। এক আস্ত নজরে চন্দ্রকিরণের মোহাচ্ছন্ন মায়ায় ঐকান্তিকভাবে চেয়ে রইল পাশের মুক্তকেশীর ওই চন্দ্রাননে। সবুজাভ ক্ষীন বাতি আর চাঁদের আলোর প্লাবনে বিভ্রান্ত সে। হৃদয় কাঁপানো সেই কামিনীর পদ্মাক্ষীর আবছা দৃশ্যতে অস্থির হয়ে উঠে ইনজাদ। চোখ ফিরিয়ে ড্রয়ার হাতরে সিগারেটের প্যাকেট বের করে উঠে দাঁড়ায়। ভয়মিশ্রিত স্বরে উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে রেহাংশী—
“কোথায় যাচ্ছেন?”
ইনজাদ মিইয়ে গলায় প্রত্যুত্তর করে—
“কোথাও না। তুমি ঘুমাও, আমি আসছি।”
“এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”
রেহাংশীর কণ্ঠের ব্যস্ততা বলছে সন্ত্রস্ত সে।
“ঘুমাও তুমি। আমি এক্ষুণি ফিরে আসছি।”
দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে আলুলায়িত পায়ে পায়চারি শুরু করে ইনজাদ। সময় চলতে থাকে। সিগারেট জ্বলতে থাকে একের পর এক।
একসময় থমকায় ইনজাদ। সময় তখন মধ্যরাত্রি। নিজ কক্ষে ফিরে আসতেই অক্ষিযুগল আবদ্ধ হয় রেহাংশীর কোমলাঙ্গ দেহে। অপ্রকৃতিস্থতা কামিনীর দুর্গম কমনীয়তা আচড়ে পড়ছে ইনজাদের চক্ষুদর্পণে। খসে পড়া শাড়ীর আঁচল, হাঁটু অব্দি জড়ানো শাড়ির ফাঁক-ফোকর গলিয়ে নিষিদ্ধ অঙ্গের হাতছানি। ইনজাদ স্থবির। চোখের গতিপথ পরিবর্তন করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আপাতত তার দীর্ঘ ঘুম প্রয়োজন।সুদীর্ঘ ঘুম।
চলবে,,,