#মোহঘোর
#পর্বঃ২৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
হেমন্তের বিষণ্ণ তমাসাছন্ন যামবতী। হিমেল প্রভঞ্জনের সারথি হয়েছে ঝিরিঝির আকাশ কন্যা। তার হিমশীতল স্পর্শ যেন ধরণীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলো। ফোঁটা ফোঁটা ইলশেগুড়ি বৃষ্টিতে সিক্ত হলো ইনজাদ। গায়ের রোম কাটা দিয়ে উঠেছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছে সে। শ্রান্ত, অবসণ্ন, অবস্বাদগ্রস্ত দেহ। ধীরগতিতে কলিং বেলে চাপ দিলো। ক্ষণকাল ব্যয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল ভেতরের অপেক্ষারত প্রাণঘাতীনি কন্যা। রেহাংশীকে দেখেই ইনজাদের সমস্ত ক্লান্তি কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। রেহাংশী গালভর্তি মিষ্টি হাসল। ইনজাদ ভেতরে ঢুকেই উলটো হাতে দরজা ভেজাল। অরবে অধর ছোঁয়াল রেহাংশীর কণ্ঠমনিতে। আপ্লুত, প্রসন্ন হলো রেহাংশী। নরম হাসিতে পদ্মকোমল ঠোঁটে আলোড়ন তুলল। ইনজাদ সতেজ গলায় বলল—
“পারফিউম দিয়েছ কেন? তোমাকে না বলেছি পারফিউম দেবে না। তোমার শরীরের ঘ্রাণ-ই আমার ভালো লাগে।”
ইনজাদ জুতো খুলে রেকে রাখল। রেহাংশী দরজার লক লাগাতে লাগাতে বলল—
“পারফিউম দেইনি তো?”
ইনজাদ কিঞ্চিৎ কৌতূহলে আচ্ছন্ন হয়ে বলল—
“তাহলে অন্যরকম লাগল কেন?”
রেহাংশী ঠোঁট চিপে হাসে। ইনজাদ দ্বিধান্বিত হয়। নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়িয়ে বলল—
“বুঝতে পেরেছি।”
স্বামীর পিছু নিল রেহাংশী। ইনজাদ হাতের ছোটো ব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল। শার্টের বাটন আলগা করতে করতে বলল—
” এত খুশি কেন? স্পেশাল কিছু?”
রেহাংশীর চোখে-মুখে প্রানোচ্ছ্বাস। খিলখিল করে হাসছে তার কোমল আনন। ইনজাদ বিভ্রান্ত হলো। ঐৎসুক্য গলায় বলল—
“হয়েছে টা কী আজ বিষবাণের? নতুন শাড়ি, এত খুশি? কেন বিষবাণ?”
রেহাংশী ঝকমকে হেসে ফাঁপা স্বরে বলল—
“আজ আম্মা ফোন করেছিল। কথা বলেছে আমার সাথে।”
ইনজাদ বিস্মিত হলো না। তবে সে চমকিত হলো এই মেয়ের কান্ড দেখে। বিগত আড়াই মাসেও তমালিকা রেহাংশীর সাথে কথা বলেনি। ইনজাদের সাথে কথা হয়। তাও অফিস টাইমে। কিন্তু এই মেয়ের উচ্ছ্বাস! যেন বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারে ভাসিয়ে নেবে সব!
ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—
“কী বলেছেন আম্মা?”
“আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছে।”
“আমার কথা?”
“হ্যাঁ। আপনি ঠিক মতো খাচ্ছেন কি না, ঘুমাচ্ছেন কি না, কাজে যাচ্ছেন কি না, আপনার শরীর….।”
“আর তোমার?”
সহসা থেমে গেল তোতাপাখি। যে পাখির মায়ায় পড়েছে ইনজাদ। রেহাংশী চুপ হয়ে গেল। নিমগ্ন দৃষ্টি তার মেঝের শুভ্র বুকে। ইনজাদ ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে প্যাকেটটা হাতে নিল। শান্ত পায়ে এগিয়ে এলো। রেহাংশীকে বিছানায় বসাল। মেঝেতে হাঁটু ঠেসে তার সামনে বসল ইনজাদ। গাঢ় নীল রঙের সোনালী পাড়ের প্যাকেট থেকে একটা বক্স বের করে তা রেহাংশীর হাতের তালুতে দিলো। স্বাভাবিক সুরে বলল—
“দেখোতো এইটা পছন্দ হয় কি না।”
রেহাংশী বাচ্চাদের মতো উদগ্রীব হয়ে বলল—
“কী?”
“নোজ রিং। খুলে দেখো।”
রেহাংশী আলতো হাতে ছোট্ট নাকের ফুলটা হাতে নেয়। সাদা রঙের পাথরের ঝলকানিতে চোখের পাতায় খুশি উছলে উঠে তার। রেহাংশী অধৈর্য গলায় বলল—
“পাথরের?”
“না, ডায়মন্ড।”
“ও বাবা! তাহলে তো অনেক দাম।”
ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। আদুরে গলায় বলল—
“আমার বউয়ের চেয়ে বেশি না। মাত্র টুয়েন্টি ওয়ান থাউজেন্ড।”
রেহাংশী চোখে কোটর প্রস্ফুটিত করল তূরন্ত বেগে। বিস্ফোরিত গলায় বলল—
“একুশ হাজার!”
“হ্যাঁ, তো?”
“এত দাম দিয়ে আনলেন কেন? আমার তো একটা সোনার আছে।”
“তাতে কী? বিয়েতে যাবে না। তাই। দাও পরিয়ে দেই।”
রেহাংশী সংকীর্ণ সুরে বলল—
“থাক, আমি পরে নেবো।”
“আমি পরিয়ে দিই।”
“উঁহু। লাগবে না।”
রেহাংশী ইনজাদের ফুলে উঠা বাহুতে হাত দেয়। বুকের কাছে হাত নিয়ে বলল—
“আপনার শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে। যান, হাত-মুখ ধুয়ে জামা পরে নিন।”
ইনজাদ মিষ্টি হেসে ফিচেল গলায় বলল—
“কেন? কন্ট্রোল হচ্ছে না বুঝি!”
রেহাংশী দুর্বল ধাক্কা মেরে বলল—
“দুর! যান তো।”
ইনজাদ একটু উচু করে হাঁটু। রেহাংশীর নাকের ডগায় আঙুল ছুঁইয়ে বলল—
“যাচ্ছি। এইটা পরে নাও। আর খাবার বাড়ো। খিদে পেয়েছে আমার।”
রেহাংশী মাথা ঝাঁকায়। ইনজাদ উঠে চলে যায় সোজা ওয়াশরুমে। রেহাংশীর অবনত চাহনি তখন তার হাতের তালুতে। জ্বলজ্বল করতে থাকা নাকের ফুলে। এত দামি জিনিস সে আগে কখনো পরেনি। এই মানুষটা তাকে এত ভালোবাসে কেন? এত খেয়াল রাখে কেন? কোনো কিছু না চাইতেও যেন ডালা ভরা সুখ তার আঁচলে ঢেলে দেয়। রেহাংশীর নানী তাকে গল্প শোনাত। রূপকথার গল্প। রূপকথার রাজকুমার নাকি রাজকুমারীকে খুব ভালোবাসে! রেহাংশীর মনে হতো সব মিথ্যে, বানোয়াট কাহিনী। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব রূপকথা মিথ্যে হয় না। তার জীবনে সত্যিই রাজকুমার এসেছে। যে তাকে আকাশসম ভালোবাসে, সায়রের ন্যায় গভীরভাবে তাকে কাছে টানে, পাহাড়ের মতো অটল হয়ে তার পাশে থাকে। রেহাংশীর চোখ ছলছল পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ে। এত সুখ তার কপালে ছিল বলেই কী তার সব শেষ হয়ে গিয়েছিল?
,
,
,
ইনজাদ খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত। রেহাংশীর থমথমে মুখচ্ছবিতে তাকিয়ে বলল—
“তোমাকে না বলেছি খেয়ে নিতে। আমার দেরি হলে বসে থাকো কেন?”
রেহাংশী নতমুখে বিরস গলায় বলল—
“একা একা খেতে ভালো লাগে না।”
“তাহলে দোকা করে দিই। আরেকটা বিয়ে করে তোমার জন্য সাথী নিয়ে আসি।”
রেহাংশী মাথা তুলল। চকচক করছে তার দৃষ্টি। খাবারের প্লেট তার সামনেই। তবুও তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। রেহাংশীর প্রদীপ্ত চাহনিতে হেসে ফেলল ইনজাদ। চাটুকদার গলায় বলল—
“জাস্ট কিডিং! তোমাকে হজম করতেই অবস্থা যায় যায় আমার, এখন আরেক ঝামেলা, নো চান্স! খাও।”
রেহাংশীর মুখের কালো আঁধার আরও ঘনীভূত হলো। ইনজাদ ত্রস্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে —
“কী হয়েছে তোমার?”
“আপনি আম্মা- বাবার জন্য কিছু আনেননি কেন?”
অধরে কোণ টেনে নিল ইনজাদ। সরল গলায় বলল—
“আমার মোবাইলটা নিয়ে আসো। টেবিলের ওপর রেখেছি।”
রেহাংশী চেয়ার থেকে উঠে হাঁটা ধরে। কিছু সময় পর মোবাইল ফোন নিয়ে ফিরে আসে। চেয়ার টেনে বসে টেবিলের ওপর হাত রেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ইনজাদের দিকে। ইনজাদ মোবাইলে কিছু একটা বের করে রেহাংশীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—
“এইটা দেখো।”
রেহাংশী উৎসাহ নিয়ে মোবাইল নিয়ে নেয়। চমকিত গলায় বলল—
“চুড়ি?”
“না, বালা। এগুলোক বালা বলে। আম্মার জন্য অর্ডার করেছি। ”
“আর বাবার জন্য?”
“বাবার অনেক দিনের শখ একটা কাশ্মীরি শালের। আমার এক বন্ধুকে বলেছি। বাড়ি যাওয়ার আগে দেবে বলেছে।”
ইনজাদের খাওয়া শেষ। খালি প্লেটটা হাতে নিয়ে বেসিং এর সামনে যায়। রেহাংশী অপলক চেয়ে আছে মোবাইলের ছবিটার দিকে। হাত ধুয়ে এসে রেহাংশীর পাশে রাখল প্লেট ইনজাদ। রেহাংশীর কাঁধে চিবুক রেখে দুই পাশে হাত রাখে। সশব্দে বলল—
“পছন্দ হয়েছে?”
রেহাংশী অস্ফুট স্বরে বলল—
“হুম।”
“লাগবে?”
“উঁহু।”
ইনজাদ মুচকি হাসল। সচল গলায় বলল—
“চিন্তা কোরো না। কিনে দেবো। দশটা না, পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। কিন্তু এই মাসে হবে না। অনেক খরচ হয়েছে এ মাসে। সামনের মাসে দেবো।”
রেহাংশী ভাবনাহীন মস্তিষ্কে চট করে বলল—
“কত দাম?”
ইনজাদ সোজা হলো। কক্ষের দিকে পা বাড়িয়ে বলল—
“বেশি না। লাখ খানেক। ”
আঁতকে উঠে রেহাংশী। তার মানসপটে ভেসে উঠে সেই দিন। দুমুঠো কাঁচের চুড়ির জন্য তার মামি তাকে কত কথা শুনিয়েছে! আর আজ অদৃষ্ট তাকে লাখ টাকার সোনার বালার স্বপ্ন দেখায়!
রান্না ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করে কক্ষে আসে রেহাংশী। দৈবাৎ শিরশিরে হাওয়া তাকে আলগোছে ছুঁইয়ে গেল। বারান্দার থাই খোলা। হুরহুর করে বাতাস ঢুকছে। ইনজাদ সিগারেট টেনে যাচ্ছে। রেহাংশী কোমল হাসে। মানুষটার হাজার ভালো অভ্যাসের মাঝে এই একটা বাজে অভ্যাস। তবে অনেকটা কমে এসেছে। রেস্তোরাঁর দরজার পাশে বড়ো করে লেখা ‘নো স্মোকিং’। ম্যানেজার হয়ে নিয়মের বরখেলাপ তো করতে পারে না। তাই এই রাতটুকু নিজের ইচ্ছে মতো ব্যয় করে ইনজাদ। রেহাংশী প্রতিক্রিয়া করে না। প্রথম প্রথম অসহ্য লাগলেও এখন অনেকটা সয়ে নিয়েছে সে। ইনজাদ যখন বুকের মাঝে তাকে টেনে নেয় তখন এক অদ্ভুত মাদকে আসক্ত হয় রেহাংশী। আর কিছু তার ভাবনাতে আসে না। আলগোছে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। থাকনা মানুষটার কিছু বদ অভ্যাস। তাকে তো নিয়ম করে ভালোবাসে, খুব যত্ন করে হৃৎকুঠিরে জায়গা দিয়েছে, প্রণয়ে আসক্ত করেছে, আর কী চাই জীবনে সুখী হতে? রেহাংশী আর কিছুই চায় না। এই মানুষটার বক্ষস্থলেই শীতল পাটির মতো জড়িয়ে থাকতে চায়। নির্ঘুম রাতের আলো-আঁধারের সারথি হতে চায়। জারকাটা দেওয়া শীতের রাতের উম হতে চায়। দু’চোখের পাতায় জাগ্রত স্বপ্ন হতে চায়। সারাজীবন তার হৃৎযন্ত্রের কম্পন হয়ে থাকতে চায়। এ জীবনে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। রেহাংশীর আঁখিযুগল নিভে আসে।
ইনজাদ ভেতরে প্রবেশ করে। হাওয়ায় শীতলতা। রেহাংশী পাতলা চাদর জড়িয়ে রেখেছে গায়ে। তাই দেখে বারান্দার থাই টেনে দিলো ইনজাদ। ধীরপায়ে এসে প্রথমে হলুদাভ বাতি জ্বালালো। কৃত্রিম উজ্জ্বল বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। রেহাংশী আড়ষ্ট হয়ে রইল। তার ঘুমো ঘুমো চোখ। দেহের অভ্যন্তরে শীতল স্পর্শে জাগ্রত হলো ইন্দ্রিয়।
চলবে,,,