#মোহঘোর
#পর্বঃ৪৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
“কেমন আছিস জিজ্ঞেস করব না। কারণ, আমি জানি তুই ভালো আছিস। ভালো থাকার জন্যই তো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলি। কিন্তু, একবারো কী ভেবেছিস, তোকে ছাড়া আমি কেমন থাকব? কেন ভাবিসনি রেহাংশী? এ মন পিঞ্জিরায় তোর জন্য যে ভালোবাসার খাঁচাটা আমি তৈরি করেছিলাম, তা কেন শূন্য রেখে চলে গেলি? চার বছরে একবারো কী আমাকে নিয়ে ভাবার সময় হয়নি তোর? তোর বুকের মধ্যে একবারো আমার নামের ভালোবাসার ফুল কেন ফুটল না? খরা-ই থেকে গেল আমার হৃদয়ে, বসন্ত আর এলো না!
তোর মনে আছে, প্রথমবার যখন তোর দাঁত পড়েছিল? মামি অসুস্থ ছিল। জোর করে তোর দাঁতটা আমি ফেলে দিয়েছিলাম। তুই একটা কামড় বসিয়েছিলি আমার হাতে। তার দাগ আমি আজও মুছে যেতে দিইনি। চুড়ির জন্য মার খেয়েছিলি। সাধ্য ছিল নারে! তাই দিতে পারিনি। তোর পায়ে নুপূর দেখার শখ ছিল। ভেবেছিলাম নিজ হাতে পরাব তোর পায়ে। কিন্তু সেই সুযোগ-ই দিলি না আমায়! মেয়েদের টিপ পরতে নেই। ইসলামে বাঁধা। তুই পরিস না কখনো। কেন এতটা পর করলি আমায়? বলতে পারিস?
আমি তোর জন্য এসেছিলাম ও বাড়িতে। কিন্তু তুই? কেন করলি রেহাংশী? কেন ভালোবাসতে পারলি আমায়? আমার জীবনের অপূর্ণতার খাতায় তুই কেন যোগ হলি? কেন আমার ভালোবাসার পূর্ণতা দিলি না? তোর জন্য যে আমি এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না। তুই তো শান্তিতেই ঘুমাস। তুই শান্তিতে থাক। পৃথিবীর সব সুখ তোর অদৃষ্টে লেপে যাক। আমার কপালের সব অব্যক্ত সুখ তোর হোক। তুই ভালো থাক। তোর ভালোবাসা, সব সময় তোর হয়ে থাক। আমি যেখানেই থাকি না কেন, সব সময় চাইব তুই ভালো থাক। আমার শূন্যতার বেড়াজালে তোর পূর্ণতা হোক। তোর ভালোবাসা পাওয়ার তৃষ্ণা আমার এ জনমে যাবে না। হৃৎপিন্ডের যেখানে তোকে আমি রেখেছি, তার ছোঁয়াও আমি কাউকে লাগতে দেবো না। আমার না হওয়া পরিণীতা তুই। তোর প্রেমেই আমি বৈরাগী। আমার অদৃশ্য রাজ্য তুই, সেই রাজ্যের আছোঁয়া রাজকুমারী তুই। ওই সুদূর আকাশের চাঁদের মতো আমি দূর থেকেই তোকে দেখব, ভালোবাসব। শুধু একটিবার তুই ভেবেনিস, তোর নুহাশ ভাইয়া সত্যিই তোকে তার প্রাণবধুঁ ভেবেছিল!”
সাদা কাগজের ওপর কালো অক্ষরে নুহাশের সুসংস্থিত অনুভূতি। যার প্রতিটি শব্দের সাথে টুপ টুপ করে ঝরছে রেহাংশীর চোখের জল। নীরব কান্নারা তার কণ্ঠরোধ করে রেখেছে। হেঁচকি তুলে যাচ্ছে সে। চিঠির পাতাটা কড়কড়ে। নুহাশের চোখের জলে হয়তো সিক্ত হয়েছিল! অস্পষ্ট দাগের ইশারা! চিঠির পাতাটি সরিয়ে ঝাপসা,ছলছল চোখে তাকাল বক্সের দিকে। ছোট্ট একটি ইনটেক করা পলিথিনে রেহাংশীর ছোট্ট ইদুর দাঁত, বক্স ভর্তি প্রায় পনেরো মুঠ রেশমি চুড়ি, এক জোড়া নুপূর, কয়েক পাতা টিপ। রেহাংশীর চোখের জলে সিক্ত হতে লাগল সব। কারো অব্যক্ত অনুভূতিরা স্নিগ্ধ, শীতল জলে অবগাহনে মত্ত। নত মাথার চোখের জল নাকের ডগা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে। রেহাংশী ঠোঁট কামড়ে কান্না রোধ করার চেষ্টা করল। পাশে বসা ইনজাদ নম্র গলায় বলল—
“বাকিটা শেষ করো বিষবাণ, দ্রুত।”
রেহাংশী চোখ তুলে তাকাল ইনজাদের দিকে। কাতর, বিমর্ষ, হতপ্রায় চাহনি। ইনজাদ চোখের ইশারায় বলল, চিঠির বাকি অংশটুকু পড়তে। রেহাংশী চোখের পানি মুছে নিল। পাতা উলটালো ধীর হাতে। কালো অক্ষরগুলো এতটা ধারালো কেন? সব বিদীর্ণ করে রক্তাক্ত করছে!
” কাঁদিস না। ওসব আমার ছেলেমানুষি। আমার ছন্নছাড়া একপাক্ষিক ভালোবাসা। এবার তোকে লিখব। কেমন আছিস তুই? রাগ করেছিস? বিয়ের দিন কথা বলিনি বলে! রাগ করিস না। তোর ঢাল তোর সাথেই আছে রে। সেদিন আমার কী মনে হয়েছিল জানিস? আমি সত্যিই তোর যোগ্য নই। ইনজাদ-ই সেই পুরুষ যার ললাটে আমার পুতুর লেখা ছিল। ও তোকে ভালো রাখবে। ভাগ্য বল! চার বছরে আমি যা পারিনি, ইনজাদ তা চারদিনে করে ফেলল! ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়!
‘হাজার বার বলেও কখনো ভালোবাসা হয় না, কিন্তু একবার না বলেও….অনন্ত জীবনের ভালোবাসা হয়ে যায়।’
তোর আর ইনজাদের সম্পর্কটাও তেমন। সেদিন তোর হয়ে ওকে প্রতিবাদ করতে দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি, তুই আমার না হয়ে স্বামী সোহাগী হো। স্বামীর সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে পড়ুক তোর আঁচলে। ভালোবাসায় মুড়িয়ে থাক তোর অপ্রাপ্তিগুলো। লোকের হিংসে হোক তোর সুখ দেখে!
তোকে আমি কখনো ভুলব নারে পুতুল। আফসোস! জীবনের রেওয়ামিলের ডেবিট-ক্রেডিট মিললো না আমার। অনিশ্চিত হিসেব করে পায়েলকে বসাতে হলো। তবে তার অবহেলা আমি করব না। ভালোবাসব ওকে আমি, কিন্তু তোর মতো করে পারব না। জানিস, ছেলেরা জীবনের প্রথম সিগারেটের টান, আর প্রথম ভালোবাসার টান ভুলতে পারে না। আমিও পারব না তোকে। তবে পায়েলকে আমি তার অধিকার দেবো। কে বলেছে দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায় না? যায়, হয়তো প্রথমবারের মতো করে নয়। আমিও পায়েলকে ভালোবাসব। রোজ যেই মেয়েটা আমার জন্য রাত জেগে বসে থাকে, আমার জন্য চিন্তা করে তাকে ভালোবাসব। আমার স্ত্রীকে ভালোবাসব। তবে আমার পুতুলকে ভুলে গিয়ে নয়।
সুখে থাকিস পুতুল
আমার ভালোবাসার পুতুল।
ইতি তোর পাগল
নুহাশ ভাই।
অবিশ্রান্ত দরিরয়া উত্তাল ঢেউ আঁছড়ে পড়ল রেহাংশীর বুকে। সমূলে উপরে যাওয়া গাছের মতো হামলে পড়ল ইনজাদের বক্ষ:স্থলে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। ইনজাদ আলতো করে জড়িয়ে ধরল রেহাংশীকে। রেহাংশীর উরুর ওপর থেকে বক্সটা পড়তে গেলেই ধরে ফেলে ইনজাদ। বিছানার ওপর সন্তর্পণে রেখে বুক বুলিয়ে শ্বাস ফেলল। রেহাংশী ঝমঝমিয়ে কেঁদে বলল—
“এমন কেন হয় বলুন তো। যে মানুষগুলোর ভালোবাসার জন্য আমি হাহাকার করেছি, তারা কেন আমাকে ভালোবাসতে পারল না? মা কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল, বাবা নামক ওই ব্যক্তি কেন আমার খোঁজ নিল না? যেই মানুষগুলোকে আমি আমার ছায়া ভেবেছি, তারা কেন আমাকে শুধু রৌদ্র দাহে জ্বালালো?
আর ওই পাগল মানুষটাকে, যাকে সহ্য করতে পারতাম না; সে কেন এতটা ভালোবাসল আমায়? কেন বাসল? বিশ্বাস করুন, আমি কখনো নুহাশ ভাইয়া ভালোবাসিনি। কখনো না।”
ইনজাদ নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে বলল—
“ভালোবাসা এমনই এক অদ্ভুত অনুভূতি, বিনা পরিচর্যায় যার অঙ্কুরোদগম হয়। ভালোবাসা এক অঁচ্ছুৎ মায়া, যার ঘোর কাটাতে কাটাতে আমরা বিভোর হয়ে যাই। ভালোবাসা সমুদ্রের ওই উত্তাল ঢেউ, যার মাতাল তরঙ্গে আমরা ভেসে যাই নিরুদ্দেশ। ভালোবাসার গভীরতা কত? যার সঠিক অঙ্ক আজ পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। ভালোবাসার সংঙ্গা আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তার পরিমাণ আজও নির্ধারিত হয়নি।
অসীম আকাশের সাথে যার তুলনা, সায়রের অতলস্পর্শী জলরাশির সাথে যার তুলনা, হিমালয়ের শীতলতার সাথে যার তুলনা, মানুষের সাধ্য কী তার কারণ নির্ণয় করে?
হয়ে যায় ভালোবাসা। বিনা কারণে, বিনা জানে, বিনা ভাবনায়; ব্যস, হয়ে যায় ভালোবাসা।”
রেহাংশী মাথা তোলে। তার পদ্মদিঘি জলে থৈ থৈ। ইনজাদ হাসল। হাতের অঞ্জলিতে রেহাংশীর মুখে নিয়ে গভীর চুমু খেলো তার ললাটে। নাকে নাক ঘষে চোখে হেসে বলল—
“কে বলেছে আমার বিষবাণকে কেউ ভালোবাসে না? তাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব আছে না কী! নিভৃতে,জাগরণে, কত কত মানুষ! তাই না?”
রেহাংশী চুপ করে রইল। দরজার ফাঁক গলিয়ে মাথা ঢুকিয়েছে ত্রিনা। চটপটে গলায় বলল—
“তোমরা কী রোমান্স করছ? না কী আমি একটু ভেতরে আসবো?”
রেহাংশী চটজলদি চোখ মুছে নেয়। ত্রিনার দিকে বক্রনেত্রে তাকাল ইনজাদ। ভ্রূ নাচিয়ে বলল—
” এসেই যখন পড়েছিস, পারমিশন কেন চাইছিস?”
ত্রিনা ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। বিছানায় রাখা বক্সটার দিকে চোখ পড়তেই খুশিতে ঝলমলিয়ে বলল—
“ও মা এত চুড়ি!”
ত্রিনা হাত দিতে গেলেই খপ করে তার হাত ধরে ফেলে ইনজাদ। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
” আমার বউয়ের জিনিসে তুই হাত দিস কেন? দূরে থাক।”
ত্রিনা মুখ ভেঙচায়। ইনজাদ বিছানা থেকে উঠে হাঁটু মুড়ে রেহাংশীর সামনে বসে। বক্স থেকে লাল রঙের দুই মুঠ চুড়ি নিয়ে রেহাংশীর দুই হাতে পরিয়ে দেয়। পায়ে পরিয়ে দেয় নুপূর। টিপের পাতা রয়ে গেল। ফিক করে হেসে ফেলে ইনজাদ। দাঁতের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল—
“দেখি, হা করো, দাঁতটা লাগিয়ে দিই।”
রেহাংশী লজ্জায় ডুবে বলল—
“ধুর!”
গা দুলিয়ে হেসে উঠে ইনজাদ। খিলখিল করে হেসে উঠে ত্রিনা।
চলবে,,,