মোহঘোর”পর্বঃ৩০

0
533

#মোহঘোর
#পর্বঃ৩০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সতেজ, প্রাণবন্ত প্রভাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আবেশে লুপ্ত বসুন্ধরা ঝিমিয়ে আছে এখনো। মিহি কুয়াশার চাদর আদরে লেপ্টে রেখেছে তাকে। হিম,হিম শীতল পরশ এঁকে যাচ্ছে থম ধরা পৃথিবীর ঘুমন্ত পরিবেশে। স্বচ্ছ বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির জমেছে পাতার বুকে।

নিজেকে শাড়ির ভাঁজে আবৃত করেছে রেহাংশী। শুভ্র টাইলসের ঘরে যেন শীতলতার রাজা রেগে আছেন! তার হুংকার ছড়ানো শীতলতা। হিমশীলার এক অদৃশ্য অনুভূতি।

রান্না ঘরে অতি সাবধানে পা রাখে রেহাংশী। তমালিকা বেলন-পিঁড়িতে ব্যস্ত। ইতি-বিতি করছে রেহাংশীর মনকুঠির। গলার কথা দাঁতের কাছে এসে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে বারংবার। রেহাংশী শ্বাস ফেলল। তার উপস্থিতিতে তমালিকার ভাবান্তর হলো না। রেহাংশী কণ্ঠ শিথিল রেখে জড়তা নিয়ে বলল—

“আম্মা, আমি রুটি বানিয়ে দিই?”

রেহাংশীর বুকটা দুরুদুরু করছে। সকাল সকাল তমালিকার উত্তাপে সে পড়তে চায় না। তবুও…।
রেহাংশীকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তমালিকা। রেহাংশীর বুকের ভেতর যেন রঙধনু উঠে গেল বিনা বর্ষণে! সে চট করে বসে পড়ল। তমালিকা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন রান্নাঘরের তাক ঘেঁষে। রেহাংশী ইতস্তত বোধ করছে। তমালিকার স্থির, সরল, গভীর চাহনি তাকে কেমন অস্বস্তিতে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তবুও নিজের কাছ সারলো সে। গরম তাওয়ায় যখন রুটি দিলো রেহাংশী আচানক তমালিকা আড়ষ্ট গলায় বললেন—

” ইনজাদ তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না?”

একটা সরল বাক্য কেমন অদ্ভুত শোনাল রেহাংশীর কাছে। সে স্তব্ধ হয়ে চাইল। তমালিকার চোখে অপরাধবোধের ঢেউ উঠেছে। তিনি কাছে এগিয়ে এসে রেহাংশীর মাথায় হাত রাখলেন। গভীর মমতায় জাগ্রত মাতৃত্বের অবাধ স্বরে বললেন—

“আমার একটাই ছেলে। পড়ালেখার জন্য ওকে বেশি একটা কাছে পাইনি। ওর খেয়াল রেখো। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই তোমার কাছে।”

অরবে বুক কেঁপে যাওয়া রেহাংশী ঝমঝম করে কেঁদে ফেলল। তমালিকাকে জড়িয়ে ধরল গভীর আবেশে।
,
,
,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা গুটালো ইনজাদ। ভেতরে ঢুকল রেহাংশী। তার জলপুকুরের জলোচ্ছ্বাস চলছে। ইনজাদকে সময় না দিয়েই তার বুকে হামলে পড়ে। বুক ভাসানো কান্নায় ভিজিয়ে তুলে তার বক্ষদেশ। ইনজাদ আলতো হাত রাখে রেহাংশীর পিঠের ওপর। স্বাভাবিক গলায় বলল—

“কী হয়েছে? আম্মা কিছু বলেছেন?”

রেহাংশী ফুঁফাতে লাগল। কণ্ঠরোদ হয়ে এলো তার। জমাট গলায় বুকের পাঁজর ঝাকিয়ে বলল—

“আম্মা আপনার খেয়াল রাখতে বলেছেন।”

ইনজাদ নরম হাসল। দুই হাতে দৃঢ় চাপে বুকে গেঁথে নিল রেহাংশীকে।

“বলেছি তো, আমার আম্মা এমন নন। একবার তার মনে জায়গা করে নাও, আমার চেয়ে বেশি তোমায় ভালোবাসবেন।”

“হুম।”

“চেঞ্জ করবে?”

“না।”

“তাহলে যাও। দেখা করে এসো। আমি আসছি।”

রেহাংশী মাথা সরিয়ে উঁচু করে বলল—

“আপনি যাবেন না?”

ইনজাদ ফিচেল হেসে বলল—

“প্রথমবার শশুর বাড়ি যাচ্ছি। খালি হাতে যাওয়া যায়?”

“কী আনবেন?”

“তোমাকে বলব কেন?”

রেহাংশী মৃদু হাসল। মিষ্টি করে বলল—

“আম্মাকে নিয়ে যাব?”

“না, তুমি একাই যাও। আম্মা সন্ধ্যায় যাবেন।”

“আচ্ছা।”

ইনজাদ ঠোঁট চিপে মাথা হেলায়। ইনজাদ থেকে সরে এসে দরজার কাছে যেতেই স্বামীর কণ্ঠে পেছন ফেরে রেহাংশী।

“ও বাড়িতে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?”

রেহাংশী ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে এসে ইনজাদকে শেষ বিকেলের রোদের মতো আঁকড়ে ধরে। যেন ছেড়ে দিলেই সাঁঝ বেলার আঁধারে মিলিয়ে যাবে!

“আমি আপনাকে এ জীবনে ভুলতে পারব না।”

“আমিও তোমাকে ভুলতে দেবো না বিষবাণ।”

রেহাংশীর সন্নিকটে এসে নিজের সংসর্গে দলিত করে তাকে। ঘনশ্যামের মাঝে দোল খেলানো হিম বায়ুর মতো ফুরফুরে কণ্ঠে বলল—-

“ও স্বয়ংপ্রভা!
আমার রিক্ত দিবসের ঘন আভা, আমার বদ্ধ হৃদয়ের অকুন্ঠিত প্রজ্জ্বলিত শিখা, আমার আঁধার আকাশের সুধাবর্ষী;
যার বিগলিত কিরণ চুইয়ে পড়ে আমার প্রকোষ্ঠে, যার চন্দ্রানন ভেসে উঠে আমার শতবর্ষের পূন্যে, আমার আজীবনের আবাস, তোমার কাঁপন ধরা প্রণয়েই আমার নাশ!”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here