#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পড়ন্ত বিকেলের ম্লান ছটা! শুভ্র কুয়াশার শামিয়ানা টুকটুক করে তার আবরণ তৈরি করছে। দিবসের শেষ ভাগ পৌঁছেছে পশ্চিমাদেশে। বসন্তদূতের আচানক ডাকে সরব হলো বিষন্ন বিকেল।
পায়েলের সাজ শেষ পর্যায়। পাড়ার মেয়েরা তাকে সাজিয়েছে আপন ভঙ্গিমায়। প্রশস্ত চোখে চেয়ে আছে রেহাংশী। সে অবশ্য বিয়েতে সাজতে পারেনি! তার বিয়ে নামক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সে আয়ত্ত করে ফেলেছে। এখন শুধু তার প্রয়োগ চলছে। নীরব শ্বাস ফেলে সে।
নুহাশদের বাড়ি থেকে যে গহনা পাঠানো হয়েছে তা পরিয়ে দিচ্ছে তার মা সীমা। ফুফুর দিকে কাতর দৃষ্টিতে চেয়েও কোনো মূল্য পায়নি রেহাংশী। সাজানো শেষ হলে বাড়তি লোকজন কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। রেহাংশী পায়েলের সন্নিকটে গিয়ে বসল। চোখ ভর্তি খুশি নিয়ে সীমাকে বলল—
“কেমন আছ ফুফু?”
সীমা কাষ্ঠ গলায় বললেন—
“ভালো।”
“ফুফাকেও নিয়ে আসতে!”
খলবলিয়ে উঠলেন সীমা। বললেন—
“কেন? তাকে পঙ্গু করে খায়েশ মিটেনি, এবার যেন পুরো মেরে ফেলতে পারিস সেটাই ভাবছিস!”
রেহাংশী কেঁপে ওঠল। পায়েল নীরব চোখে চাইল। রেহাংশী চোখে হেসে ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল তরল হাসি। আজ তার খারাপ লাগছে না। আমাদের মন খারাপ করতে নেই। যে মানুষগুলো আমাদের ভালোবাসে, আমাদের তাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত; না কী যারা আমাদের অবজ্ঞা করে! জরুরি নয় পৃথিবীর সব মানুষ আমাদের সমানভাবে ভালোবাসবে!
রেহাংশী সরস চোখে চাইল। উবে গেল তার মন খারাপের কালো মেঘ। সেখানে জায়গা করে নিল এক আকাশ নীলাভ, শুভ্র, স্বচ্ছ জলদ।
পায়েলের সামনে থাকা ভারী হারটা হাতে নিল রেহাংশী। প্রসন্ন গলায় বলল—
“এইটা তো বেশ ভারী! জানো এখন সোনার দাম বেড়েছে? আম্মার জন্য একজোড়া বালা এনেছেন তিনি। দাম কত জানো! এক….।”
কথার মাঝেই রেহাংশীর হাত থেকে বেখেয়ালে হারটা নিচে পড়ে যায়। পায়েল আঁতকে ওঠে। সীমা চিৎকার করে উঠে বলল—
“এইটা কী করলি তুই?”
রেহাংশী ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে বিহ্বল হয়ে মেঝে থেকে হারটা তুলে নিল। কলিজা লাফিয়ে উঠল তার। হারের নিচের খাঁজ কাটা ডিজাইনটা ভেঙ্গে যায়। সীমা সরোষে বললেন—
“দেখলি, দেখলি তুই! বলেছি না, এই মেয়ে যেখানে যাবে একটা অঘটন ঘটাবেই!
রেহাংশী ত্রস্তে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। আমতা আমতা করে বলল—
“আমি ইচ্ছে করে করিনি ফুফু। মাফ করে দাও।”
আক্রোশে ফেটে পড়লেন সীমা। স্বামীর ওই অবস্থা দেখেও ছোট্ট রেহাংশীকে তখন তিনি কিছুই বলতে পারেননি। তবে আজ আর রুখতে পারলেন না নিজেকে। সজোরে এক থাপ্পড় বসালেন রেহাংশীর গালে। শিউরে উঠল পায়েল। দরজার কাছে দাঁড়ানো ইনজাদকে দেখে তার গলা শুকিয়ে এলো। রক্তিম চোখ জোড়া যেন সবকিছু ছাই করে দেবে!
ইনজাদ সংক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠে—-
“আপনার সাহস কী করে হলো ওর গায়ে হাত তোলার?”
সীমার কম্পিত দেহে টান পড়ে। তিনি ক্ষুব্ধ চোখে চাইলেন। ইনজাদকে আজ -ই তিনি প্রথম দেখেছেন। ইনজাদ দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে এলো। ফুঁসে যাচ্ছেন সীমা। পায়েল পাথর বনে গেল। রেহাংশীর নতমুখে প্রকট হলো অসহায়তা।
ইনজাদ রুষ্ট গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—
“ওর গায়ে হাত কেন তুললেন?”
রাগে অস্থির ইনজাদের মুখের ভঙ্গিতে ঘাবড়ে যায় সীমা। তার কণ্ঠনালী বাক হারিয়ে ফেলল। তিনি বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে মিইয়ে সুরে বললেন—
“ওওওও….।”
ফুঁসলে উঠে ইনজাদ। ক্রোধান্ধের মতো বিছানার ওপর থাকা নুহাশদের বাড়ি থেকে আসা জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দেয়। কক্ষের বিভিন্ন আসবাবপত্র তার রাগের স্ফুলিঙ্গে ঝলসে ওঠে। চিৎকার -চেঁচামেচিতে তমালিকা, পারভেজ মির্জাসহ নুপূরের বাবা-মা এসে দাঁড়ান। ঘরভর্তি মানুষের সামনে ক্রোশভরা কণ্ঠে দাপিয়ে উঠে ইনজাদ।
“আপনার সাহস কী করে হয় ওর গায়ে হাত তোলার? ভেবেছেন কী আপনারা? আমি কিছুই জানি না। একটা অসহায় মেয়ের সাথে যা নয় তা করেছেন আপনারা। ”
ছুটে আসে এহসাস। রওশন আরাও টলতে টলতে এসে দাঁড়ালেন। ইনজাদের গলার স্বর গর্জনে পরিণত হলো। রেহাংশী স্থির নয়ন দিয়ে জল ঝরছে। ইনজাদ বিক্ষুব্ধ গলায় বলল—
“সব শুনেছি আমি। একটা আট বছরের মেয়েকে ভাবতে বাধ্য করেছেন যে ও নিজেই ওর মায়ের খুনি! নিজের ছেলের অপকর্মকে থামাতে না পারে তার মেয়ের ঘাড়ে ছেলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সব দোষ চাপিয়ে দিলেন!
আর আপনি কী করেছেন? মিসেস খন্দকার তার আদরের মেয়ের কুকীর্তি লুকাতে রেহাংশীর জীবন বিষিয়ে তুলেছেন। ওর জীবনটা হেল করে দিয়েছেন আপনারা। আজ কোন সাহসে হাত তুললেন আপনি? সেদিন রেহাংশী না হয়ে যদি পায়েল হতো তাহলে কী করতেন আপনি? ছেলের বউ বানাতেন ওকে?”
উপস্থিত জনতারা নির্বাক। পারভেজ মির্জা দমে রইলেন। এহসাস পকেটে দু হাত গুঁজে বাকা হাসল। পুলকিত সে। সীমা অপ্রস্তুত হলেন। তিনি ভাবতে পারেননি ঘটনার বিস্তৃত এতটা ভয়ংকর হবে!
ইনজাদ ঝপ করে রেহাংশীর হাত চেপে ধরল। কায়া কাঁপিয়ে তার দিকে চাইল রেহাংশী। ইনজাদ আত্মগৌরবের সাথে বলল—-
“রেহাংশী স্ত্রী হয় আমার। ওর গায়ে হাত তোলা তো দূর, ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও দশবার ভাববেন। অনাথ নয় ও। আপনাদের যা আছে, তার থেকে তিনগুন বেশি আছে ওর। আর কোনোদিন যদি ভুলেও ওর গায়ে হাত তোলার কথা স্বপ্নেও ভেবেছেন, ভুলে যাব আমি আপনারা বয়সে আমার থেকে বড়ো। এসো রেহাংশী। আজকের পর যেন এই বাড়ি আসার কথা আমি তোমার মুখ থেকে না শুনি। তাহলে সারাজীবনের জন্য আমাকে হারাবে তুমি।”
আড়ষ্ট রেহাংশীর হাত টেনে নিয়ে চলল ইনজাদ। বাকরুদ্ধ প্রতিটি মানুষ শুধু বিবশ চোখে চেয়ে রইল।
,
,
,
বিছানায় এলোপাথাড়ি শুয়ে আছে ইনজাদ। রাগে তার মস্তিষ্কের দুই পাশ টনটন করছে। মাথার নিচে হাত রেখে নিমীলিত চোখে শান্ত হয়ে আছে। নিশ্চল হয়ে তার পায়ের কাছটায় বসে আছে রেহাংশী। আচানক গটগট করে বলল—
“এমন করলেন কেন আপনি? কী দরকার ছিল এসব করার? পায়েল আপুর বিয়ের সমস্ত জিনিস ভেঙ্গে ফেলেছেন!”
ইনজাদ সপ্রতিভ হলো। শিরায় শিরায় উষ্ণ লহুতে গতি বাড়াল। ঝট করে উঠেই রেহাংশীর দুই গাল চেপে ধরে। হিনহিনে গলায় বলল—
“কী সমস্যা তোমার? কেন কিছু বললে না তুমি? একটা প্রশ্ন করেছিলাম তোমাকে আমি। সেই কারণে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলে তুমি! একবারো ভাবনি আমার কেমন লেগেছে। আর আজ! কেউ তোমার গায়ে হাত তুলল, আর তুমি চুপ করে রইলে। আমি খাওয়াবো, আমি পরাব আর আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলবে বাইরের মানুষ! এত সাহস! ”
রেহাংশী কঁকিয়ে ওঠল। চোয়ালের ব্যথায় তার চোখ দিয়ে জলস্রোত নেমে এলো। ইনজাদ শান্ত হলো। রেহাংশীর গাল ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে বিছানায় ভর দিয়ে হেলান দিয়ে বসল। শীতল গলায় বলল—
“আর কখনো যেন এমন না হয়। আমার বিষবাণ অবলা নয়!”
ইনজাদ উঠে দাঁড়াল। তাকে অনুসরণ করে উঠে দাঁড়াল রেহাংশী। উৎসুক গলায় বলল—
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“মাথা ধরেছে আমার।”
তটস্থ পায়ে কক্ষ থেকে বের হলো ইনজাদ।
চলবে,,,