#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে তড়াক করে উঠল ইনজাদের মস্তিষ্ক। এই নাম সে শুনেছে। কয়েকবার শুনেছে। জিবরান খন্দকার হতচকিত। রেহাংশীর নামটাও তার আবছা মনে আছে। তিনি সরল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—
“কে তুমি?”
রেহাংশী শক্ত কণ্ঠে বলল—
“কেন? চিনতে কষ্ট হচ্ছে? হওয়ার-ই কথা।”
রেহাংশী কাঁদছে না। তবুও অবিরত ধারায় ঝরছে তার চোখের ধারা। একটু পরপর হেঁচকি তুলছে সে। কান্না রোধের বিফল চেষ্টা। ইনজাদ আশ্চর্য চোখে চেয়ে বলল—
“স্যার আপনি ওকে চেনেন?”
জিবরান খন্দকার অতীতে ডুব দিলেন। আট কী নয় বছরের রেহাংশী তাকে দেখেই ছুটে পালাল। জিবরান খন্দকার ডাকলেন। কিন্তু রেহাংশী শুনল না। ছাদে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইল। জিবরান খন্দকার ফিরে গেলেন সেদিনকার মতো। তিনি আরো একবার এসেছিলেন। সেদিনও রেহাংশীর দেখা তিনি পাননি। রেহাংশী তার নানির বাড়ি ছিল। এরপর আর কখনো তিনি খন্দকার বাড়িতে পা রাখেননি। একটু একটু করে তার স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যেতে লাগল রেহাংশী নামের ছোট্ট এক দূরন্ত শিশুর কলতান। বাবা আসার খুশিতে যে রাতভোর জেগে থাকত। শহর থেকে বাবাকে কী কী নিয়ে আসতে বলবে তার লিস্ট তৈরি করে রাখত। বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমানোর অব্যক্ত আবদার সবসময় বুকে গুঁজে রাখত। ব্যক্ত করা হয়নি সেই আবদার। তার আগেই সব কিছু বদলে গেল।
জিবরান খন্দকার অবিশ্বাসী গলায় বললেন—-
“ও ওওর নাম রেহাংশী? বাড়ি কোথায় তোমাদের?”
ইনজাদ ছোট্ট করে বলল—
“মিঠাপুকুর।”
“তোমার বাড়ি মিঠাপুকুর! তুমি খন্দকার বাড়ি চেনো? জুলহাস খন্দকার?”
চোখের কোটর ছোটো করল ইনজাদ। অবিরত গলায় বলল—
“জি, আমার বাড়ির খন্দকার বাড়ির সামনেই। জুলহাস খন্দ…এক মিনিট। আপনি জিবরান খন্দকার, জুলহাস খন্দকারের ছোটো ভাই। অনেক বছর আগে যে বাড়ি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তার মানে আপনিই রেহাংশীর বাবা?”
রেহাংশী উনুনের গনগনে আগুনের মতো জ্বলে উঠে বলল—
“না, এই লোকটা আমার বাবা না। এই লোকটা একটা খুনি। আমার মাকে খুন করেছে। আপনি পুলিশকে ফোন করুন। তাড়াতাড়ি ফোন করুন।”
জিবরান খন্দকার আবেগে আপ্লুত হলেন। এতবছর পর মেয়েকে চোখের সামনে দেখে তার শক্ত মনটা হঠাৎ করেই দরিয়া হয়ে গেল। চোখের জলে ভিজে গেল পল্লব। জমাট গলায় বললেন—
“রেহাংশী, মা আমার, কথা শোন আমার।”
জিবরান খন্দকার খানিকটা এগিয়ে গেলেন রেহাংশীর কাছে। রেহাংশী আগুনের গলিত লোহার মতো ছ্যাত করে উঠে বলল—
“একদম ছোঁবেন না আপনি আমাকে। কীসের মেয়ে, কীসের মা! কেউ না আমি আপনার। কেউ না। শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। খুনি! আমার মাকে খুন করে আমাকে খুনি বানিয়েছে।”
রেহাংশী ইনজাদের দিকে চাইল। তার ব্লেজারের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—
“আমি আমার মাকে খুন করিনি বিশ্বাস করুন। এই লোকটা খুন করেছে। আমার মাকে যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে মেরেছে। আপনি পুলিশকে ফোন করুন না। এই লোকটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন। এর মতো মানুষের খোলা বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই লোকটার জন্য আমার মা মরেছে, এই লোকটার কারণে সবাই আমাকে দূর দূর করেছে, এই লোকটার জন্য আমার ছোটোবেলা নষ্ট হয়ে গেছে। অপয়া, অলক্ষুণে বলে সবাই কথা শুনিয়েছে। আর সে এখানে এসে দিব্যি স্ত্রী- সন্তান নিয়ে সুখে আছে। যখন এতই অপছন্দ তাহলে আমাকে জন্ম দিলো কেন? মেরে ফেলল না কেন আমাকে? জনম ভরে কাঁদার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল আমাকে। আপনি এই লোকটাকে পুলিশে দিয়ে দিন। ফোন করুন না।”
ইনজাদ আলতো করে জড়িয়ে ধরল রেহাংশীকে। পাঁজর কাঁপিয়ে রোদনে আচ্ছন্ন মেয়েটির চোখের জল সবার চোখ সিক্ত করল। সিন্ধুজা, সৌরভ ভাবতে পারেনি তাদের একটা বোনও আছে। সিন্ধুজার মা সাবরিনা বিবশ চোখে চেয়ে রইলেন। নিজেকে তার অপরাধি মনে হচ্ছে। নিজের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গিয়ে অন্য কারো জীবন নষ্ট করে ফেলেছে সে। কিন্তু সবকিছুর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন জিবরান খন্দকার। তার ছোট্ট রেহাংশী বিবাহিত! সংসার করছে সে। মায়ের মতো হয়েছে। ধারালো স্বরে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে।
রেহাংশীর মা জয়ার সাথে জিবরান খন্দকারের সম্পর্কের বিয়ে ছিল। সুন্দরী জয়ার প্রেমে মত্ত হয়ে অনেকটা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলেন তাকে। কিন্তু বছর ঘুরতেই জন্ম হয়ছিল রেহাংশীর। পরিবারের খরচ বাড়ে। জিবরান খন্দকার উপার্জনের জন্য গ্রাম ছাড়েন। ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। একটা নতুন গার্মেন্টের ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই ডিভোর্সি সাবরিনার সংস্পর্শে এক নতুন জগত গড়ে তুলেন তিনি। জন্ম হয় সৌরভের। মোহের বশে করা ভুল রূপ নেয় জীবনের সবচেয়ে বড়ো মোহঘোরের। জয়ার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। ঘুনে ধরা সম্পর্কে টান পড়তেই জয়া বেছেনিলেন মুক্তির পথ। যা তার সন্তানের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল। জয়ার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়ে রেহাংশীর। রাতভোর জেগে ক্রন্দনে বিহ্বল মাকে তখন খুব অচেনা মনে হতো তার। রেহাংশী জানত না সেই কান্নার কারণ। একদিন হঠাৎ করেই এলো সে দিন। অসুস্থ জয়া জিবরান খন্দকারের সাথে কলহে লিপ্ত হলেন। রেহাংশী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। রাতের প্রহর। হঠাৎ লোডশেডিং হয়। ঘাবড়ে যায় রেহাংশী। অন্ধকারে এক পর্যায় চিৎকার করে উঠেন জয়া। যখন বিদ্যুতের ঝলকে সবকিছু স্পষ্ট হয় তখন জয়ার আত্মারাম তাকে ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। স্বামীর মুখে তালাকের কথা শুনে অসুস্থ জয়া আর সহ্য করতে পারেননি। হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি পরপারে পাড়ি জমান। সেই থেকে আঁধারে ভয় রেহাংশীর। নিজের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষকে কেড়ে নিয়েছে সে মিনিট খানেকের আঁধার। এইটাই তার ছোট্ট মস্তিষ্কের বিশ্বাস যা ধীরে ধীরে তাকে জেকে ধরেছে।
ইনজাদ নম্র গলায় বলল—
“শান্ত হও রেহাংশী।”
রেহাংশী ফের তেঁতে ওঠল। রাগ ঝরা কণ্ঠে দাপিয়ে উঠে বলল—
“কীসের শান্ত হবো আমি? হবো না। আপনি পুলিশকে ফোন করছেন না কেন? এই লোকটা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
রেহাংশী উন্মাদগ্রস্ত ! ঘৃণায়, রাগে তার কোমল দেহ থরথর করে কাঁপছে। দ্রুত বেগে গিয়ে জিবরান খন্দকারকে ফের ধাক্কা মারে। তাকে সামলে নেয় সিন্ধুজা। এবার আর পূর্বেকার মতো রাগ হলো না তার। ইনজাদ টেনে ধরল রেহাংশীকে। ধমকে উঠে বলল—
“কাম ডাউন, রেহাংশী। শান্ত হও এবার।”
“কেন হবো? এই লোকটার জন্য আমার পুরো জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। সব থেকেও কিছুই নেই আমার। শুধু এই লোকটার জন্য। আপনি পুলিশকে ডাকুন। এই লোকটাকে জেলে পাঠিয়ে দিন। আমি এর মুখ দেখতে চাই না। চলে যেতে বলুন এই লোকটাকে।”
রেহাংশীকে থামানো যাচ্ছে না। উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ শুরু করল সে। ইনজাদ না পেরে জোরে ধমকে উঠতেই মিইয়ে যায় রেহাংশী। নিভে যেতে থাকে তার চোখ। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে টলে পড়তেই তাকে জড়িয়ে নেয় ইনজাদ। জিবরান খন্দকার এগিয়ে আসতেই শক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে ইনজাদ।
“প্লিজ স্যার, ডোন্ট টাচ!”
জিবরান খন্দকার মর্মভেদী গলায় বললেন—
“ইনজাদ! ও আমার মেয়ে!”
“বাট নাউ, শি ইজ মাই ওয়াইফ।”
রেহাংশীর অচেতন দেহ কোলে তুলে নেয় ইনজাদ। একজন স্টাফকে নিয়ে এগিয়ে আসে মেহমাদ। হলের ভেতরের দিকে একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় রেহাংশীকে। ছোট্ট কক্ষটিতে একটা নরম গদি বিছানো। রেহাংশীকে সেখানে শুইয়ে দেয় ইনজাদ। মেহমাদ চলে যায়। রেহাংশীর এক হাত নিজের অঞ্জলিতে নিয়ে তার শিয়রের সামনেই বসে থাকে ইনজাদ। অপেক্ষা…..।
,
,
,
চোখ পিটপিট করছে রেহাংশী। বিছানার ওপর নিশ্চল তার দেহ। মস্তিষ্কের নিষ্প্রভ স্নায়ু চঞ্চল হতেই ধপ করে উঠে বসে সে। রেহাংশীর দিকে প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে ইনজাদ। সমূলে উপরে যাওয়া বৃক্ষের মতো ইনজাদের গলা জড়িয়ে ধরে রেহাংশী। পাঁজর ভেঙ্গে শব্দহীন কান্নার জো তুলে। ইনজাদ আলগোছে রেহাংশীর পিঠের ওপর হাত রাখে। আলতো স্বরে বলল—
“কান্না থামাও রেহাংশী। প্লিজ..।”
রেহাংশী আরো দৃঢ় করে আঁকড়ে ধরে ইনজাদের গলা। তার সমস্ত ভার ঢেলে দেয় ইনজাদের বুকের ওপর। ইনজাদ অবিচল গলায় ফের বলল–
“প্লিজ কান্না থামাও।”
রেহাংশী হাতের বেড় শিথিল করে। হাঁটু ভর দেওয়া দেহ গদির পাটাতনে রাখে। উলুথুলু চাহনিতে ব্যস্ত সে। চোখের কোটর ঝাপসা। বিছানা থেকে মেঝেতে রাখা দুই পায়ের এক পা বিছানায় রাখে ইনজাদ। রেহাংশীর দিকে ঘুরে বসে। আরেকটু কাছে এগিয়ে যায় রেহাংশীর। ভেজা আঁখিপল্লব চুইয়ে পড়ছে স্বচ্ছ, নোনতা নহর। ইনজাদ রেহাংশীর হাতের কব্জি হাত দিয়ে ঘষে বলল—
“চুড়ি পরোনি কেন?”
রেহাংশী নির্বাক। তার কণ্ঠদেশে চাহনি বিদ্ধ করল ইনজাদ। বলল–
“গলায়ও কিছু পরোনি।”
রেহাংশী নাক টানছে। হাতের উলটো পাশ দিয়ে সিক্ত চোখ মুছে নেয়। ইনজাদ ফিচেল হাসে। রেহাংশীর ভাঁজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে দুষ্ট করে চাহনি। তার পায়ের কাছে শাড়িতে হাত গলায় ইনজাদ। ছোঁয়ার মাত্রা উপরের দিকে উঠতেই পা সরিয়ে নেয়ে রেহাংশী। ঠান্ডা গলায় বলল–
“এমন করছেন কেন?”
ইনজাদ অধর বিস্তৃত করে বলল—
“হাসো না কেন? হাসো, হাসো।”
রেহাংশীর গলায়, গালে অধরের ছোট্ট স্পর্শ আঁকে ইনজাদ। ফুরফুরে হেসে বলল—
“এত কান্নার কীসের? আমার বিষবাণ কাঁদবে কেন? অন্যকে কাঁদাবে। আমার মতো।”
রেহাংশী মুখ ভার করে বলল—
“আমি আপনাকে কাঁদাই?”
“তা নয়তো কী? কিছু হলেই তো কথা বন্ধ করে দাও, খাওয়া বন্ধ করে দাও, আমাকে তো কাছেও ঘেঁষতে দাও না।”
“এত ঘষাঘষি কীসের আপনার?”
ইনজাদ ফিক করে হেসে বলল—
“শীতকালে ঘষাঘষিই তো ভালো। শরীর গরম থাকে।”
খলখল করে হেসে উঠে ইনজাদ।
চলবে,,,