মোহঘোর #পর্বঃ৪৩

0
657

#মোহঘোর
#পর্বঃ৪৩
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে ইনজাদ। তার মন, মস্তিষ্ক অশান্ত, উদ্বেলিত, বিচলিত। মেহমাদ গাঢ় নজরে তাকিয়ে আছে। ইনজাদের গম্ভীর আননে চিন্তার রেখা প্রস্ফুটিত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
মেহমাদ কণ্ঠ সচল করে বলল—

“তুই এত ভাবছিস কেন?”

ইনজাদ শ্বাস ফেলল। অসহায় স্বরে বলল–

“তুই বল আমি কী করব? এই মেয়ে আমার কোনো কথাই শুনছে না। ভাবতে পারছিস! কী করেছে ও? কী ভাবে ও আমার সম্পর্কে?”

মেহমাদ তরল শ্বাস ফেলল। দুই হাতের অঞ্জলি দিয়ে পুরো মুখ ঘুরিয়ে চিবুকে এনে বলল—

“ও আসলে অনেক টেনশনে আছে। ও তোকে সন্দেহ করে না। ও তোকে হারানোর ভয় করে। সিন্ধুজা ওর সমস্যা নয় সমস্যা সিন্ধুজা ওর বাবার সাথে রিলেটেড। ওর মস্তিষ্ক এটা মানতে চাইছে না যে পৃথিবীর সব পুরুষ এক নয়। মানতে পারছে না সব পুরুষ বদলায় না।”

“এখন তুই বল আমি করব? কী করে বিশ্বাস করাব আমি ওকে, যে আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি।”

মেহমাদ বিজ্ঞের মতো বলল—

“তুই ওকে ভালোবাসিস তা ও ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই তোকে হারানোর ভয় ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তোর তো খুশি হওয়া উচিত। ভাগ্যবান তুই! কোনো এক নারী তোকে তার সর্বস্ব মেনেছে।”

“তোর ফিলোসফি তোর কাছে রাখ। আমার ভয় হয়। ওকে রেখে কোথাও যেতে পারি না আমি। ওই মেয়ে ভয়ংকর। ওর রাগের পরিধি তোর জানা নেই। নিজের ক্ষতি করতে রেহাংশী একবারো ভাববে না। ভাববে না ওর কিছু হলে আমার কী হবে? ছোট্ট একটা কারণে কী করেছে বুঝতে পারছিস তুই?”

মেহমাদ নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে রইল। গাঢ় কণ্ঠে বলল—

“সময় দে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর।”

ইনজাদ কৌতূহলী চোখে তাকাল। মেহমাদ তার ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে ইনজাদকে দিলো। ইনজাদ কপাল কুঁচকে বলল—

“সাইক্রিয়াটিস্ট?”

“হুম। ওর মানসিক চাপ কমাতে কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন। তোর মনে আছে, ইফতারের কথা? যুথির সাথে ব্রেকআপের পর ও দুইবার সুইসাইড করতে গেছিল! সেই ছেলে এখন একটা আইটি ফার্মের মালিক। রেহাংশীও ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখ। কার্ডটা রাখ। তুই জানাস কবে যাবি। আমি জানিয়ে রাখব তাকে। তিয়ার পরিচিত।”

ইনজাদ নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। মেহমাদ উঠে দাঁড়ায়। মোলায়েম স্বরে বলল—

“আমি এখন যাই। কিছু লাগলে জানাস আমাকে।”

“আচ্ছা। একটা কাজ করতে পারবি?”

“বল।”

“মোবাইলটা ভেঙে ফেলেছে আমার। তোকে টাকা দিচ্ছি একটা সেট নিয়ে আয়। এখন বাইরে যেতে পারছি না।”

মেহমাদ অল্প বিস্তর হেসে নিজের মোবাইল ফোন থেকে সিম বের করে ইনজাদকে দিয়ে দেয়। ইনজাদ আপত্তি করে বলল—

“আরে কী করছিস?”

“নে, বাসায় আরো একটা আছে। তুইও তো একবার নিজের নতুন মোবাইল আমাকে দিয়েছিলি তিয়াকে গিফ্ট করার জন্য। ফেরত নিসনি তো আর। আমি তো পুরান দিলাম। রেখে দে। আসি আমি। আমার বোনের খেয়াল রাখবি। নাহলে তোর মাজার হাড্ডি ভাঙব।”

ইনজাদ গালভর্তি হেসে বলল—

“তিয়াকে নিয়ে বাসায় আসিস।”

“হুম।”
,
,
,
নিদ্রাচ্ছন্ন রেহাংশী। গায়ে চাদর টানা। তার হাত বেরিয়ে আছে বিছানা থেকে দূরে। চুল ছড়িয়ে আছে বিছানায়। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা রেহাংশীর মোবাইল ফোন থেকে নিজের সিম খুলে নিল সে। মেহমাদের দেওয়া মোবাইল ফোনে সিম ইনসার্ট করে পকেটে নিয়ে নিল।

ধীর পায়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। নৈঃশব্দে বসল মেঝেতে। রেহাংশীর বাড়িয়ে থাকা হাতটা চাদরের আদলে ঢেকে দিলো। তার অবিন্যস্ত চুলে হাত গলালো। কপালে, গালে বিছিয়ে থাকা চুল আঙুলের সাহায্যে কানের পেছনে গুঁজে দিল। ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো গাঢ় মায়ায়। মৃদু স্বরে ডাকল—

“রেহাংশী! উঠো, সন্ধ্যা হয়েছে।”

কিঞ্চিৎ শব্দের ঝংকার আলোড়ন তুলল রেহাংশীর কর্ণগহ্বরে। গায়ের চাদরে নিজেকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে চোখের পাতা শক্ত করে নিল। ইনজাদ হালকা হেসে ফের ডাকল—-

“রেহাংশী! ওঠো, মামা -মামি আসবে। তাড়াতাড়ি ওঠো।”

রেহাংশী চট করে চোখ খুলল। ধড়াম করে উঠে বসল। প্রসারিত চোখে বলল—

“কী বলছেন? মামা-মামি আসবে? কখন? কবে?”

ইনজাদ বিছানায় হাতের ভর দিয়ে উঠে রেহাংশীর পাশে বসল। স্মিত কণ্ঠে বলল—

“তারা রওনা দিয়েছে।”

“আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন? এখন কী হবে বলুন তো? আমি কিচ্ছু রান্না করিনি।”

“রান্না নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। মামি করে নেবে।”

রেহাংশী মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল—-

“পাগল হয়েছেন আপনি? বেড়াতে এসে কেউ রান্না করে?”

এলোমেলো চুল গুলো হাত খোঁপা করে নেয় রেহাংশী। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে আসে। ইনজাদ সতেজ গলায় বলল—

“এত ব্যস্ত হতে হবে না। আস্তে ধীরে করো।”

“মামা-মামি প্রথমবার আসবে। কী ভাববে বলুন তো?”

“কী ভাববে?”

“ভাববে, ছেলের বউ কোনো কাজের না।”

ইনজাদ চোখে হাসল।

“দুপুরে ঔষধ খেয়েছিলে?”

“হুম।”

“আচ্ছা যাও। কী রান্না করবে করো। আমি একটু নিচে গেলাম।”

রেহাংশী কপালে ভাঁজ তুলল। চোয়াল শক্ত করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল—

“কোথায় যাবেন?”

ইনজাদ লম্বা শ্বাস ফেলল। চোখে সতেজতা নিয়ে বলল—-

“মাথা ধরেছে আমার।”

রেহাংশী বুঝতে পারল ইনজাদের সিগারেটের নেশা উঠেছে। সকালেই সিগারেটের খালি প্যাকেট ময়লার ঝুড়িতে ফেলেছে সে। নিরুদ্বেগ গলায় বলল—

“যান, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। অনেক রান্না বাকি।”

ইনজাদ আলতো হেসে বলল–

“আচ্ছা।”
,
,
,
সন্ধ্যার গাঢ় তিমির। আকাশে এক ফালি চাঁদ। হিমশীতল প্রকৃতি। অগ্নিসখে যেন বরফ ভেসে বেড়াচ্ছে! ইনজাদ টিশার্টের ওপর ফুলস্লিভের ভারী গেঞ্জি পরেছে। চায়ের দোকান থেকে ছিটকে আসছে আলো। ইনজাদ এক কোণে দাঁড়িয়ে একটা ইটের ওপর তার বাম পা তুলে রেখেছে। বাম হাতে সিগারেট ডানহাতে মোবাইল ফোন কানে চেপে রেখেছে।

” সরি মানান ভাই। যেতে পারিনি আমি। আমি স্যারকে জানিয়ে দিয়েছি। আমার পক্ষে আর এই চাকরিটা করা সম্ভব না। স্যারকে আমি আপনার নাম রিকোমেন্ড করেছি। আর ওই কোম্পানির লিস্টটা আপনার ইমেইলে পাঠিয়েছি। কোম্পানিটা ভালোই। তবে আপনি আরেকবার ক্রস চেক করে নেবেন। পারলে একটু সরাসরি তাদের সাথে কথা বলবেন। স্যারের সাথে বা সিন্ধুজার সাথেও একবার কথা বলে নেবেন।”

মানান নরম কণ্ঠে বলল—

“বুঝলাম, কিন্তু শ্বশুরকে বারবার স্যার কেন বলছ?”

ইনজাদ সিগারেটে টান দিলো। বাকিটুকু নিচে ফেলে ইটের ওপর থেকে পা সরিয়ে পিষে দিলো। নির্মল গলায় বলল—

“তার সাথে আমার কোনো পার্সোনাল সম্পর্ক নেই। যা আছে প্রফেশনাল।”

“তাহলে পার্সোনাল সম্পর্কের জন্য প্রফেশন কেন ছাড়ছ?”

“রেহাংশীর জন্য। আমি ছাড়া ওর ভরসা করার মতো কেউ নেই মানান ভাই। সেই আমিটাও যদি ওর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু না হতে পারি, তাহলে ও কোথায় যাবে? বাদ দিন। রাখি, ভালো থাকবেন। ভাবীকে নিয়ে বাসায় আসবেন। আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

চকিতে কারো কণ্ঠ শুনতে পায় ইনজাদ। নিয়নের বাতির আলোতে সে তার মামাকে দেখল। ইনজাদ গালভর্তি হেসে ডেকে উঠল—

“মামা!”

ত্রিমুল কাউকে ইনজাদের ঠিকানা জিজ্ঞেস করছিল। তার কণ্ঠেই সামনে তাকাল। ইনজাদকে দেখেই প্রসন্ন হাসল। ইনজাদ হেঁটে গেল সামনে। বলল—-

“এত দেরি করলে যে?”

“আরে ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। এই চিপাগলির মধ্যে বাসা নিলি ক্যান?”

ইনজাদ অধর বিস্তৃত করে বলল—

” আমি তোমার মতো বড়োলোক্স নই। শহরে নিজের বাড়ি আর গাড়ি থাকলে, আর কী লাগে! ভাড়া বাসা ওই চিপাগলিই। কেমন আছ মামি?”

সুরমা এক পশলা হেসে বললেন—

“ভালো, তুমি কেমন আছ?”

“ভালো। তোকে জিজ্ঞেস করব না। ওইখানেই দাঁড়া।”

ত্রিনা নাক ফুলিয়ে বলল—

“তোমার জিজ্ঞেস করতে হবে না। হুহ!”

সুরমা আর ত্রিমুল মুচকি হাসল। ত্রিমুল প্রশ্ন ছুড়লেন—

“এখানে কী করছিলি?”

ইনজাদকে সুযোগ না দিয়েই ফটফট করে বলা শুরু করে ত্রিনা—

“হাওয়া খেতে এসেছে হাওয়া। স্মেল পাচ্ছ না? ছি! ইয়াক! রেহাংশী যে কী করে এটাকে সহ্য করে!”

ইনজাদ অপ্রস্তুত হলো। ইচ্ছে করছে ঠাসা এক চড় বসাতে ত্রিনার গালে। নিজের অভীপ্সাকে দমন করল সে। হেসে বলল—

“ব্যাগ দাও আমার কাছে।”

” আরে না, তোর নিতে হবে না। ”

ত্রিনা টগবগ করে বলল—

“তোমার নিতে হবে না। পরে মিষ্টি বউ বলবে, তার বরকে দিয়ে আমরা কুলির কাজ করিয়েছি।”

সুরমা ধমকি মেরে বললেন—

“তুই চুপ করবি? থাম। রেহাংশী কেমন আছে ইনজাদ?”

“ভালো, এখান দাঁড়িয়ে কথা বলবে না কী? বাসায় চলো। ও অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। আর, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। যেভাবে চলছে চলতে দাও।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here