#মোহঘোর
#পর্বঃ৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
উদাসচিত্তে ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে ইনজাদ। ভীতিহীন স্থির চাহনি। তার বৈবর্ণ আননে প্রভাকরের তেরছা কিরণ। গতকাল বিকেলে ফিরেছে সে। ফেরার পর থেকে তার বেপরোয়া, অস্থির, অসহিষ্ণু হৃৎপ্রকোষ্ঠে ঝড় চলছে। রাস্তায় পায়চারি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ছাদের পাটাতনে চপল পায়ের চলা। দেখা মিলল না কাঙ্ক্ষিত মানুষের। ইনজাদ বিধ্বস্ত। নির্নিমিখ চেয়ে আছে রেহাংশীর ভাঙা জানালায়। এখান থেকে অবশ্য তা দেখা যায় না। তবুও অবুঝ মনের সান্ত্বনা।
ইনজাদ এক বিচিত্র ফন্দি আঁটলো।
বিকেলে স্থবির পরিবেশ। সূর্যের নিষ্প্রভ আভা। মোড়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে ইনজাদ। তার সন্ধানী চোখ পিপলুর অপেক্ষায়। খানিক বাদেই দুরন্ত পিপলু তার দলবল নিয়ে এলো। হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর বল। অধর বিস্তৃত হয় ইনজাদের। পিপলুকে ডাক দিয়ে নিজের কাছে বসায়। ছোট্ট বাচ্চাদের ভুলাতে হলে তাদের মুখরোচক খাবার খাওয়াতে হয়। আর পিপলু তো দুষ্টের শিরমণি। পিপলুকে পঞ্চাশ টাকার এক নোট দিয়ে হাসল ইনজাদ। পিপলু চোখ চকচক করে ওঠে। ইনজাদ কিছু একটা বলতেই উল্লাসিত হয় পিপলু।
বিছানায় এলোথেলো হয়ে ঘুমে বিভোর রেহাংশী। আচানক তার গায়ে কিছু একটা পড়তেই হকচকিয়ে উঠে বসে সে। বুকে থু থু ছিটিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। বুক ভরে শ্বাস নেয়। নিজেকে ধাতস্থ করে। মেঝের ওপর বল দেখে ভ্রূ বাঁকায় রেহাংশী। এ নির্ঘাত পিপলুর কাজ!
রেহাংশী জানালার কাছে আসে। তার জানালায় এখনো কাঁচ লাগানো হয়নি। জোর দেইনি সে। ঘুমো ঘুমো চোখে পিপলুকে দেখেই মেজাজ চওড়া হলো তার। শব্দহীন বাক্যে জানালা দিয়ে তাকে শাসিয়ে নিজের কক্ষ থেকে বের হয়। বাড়ির বাইরে আসতেই রেহাংশীকে দেখে ছুট লাগায় পিপলু। রেহাংশী হাতের বলটা নিয়ে ফুঁসলে উঠে বলল—
“পিপলুর বাচ্চা! চাচাকে যদি না বলেছি আজ। স্কুল বন্ধ থাকায় তোর ঠ্যাঙ অনেক বেড়েছে।”
পিপলু পেছন ফিরে ভেঙচি কেটে খিচতি মেরে পূনরায় দৌড় লাগায়। রেহাংশী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। সিদ্ধান্ত নেয় পিপলুর বাবাকে সে জানাবে তার ছেলের কর্মকাণ্ড। দম ফেলে যখনই পেছন ফিরে রেহাংশী, আচমকা ইনজাদকে দেখে ভড়কে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। বল পিপলু নয় ইনজাদ মেরেছে ঘরের ভেতর।
তাকে পাশ কাটিয়ে সরে আসে রেহাংশী। ইনজাদ ডেকে উঠে।
“দাঁড়াও।”
রেহাংশী শুনল না। তার গতি অশিথিল।
” শোনো রেহাংশী। দাঁড়াও বলছি।”
নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ় রেহাংশী থামল না। ইনজাদ দারাজ গলায় বলল—
“বিষবাণ!”
রেহাংশী থমকাল। পেছন ফিরে দৃঢ় গলায় রাগমিশ্রণ করে বলল—
“এই নামে আমাকে আর ডাকবেন না।”
ইনজাদ নরম পায়ে রেহাংশীর কাছে এসে দাঁড়াল। অতিষ্ঠ গলায় বলল—
“কথা শুনছিলে না কেন আমার?”
“আপনি আর কখনো আমার সাথে কথা বলবেন না।”
ইনজাদ বদ্ধশ্বাসে বলল—
“এই বিয়ে তুমি করবে না।”
রেহাংশী চট করেই হেসে ফেলে। কটাক্ষ করে বলল—
“এখন আমার বিয়েতেও আপনার সমস্যা?”
ইনজাদ গাঢ় গলায় বলল—
“তোমার বিয়েতে আমার কোনো সমস্যা নেই। রতনকে বিয়ে করবে না তুমি।”
রেহাংশী ভাবাবেশহীন চোখে তাকাল। বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে বলল—
“কী সমস্যা আপনার বলুন তো? আমি কাকে বিয়ে করব না করব তা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাতে আপনার কী?”
ইনজাদ নিরেট গলায় বলল—
“রতন তোমার যোগ্য নয়। আরে আমি তো দু’দিন হলো এখানে এসেছি। কিন্তু তুমি তো সব জানো। সব জেনেও কী করে রাজি হলে এই বিয়ের জন্য?”
অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলে রেহাংশী। সরস গলায় বলল—
“আপনার কী আমার বিয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে না কি রতনকে বিয়ে করছি সেই জন্য চিন্তা হচ্ছে? কিন্তু আমি তো ভাবছি, আপনার আমার জন্য চিন্তা কেন হবে? কে হই আমি আপনার?”
ইনজাদের কথা আটকে গেল গলায়। স্বরনালিতে সাপের মতো পেঁচিয়ে গেল তার সমস্ত কথামালা। চোখের পাতা ভার হলো। সিক্ত হলো তা। রেহাংশী শ্লেষাত্মক গলায় বলল—
“উড়ো আহ্লাদ সবাই দেখাতে পারে পরদেশী। এইটাই সমাজের নিয়ম! একজন অসহায় মানুষ যখন রোগে-শোকে জর্জরিত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে কেউ এগিয়ে আসে না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর খাটিয়ার পাশে বসে বলে,” আহ! বড়ো ভালো মানুষ ছিল।” আমরা মানুষগুলো এমন। যদি ভালো মানুষই ছিল তাহলে আগে কেন সাহায্যের হাত বাড়াল না তারা?
কারণ আমাদের সংকীর্ণ মনমানসিকতা, অপরের দুঃখে নামের অশ্রু বিসর্জন। আমরা সবাই সমাজ বদলাতে চাই। তবে নিজের হাতে নয়, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে।
আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমি রতনকেই বিয়ে করব। আমার তকদিরে যা আছে তাই হবে। আপনি আর কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। আমি এই পৃথিবীর মানুষদের ঘৃণা করি, যারা অন্যকে শুধু সহমর্মিতা দেখায়। আপনিও তাদের মধ্যে একজন। আর কখনো আমাকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করবেন না। কখনো না।”
রেহাংশীর চোখ দিয়ে ঝরা পানিতে তার গাল ভিজে গেল। হাতের উলটো পাশ দিয়ে তা মুছে নিয়ে জোরপূর্বক হাসল সে। চোখের চাহনিতে ছিল একরাশ ঘৃণার পাহাড়। তা ধ্বসে পড়ল ইনজাদে বুকের ওপর।
নিজের কক্ষের জানালা দিয়ে সবটা দেখছে নুপূর। কথার আওয়াজ না আসলেও ভাবভঙ্গি তার দৃষ্টিগোচর হলো।
,
,
,
“কি কথা বলছিলি তুই ওর সাথে?”
রেহাংশী তেরছা গলায় প্রত্যুক্তি করে বলল—
“তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করো।”
নুপূর অসহিষ্ণু গলায় বলল—
“তুই এতটা নিচে নামলি কী করে? সবটা জেনেও বারবার কেন যাচ্ছিস ওর সামনে?”
“আমাকে কেন বলছ? আমি কী করেছি? সে নিজেই আমার সাথে কথা বলেছে। ”
“তাই বলে তুই..।”
নুপূর তার কথা শেষ করতে পারে না। তার পূর্বেই ছুটে আসে পায়েল। বোনের গলা জড়িয়ে ধরে সাগর পরিমান খুশি নিয়ে বলল—
“তমালিকা চাচী ফোন করছে। আজ সন্ধ্যায় ওরা তোমাকে আংটি পরাতে আসবে। ইনজাদও আসবে সাথে।”
বোনের দুই গালে হাত রাখে পায়েল। তার চোখের কোটরে খুশি উপচে পড়ছে। নুপূর নির্লিপ্ত। রেহাংশী বিরস হাসল। সংগোপনে চোখের পানি মুছে নিয়ে বেরিয়ে আসল সেখান থেকে। ঝিনুক বেগম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মেয়েকে দেখতে আসবে। সেই খুশিতে তোড়জোড় শুরু করলেন। রেহাংশীকে দেখেই চিৎকার করে বললেন যেন তাকে সাহায্য করে। সোমা মুখ বাঁকায়। এখন রেহাংশীকে গাধার মতো খাটাবে।
,
,
,
নতজানু মুখে বসে আছে ইনজাদ। যা কথা বলার তার বাবা- মা বলছে। ইনজাদ শুধু শুনে যাচ্ছে। ঘোরগ্রস্ত সে। রাগে বিহ্বল। ইনজাদের হাত কাঁপছে। চোখের পল্লবে অস্থিরতা। মন-মস্তিষ্কে উদ্বেলতা। নুহাশ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। রওশন আরা বসেছেন একপাশে অন্যপাশে ঝিনুক বেগম আর জুলহাস খন্দকার। তাদের পাশেই নুপূর। তার নত চোখে একরাশ লাজুকতা। বুকে ডিবডিব শব্দ। চপলতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুগ্ধ নয়নে আড় চোখে দেখছে ইনজাদকে। আড়ষ্ট হয়ে যায় অনুপলেই। বিবশ দেহপিঞ্জরের সেই কম্পিত যন্ত্রটা যেন হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে ওঠল। তার কাঁধে হাত রেখে সোফার পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে পায়েল। অদূরে এক কোণে ঠায় হয়েছে রেহাংশীর। সে ওখান থেকেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
ইনজাদ একবারও চোখ তুলে তাকাল না। যেন সে তাকালেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর কাণ্ডটি আজ ঘটে যাবে। বিষবাণের কথা সে শুনেছে। তাকাবে না আর। সকলের মুখে উজ্জ্বল হাসি। তমালিকা ক্ষুদ্র চোখে তাকাল রেহাংশীর দিকে। মেয়েটার শারীরিক গঠন ছিমছাম, উজ্জ্বল গায়ের রং, বয়সটাও কম। ছেলের জন্য এ মেয়েটাকেই প্রথম পছন্দ হয়েছিল তার। কিন্তু পরবর্তীতে নানান জনের নানান কথা শুনে মত পালটে যায় তার। ছেলের জীবনে তিনি কোনো ধরনের ঝুঁকি চান না। তার উপর মেয়েটার কেউ নেই। এতিম! না, চোখ ফেরান তমালিকা। ঝিনুক বেগম রেহাংশীকে নাশতা আনার কথা বললেন। কোনোরকম দ্বিরূক্তি ছাড়াই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে।
চকিতে একটা জোরালো শব্দ হয়। সোমার বিস্ফোরিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। রান্নাঘরের কাছাকাছি ছিল নুহাশ। দৌড়ে গিয়ে হতবাক সে। ভাতের পাতিল নিচে পড়ে মাড়সহ ভাতের অর্ধেকটা রেহাংশীর পায়ের ওপর। রেহাংশী শ্বাস আটকে বসে আসে। গলায় স্বর নেই। চোখ-মুখ খিঁচে নোনা জলের সমুদ্র নির্গত হচ্ছে চোখের পল্লব চুইয়ে। নুহাশ শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসতেই প্রতিবাদ করে উঠে রেহাংশী।
“আসবে না তুমি। ছোঁবে না আমাকে।”
নুহাশ দমে যায়। বাড়ির সকলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দেখে মেঝেতে বসে আছে রেহাংশী। সকলের ভয় জড়িত চাহনি। হতভম্ব, হতবাক ! এক মুহূর্তের জন্য পাথর বনে গেল সবাই। সকলের চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে আসে ইনজাদ। রান্নাঘরে রেহাংশীকে দেখেই চোখের পল্লব ছড়িয়ে বড়ো একটা শ্বাস ফেলে সে। পায়ের দিকটা জমে গেছে তার। হাঁসফাঁস করছে অন্তঃকরণ। দ্বিধাগ্রস্ত ইনজাদ দৈবাৎ চিৎকার করে উঠে—
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনারা?”
ইনজাদ ছুটে এসে রেহাংশীকে ক্রোড়ে আবৃত করে নেয়। রান্নাঘরের ওপরের বেসিং এর নিচের দিকটাতেও বড়ো একটা বেসিং আছে। ইনজাদ সেটার কাছেই রেহাংশীকে বসায়। কল ছেড়ে পা টানটান করে দেয় জলস্রোতের নিচে। ঠোঁট কামড়ে ধরে রেহাংশী। ইনজাদের বুকের কাছে খামচে ধরে। যত পানি পড়ছে নিজেকে সংকুচিত করছে সে। রেহাংশী কোনো শব্দ করল না। নীরব স্রোত নামছে তার নেত্রযুগল দিয়ে। ব্যাথা দমাতে হাতের বেড় শক্ত করছে। তাতে করে ইনজাদের শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম ছিঁড়ে যায়। তার নগ্ন বুকে রেহাংশীর ক্ষীপ্ত হাতের দংশন। গেঁথে যাচ্ছে প্রতিটি আঙুলের নখের ডগা। সেদিকে মনোযোগ নেই ইনজাদের। রেহাংশীর প্লাজো আরেকটু উপরে উঠিয়ে নিজের হাত পানির স্রোতে ধরে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো পোড়া জায়গাটায়। বাড়ির সকলে স্থির হয়ে চেয়ে আছে। নুহাশের মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে রাগে। সে তৎক্ষণাৎ সরে আসলো সেখান থেকে। রেহাংশী মুখ গুঁজে দেয় ইনজাদের বুকে। তক্ষুণি কিছু একটা অনুভূত হয় ইনজাদের। সে সপ্রতিভ চোখে তাকাল। রেহাংশী বুক থেকে কপাল উঠাতেই জলেভরা চোখ দুটো দৃশ্যমান হলো ইনজাদের চক্ষুদর্পণে। রেহাংশীর বুকের ওঠানামা বাড়তে লাগল । নিমেষহীন ওই দীর্ঘ ভেজা আঁখিপল্লবে চেয়ে রইল ইনজাদ। এক অদৃশ্য, অাছোঁয়া আকুতি তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রেহাংশীকে আরেকটু চেপে ধরল ইনজাদ। তার বক্ষস্থলে যেন আস্থার নীড় খুঁজে পেল রেহাংশী। ইনজাদ চিবুক রাখে রেহাংশীর মাথার ওপর। স্বগতোক্তি করল—“নিজের ক্ষমতা চিনে নাও বিষবাণ। এখনো দেরি হয়ে যায়নি। পরদেশী না হয় পর-ই থাকুক। আপন মানুষ খুঁজে নাও।”
রেহাংশীর কাতর দৃষ্টি অসহায় করে তুলল ইনজাদের চিত্ত। দেহের ভেতর যে ছোট্ট কম্পিত যন্ত্রটা আছে তার কম্পন যেন ধীরে ধীরে নীরব হয়ে আসছে। রেহাংশী তার পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিলো ইনজাদের ওপর। পায়ের দিকটায় তাকাতেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে তার।ফর্সা পা লাল হয়ে আছে যেন ছোঁয়া লাগতেই গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে! রেহাংশীকে বুক পাঁজরে চেপে ধরে কোলে তুলে নিল ইনজাদ। সকলের হতভম্ব চাহনি এখনো স্থির। বার্নল না থাকায় আপাতত পেস্টের ব্যবহার করে সে। চরম বিরক্তও হয়। এত প্রয়োজনীয় একটা জিনিস ঘরে নেই!
সোফার দুই পাশ খামচে ধরে বসে আছে রেহাংশী। সকলের নিস্তব্ধতায় কেমন ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হলো। পানি গড়িয়ে পড়ছে রেহাংশীর চোখের কোণ থেকে। ইনজাদ বিস্মিত হয়। মেয়েটা একটা শব্দও করল না!
ঠোঁট কেটে গেছে রেহাংশীর। ব্যাথার কথা ভুলতে ঠোঁটের ওপরেই সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে। ঝিনুক বেগম আচমকা চিৎকার করে উঠলেন—
“আমি বলেছিলাম না। কেউ তো আমার কথা বিশ্বাস করো না। এই মেয়ে যেখানে যাবে অনিষ্ট করেই ছাড়বে।”
জুলহাস খন্দকার ঈষৎ বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন—
“অযথা কথা বলো না তো। মেয়েটার পায়ের অবস্থা দেখেছ?”
“আমি কী আর সাধে বলি। শোনো না তো আমার কথা। যেই মেয়ে নিজের মা-কে খেয়েছে সে আর কী করবে!”
এইবার শব্দ করল রেহাংশী। ছলকে উঠা পানির ন্যায় ঝরল তার চোখের জল। ইনজাদ তাকাল। মৃদু হাসল। কাঁদল তাহলে! ব্যাথা অনুভূত হয় তাহলে এই মেয়ের!
ইনজাদ শক্ত গলায় বলল—
“আম্মা, আংটি দিন।”
সবাই চমকে গেল। অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলো সবার। শুধু ভাবাবেশ হলো না রেহাংশীর। সে নীরব স্রোত ঝরাতে লাগল। তমালিকা ব্যস্ত হয়ে আংটি খুঁজতে লাগল। তাড়াহুড়োর মাঝে সোফায় রেখেই চলে গিয়েছিলেন। এখন খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি কড়া চোখে তাকালেন। ঘটনার বর্ণনায় সকলের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। আংটি যাবে কোথায়?
আরেকবার আঙুল উঠবে রেহাংশীর ওপর। সেই সুযোগ দিতে নারাজ ইনজাদ। সহসা সে এক অদ্ভুদ কাজ করল। মায়ের হাত থেকে একটা স্বর্ণের চুড়ি খুলে নুপূরের হাতে পরিয়ে দেয়।
আকাশ ছোঁয়া বিস্ময় খেলে গেল উপস্থিত মানব- মানবীদের চোখে। তাদের সেই চাহনি বিদীর্ণ করল ইনজাদের কথার বাণ—
“জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। যার আগাম ধারণা তো দুর, শরীরের লোমের পাশ দিয়ে চলে গেলেও তার আভাস পাওয়া যায় না; যদি না স্বয়ং ভাগ্যবিধাতা চান। তাই, তার সৃষ্ট মানুষকে দোষ দেওয়া বন্ধ করুন। আমাদের জীবনে তাই ঘটবে যা তিঁনি ঘটাতে চান। কোনো মানুষের তাতে উপস্থিতি নেই।
আসুন আম্মা। চলো বাবা। আর আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন। যত দ্রুত সম্ভব এই বিয়েটা হয়ে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তত আপনাদের ভ্রান্ত ধারণার ইতি ঘটবে।”
রেহাংশী মাথা তুলল না। শুধু হাতের মুষ্টি শক্ত করল।তার কোমল হাতের মুঠোতে ছোট্ট লাল বক্স।
চলবে,,,