#মোহঘোর
#পর্বঃ২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
শেষ দুপুরের ক্লান্ত রোদ। পশ্চিমে হেলতে শুরু করা প্রভাকরের রাক্ষুষে দাপট কমে গেলেও তার আভা ছড়িয়ে আছে শহরতলির পথে-প্রান্তরে। যেন গগনবিদারী রক্তক্ষরণ হচ্ছে পিচঢালা সড়ক পথে!
নিমেষহীন চোখে চেয়ে আছে রেহাংশী। কোণার দিকের টেবিলে বসে থাকলেও তার উদ্ভাসিত, কৌতূহলী আর তাচ্ছিল্য দৃষ্টি আটকে আছে রেস্তোরাঁর মাঝের দিকের সামনের টেবিলে। স্লিভলেস পাতলা টপ আর টাইট জিন্স পরা মেয়েটার শরীরীয় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অত্যন্ত প্রস্ফুটিতভাবে ধরা দিচ্ছে মানুষের বাহ্যিক চোখে। রেহাংশীর এমন অদ্ভুত চাহনিতে বিব্রত হলো ইনজাদ। পেছন ফিরে মেয়েটিকে দেখেই সামনে তাকাল। গলা কেঁশে বলল—
” এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
ধ্যাণ ছুটল রেহাংশীর। চোখ নত করল দ্রুততার সাথে। অস্বস্তি কাটাতে মিইয়ে গলায় বলল—
“কিছু না।”
ইনজাদ হাসল। স্যুপের বাটি থেকে চামচ উঠিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে দিলো। সাবলীল গলায় বলল—
“এভাবে আর কখনো তাকাবে না।”
রেহাংশী চমকিত নজরে মাথা তুলল। মোলায়েম চাহনিতে লজ্জারা ভর করল জোরালো মাত্রায়। ইনজাদ চামচটা বাটিতে রেখে টেবিলের ওপর হাত রেখে নরম গলায় বলল—
” ‘ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কভার’ কথাটা নিশ্চয়ই শুনেছ? কারো উপরিভাগ দেখে তাকে চেনা যায় না। কারো জামা-কাপড় তার চরিত্র মূল্যায়ন করতে পারে না। ”
রেহাংশী লজ্জিত হয়। শহুরে মানুষের চালচলন তার বোধগম্য নয়। মেয়েটির শরীরের সমস্ত খাঁজ এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে। তাকে দেখে অপ্রস্তুত রেহাংশী। সে যে এ বিষয়ে অবগত নয় তা নয়, তবুও দৃশ্যমান ওই অযাচিত দৃশ্য তার মনের কোণে অদ্ভুত আবছায়া তৈরি করল।
ইনজাদ গাঢ় গলায় ফের বলল—
“এই যে তুমি মেয়েটির দিকে তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ! এতে সে বিব্রত হবে। তবে তারচেয়ে বেশি তুমি হবে। তুমি হয়তো ভাবছ, মেয়েটি উশৃঙ্খল ! একচুয়েলী এইটা আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তনের একটা ধাপ। আমরা ওয়েস্টার্ন কালচার ফলো করতে করতে কখন যে নিজের সংস্কৃতি- সভ্যতা পেছনে ফেলে এসেছি তা নিজেও জানি না। শাড়ি পরা অনেকেই এখন সেকেলে ভাবে। কিন্তু একসময় এই শাড়িতে নারী বোঝাত। বিদেশে কেউ যখন শাড়ি পরে বের হয় তখন কিন্তু ওই দেশের মানুষ আমাদের এই সংস্কৃতিকে ভালোবাসার চোখে দেখে। এপ্রিসিয়েট করে। কিন্তু দেশের মানুষ হয়ে আমরা অনেক সময় তার অবমাননা করি। আর ওয়েস্টার্ন কালচার গ্রহণ করলেই যে মনটা ওয়েস্টার্ন হয়ে যায় তা নয়। আজকাল মানুষ কমফোর্টের জন্য বিভিন্ন কিছু ট্রাই করে।
কিন্তু যাই হোক, এইটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আর কখনো এভাবে দেখবে না কাউকে। এতে মানুষের ধারণায় বাজে ইফেক্ট পড়ে। খাও।”
রেহাংশী ঠোঁট গুঁজ করে বলল—
“খাবো না আমি।”
“একটু কিছু তো খাও। স্যুপটা খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে।”
“না, আমার স্যুপ ভালো লাগে না।”
ইনজাদ একটু ধাতস্থ হয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে কিছু বলতে গেলেই ব্যগ্রতায় বলে উঠে রেহাংশী—
“দয়া করে আপনার পান্ডিন্ত্যের দ্বার খুলবেন না। আমি স্যুপ খাবো না।”
অধর ছড়িয়ে হাসল ইনজাদ। নম্র গলায় বলল—
“কী খাবে বলো।”
“কিছু না।”
“কিছু না খেলে কী করে হয় বিষবাণ! এত কষ্ট করে রেস্টুরেন্টে এলে, কিছু তো খাও। আইসক্রিম খাবে?”
রেহাংশী কিছু সময় চুপ থেকে বলল—
“হুম।”
“কোন ফ্লেভার? ম্যাংগো, ব্ল্যাকবেরি, স্টবেরি, ভেনিলা, বাটার স্কচ….।”
“দুর! চুপ করুন তো। এত নাম বলার কী আছে? একটা হলেই হলো।”
ইনজাদ ছোট্ট করে হেসে বলল—
“তোমার কোনটা পছন্দ বলো?”
রেহাংশী ভাবান্তরহীন গলায় বলল—
“কোনোটাই না।”
চোখে হাসল ইনজাদ। রেহাংশী চোখের পল্লব নাচিয়ে তাকাল। চোখা নাক-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠল। ইনজাদ তিমনকে ডাকল। তাকে ম্যাংগো আর বাটার স্কচ ফ্লেভারে আইসক্রিম আনতে বলে। রেহাংশীকে দেখেই চট করেই হাসল সে। তারপর চলে যেতেই রেহাংশী চোখ বড়ো বড়ো করে বলল—
“এই ছেলেটা এখানে কাজ করে? ওর কী পড়াশোনা শেষ? দেখে তো আমার থেকেও ছোটো মনে হয়! এত জলদি পড়া শেষ হলো কী করে?”
“উঁহু, ও এখনো পড়ে। এখানে পার্ট টাইম জব করে।”
“ও।”
তিমন কিছুক্ষণ পর আইসক্রিম নিয়ে আসে। একগাল ফুরফুরে হেসে রেহাংশীর দিকে তাকায়। তার জন্য আলাদা একটা আইটেমও নিয়ে আসে। ক্যাপিচিনো! ইনজাদ মুচকি হেসে বলল—
“কফি কেন এনেছ?”
তিমন মায়াময় হাসল। অল্প বিস্তর গলায় বলল—
“এইট আমার তরফ থেকে ম্যামের জন্য।”
ইনজাদ রেহাংশীর দিকে তাকাল। মৃদুহাস্য অধরে তার দিকে চোখ রেখেই বলল—
” আইসক্রিমের সাথে কফি! হোয়াট আ কম্বিনেশন!”
লজ্জায় গাঢ় হলো তিমনের চোখের দর্পণ। কোমল চোখে চেয়ে কানের লতিতে টান ধরে বলল—
“সরি স্যার।”
“ইটস ওকে। তোমার ম্যাম না খেলেও আমি খেয়ে নেবো। আমার খাওয়া রুচি তোমার ম্যামের তুলনায় ভালো।”
তিমন প্রাণোচ্ছল হেসে রেহাংশীর দিকে তাকিয়ে লজ্জামিশ্রিত গলায় বলল—
“সরি ম্যাম।”
“আরে না, না। কিছু হবে না। আমি খেয়ে নেবো।”
আরেক দফা মন জুড়ানো হাসল তিমন। তার চোখ দুটো খুশিতে টগবগ করে ওঠল।
গলিত আইসক্রিম ঠোঁটের কোণে লেগে আছে রেহাংশীর। ইনজাদ নিগূঢ়, মোহবিষ্ট, আবেশিত নজরে তাকিয়ে আছে। রেহাংশীর অধরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তার বুকের পাঁজরে। মেয়েটার চোখের পল্লবের ওই বঙ্কিম ধাঁচে হাজার দিবস চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ইনজাদ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল। আচানক তার ধ্যাণ ছুটে। শশব্যস্ত হয়ে পেছন ফিরতেই হৈ-হুল্লোড় শুনতে পায়। মেয়েলী তীক্ষ্ম স্বর কাঁচবন্ধ রেস্তোরাঁয় ঝংকার তুলল।
ইনজাদ ব্যগ্র গলায় বলল—
“তুমি বসো, আমি আসছি।”
উদ্বিগ চোখে চেয়ে রইল রেহাংশী। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এলো।
রেস্তোরাঁর সামনের দিকের টেবিলে একটি মেয়ের জোরালো কণ্ঠস্বরে কাঁপন উঠেছে স্টাফদের দেহে। চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। ইনজাদ ব্যস্ত পায়ে এসেই বলল—
“এক্সকিউজ মি! কী সমস্যা আপনার?”
মেয়েটি ফিরে তাকাল। গাঢ় কফি কালারের টপস গায়ে পরা মেয়েটির ধারালো চাহনি, বজ্রের মতো কণ্ঠ আর তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ব। আড় ঠোঁটে দাঁতে দাঁত চাপল মেয়েটি। ইনজাদকে দেখেই ফুঁসে উঠে বলল—
“ও আপনি তাহলে এখানকার ম্যানেজার?”
ইনজাদ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল—
“জি।”
মেয়েটি রাগের অগ্নি বর্ষণ করে বলল—
“হোয়াট দ্যা হেল! এই আপনাদের সার্ভিস? চুল! স্যুপে চুল?”
ইনজাদ গম্ভীর চোখে তাকাল। টেবিলের ওপর আঁখি নিবদ্ধ করে। দৈবাৎ অভূতপূর্ব ঘটণা ঘটল। মেয়েটি টেবিল ক্লথ ধরে একটান মারতেই টেবিলের সব খাবার পড়ে গেল মেঝেতে। ইনজাদ কঠিন শান্ত। মানান পাশ ঘেঁষে এসে চাপা স্বরে বলল—
“ঝামেলা কোরো না ইনজাদ।”
ইনজাদ পুরো রেস্তোরাঁয় চোখ বোলাল। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সকলের উৎসুক চাহনি। ইনজাদ গাঢ় স্বরে চট করে বলে উঠল—
“সবাই শান্ত হোন। কেউ বিচলিত হবেন না। আপনারা সবাই যার যার জায়গায় বসুন।”
মেয়েটির শরীর কাঁপছে। ইনজাদ কোমল চোখে তাকাল। সাবলীল গলায় বলল—
“বলুন, কী সমস্যা আপনার? একদম ডিটেলসে বলবেন। আর বাংলায়। যেন আপনার প্রতিটি শব্দ সকলের বোধগম্য হয়।”
চলবে,,,