#মোহঘোর
#পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সূর্যের দামাল আভা মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে কিঞ্চিৎ নেমে এসেছে। তার তপ্ততায় হাঁপিয়ে উঠেছে ধরণী। গনগনে বিবস্নানের উত্তপ্ততা বিষিয়ে তুলছে ধরনীস্থ মানুষের জনজীবন।
কাঠের জানালার কপাট খোলা। হুরহুরে দক্ষিণা পবনের শীতলতা। খাটের একপাশে বসে আছে রেহাংশী। ভরা পেটে অতি সাবধানে পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে পারুল। তার হাতে মাঝারি সাইজের একটা ট্রে। রেহাংশী দেখতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে তার হাত থেকে ট্রে নিয়ে নেয়। অস্থির হয়ে বলল—
“তোকে কে বলল এসব করতে? বস এখানে।”
পারুল স্নিগ্ধ হাসল। ক্লান্ত, ভারী শরীরে প্রশান্তির হাসি। তাকে খাটের ওপর বসায় রেহাংশী। ট্রে টা পড়ার টেবিলের কোণায় রেখে মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল—
“তোকে এসব কে করতে বলেছে? আমি কী খেতে এসেছি?”
পারুল মুচকি হেসে বলল—
“আমি কী বলেছি তোকে তুই খেতে এসেছিস! মেহমানকে বুঝি নাশতা দিতে হয় না?”
“আমি কী মেহমান?”
“না, তুই আমার সতীন।”
খিলখিলিয়ে উঠে দুই বান্ধবী। পল ব্যয়ে চুপ হয়ে যায় পারুল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“বিয়েতে আছিসনি কেন তুই? আমি কত আশা করেছিলাম!”
রেহাংশী স্বাভাবিক হেসে বলল—
“বিয়ের সময় আসলে কি এখন আসতে পারতাম? পারতাম না।”
পারুল রুষ্ট হয়ে বলল—
“বাজে কথা বলিস কেন? ওসব আমি বিশ্বাস করি না।”
রেহাংশী ঝলমলে হাসে। তার অন্তঃকরণের ব্যাথা চাপা পড়ে সেখানেই। অমায়িক গলায় বলল—
“তুই না করিস, সবাই তো করে। তাতে কী? বিয়েতে আসিনি তো। এখন তো এসেছি। বাবুকে দেখতে। এই কত মাস রে। তোকে তো পুরো ফুটবল লাগছে।”
পারুল মোলায়েম হাসে। চোখে তারায় খুশি নিয়ে বলল —
“আট।”
রেহাংশী ঠেস মেরে বলল—
“এত জলদির কী ছিল রে? বিয়ে হয়েছে তো একবছরও ঠিক করে হয়নি।”
চোখ লুকোয় পারুল। লজ্জামিশ্রিত গলায় বলল—
“হয়ে গেছে। আল্লাহর ইচ্ছে। ”
“হু, তোরে বলছে।”
পারুল ঠোঁট চিপে লজ্জা লুকোয়। আচমকা ভ্রূ নাচিয়ে বলল—
“কাকীমা তোকে একা আসতে দিলো?”
রেহাংশী ঝুমঝুমিয়ে হাসে। হেসে হেসে বলল—
“মেম্বারের ছেলের বউ হচ্ছি। একটা ভাব আছে না!”
পারুল আঁতকে উঠে বলল—
“কী বলছিস তুই?”
সানন্দে বলে উঠে রেহাংশী—-
“হ্যাঁ। বড়ো আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
“তাই বলে রতন গুন্ডার সাথে?”
“গুন্ডা বলছিস কেন? ও তো এখন ভালো হয়ে গেছে। আর আমি কোন রাজকন্যারে? যে আমার জন্য ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার আসবে!”
পারুলের মন ক্ষুণ্ণ হয়। জ্বলন্ত মোমবাতি যেন ক্ষীণ হাওয়ায় নিভে গেল। মন খারাপ করে বলল—
“তুই বিয়েতে রাজি?”
শব্দ করে হেসে উঠে রেহাংশী। চাপা গলায় বলল—
“হবো না কেন? আমার মতো অপয়াকে কেউ বিয়ে করবে এই তো ঢের! তার আবার রাজি হওয়া আর না হওয়া কী!”
পারুলের নেত্রযুগল সিক্ত হয়। ভার গলায় বলল—
“তুই সত্যিই ওই রতন গুন্ডাকে বিয়ে করবি?”
রেহাংশী সচল চোখে তাকায়। মৌনতার দ্বারে কড়া নেড়ে বলল—
“হুম।”
পারুল ক্ষুণ্ণ গলায় বলল—
“প্লিজ এমন করিস না।”
রেহাংশী স্বাভাবিক গলায় বলল—
“দুর! তুই এত ইমোশনাল হচ্ছিস কেন? বিয়ের এখনো অনেক সময়। ততদিনে রতন ভালো হয়ে যাবে। আরে ঘরে বউ থাকলে ডাকাতও মসজিদের ইমাম হয়ে যায়। আমাকে নিয়ে এত ভাবিস না।”
রেহাংশীর শ্লেষাত্মক কথার ধার পারুল বুঝতে পারল। বাধ্য হয়ে এই বিয়েতে রাজি সে। অবশ্য করার কিছু নেই। তার বাবাও তো আসবে না এই বিয়ে বন্ধ করতে। একা রেহাংশীর ক্ষমতা কোথায়?
রেহাংশী ফিক করে হেসে ফেলে। যারপরনাই অবাক হয় পারুল। মেয়েটা এতকিছুর মধ্যে হাসে!
সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ে পারুল—-
“দেরি কেন?”
“নুপূর আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে তো।”
পারুল একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—
“কার সাথে?”
“ওই যে আমাদের বাড়ির সামনে যে নতুন বাড়িটা হয়েছে ওই বাড়ির ছেলে। ”
“ছেলে কী করে রে?”
“তা জানি না। তবে শহরে থাকে। ”
“ও। বিয়ে কী ঠিক হয়েই গেছে?”
“উঁহু। তার মা এসেছিল বড়ো আম্মুর কাছে। চাচী বলেছে তার ছেলের সাথে কথা বলে সব পাকাপাকি করবে।”
পারুল পেলব গলায় বলল—
“তুই কী নুপূর আপুর বিয়েতেও থাকবি না?”
এক মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত পথিকের দৃষ্টির ন্যায় পারুলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেহাংশী। তার কোমল চিত্তের হৃদয়ভেদী আর্তনাদ হাসিতে এক পলকে উড়িয়ে দিয়ে বলল—
“জানি না তো। থাকতে দিলে থাকব। না হলে নানুর বাড়ি চলে যাব। মামী অবশ্য রাগ করবে। তবে ফিরিয়ে দেবে না।”
খিলখিলিয়ে উঠে রেহাংশী। তার বুকের গহ্বর এখন ম্যাজিক খাতার মতো। যাতে তার কষ্টগুলো খুব যতন করে সে লিখে। কিন্তু মুহূর্তেই তা কর্পূরের ন্যায় উবে যায়। তাই কোনো কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারে না। রেহাংশী নিজের কথা বাদ দেই। অনেকটা রোদ্র ঝলমলে দিনের মতো চকচক চোখে চেয়ে প্রাণবন্ত গলায় বলল—
“দুলাভাই আসেনি?”
“এসেছিল, চলে গেছে।”
“ইশ! তোর বরকে আমার দেখা হলো না। এই ছবি আছে তোর কাছে?”
“আছে তো। তুই বস, আমি দেখাচ্ছি।”
পারুল উঠতে গেলে তাকে বাঁধা দেয় রেহাংশী। শাষণ করে বলল—
“একদম উঠবি না। আমাকে বল, আমি এনে দিচ্ছি।”
পারুল তাদের স্টিলের শোকেস দেখিয়ে দেয়। তার ওপরেই মোবাইল রাখা। রেহাংশী গুটগুট পায়ে মোবাইল নিয়ে আসে। দুই বান্ধবী একে অপরের সাথে সেঁটে বসে। পারুল তার বিয়ের ছবিগুলো দেখাতে থাকে। রেহাংশীর চোখের মনিতে খুশি ঝরে পড়ে। বিয়েতে সে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই যে তার অপয়া ট্যাগ। তা আর দিলো কই! গ্রামের মানুষ এসব অনেক বেশি মেনে চলে। যার পুরোটাই কুসংস্কার।
“তোকে তো ভারি মিষ্টি লাগছে! তুই কী শশুড় বাড়িতেই থাকিস?”
“হ্যাঁ।”
“শুনলাম তোর বড় না কি শহরে থাকে?”
“হুম। কিন্তু ও বলেছে বাবু হওয়ার পর আমাকেও ঢাকা নিয়ে যাবে।”
“তাই না কি?”
“হ্যাঁ।”
“ইশ! তাহলে তো ভীষণ মজা হবে!”
পারুল নরম চোখে তাকায়। গ্যালারির ছবিতে আঁখি নিবদ্ধ রেহাংশীর। পারুলের মনে ব্যাথা হয়। তার বাবার বাজারে একটা দোকান আছে। তা দিয়েই তাদের সংসার ভালোই চলে। ছোটো ভাইটা মাদ্রাসায় পড়ে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার দেখেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। রেহাংশীর পরিবার তার থেকেও উন্নত। গ্রামে তাদের নাম ডাকও আছে। তবুও কতটা অবহেলিত সে। বাবা-মা না থাকলে যা হয়। সন্তানের সবচেয়ে বড়ো আপনজন-ই তো মা-বাবা। তাদের মতো নিঃস্বার্থবাবে পৃথিবীর কেউ ভালোবাসতে পারে না। পারুলের ব্যথিত নয়ন দেখে রেহাংশীর উজ্জ্বল হাসি।
,
,
,
নিজের শার্টের হাতা গুটিয়েছে ইনজাদ। বিক্ষিপ্ত চাহনি তার। রাগে, ক্রোশে আচ্ছন্ন সে। মায়ের এমন কাজ সে মোটেও আশা করেনি। তবে প্রশ্নও করেনি। কারণ প্রশ্ন করলেই তমালিকা জানতে পারবে রেহাংশী এসব বলেছে। আর তখন তা মেয়েটার জন্য একদম সুখকর হবে না।
বিতৃষ্ণা নিয়ে ঢাকা ফেরার জোগাড় করেছে ইনজাদ। তমালিকা উদ্বিগ্ন, উদ্বেলিত। কাঁধের ব্যাগটা একপাশে নিয়েই নিজের কক্ষ থেকে বের হলো ইনজাদ। তমালিকা ত্রস্ত গলায় বলল—
“কী হয়েছে তোর? দুপুরে ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়াও করলি না। বললি সন্ধ্যায় যাবি। আর এই বিকেল বেলায় কেন পাগলামি শুরু করলি?”
ইনজাদ রাগ চেপে রাখতে পারল না। দমদমে গলায় বলল—
“ভালো লাগছে না আমার। তাই। আর সন্ধ্যায় বলেছি তো কী হয়েছে? এক্ষুণি যাব আমি।”
“কিছু মুখে দিয়ে তো যা।”
“ইচ্ছে করছে না। ”
বসার ঘরে নিমগ্নচিত্তে বসে আছেন পারভেজ মির্জা। তার দিকে কোনোমতে এক পলক তাকিয়ে চওড়া গলায় বলল—
“আমি যাচ্ছি বাবা। ”
পারভেজ মির্জা হালকা করে মাথা ঝাঁকালেন। ইনজাদ বের হওয়ার পরও তমালিকা ছেলের যাওয়ার পথে অনিমেষ চেয়ে রইলেন। চোখের পাতা ছড়িয়ে যে ছেলে কখনো কথা বলেনি, সে আজ ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে কথা বলছে! মায়ের বাধ্য ছেলে হঠাৎ করেই অবাধ্য হয়ে গেল। মা কেন ছেলের মনের কথা বুঝতে পারছে না?
মেঠোপথ ধরে হাঁটছে ইনজাদ। বিকেলের তাজা হাওয়ায় তার হাতের পশমে দোলা লাগলেও মনের স্বস্তি হচ্ছে না। মৃদু মলয়ে পরাবৃত মেদিনীর পত্রপল্লব দোল খেলছে। কিন্তু ইনজাদের মানসপটে ভেসে উঠা সেই রমণীর তীক্ষ্ম কথার ছুরি তাকে প্রতিনিয়ত থমকে দিচ্ছে। সিগারেট ধরায় ইনজাদ। হেঁটে হেঁটে সিগারেটে সুখটান দেওয়া ঠিক জমে না। তাও এই একলা একা পথে! মেঠোপথ ছেড়ে পাকা সড়কে পা রাখে ইনজাদ। চলতে থাকে নিষ্পেষিত মস্তিষ্কে।
,
,
,
বিকেল গড়িয়েছে। সূর্যের ম্লান আলোয় বসুন্ধরা নিষ্প্রভ। নিস্পৃহ পায়ে হেঁটে চলছে রেহাংশী। পারুল না খাইয়ে ছাড়ল না। বিকেলের মেঠোপথ জনশূন্য। মানুষজন ভাতঘুমে ব্যস্ত। রেহাংশী বাড়ি ফিরছে। পথের দুই পাশে নারিকেল গাছ, রেইনট্রি আর খেজুর গাছের ঝাড়। খেজুর গাছের পাশে ঝা লাগানো। তাতে লতানো সিমগাছ। তাতে সাদা আর বেগুনী রঙের ছোটো ছোটো ফুল ধরেছে। ছোট্ট আমগাছের ডগায় কালচে বেগুনী রঙের কচিপাতা। পুকুরের শ্যাওলা পড়া পানিতে হাঁসের অবাধ বিচরণ। মাথা ডুবিয়ে জলখেলায় মত্ত তারা। পাড়ে থাকা গাছের নির্মল ছায়া পড়ছে পুকুরের জলে। রেহাংশী দাঁড়াল। খেজুর গাছের সাথে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সেই হাঁসগুলোর জলখেলা দেখছে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। মনে পড়ে দাদির কথা। তাকে খেজুর গাছের কাঁটা নিয়ে যেতে বলেছে। নিয়ে নিল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যখন যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তার সামনেই ভূতের মতো আবির্ভুত হলো রতন। বাইকের জোরালো, কর্কশ আওয়াজে শিউরে উঠে সে। রতন গালভর্তি হাসে। প্রশ্ন করে—
“কই গেছিলা?”
“পারুলের বাসায়।”
“কেন?”
“ওকে দেখতে।”
“কাঁটা দিয়া কী করবা?”
“দাদি নিতে বলেছে। পিঠা বানাবে।”
রতন চোখে হাসল। গদগদ গলায় বলল—
“চলো, তোমার বাড়ি পৌঁছাইয়া দেই।”
রেহাংশী আপত্তি করে বলল—
“লাগবে না। আমি একাই যেতে পারব।”
রতন হাসল। বাইকের ফ্রন্ট গ্লাসে নিজের মুখটা দেখে চুলে হাত গলালো। হেসে হেসে বলল—
“এখন তো আর সমস্যা নাই। কেউ তোমারে কথা শুনাইতে পারব না। বসো, আমি পৌঁছাইয়া দেই।”
রেহাংশী দৃঢ় গলায় বলল—
“বললাম তো না। আপনি যান।”
“আংটি কই তোমার?”
রেহাংশী থতমত খেয়ে যায়। ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল—
“আঙুল ব্যাথা করছিল তাই খুলে রেখেছি।”
“মিথ্যা বইল না। মিথ্যা কথা তোমারে মানায় না। আচ্ছা, যাও। সাবধানে যাইয়ো।”
রতন জোর একটা শব্দ করে তার বাইক সচল করে। দুইজনকে পাকা রাস্তার মোড় থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল ইনজাদ। ভুলেও একবার তার দিকে ফিরে তাকাল না রেহাংশী। ছোটো ছোটো পায়ে তার সামনে দিয়ে এসে একটা ছোট্ট মেঠোপথে ঢুকে পড়ে। হাতের সিগারেট দলিয়ে ফেলে মুষ্ঠিতে ইনজাদ।
চলবে,,,