মোহিনী পাঠ-১

Story – মোহিনী
Writer – Nirjara Neera
পার্ট – ১
.
চোখটা এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছি। মানে রাস্তা টা দিয়ে হেটে যাচ্ছি। রাস্তার অবস্থা বেশ শোচনীয়। নানা রকম খানা খন্দে ভরা। বৃষ্টির পানি জমে একেকটা বিভিন্ন রকমের পুকুর হয়ে আছে। পারত পক্ষে আমি এই রাস্তা কখনো মাড়ায় না। কিন্তু আজকে মাড়াতে হবে। হতে পারে এখন থেকে প্রতিদিন মাড়াতে হবে। কারন একটা বাড়িতে আমাকে ডাকা হয়েছে। যাদের বাড়িতে যাচ্ছি তাদের সাথে আমার তেমন কোনো জানাশোনা নেই। শুধু স্থানীয় জমিদার বলে শুনেছিলাম। কেন তারা আমাকে ডেকেছে মনে মনে ভাবছিলাম। হুট করেই নিজের মাথায় নিজেই একটা থাপ্পর মারলাম। মনে মনে বললাম “আরে গাধী তোরে তো সবাই ডাকবে। তুই একটা টিচার… না গাধী টিচার।”
নিজের উপরই একরাশ বিরক্তি নিয়ে সামনে পা ফেললাম। কিন্তু পা ফেলতেই কিছু একটা ঘটল। আমি বুঝতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করে ফেললাম যাতে কি হয়েছে তা যেন দেখতে না হয়। কিন্তু চোখ আমার টা বন্ধ হলেও পাবলিকের চোখ বন্ধ ছিল না। কারো খিক খিক, খ্যাক খ্যাক, কারো অট্টহাসি, কারো ফাটা বাঁশের মত হাসি শুনতে পেলাম। কি হলো? সবাই হাসছে কেন? মাথা আর হাতে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। আহ… কি ব্যথা! চোখ খুললাম। কিন্তু বিশাল আকাশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। খটকা লাগল। আমি কি মরে গেছি? হতে পারে। যাক ভালোই হলো। এখন একটু শান্তি তে ঘুমাই তে পারব। এই বলে যখন পাশ ফিরলাম তখনই ভেজা ভেজা লাগল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। ভেজা জিনিস আমার একদম পছন্দ না। এবার আমি দুনিয়া তে ফিরলাম। চার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম কি হলো। আমি মারাত্মক খারাপ ভাবে একটা আছাড় খেয়েছি। শুধু তাই না। এমন ভাবে খেয়েছি যাতে আমি চিৎপটাং হয়ে রাস্তায় শুয়ে আছি। আর তা দেখে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই হাসছে। হাসুক… হাসির তো ব্যাপার। অমন একটা মেয়ে রাস্তায় পড়ে গেল তাতো হাসির ব্যাপার। আমি ওদের পরোয়া না করে উঠতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। হাত ছিলে গেছে, পাও ছিলে গেছে নিশ্চই। ভাগ্যিস এটা মেইন রোড ছিল না। না হলে দ্বিগুন লজ্জার মুখে পড়তে হত। এটা কাচা রাস্তা। অনেক কষ্ট করে উঠে দাড়ালাম। তারপর ময়লা ঝেড়ে হাটা শুরু করলাম। আশে পাশের মানুষের হাসিকে তোয়াক্কা না করেই। আসলেই যখন আপনাকে কেউ লজ্জা দিবে তখন এমন ভাব দেখাবেন যেন আপনি একদমই লজ্জা পাচ্ছেন না।
ওইতো বাসা দেখা যাচ্ছে। মানে গেট। গেট টা এত বড় না। ছোট খাট সাইজ। বৃষ্টির সময় হওয়ায় গেইটের দেওয়ালের শ্যাওলা গুলো ঘন সবুজ হয়ে আছে। গেইটের ওপরের দিকে লতা পাতা জড়ানো। তাতে ছোট ছোট ফুল ফুটে রয়েছে। ফুল গুলো গেট টাকে একদম জীবন্ত বানিয়ে ছেড়েছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম গেইটের সৌন্দর্যের দিকে। আহামরি কোনো গেইট নয়। তবুও যেন নজর আটকে রাখার মত। হয়ত ফুল গুলোর জন্য। যখন আমি আমার বাড়ি বানাব তখন এইরকম ফুলের গাছ গুলো লাগাব যাতে গেট জীবন্ত হয়ে উঠে। নিজে নিজে স্বগতোক্তি করলাম।
এই পরিকল্পনা করে যখনই গেইটের ভিতর ঢুকলাম অমনি একটা ধমকা বাতাস গায়ে লাগল। বাতাস আমার ভালো লাগে কিন্তু এই বাতাস কেন জানি আমার ভালো লাগল না। বাতাসে আমার গায়ের ওড়না একদিকে পড়ে গেল। ভাগ্যিস কোন মানুষ জন নাই। না কিযে লজ্জার মুখে পড়তে হতো। ওড়না ঠিক করতে করতে বির বির করতে লাগলাম। ঘরের বারান্দায় পা রাখতেই পিলারের সাথে বাড়ি খেলাম। উফফ্… আমি গাধী মেয়েটা যেখানেই যাই সেখানেই কিছু একটা হয়েই থাকে। নিশ্চয় আলু হয়ে আছে কপাল টা। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কলিংবেলে হাত দিলাম। বাজল না। কয়েকবার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলাম এটা নষ্ট। দরজায় হাত দিয়ে টোকা দিতে লাগলাম। এই ফাঁকে চারদিকে তাকালাম। সুন্দর গোছানো ছোট্ট উঠান। একপাশে অযত্নে গড়ে উঠা ফুলের বাগান। পাশ দিয়ে প্রশস্ত জায়গা। এমন সময় দরজায় খুট করে শব্দ হলো। সাথে সাথে আমি সামনে তাকালাম। ফর্সা ধরনের একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দরজা খুললেন। উনাকে দেখে মনে হলো যৌবনে অনেক সুন্দরি ছিলেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম
-“আসসালামু আলাইকুম। জি… আমাকে কে ফোন করা হয়েছিল। এখানে আসতে বলা হয়েছিল।”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষন তাকিয়েই বললেন
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আস ভিতরে আস। আমিই ফোন করেছিলাম তোমাকে।”
ছোটবেলা থেকেই এদের নাম শুনেছি কিন্তু দেখার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। টিচার হওয়ার সুবাদে আজ স্বচক্ষে দেখার ভাগ্য হল।
ভদ্রমহিলা আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ঘর দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ছিমছাম সাজানো গোছানো ঘর। কেমন যেন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। মনে হল ঘরে তেমন বাচ্চা কাচ্চা নেই। থাকলে এতটা সুনসান হয়ে থাকত না।
ভদ্রমহিলা একটা রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে সোফায় বসতে দিলেন। ভিতরে কাউকে ডেকে আমাকে চা দেওয়ার কথা বললেন চুলায়।
আমি দ্রুত বলে উঠলাম
-“না না চা লাগবেনা। আমি এখনই চলে যাব।”
-“খেয়ে যাও দেরী হবে না। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। আমার মেয়ের জন্য। তার আগের মিস এর বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। তাই নতুন টিচার এর খোঁজ নিচ্ছিলাম। তোমার কথা শুনে ফোন করলাম।”
-“আপনার মেয়ের নাম কি?”
-“মারোয়া! ক্লাস ফোরে উঠেছে এবার। প্রথম হয়ে।”
.
অামি মনে মনে ভাবলাম “টিউশনি খারাপ হবেনা।”
ভদ্রমহিলা বলতে লাগলেন,
-আসলে আগের মিস মারোয়া কে পছন্দ করত। রিয়া নাম। এখন বিয়ে হয়েছে। তাই পড়াতে পারছেনা। আর বাড়িতে কোন পুরুষ টিচার আনতে চাচ্ছিলাম না। মেয়ে একটা বড় হয়েছে বুঝোই তো।”
আমি হা করে তাকালাম। কার কথা বলছে বুঝতে পারছিনা। মারোয়ার আম্মু নিজ থেকে বললেন
-“আমার বড় মেয়ে মুক্তা। ও এবার এসএসসি পরিক্ষার্থী।”
মারোয়ার আম্মু বলা শুরু করলেন। বুঝতে পারলাম গল্প প্রিয় মানুষ। একাকিত্ব কাটেনা এখানে থেকে। তিনি তার পরিবার এর আদ্যপান্ত সব বললেন। মারোয়ার আব্বুর মৃত্যু নিয়ে, দেবর-ভাসুর দের জায়গা নিয়ে বিরোধ, অবাধ্য বড় ছেলে কে নিয়ে।
আমি কিছুতেই বসা থেকে উঠতে পারছিলাম না। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছিল। কিছুক্ষণ পর আযান দিবে। কিন্তু মারোয়ার আম্মু অনর্গল কথা বলেতই লাগলেন। আমি উঠতে চেয়েও পারছিলাম না। উসখুস করঝিলাম। মারোয়া ও ভিতর থেকে চলে এসেছিল। আমাকে এসে সালাম দিয়েছিল। ভারী মিষ্টি মেয়ে। এখন আমি এখান থেকে উঠার উপায় খুজতেছিলাম। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আস্তে আস্তে ফোন নিয়ে রিংটোন বাজাই দিলাম। আর এমন ভাব করলাম যেন আমার কল আসছে। আর মারোয়ার আম্মু কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাড়াতাড়ি ফোন কানে লাগালাম। আর বললাম
-“জি জি আমি এক্ষুনি আসছি।”
এই বলে ফোন রেখে উঠে দাড়ালাম। মারোয়ার আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম
-“আমাকে এক্ষুনি উঠতে হবে। কাল থেকে মারোয়া কে আমি পড়াতে আসব।”
.
তিনি আর বাধা দিলেন না। বের হতে যাব তখন আবার ডাকলেন। বললেন
-“এত মাটি কোথ থেকে?”
আমি এবার নিজের দিকে তাকালাম। সত্যি তো অনেক কাদা লেগে আছে। এখন অবশ্য শুকিয়ে গেছে।
-“বাইরে রাস্তায় বৃষ্টি পড়ে কাদা হয়েছিল। ওই খান থেকে লেগেছে।”
ফের মারোয়ার আম্মু আমাকে পরিষ্কার হতে সাহায্য করলেন। কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দিলেন। শেষে যখন বের হতে লাগলাম তিনি জিজ্ঞেস করলেন
-“তোমার নাম তো জানা হল না। কি নাম তোমার?”
-“আমার নাম রেহনুমা… রেহনুমা হাসান।
-” বাহ্! খুব সুন্দর! আনোয়ার হাসানের মেয়ে নাকি তুমি?”
-“জি!”
-“বাহ্ ভালো! তোমার আব্বুর সাথে পরিচয় আছে আমাদের। মারোয়ার আব্বু বেঁচে থাকতে বেশ কয়েকবার এসেছিল এখানে।”
জবাবে আমি একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। মনটা ভালো হয়ে গেল। মারোয়ার আম্মুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা টা বেড়ে গেল। এমন সময় ঘর থেকে ফোন আসল। আমার ভাই রিফাত ফোন করছে। -“কিরে রিফাত… কি হয়ছে?
-“কি হয়ছে আমারে জিগাস? কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আম্মু এদিকে আমার মাথা খেয়ে ফেলতেছে।”
-“ওকে ওকে আমি আসতেছি।”
ফোন কেটে দিলাম। রিফাত আমার ছোট ভাই। আমরা দু বোন, এক ভাই। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ছে এক বছর আগে। তার নাম রেহনুবা হাসান। আর ভাইয়ের নাম রিফাত হাসান।
ঘরে পৌছতেই আম্মু চেঁচামেচি শুরু করল। আম্মুর এমনিতেই অল্প ব্যাপারে হই হই রই রই করা অভ্যাস। দেরী হওয়ায় আজকে আরো বেশি বকা বর্ষন করতে লাগলেন। আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে কলের পাড়ে চলে এলাম। ঘামে চট চট করছে শরীর টা। গোসল করতে হবে
গোসল সেরে বের হতেই দেখলাম নুবা আপু ফোন করছে। আম্মু কথা বলছে তার সাথে। সামনের সপ্তাহে দুলাভাই বিদেশ চলে যাবে। তাই চলে যাওয়ার আগের দিন জামাই কে শ্বশুর বাড়ি মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য বানিয়ে পাঠাতে হয়। আপুকে সেটা পাঠানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। হায়রে মানুষ!
রান্না ঘরে গিয়ে ডেকচির ঢাকনা উল্টিয়ে দেখলাম আম্মু কি রান্না করছে। একটাতে ভাত, একটাতে ডাল, একটাতে শুকনা তরকারি। মাকে ডাক দিলাম
-“আম্মু… আম্মু”
-“কি হইছে?”
-“তরকারি আর নাই?”
-“আর নাই মা। ওই উপরে কড়াই তে ডিম ভেজে রাখছি। ওইটা নে।”
-“লাগবেনা মা। ওইটা রিফাত কে দিও।”
.
খেয়ে পড়তে বসলাম। রিফাত একপাশে বসে গুন গুন করে পড়ছে। আমার বি.এ ফাইনাল পরিক্ষা বেশি দূরে না। বই এখনো অর্ধেক কেনা হয়নি। বাকি গুলা নিয়ে পড়তে বসলাম। কিন্তু পড়ায় মন বসছে না। বাম চোখের পাতা টা ভীষন ভাবে কাঁপছে। চোখের পাতা কাপলেই আমার মনে হয় কোনো না কোনো অঘটন ঘটবেই। ছোট বেলায় একবার ভীষন চোখ লাফিয়েছিল। তখন আব্বুর সাথে সাইকেলে বাজারে যাচ্ছিলাম। চোখ লাফাতেই কেমন করে যেন আব্বু আর আমি সাইকেল থেকে পড়ে যাই। কিন্তু আব্বুর কারনে কোনো ক্ষতি হয়নি।। এরপর ক্লাস টেনে থাকতে টেস্ট পরিক্ষার রেজাল্ট দেয়ার আগেই চোখ লাফিয়ে ছিল, তো সেই পরিক্ষার রেজাল্টে এক সাবজেক্টে খারাপ করেছিলাম। তখন থেকে আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস চোখ লাফালেই আমার বিপদ আসবে।
.
এখনো কোন ভাবে থামাতে পারছিনা। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কি হতে যাচ্ছে? পরীক্ষায় ফেল করবো না তো? নাকি পরীক্ষাই দেওয়া হবে না?
.
বাড়ির পাশেই স্কুল টা। বেসরকারি স্কুল। ঘন্টা পড়লে আমার ঘর থেকে শোনা যায়। ওই স্কুলের আমি একজন নড়বড়ে শিক্ষিকা। আমার টিউশন গুলা বেশির ভাগই স্কুল থেকে পাওয়া। এজন্য আমি বেশ কৃতজ্ঞও।
স্কুল থেকে সোজা টিউশনিতে চলে গেলাম। দুপুরের খাবার খাইনি। ভাল লাগছিল না। অনু দের বাড়িতে যেতে লাগলাম। অনু আমার আরেকটা ছাত্রী। পঞ্চম শ্রেনির ও। আমার স্কুলেই পড়ে। আসলে অনু কয়েক বছর ধরে পড়তেছে। ওকে ছাড়ি নাই তারও একটা কারন আছে। ওটা হলো ওদের বাড়ির সামনের বেলী ফুলের গাছ টা। বেলী আমার খুব প্রিয় ফুল। এই বর্ষায় কলি আসছে আমি দেখেছি। হয়তো আজ গিয়ে ফুটন্ত পাব।
ভাবনায় ছেদ ঘটল এক মহিলার ডাকে। পিছন ফিরে তাকালাম। মহিলা টাকে আমি চিনি। খুব ভালো না। তার নাতি কে আমি পড়াইছিলাম কোন এক রমজান মাসে। কিন্তু মহিলা খুব পাজি। ঈদের খরচের জন্য পড়ালেও ঈদের আগে কোনো টাকা পাই নি। টাকা দিয়েছিল ঈদের একমাস পর। বদ মহিলা! তার পর ছেড়ে দিছিলাম টিউশনিটা। কিন্তু পাজি মহিলা আমার পেছনে লেগে আছে।
-“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন? আপনার বুড়া কই?( বুড়া মানে উনার নাতি। আদর করে ডাকা।)
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ভালা আছি।। তুমি ভালা আছোনি? বুড়া কি আর বুড়ির খবর রাখে? সে বাপের সাথে দোকানে গেছে।
-“তা কি খবর কেন ডাকলেন?”
-“আমার নাতিরে একডু পড়াও না। কুনো ছার পাইতেছনা।”
মনে মনে বললাম “বয়ে গেচে আমার তোমার নাতি কে পড়াতে।” কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম
-“ওর মাকে দেন। মা ছাড়া কেও ওকে ধৈর্য ধরে পড়াতে পারবেনা।”
-“আরে দুররর… হেই বেডি পড়াতে পার নাহি?”
(অতঃপর বউয়ের নামে নানা কাহিনী বললেন। এদের এই একটা সমস্যা। বউ এর নামে রচনা লিখতে বললে দিস্তার পর দিস্ত কুৎসা লিখতে পারবে)
.
আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম
-“আরেকটা টিচার দেখেন আমার সময় নাই।”
-“কোই? ছার তো পাই না। তুমি খুইজ্যা দাও না।”
(খাইছে কপাল মনে মনে বললাম। এত সহজে আমাকে ছাড়বেনা। তাই মাথা ঘুরিয়ে বললাম
-“আপনি ওই স্কুলের আনিস আছে না!
-“হ…হ।”
-“ওকে বলেন… ওই যেমনে তেমনে যোগায় দিবে”
-“আমিতো আইজকা গেছিলাম। আনিসরে তো পাই নাই।”
মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললাম
-“আছে ও…. কাজে গেছে…কালকে আসবে। আপনি কালকে যান। পাবেন ওকে। আর আমার কথা বলবেন না ওকে।”
.
এই বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে চলা শুরু করলাম আর একটা নিশ্বাস নিলাম যেটা এতক্ষন মনে হয় চেপে রেখেছিলাম। কিছুক্ষন হাটার পর যখন অনুদের বাড়ি পৌছলাম তখন ক্ষুধা টা চড়চড় করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ওই তো বেলি ফুলের গাছ টা দেখা যাচ্ছে। ও আল্লাহ…! আমি কি দেখছি। বেলি ফুল ফুটে পুরা গাছ টা সাদা দেখাচ্ছে। আর গন্ধে চারদিকে মৌ মৌ করছে। কতক্ষণ তাকায় ছিলাম হুশ নেই। অনুর ডাক শুনে হুশ ভাঙল।
অনুদের পড়া শেষে গাছের সামনে দাড়ালাম। এক গোছা ফুল ছিড়ে মাথার খোঁপার সাথে গুজে দিলাম। আরো এক গোছা নিয়ে লাগালাম। ফুল ছিড়া তেমন ভালো কাজ না। কিন্তু কি করব? বেলী ফুল টা দেখে আমি লোভ সামলাতে পারি না। বড্ড লোভী আমি।
এবার শুরু করলাম হাটা। আশ্চর্য্য আমি ক্ষুধা ভুলে গিয়েছি। আর আমার সাথে বেলি ফুলের খুশবু শরীরের সাথে এমন ভাবে জড়িয়েছে যেন পারফিউম লাগিয়েছি। অথচ আমি পারফিউম লাগায় না। মন টা ভালো হয়ে গেল। কিন্তু আমার চোখের পাতাটা হালকা ভাবে নড়তে লাগল। বাম হাতে চেপে ধরলাম চোখটা।
.
আজকে মারোয়াদদের বাসায় প্রথম দিন। গিয়ে দেখলাম মারোয়া প্রথম থেকেই পড়াতে বসা। ও পড়ছে। আমার খুব পছন্দ হল ওকে। ও দেখতে খুব ফরসা। ঘরের সবাই দেখলাম খুব ফরসা। কিন্তু মারোয়া কিছুটা ব্যাতিক্রম। ওকে দেখতে অনেকটা কোরিয়ান মেয়েদের মতো। পার্থক্য শুধু চোখে। ওর চেহারায় কোরিয়ান একটা মডেল দেখেছিলাম। থাক সে কথা। ওকে পড়াচ্ছিলাম এমন সময় দরজায় দড়াম করে একটা শব্দ হল। শব্দে আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। সাথে সাথে বুকে থু থু দিলাম। কিন্তু মারোয়ার তেমন ভয় পেয়েছে বলে মনে হল না। স্বাভাবিক ভাবে পড়ছে। মারোয়া কে জিজ্ঞাস করলাম
-“কি হলো? কিসের শব্দ এটা?”
মারোয়া বলল
-“ভাইয়া আসছে।”
-“এত জোরে দরজা কেন খুলছে? আস্তে খুলতে পারেনা।”
-“দরজায় একটু সমস্যা আছে তাই ভাইয়া জোরে ধাক্কা মারে। তাই এত শব্দ।”
ঘরে মারোয়ার ভাই ঢুকলো। আমি সরাসরি না থাকিয়ে আড় চোখে তাকালাম। তাকিয়েই আমার মাথায় হাত পড়ল। এ – এ তো মামুন! মামুন যে মারোয়ার ভাই হবে সেটা আমি বিন্দু মাত্রও ভাবি নি। আমি বরাবরই কখনো মামুনের দিকে কখনো তাকাই নি। কারন ওর চোখের দিকে কখনো তাকাতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই পাশের এরিয়ায় হওয়ায় প্রায় সময় রাস্তা তাকে দেখতাম। যখনই দেখতাম চোখ নামিয়ে ফেলতাম। কারন ছেলেদের চেহারার মাঝে সৌন্দর্য্যের সাথে গাম্ভীর্য্য যোগ হলে তার দিকে সরাসরি তাকানো যায় না। চোখ নামিয়ে ফেলতে হয়।
.
মামুন অন্য ঘরে ঢুকে গেলে তারপর নিশ্বাস নিতে পারলাম।
মামুন ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর। আর তার গাম্ভীর্য কে ভয়ানকও বলা যায়। ছেলে মানুষের এত সুন্দর হওয়া অপরাধ। ও আমার চেয়ে দু বছরের বড়। যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যায় তখন পুরা রাস্তা থমকে যায় এক পলকের জন্য। সবাই এক বার হলেও তাকায় ওর দিকে। ওর সাথে রাস্তায় দেখা হলে আমি মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে আসি। কারন ওর দিকে আমি তাকাতে পারিনা। যেমন সূর্যের দিকে কেউ তাকাতে পারে না ঠিক তেমনি। ও কখনো আমাকে খেয়াল করেছে কিনা কে জানে?
.
ভাবনায় ছেদ পড়ল মামুন আবার আসাতে। তবে এবার খালি গায়ে। তার উপর হাটু প্যান্ট। ওর ফরসা শরীর পুরাটা দেখা যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললাম। আমার হাটু সহ কাঁপতে শুরু করল। নড়বড়ে গলায় মারোয়া কে বললাম
-“তো..তো..তোমা..মার ভাইইই খা..খালি গায়ে কে..কেন?”
মারোয়া আমার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল
-“ভাইয়া এখন গোসল করবে তাই। এই সময় ভাইয়া গোসল করে।”
সাংঘাতিক! প্রতিদিন যদি খালি গায়ে ওকে দেখি তাহলে আমি হার্ট এট্টাক করব নিশ্চিত।
ইয়া আল্লাহ আমি কি ভাবতেছি এগুলা? জোর করে মনটা মারোয়ার দিকে আনলাম। কোন রকম পড়া শেষ করে আমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসলাম। বাড়িতে এসেই শরীর টাকে বিছানাই এলিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এভাবে তো চলতে পারেনা। ওই সময় আমি আর যেতে পারব না। আমার মারোয়া দের ওই খানে যাওয়ার সময় বদলাতে হবে। অনেক ভেবে চিন্তে সকালের সময় টা ঠিক করলাম। এটা ঠিক হবে। ফোন করে মারোয়ার মা কে এই কথা বলে দিলাম। অামার কথা শুনে আম্মু এসে বলতে লাগল
-“কিরে খারাপ লাগতেছে নাকি? শুয়ে পড়লি কেন? দুপুরে খেতে আসিস নি কেন? না খেলে শরীর খারাপ হবেনা তো কি হবে? উঠ আর দুইটা খাই নে।”
আমি উঠে বসলাম। গিয়ে দেখলাম ভাত রান্না হয়ছে ঠিক কিন্তু দুপুরের ভাতের ডেকচির ঢাকনা উল্টিয়ে দেখলাম। এখনো ভাত রয়ে গেছে। অথচ আমার মতে ভাত একজনের থাকার কথা। তার মানে…
আমি জোরে ডাক দিলাম
-“আম্মু… আম্মু… তুমি ভাত খাওনাই কেন?”
-“তুই খাসনি কেন?”
-“আমি তো কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই।”
-“তুই না খাইলে আমি কিভাবে খাব বল?”
আমার মা টা এতো পাগল কেন? নাকি মায়েরা এরকম পাগলই হয়! আমি হাত ধরে নিয়ে গেলাম। একসাথে খেতে বসলাম। রিফাত চলে আসলে সেও বসে গেল খেতে। আব্বু ও কি দিতে এসেছিল। সেও খেতে বসল। কারোই পেট ভরল না কিন্তু মনটা ভরে গেল। শুধু একজনের অভাব। আমার বোনের। সে ও যে তেমন সুখি নাই। অনু দের টাকা দেওয়ার কথা। ওটা পেলে যা কিনে দেওয়ার দেব।
এসব ভাবতে ভাবতে দু চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এল।
এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল। মামুনের মুখোমুখি আমাকে হতে হয় না। সকালে গিয়ে মারোয়া কে পড়ায় অাসি তখন ও ঘুমে কাতর থাকে। আর রিফাত একটা পার্ট টাইম জব পাইছে। আমি মানা করেছিলাম ওর পড়ার কথা ভেবে। কিন্তু ও মানতে নারাজ। সাথে একটা টিউশনি নিল। এজন্য আমাদের দারিদ্র্যতা কিছুটা দুর হয়ছে। আমিও আরেকটা টিউশনি নিসি। বলতে গেলে আমার জীবন টা এখন নরমাল হয়েছে। টেনশন ফ্রী জীবন। ভালো করে পড়তেছি। সামনের পরীক্ষার জন্য। তবে নিয়মিত বেলী ফুল খোঁপায় লাগানো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ওইটা লাগাই। আর চোখ কাঁপা টা বন্ধ হয় নি। ওই টা চলতে লাগল। কোনো অঘটন না দেখে এবার আর পাত্তা দিই না। আমার এই নরমাল জীবনে একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটল। মারোয়ার আম্মুর ভাইয়ের ছেলের বিয়ে সামনের সপ্তাহে। ছেলেটা বিদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে এসেছে। সাথে বাবার ব্যবসা ও পেয়েছে। আর যার সাথে বিয়ে হবে সেও এক এমপির মেয়ে। এত বড় লোকের এলাহি কাণ্ড। ওই খানে যাবে মারোয়া রা। মারোয়ার আম্মু যেতে বললেন আমাকে তাদের সাথে। আমি মানা করে দিলাম। আমি গিয়ে ওদের সাথে তাল মিলাত পারব না। তাছাড়া আমার কোনো ভালো কাপড় চোপর নাই। ওই খানে গেলে আমাকে খ্যাত লাগবে সবার মাঝে। কিন্তু বাধ সাধল মারোয়া। অামাকে যেতেই হবে। ওর জোড়াজুড়ি দেখে ওর আম্মু আরেক বার বলল। এবারও আমি মানা করে দিলাম। কিন্তু মারোয়া মন খারাপ করে ফেলল। আমার কিছু করার ছিলনা। চলে আসার সময় মারোয়া কে মন খারাপ করতে মানা করলাম। তারপর মারোয়ার আম্মু কে ডেকে সব বুঝায় বললাম যে আমার ভালো কাপড় চোপড় নাই, তার উপর আব্বু দিবে না। একরাশ বাহানা দিলাম। মারোয়ার আম্মু মানতে বাধ্য হল। আর তখন আমি বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। মারোয়ারা পরশু যাবে বিয়েতে। একটু আগেই। আমি ঘরে আম্মু আব্বু দুজনকে বললাম। আব্বু রাজি হলেও আম্মু রাজি হল না। শুধু বলল গিয়ে কি করবে ওখানে? ঠিক তাই।।
কিন্তু আসল সমস্যা সৃষ্টি হল একদিন পরেই। মারোয়া কিছুতেই যাবেনা আমাকে ছাড়া। তাই বাধ্য হয়ে মারোয়ার মা আমাকে ফোন সকালে। বলতে গেলে ভোর। ভোর ছয়টায় ফোন দিয়ে আমাকে আসতে বললেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। মারোয়া দের ওখানে যাওয়ার কথা সাতটাই। কিন্তু ছয়টায় কেন ফোন করছে? আর আজকে যাওয়ার কথা। বিয়েতে আর কি! আজকে আমার ছুটি ছিল। যাই হোক চোখ ঢলতে ঢলতে রেডি হয়ে গেলাম। মারোয়া দের ওখানে গিয়ে আমার হা হওয়ার পালা।
.
সবাই এত সুন্দর করে সেজেছে যে দেখে আমি বিষম। মারোয়ার আম্মু কে তিন সন্তানের জননীর মত লাগছে না। আর মুক্তা কে তো আকাশ থেকে নেমে আসা কোন পরী। সবার তো খুশি থাকার কথা। কিন্তু সবার চেহারায় বিষাদের ছায়া কেন? মুক্তা কে জিজ্ঞেস করতেই বলল
-” মারোয়া আপনাকে ছাড়া কোথাও যাবেনা অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
এবার আমার অবাক হওয়ার। মারোয়া আমাকে ছাড়া যাবে না কেন? ওর সাথে আমার অতটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় নি। মাত্র ১০/১৫ দিন হচ্ছে ওকে পড়াচ্ছি। আর এই কয়দিনেই এতটা আপন কেমনে হলাম? আমি মারোয়া কে জিজ্ঞেস করলাম
-“কিরে মারোয়া! কি হয়ছে? যাচ্ছো না কেন? দেখ না সবাই কত কষ্ট পাচ্ছে!”
-“তো আপনি আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? আমার কষ্ট হচ্ছেনা?”
আমি ওর কথা শুনে হা করে গেলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকে রাজি হতে হল। মারোয়া খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আম্মুকে ফোন করে জানালাম। আম্মু গাইগুই করছিল। উনি চাচ্ছিলেন না। তার পরও রাজি হলেন। মারোয়ার আম্মু আমাকে মুক্তার একটা একটা গাউন বের করে দিলেন। খুব সুন্দর গাউন টা। আমি রেডি হলাম ওদের ঘরেই। স্কুল এবং টিউশনি থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিলাম। যখন ড্রেসটা পড়ে বের হলাম সবাই বলল তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে। কিন্তু মারোয়া খুশিতে হাত তালি দিয়ে বলল আপনাকে ফ্রোজেন এর পুতুল এর মত লাগছে। আমি শুনে শুধু হাসলাম। কিন্তু মামুন যখন ঘরে ঢুকল তখন আমার দম আটকে গেল। নেভী ব্লু পাঠান পাঞ্জাবী তে মামুনের দিকে চোখ আটকে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। যেন তীর বিধল একটা! গহীন হৃদয়ে!
.
চোখ নামিয়ে ফেললাম। গাড়ী রিজার্ভ করা হয়েছিল। আমি আর মারোয়া পিছনের সিটে, মুক্তা আর মারোয়ার আম্মু মাঝখানের সিটে। ড্রাইভারের সাথে মামুন বসল। যখন গাড়িতে উঠে বসলাম তখন আমার বাম চোখের পাতাটা হালকা নড়তে শুরু করল। এবারও পাত্তা দিলাম না। এরপর গাড়ি রওনা হল বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
.
চলবে…
.
যারা মোহিনী মোহিনী করছেন তাদের জন্য। নতুন করে আপলোড করছি। পুরো কাহিনী আগের মতই থাকবে। শুধু অবাঞ্ছিত কিছু বিষয় আর লাইন বাদ দিচ্ছি। চেষ্টা করছি মোটা মুটি সময় কাটানোর মত একটা লেখা হয়। হ্যাপি রিডিং ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here